০
২২৮৬ বার পঠিত
নেটফ্লিক্সে ‘দ্য লেজেন্ড অফ ব্রুস লি’ দেখতেছি। মার্শাল আর্ট নিয়ে ভাল একটা সিরিজ। এই সিরিজের মাধ্যমে ব্রুস লি সম্বন্ধে নতুন অনেক কিছু জানলাম। তার ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব ছিল, যার কারণে মার্শাল আর্টে আগ্রহ জাগে। বাবা মধ্যবিত্ত হলেও ছেলেকে হংকং এর সবচেয়ে ভাল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠান। স্কুলে শাদাদের সাথে অল্পকিছু চাইনিজ ছাত্র-ছাত্রী ছিল। ব্রুস লি স্কুলে চা-চা ড্যান্স চ্যাম্পিয়ন হয়। কিন্তু শাদা ছাত্রেরা তাকে ‘ইয়েলো মাংকি’, ‘চিংকু’ ইত্যাদি বলে উত্যক্ত করত, স্কুলে তাকে দু’একবার বুলিয়িং এর শিকার হতে হয় । চা-চা ড্যান্সে চ্যাম্পিয়ন হয়েও সে তার মান-সম্মান বাড়াতে পারেনি।
তখন ব্রুস লি’র মধ্যে মার্শাল আর্টের প্রতি আগ্রহ জাগে। ব্রুস লি’র বাবা ছিলেন ট্রাডিশনাল চাইনিজ পালার অভিনেতা, কিন্তু তার সান ফ্রান্সিসকো প্রবাসী মামা একজন মার্শাল আর্টিস্ট। মামা তখন তার বন্ধু ইপ মানের সাথে কথা বলে তার উইং চান স্কুলে ব্রুস লি কে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়। হাইস্কুলের শেষ সময়টাতে ব্রুস লি সারাদিন কঠিন প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। সামারে সারাদিন ইপ মানের স্কুলে কাটায়, চা-চা ড্যান্স পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।
এই সময় স্কুলে বক্সিং কম্পিটিশান হলে ব্রুস লি সেটাতে অংশ নিতে চায়। কিন্তু তার বক্সিং এর প্রশিক্ষণ না থাকায় টিমে ঢুকতে বেগ পেতে হয়, বিশেষ করে এর আগে বক্সিং টিমে চিনা কোন ছাত্র কখনো অংশ নেয়নি। বক্সিং টিমে ঢুকে ব্রুস লি কোচের কাছ থেকে বক্সিং এর প্রশিক্ষণ পান এবং স্কুলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগী হিসেবে নির্বাচিত হন। মূল লড়াইয়ে আগের চ্যাম্পিয়ন খুবই কম সময়ে ধরাশায়ী করে ব্রুস লি নতুন চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেন। এই লড়াইয়ে ব্রুস লি বক্সিং এর নিয়ম অনুসরণ করে চা-চা ড্যান্সের লেগওয়ার্ক, এবং ফাইনালি উইং চান ‘ওয়ান ইঞ্চ পাঞ্চ’ দিয়ে খুব সহজে জয় ছিনিয়ে নেয়।
তার বিজয়ে হংকং এর চিনা সমাজ খুশি হলেও মাস্টার ইপ খুশি হতে পারেননি। কারণ মূল প্রতিযোগিতায় কথা ছিল, ব্রুস লি প্রথম দুই রাউন্ড মার খাবে, মার খেয়ে প্রতিপক্ষকে দূর্বল করবে। তারপরে শেষ রাউন্ডে উইং চামের বিখ্যাত ‘ওয়ান ইঞ্চ পাঞ্চ’ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করবে। কিন্তু ব্রুস লি ওস্তাদের কথা শোনেনি, সে রিস্ক নিতে চায়নি, প্রথম চান্স পাওয়া মাত্র পাঞ্চ কষিয়ে দিয়েছে। বাই দ্য ওয়ে ইংরেজি পাঞ্চ (punch) শব্দটির সাথে বাংলা পাঁচের মিল আছে, পাঁচরকম ফলের জুস দিয়ে পাঞ্চ তৈরি করা হয়। ঘুষি বা পাঁচ রকমের জ্যুস দুটোরই ইংরেজি পাঞ্চ।
বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হবার পরে মহল্লায় ব্রুস লি’র নাম ছড়িয়ে যায়। সে লোকজনকে ঠগ-জোচ্চুরদের হাত থেকে বাঁচায়। এভাবে সে ‘প্রটেকশান মানি’ নিতে আসা স্থানীয় মাস্তানের বাহিনীর সাথে জড়িয়ে পড়ে। ব্রুস লি’র পারিবারিক অবস্থান এবং ইপ ম্যানের ছাত্র হওয়ায় তাকে প্রথমে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার জীবনের উপরে হুমকি আসে। জীবন হাতে নিয়ে তাকে পালিয়ে সান ফ্রান্সিসকো চলে আসতে হয়। জন্মসূত্রে ব্রুস লি আমেরিকার নাগরিক। সেখানে কিছুদিন চিনা হোটেলের পেছনে এবং রাস্তার ময়লা পরিষ্কারের কাজ করে। পরে মামার ব্যবস্থাপনায় সিয়াটলে চলে যান। সেখানে পত্রিকা বিলি করে ছুটা কাজ করে হাইস্কুল সম্পন্ন করেন।
