আগের পর্ব পড়ুন এখানে…
রাশিয়ার অভিজ্ঞতা
রোমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা রোমান সাম্রাজ্য প্রায় সমগ্র উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এশিয়া-আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল ব্যাপী বিস্তৃত ছিল। বহুকাল পর্যন্ত তার রাজধানী রোম থেকে সমগ্র সাম্রাজ্য শাসিত হত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শাসনের সুবিধার জন্য সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের শাসনকালে ৩৩০ খ্রীষ্টাব্দে রাজধানী পূর্ব দিকের গ্রীক উপনিবেশে অবস্থিত বাইজেনটিয়ামে নেওয়া হয়। এ ছাড়া শেষ দিকে সাম্রাজ্যে যখন দুর্বলতা দেখা দেয় তখন শাসনের সুবিধার জন্য সাম্রাজ্যকে কয়েক বার ভাগ করা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত ভাগ হয় ৩৯৫ খ্রীষ্টাব্দে যখন সম্রাট ১ম থিওডসিয়াস রোমান সাম্রাজ্যকে তার দুই পুত্র আরকাডিয়াস এবং অনরিয়াসের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যান। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য রোমকে কেন্দ্র করে এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বাইজেনটিয়ামকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। বাইজেনটিয়ামের নাম পরবর্তী কালে কন্সট্যান্টিনোপল করা হয়।
এই বিভাজন চার্চের বিভাজনকে ত্বরান্বিত করে। সাম্রাজ্যের দুই অংশে পূর্ব থেকেই খ্রিস্টধর্মের গ্রন্থ বাইবেলের ভাষাকে কেন্দ্র করে এমনিতে বিভাজন ছিল। রোম কেন্দ্রিক পশ্চিম অঞ্চলে বাইবেল লেখা হত লাতিন ভাষায়, অন্যদিকে পূর্ব দিকের ভাষা ছিল গ্রীক। পরবর্তী কালে এর সঙ্গে আরও বিভিন্ন পার্থক্য যুক্ত হতে থাকে এবং সবশেষে বিবাদের মধ্য দিয়ে ১০৫৪-তে রোমের চার্চ এবং কনস্ট্যান্টিনোপল কেন্দ্রিক বাইজেনটাইন চার্চ পৃথক হয়ে যায়। এই কন্সট্যাটিনোপল কেন্দ্রিক চার্চ সাধারণভাবে পরিচিত অর্থডক্স চার্চ হিসাবে।
রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে অর্থডক্স্ চার্চের যে পার্থক্যটি আমাদের বিবেচনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী সেটা হচ্ছে ক্যাথলিক চার্চে কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান হিসাবে পোপের যে পদ ছিল অর্থডক্স্ চার্চে তেমন কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। এটা ঠিক যে ক্যাথলিক চার্চের মত অর্থডক্স্ চার্চও রাষ্ট্র থেকে পৃথক প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ক্যাথলিক চার্চের মত কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান না থাকায় সম্রাট বা রাষ্ট্রের উপর চার্চের প্রাধান্য বজায় রাখার উপায় ছিল না। বরং সম্রাট বা রাষ্ট্র চার্চকে নিয়ন্ত্রণ করত।
তুর্কী মুসলমানদের হাতে ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে কন্সট্যান্টিনোপলের পতন হলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান হয়। এরপর একটা পর্যায়ে খ্রিস্ট্রিয় শক্তি হিসাবে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া আবির্ভূত হয়। রাশিয়ায় আমরা চার্চকে রাষ্ট্রের তুলনায় খর্ব দশায় দেখতে পাই যেখানে তা ছিল শাসকদের সহযোগী ও অধীনস্থ। ধর্মের নীতি-নিয়ম সম্রাটকে মেনে চলতে হত। কিন্তু চার্চ সম্রাটের রাষ্ট্রপরিচালনা বা নীতি-নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারত না যেটা আমরা পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রে ঘটতে দেখি। অর্থডক্স্ চার্চের এই অবস্থার ফলে পূর্ব ইউরোপ বিশেষত রাশিয়ায় আমরা রাষ্ট্রের যে রূপ দেখতে পাই তা অনেকটা প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্রের অনুরূপ। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্রের স্বৈরতা বা স্বেচ্ছাচারের ক্ষমতাকে সংযত বা প্রতিহত করার মত কোন কার্যকর সামাজিক প্রতিষ্ঠান ছিল না।
এই অবস্থায় আমরা পশ্চিম ইউরোপের সামন্ত শ্রেণীর অনুরূপ কোন শ্রেণীকে অর্থডক্স খ্রিস্টান রাশিয়ায় পাই না। এখানে ভূ-স্বামী শ্রেণী হিসাবে আমরা যাদেরকে দেখতে পাই তারা ছিল সম্রাটের মর্জির উপর নির্ভরশীল।
রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্রের এই বিকাশের ফলে রাশিয়ায় পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছে। অর্থাৎ পরিবর্তন যখন এসেছে তখন তা এসেছে উপর থেকে। ব্যক্তির ভূমিকা রাখবার সুযোগের কারণে পশ্চিম ইউরোপে যেভাবে সমাজের ভিতর বা তুলনায় নীচ থেকে পরিবর্তনের শক্তি ও প্রেরণা জন্ম নিতে ও বিকাশ লাভ করতে পেরেছে পূর্ব ইউরোপে, বিশেষত রাশিয়ায় তেমনটা ঘটে নাই।
পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মত এগিয়ে যেতে চেয়ে রাশিয়ায় আধুনিকায়নের সূত্রপাত ঘটান রাশিয়ার জার বা সম্রাট পিটার দি গ্রেট (জন্ম ১৬৭২ খ্রিঃ – মৃত্যু ১৭২৫ খ্রিঃ, রাজত্ব করেন ১৬৮২ খ্রিঃ থেকে ১৭২৫ খ্রিঃ পর্যন্ত)। আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন, নৌবাহিনী ও আধুনিক সেনাবাহিনী গঠন, শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ সাধন, রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখার জন্য সিনেট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি দ্বারা তিনি পশ্চাৎপদ রাশিয়ার আধুনিকায়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আধুনিকায়নের প্রয়োজনে তিনি পশ্চিম ইউরোপ থেকে শিক্ষক-প্রশিক্ষকদেরকে আনয়ন করেন। মোট কথা আধুনিক রাশিয়ার প্রথম স্থপতি যদি কাউকে বলতে হয় তবে সেটা বলতে হবে পিটার দি গ্রেটকে।
এই ধারাতেই রাশিয়ার পরবর্তী বিরাট পরিবর্তন ঘটে ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় পশ্চাৎপদ রাশিয়ার দ্রুত আধুনিকায়ন এবং উন্নয়নের জন্য ব্যক্তির দুর্বলতা বা অনুপস্থিতির জন্য রাষ্ট্রকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। তবে কমিউনিস্ট বিপ্লবের ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রযন্ত্র বহির্ভূত একটি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রের উপর একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন ঘটাতে দেখি। এ যেন আধুনিকায়নের জন্য ধর্মবিশ্বাস-মুক্ত এবং লোকবাদী ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম ইউরোপে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনে ব্যক্তি যে ভূমিকা নিতে পেরেছিল রাশিয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির অক্ষমতায় রাজনৈতিক দলকে সেই ভূমিকা নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে মার্কসবাদ এবং কমিউনিজমের মতাদর্শের সর্বাত্মক রাষ্টীয়করণ বা জাতীয়করণ সমাজের দ্রুত শিল্পায়নের কাজে লাগে। রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপ তার শিল্পায়নের জন্য এই পথ গ্রহণ করে।
তবে ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে সর্বাত্মক জাতীয়করণের মাধ্যমে শিল্পায়নে যে সমস্যা একটা পর্যায়ে দেখা দেয় সেটা পূর্ব ইউরোপসহ রাশিয়ায় দেখা দেয়। নূতন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মূলে থাকে ব্যক্তি। ব্যক্তির ভূমিকা না থাকলে সমাজ এক সময় বন্ধ্যা এবং স্থবির হয়ে যায়। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কট নেমে আসে। এই সঙ্কটকে মোকাবিলা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে মার্কসীয় সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ ক’রে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ পুঁজিবাদের পথ গ্রহণ করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। সেই সঙ্গে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির শাসনেরও অবসান হয়। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি।
চীনে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন অব্যাহত থাকলেও তা পার্টি এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই ব্যক্তিপুঁজির বিকাশের পথ গ্রহণ করে। অর্থনীতির এই ব্যবস্থাকে চীনের পার্টি নাম দিয়েছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। ভিয়েৎনামও এই ধরনের অর্থনীতির পথ অনুসরণ করছে। এই দুই দেশেরই উন্নয়ন প্রবল গতিসম্পন্ন। চীন ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
যাইহোক, আমরা পশ্চিম ও পূর্বসহ সমগ্র ইউরোপে আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে খ্রিস্ট ধর্মের একটি প্রধান ভূমিকা দেখতে পেলাম। আধুনিক সভ্যতা এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে ধরনের ব্যক্তির উদ্ভবের প্রয়োজন ছিল খ্রিস্টান ধর্ম এবং বিশেষত ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব তার পরিপোষণে প্রাথমিক ভূমিকা পালন করেছিল। একটা পর্যায়ের পর ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকা এই ধরনের ব্যক্তির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে তার উৎখাত সাধনের জন্য নবজাগরণ, ধর্ম সংস্কার এবং যুক্তিবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের প্রয়োজন হয়েছিল। এসবের ফল ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং শিল্প বিপ্লব।
এটা লক্ষণীয় যে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন পশ্চিম ইউরোপের যে সব দেশে শক্তিশালী হয়েছিল এবং ক্যাথলিক চার্চের প্রতাপকে দুর্বল করেছিল উত্তরের ইংল্যান্ডসহ সেই দেশগুলিতে গণতান্ত্রিক ও শিল্প বিপ্লব সবার আগে সফল হয় এবং এইসব দেশ ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা তুলনায় অনেক বেশী প্রভাবিত দক্ষিণের স্পেন, পর্তুগাল, ইতালির চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে যায়।
সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ধর্মের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সেটা প্রাচ্যের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেও বুঝা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে চীন এবং ভিয়েৎনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। বৌদ্ধ ধর্মে কতকগুলি সুনীতি পালন এবং পুণ্যকর্মের মাধ্যমে জন্মান্তরের চক্র থেকে মানুষের আত্মার মুক্তি বা নির্বাণের ধারণার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু মানুষের প্রতি নয় অধিকন্তু সব জীবের প্রতি দয়া ও প্রেমের উপর এই ধর্মে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই নয় যে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের ফলে মানুষ হিংসা, যুদ্ধ, নিপীড়ন বাদ দিয়েছে। কিন্তু এও ঠিক যে, ধর্মে এগুলির প্রতি বিরোধিতা থাকায় শান্তি, সহাবস্থান এবং ভ্রাতৃত্ব বোধ সমাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নেয়। বিশেষত সংযম, অহিংসা, শান্তি ও নম্রতার মূর্ত প্রতীক হিসাবে সর্বস্ব ত্যাগী ভিক্ষুদের দ্বারা গঠিত বৌদ্ধ সংঘের অবস্থান বৃহত্তর সমাজে শান্তি, স্থিতি ও সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করে। বৌদ্ধ সংঘের সদস্যরা বিবাহ করতে পারে না যেমন তারা যুদ্ধ করতে পারে না। সেখানে নারীরাও প্রবেশ করতে এবং সংসার বহির্ভূত সন্ন্যাস জীবন যাপন করতে পারে। সংঘের সদস্যদের যৌন সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ এবং ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী শুদ্ধ জীবন যাপন বাধ্যতামূলক। আসলে বৌদ্ধ সংঘের প্রায় অনুরূপ খ্রিস্ট্রিয় চার্চ। তবে ক্যাথলিক চার্চের মত কোন কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির ফলে প্রাচ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত সমাজগুলিতে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা রাজার উত্থান সহজতর হয়েছে। সংঘ রাষ্ট্র থেকে পৃথক। জনগণের ধর্ম বিশ্বাসের মাধ্যমে সংঘ বা ধর্ম রাষ্ট্রশাসনের উপরেও প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের অভাবে তা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে যেতে পারে নাই, বরং রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়েছে।
সুতরাং পশ্চিম ইউরোপে যেভাবে ব্যক্তির নিজস্ব শক্তির একটা জায়গা ধর্মের আবরণে এবং সামন্ত কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে হলেও রক্ষা পেয়েছে প্রাচ্যের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলিতে তেমনটা সাধারণভাবে হতে পারে নাই। এই বাস্তবতায় আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের প্রয়োজনে চীন, উত্তর কোরিয়া এবং ইন্দোচীনের দেশগুলিতে রাজনৈতিক দল একক কর্তৃত্বকারী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আধুনিক সভ্যতা নির্মাণে এইসব দেশ বিশেষত চীন এবং ভিয়েৎনামের সাফল্য লক্ষণীয়। এইসব দেশ এক দল কর্তৃক শাসিত হলেও সাধারণভাবে দলের ভিতর গণতন্ত্রের বিকাশ যেমন লক্ষণীয় তেমন একক দলের অধীনস্থ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও উদ্যোগে ব্যক্তি পুঁজির বিকাশও লক্ষণীয়।
জাপানের অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন। জাপানে আদি শিন্টোধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্ম উভয়ই প্রচলিত ছিল। তবে ধর্মীয় উগ্রতা বা গোঁড়ামি জাপানে ছিল না। সেখানে পশ্চিম ইউরোপের কাছাকাছি ধরনের একটা সামন্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। পশ্চিম ইউরোপের যোদ্ধা শ্রেণী হিসাবে নাইটদের অনুরূপ সামুরাই নামে খ্যাত একটি যোদ্ধা শ্রেণীও সেখানে গড়ে উঠেছিল। সবার উপরে ছিলেন সম্রাট। তাকে দেবতা হিসাবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু রাষ্ট্র শাসনে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা দুর্বল ছিল। তিনি থেকেছেন জাপানের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে। এই অবস্থায় ইউরোপের আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসবার পর তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জাপানের শাসকরা দ্রুত শিল্প পুঁজি গড়ার উদ্যেগ নেয় এবং জাপানকে আধুনিক যুগে নেয়। তবে পূর্ব থেকেই ব্যক্তির ভূমিকা নিবার সুযোগ না থাকলে ব্যক্তির মালিকানায় এই শিল্পায়নের উদ্যোগ সম্ভব হত না।
আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা বিষয় পরিষ্কার যে ধর্মের সঙ্গে আধুনিক সভ্যতার সম্পর্ক মোটেই সঙ্গতির নয়, বরং সাংঘর্ষিক। কারণ আধুনিক সভ্যতা অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম চর্চার পরিবর্তে সম্পূর্ণ রূপে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং যুক্তি-প্রমাণ নির্ভর। এই অবস্থায় পশ্চিম ইউরোপে রাষ্ট্রের উপর চার্চের আধিপত্যের অবসান ঘটাতে হয়েছে। প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের ফলে নমনীয় এবং বিকেন্দ্রীভূত চার্চ প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রকে লোকবাদী তথা সেকিউলার পথে চলার সুযোগ করে দেয়। যেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ প্রাধান্য অর্জন করতে পারে নাই, ফলে ক্যাথলিক মতবাদ ও চার্চ প্রাধান্য বজায় রাখতে পেরেছে, সেখানেও রাষ্ট্রের উপর চার্চের আধিপত্যের অবসান ঘটে। ইউরোপে চার্চ প্রধান হিসাবে পোপের ভূমিকা ধর্মের নিজস্ব গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে ধর্ম হয়ে পড়ে যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়।
এ প্রসঙ্গে আমরা যীশুর সেই বাণী উল্লেখ করতে পারি যেখানে তিনি বলছেন, ‘সিজারের প্রাপ্য সিজারকে দাও এবং ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দাও’(মার্ক- ১২꞉১৭)। এর অর্থ তিনি রাষ্ট্রের প্রাপ্য রাষ্ট্রকে এবং ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দিতে বলছেন। এর তাৎপর্য অপরিসীম। প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের প্রভাবে আদি খ্রিস্টান ধর্মে প্রত্যাবর্তনের ফলে রাষ্ট্র এবং জাগতিক কর্মকাণ্ডের উপর ধর্মের হস্তক্ষেপের সুযোগ রইল না। একবার ধর্ম রাষ্ট্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিবার পর রাষ্ট্রও আর তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন তেমন একটা বোধ করে নাই। ফলে ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসে সীমাবদ্ধ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র নমনীয়ও হয়েছে ক্ষেত্র বিশেষে।
কিন্তু অর্থডক্স চার্চ শাসিত রাশিয়ার ক্ষেত্রে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাষ্ট্রকে তুলনায় অনেক বেশী সক্রিয় হতে হয়। পশ্চিম ইউরোপের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের যে দ্রুততা অর্জনের প্রয়োজন ছিল তা সেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ও কর্তৃত্বে শিল্পায়নের পাশাপাশি ধর্মের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংগ্রামেও কমিউনিস্ট পার্টিকে ভূমিকা নিতে বাধ্য করে। ফলে সব কমিউনিস্ট শাসিত রাষ্ট্রই পুরাপুরি সেকিউলার বা লোকবাদী হয়। অবশ্য কমিউনিস্ট মতাদর্শের উৎস মার্ক্সবাদ দর্শনগতভাবেই বস্তুবাদী ও ধর্মবিশ্বাস মুক্ত। এই রকম অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির শাসনে মতাদর্শিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মের বিরুদ্ধে কম-বেশী ভূমিকা রাখতে বাধ্য হয়। একই ঘটনা আমরা বৃহৎ ধর্মগুলির মধ্যে সবচেয়ে উদার বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত চীন-ভিয়েৎনামের ক্ষেত্রেও দেখি। এই যেখানে অবস্থা সেখানে ইসলাম শাসিত সমাজে আধুনিকায়ন তথা সমাজের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রায়ন অবিশ্বাস্য রকম জটিল ও কঠিন।
সবচেয়ে বড় কথা খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে সম্পূর্ণরূপে সামাজিক তথা অরাজনৈতিক আন্দোলন রূপে। ফলে বিকাশের একটা পর্যায়ে তা রাষ্ট্র বা রাজনীতিতে যে ভূমিকাই পালন করুক তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূল রূপ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক হতে বাধ্য হয়। বিদ্যমান ধর্মের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন কখনও রাজনৈতিক ও সামরিক রূপ নিলেও সেটা মূলত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অধীনস্থ হয়ে থাকে। যে কারণে ধর্মীয় আন্দোলনের পরিণতিতে যে পরিবর্তনই ঘটুক ধর্মীয় শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় না। পশ্চিম ইউরোপে এই কারণে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের সাফল্য নূতন কোনও ধরনের চার্চকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে নাই। কিন্তু ইসলাম একই সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ধর্ম হিসাবে বিকাশ ও বিস্তার লাভ করায় এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সমস্যা হাজির করে।
[ চলবে… ]