আমেরিকাতে এসে ব্রুস লি একে একে কারাতে, জুজিৎসু, কারাতে, ফিলিপিনো বক্সিং, কোরিয়ান তায়েকোয়ান্ডো সবগুলো কৌশল শিখে নেয়। রবি ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, ‘দিবে আর নিবে, মিলিবে আর মেলাবে’, ব্রুস লি’র জীবন দর্শন ছিল সেরকম। চিনাদের একটা নিয়ম হলো ‘ইনসাইড শার্প, আউটসাইড রাউন্ড’। ব্রুস লি সেটা লাইক করত না। সে মনে করত এভাবে চিনার নিজেদের আড়াল করে রাখছে।
সিয়াটলে ব্রুস লি একে একে ফরমাল প্রতিযোগীতায় অন্যসব মার্শাল আর্টের গুরু/ওস্তাদ/ মাস্টারদের হারায়। মার্শাল আর্টের জগতে চিনই অরিজিনাল উৎপত্তিস্থল সেটা প্রতিষ্ঠা করা তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। কংফুকে বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরাকে সে তার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিল।
স্কুলের পরে ব্রুস লি ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে মার্শাল আর্ট আর প্রাচীন চিনা দর্শন নিয়ে গবেষণা শুরু করে। কংফুকে আমেরিকাতে জনপ্রিয় করা এবং সারাবিশ্বে চিনের এই গুপ্তবিদ্যা ছড়িয়ে দেয়াতে অবদান অনস্বীকার্য। চিনা মার্শাল আর্টিস্টরা ব্রুস লি’র বিরোধীতা করেছিল। তারা চাইত না চিনা ট্রাডিশনাল বিদ্যা বাইরে এভাবে প্রচার হোক। সকল বাধা উপেক্ষা করে ব্রুস লি প্রমাণ করে ছাড়েন যে চিন মার্শাল আর্টের জন্মভূমি। জাপান এবং কোরিয়ান মার্শাল আর্ট তার কাছে কিছুই না।
তাওবাদ এবং মার্শাল আর্ট নিয়ে ব্রুস লি’র একাডেমিক গবেষণা, সাথে সবসময় নতুন কৌশল শিখতে আগ্রহী থাকায় মার্শাল আর্টে ব্রুস লি অনেক নতুন কৌশল যোগ করেন। সবগুলো আর্ট ফিউশন করে নিজের একটা ফর্ম তৈরি করে নেন। তাওয়ের মূলনীতি অনুসরণ করে মার্শাল আর্টকে দুটি ভাগে করেন, ডিফেন্স এবং অফেন্স, ইন এবং ইয়ান। ইপ মানের কংফুর একটা নিয়ম হলো প্রতিপক্ষের আক্রমণকে ঠেকানো এবং একইসাথে তার সেই ফোর্স বা এনার্জিকে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। এতে প্রতিপক্ষ ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যাবে, তারপরে জো মত একটা ‘ফ্যাটাল ব্লো’ দিতে হবে।
ব্রুস লি’র নাচের অভিজ্ঞতা, বক্সিং এর ডজিং, উইং চাম এর পাওয়াফুল পাঞ্চ, অনবরত প্রশিক্ষণ, নিজেকে সমৃদ্ধ করার অদম্য চেষ্টা তাকে সফলতার চুড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে দেয়। প্রতিদিন ওয়ার্ম আপ করার জন্য দশ মাইল করে দৌড়াতেন। তার স্কুলে ভর্তি হতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের ‘উইড আউট’ করতে আগে তাদের দশ মাইল দৌড়াতে বলতেন। যে সেটা করতে পারবে না তাকে ভর্তি করতেন না।
নিজের স্কুলের বাইরের অন্য মার্শাল আর্ট স্কুলের ফর্ম জানার জন্য উপযাচক হয়ে সবার কাছে গিয়েছেন। অনেক জায়গায় স্বেচ্ছায় গিয়ে মার খেয়ে এসেছেন যাতে করে তাদের মুভগুলো বুঝে নিজে সেটা প্রাকটিস করতে পারেন। এরপরে তাদের কৌশল দিয়ে তাদেরকে পরাজিত করে মার্শাল আর্ট কম্যুনিটিতে সবার সম্মান অর্জন করেছেন।
সিয়াটল থেকে ব্রুস লি ব্যাচেলর ডিগ্রি সমাপ্ত না করেই ওকল্যান্ডে মার্শাল আর্ট স্কুল খুলতে চলে আসেন। লি তখন ক্যালিফোর্ণিয়া কারাতে চ্যাম্পিয়ন। জাপানিজরা এজন্য তাকে অসম্ভব ঘৃণা করত। কারণ সে সময় আমেরিকাতে কারাতে খুব জনপ্রিয় মার্শাল আর্ট। কোন রকম বেল্ট ছাড়া কারাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আগেরবারের চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে ব্রুস লি অনেকের নজরে আসেন।
জর্জ নামের হলিউডের এক প্রযোজক তার মার্শাল আর্ট দেখে তাকে দিয়ে মুভি বানানোর কথা চিন্তা করেন। ব্রুস লি তাতে রাজি হন, কারণ এতে করে তার মার্শাল আর্ট সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। হয়েছেও তাই, ব্রুস লি’র কারণে তার গুরু ইপ মান এখন আলোচিত। মার্শাল আর্টের জগতে একটা সম্মানিত নাম। ব্রুস লি প্রমাণ করে ছেড়েছেন শিষ্য বড় হলে গুরুর গুরুত্ব বাড়ে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন