১১
৭৬৪ বার পঠিত
৭৬৪ বার পঠিত
কার্ল মার্ক্স তাঁর ‘ইহুদি প্রশ্নে’ ( On the Jewish Question) গ্রন্থে বলেছেন,
“ টাকা হলো ইসরাইলের হিংসুক ঈশ্বর, সে আর কোনো দেবতাকে সহ্য করে না। টাকা মানুষের আর সব দেবতার জাত নষ্ট করে তাকে বাজারের মাল বানিয়ে ছাড়ে। টাকা হলো সব জিনিসের সার্বিক, স্বপ্রতিষ্ঠিত মূল্য। ফলে সে মানুষ আর প্রকৃতি, উভয় জগতেরই বিশেষ মূল্য লুট করে নিয়েছে। টাকা হলো মানুষের কাজ আর অস্তিত্বের বিচ্ছিন্নকৃত সারসত্ত্বা। এই বিজাতীয় সারসত্ত্বা তাকে শাসন করে, আর সে তারই পূজা করে।
ইহুদিদের দেবতা ইহজাগতিক হয়ে গেছে, বনে গেছে পৃথিবীর ঈশ্বর। বিনিময় বিল হচ্ছে ইহুদিদের সত্যিকারের দেবতা। তার দেবতা এক মায়াবী বিনিময় বিল ছাড়া আর কিছু নয়।
ব্যক্তি সম্পত্তি আর টাকার রাজত্বে প্রকৃতি নিয়ে যে ধারণা দাঁড়িয়েছে তাতে প্রকৃতির অবমাননার আর দূর্গতির শেষ নেই। ইহুদি ধর্মে প্রকৃতি আছে, তবে তা কেবল কল্পনায় বিরাজ করে। এরকম অবস্থা অসহ্য বোধ হওয়ায়, ১৫২৪ সালে টমাস ম্যুনৎসের বলেন, “সমস্ত জীবজন্তুও সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, পানির মাছ, আকাশের পানি, মাটির ওপর গাছ; সমস্ত প্রাণশীল অস্তিত্বকেও অবশ্যই মুক্ত হতে হবে।”ইহুদিরা ইহুদিয়ানা তরিকায় আর্থিক ক্ষমতা অর্জন করে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছে, টাকা এখন বিশ্বশক্তি। ব্যবহারিক ইহুদির মরম হয়ে গেছে খ্রিস্টান জনগণের ব্যবহারিক মরম। খ্রিস্টানরা যতটুকু ইহুদি হয়েছে ইহুদিরাও ততটুকু নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে।”
আজকে সারা দুনিয়া ইহুদি প্রভাবিত। ‘মানি ইজ দি সেকন্ড গড’, কারো কারো কাছে ‘মানি ইজ দি অনলি গড’, টঙ্কাহি কেবলম! আধুনিক সমাজে টাকার গুরুত্ব সবেচেয়ে বেশি, সবকিছুরই একটা বাজার মূল্য আছে, এবং টাকার মূল্যে সেটা নির্ধারিত করা হচ্ছে। এমনকী টাকা দিয়ে মানুষের মূল্য পর্যন্ত নির্ধারিত হয়। আপনি-আমি কেউই এর বাইরে না, সবাই যার যার ব্যবসার ধান্ধা করি, যখন ব্যবসা করি না তখন অন্যের ব্যবসায় নাক গলাই।
ধর্ম নিয়ে ব্যবসা শুরু করায় বাংলাদেশে এক সময় শ্লোগান ছিলঃ
“গোলাম আজম, সাঈদী
বাংলার ইহুদি।”
ইহুদি ধর্মের মানুষেরা বর্তমান ব্যাংকিং পদ্ধতি আবিষ্কার এবং ব্যবসায়িক লেনদেন, সূদের ব্যবসা প্রচলন করে। আধুনিক ব্যাংক শব্দটাও এসেছে তাদের কাছ থেকে। ইতালির ঘেটোতে থেকে সূদের ব্যবসা পরিচালনার সময় তারা কাস্টমারদের বসার জন্য বেঞ্চ, ইতালিয়ান ভাষায় ‘ব্যাঙ্কো’ (Banco) পেতে রাখত। তাদের বসার বেঞ্চ থেকে ব্যাংক শব্দটার উৎপত্তি।
ধর্মের সাথে ব্যবসার চিরায়ত সম্পর্ক, ইহুদিদের মত মুসলমান সমাজেও ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ,মক্কা নগরী এক সময় ব্যবসার কেন্দ্র ছিল। একসময় বৌদ্ধ মঠগুলো দূর-দূরান্তগামী ব্যবসায়ীদের কাফেলার নিরাপত্তা দিত।
আজকে সারা দুনিয়ায় টাকাই মূলমন্ত্র। ভারতের এক সময়ের বাজপেয়ী সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফারনান্দেজ তেহেলকা ডট কমের গোপন ট্যাপের কারণে মন্ত্রীত্ব হারান। সেখানে ফারনান্দেজ তার কাজের জন্য ঘুষ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে উচ্চারণ করেন ‘ডলার’। তখন তার পক্ষের অনেকেই বলছিল যে এতে কোন কিছুই প্রমাণিত হয় না, হিন্দুরা অনেক সময় বীজমন্ত্র উচ্চারণ করে থাকেন। ‘ডলার’ এখনকার সময়ের বীজমন্ত্র, এ মন্ত্রে সব কার্য সিদ্ধি হয়।
এটা সত্য যে ইহুদিরা ব্যাংকিং পদ্ধতি, সূদ ইত্যাদি ব্যবসার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। আজকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এ ব্যবসার কবলে। তাই শুধু শুধু ইহুদিদের দোষারোপ না করে, আমাদের দেখা দরকার ইহুদি সিস্টেমে থেকে আমরা নিজেরা কতটুকু ইহুদি হয়ে গেছি। আজকের বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, মনোবিদ্যা, সমাজবিদ্যা তথা জ্ঞানের সকল শাখা ইহুদিদের অবদান সমৃদ্ধ। বলাবাহুল্য, এসব জ্ঞানী গুণীদের বেশির ভাগই তাদের জন্মসূত্রে পাওয়া ইহুদি ধর্মের সমালোচনা করেছেন, অথবা ব্যক্তিগত জীবনে কোন ধর্মপালন করেননি। তাই জাতি বা ধর্মের ভিত্তিতে না দেখে ইহুদিদের যেসব বৈশিষ্ট্য আমরা জানলাম সেগুলোকে আমাদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে না দেওয়াটা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।
ইহুদি সিস্টেম (টাকা, ব্যাংক) আমাদের জীবনের সর্বস্তরে এমনভাবে প্রবেশ করেছে বড় ধরণের কোন পরিবর্তন ছাড়া এর ব্যাত্যয় ঘটানো এখন হয়তো আর সম্ভব না। বর্তমানে এ চক্র এতো শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে যে এর থেকে মুক্তির উপায় নাই। এখন কেবল সূদই নয় তার সাথে আরো আছে চক্রবৃদ্ধি সূদ, ডেরিভ্যাটিভ, ফটকা বাজার, ক্রেডিট কার্ড, ক্রেডিট হিস্টরি, ক্রেডিট স্কোর ইত্যাদি নানান মাধ্যম। সমাজে বাস করতে হলে এ চক্রের বাইরে থাকার উপায় নেই। আজকের ইহুদি আদর্শ প্রভাবিত দুনিয়ায় তাই ‘ইহুদি’ হয়েই আমাদের মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। কিন্তু ইহুদি হয়ে কী মুক্তি সম্ভব? ইহুদি মুক্তি বা কোন জাতি/ধর্ম গোষ্ঠীর মুক্তি কী মানব মুক্তির সমার্থক? এসব প্রশ্ন নিয়ে জানতে মার্ক্সের ‘ইহুদি প্রশ্নে’ পাঠ আবারো জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
শিরোনাম: ইহুদি প্রশ্নে
লেখক: কার্ল মার্কস/ কার্ল মার্ক্স
অনুবাদক: জাভেদ হুসেন
প্রকাশক: সংহতি প্রকাশন
প্রচ্ছদ: অমল আকাশ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৯
ISBN: 984 70046 0011 6
বইটির পিডিএফ ভার্সন পড়তে চাইলে এখান থেকে ডাউনলোড করতে পারেন।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
জুন ২৮, ২০১৭; ৬:৩৪ অপরাহ্ন
যা ছিল কার্ল মার্ক্সের ইহুদি বিদ্বেষ, তা আজ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা আশ্রয়। সময়ের আবহে কুৎসিত কীভাবে সুশ্রী হয়ে উঠে!
অবশ্য মার্ক্সবাদী সমাজ ব্যবস্থা সফল হলে ইহুদিদের সম্পর্কে মার্ক্সের এ বাণী বিদ্বেষমূলকই থেকে যেতো, অনুপ্রেরণা ও অনুকরণীয় হয়ে উঠত না।
উল্লেখ্য — পোস্ট-ইম্যান্সিপেশন যুগে ইহুদি বিদ্বেষের নব-জাগরণ ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মূলে মার্ক্স ও ইউলেম মা’র এর মতো কমিউনিস্ট আইডিওলগদের এ-জাতীয় ইহুদি-বিদ্বেষী প্রচারণা প্রাথমিক ভূমিকা রেখেছিল।
জুন ২৯, ২০১৭; ৯:১৯ পূর্বাহ্ন
সমালোচনা আর বিদ্বেষের মধ্যে পার্থক্য আছে। মার্ক্স যেটা করেছেন সেটা হলো সমালোচনা, ইহুদি পণ্ডিতদের যুক্তি ধরে ধরে খণ্ডন করেছেন। বলা বাহুল্য, তার সমালোচনা তখনকার সময়ে তো বটেই, আজকের সমাজের জন্য আরো বেশি প্রযোজ্য।
জুন ২৯, ২০১৭; ১২:৪১ পূর্বাহ্ন
ইহুদিরা বহু আগে থেকেই ব্যবসাবুদ্ধিতে পোক্ত ছিল। এমনকী যিশু তাদেরকে পথে আনতে ‘ধনীরা স্বর্গে ঢুকতে পারবেনা’ বলে রীতিমতো হুমকিও দিয়েছিলেন।
জুন ২৯, ২০১৭; ৯:২১ পূর্বাহ্ন
ঠিক, খ্রিস্টান ধর্মে সুদ, মুনাফার ব্যবসা নিয়ে কঠোর অবস্থান ছিল। যিশু নিজে বাজারে গিয়ে দাদন ব্যবসায়িদের সাথে ঝামেলা করেছিলেন।
জুন ২৯, ২০১৭; ৯:১৪ অপরাহ্ন
হলোকস্টের রসদ যোগানো কোন সমালোচনা নয়।
বলা বাহুল্য, ইহুদি ধর্মগ্রন্থ ‘অল্ট টেস্টামেন্ট’ই সম্ভবত প্রথম ধর্মগ্রন্থ যাতে সুদ (ইউজারী) হারাম করা হয়েছেঃ
নিউ টেস্টামেন্ট ও কোরানে সুদ নিষিদ্ধকরণ তৌরাতের অনুকরণমাত্র।
জুন ৩০, ২০১৭; ৭:৪১ পূর্বাহ্ন
ধর্মগ্রন্থে অনেক সুন্দর কথা লেখা থাকতে পারে, কিন্তু চর্চায় না থাকলে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বর্তমানে ইব্রাহীমী ধর্মের অনুসারী কেউই এসব মানে না, সূদ,দাদন, মহাজনী ব্যবসা এখন স্বাভাবিক।
জুন ৩০, ২০১৭; ৯:০৫ অপরাহ্ন
কাজেই ধর্মগ্রন্থের (যেমন যিশুর কাহিনী) উল্লেখ করে একটা জাতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো অনুচিত, যা মার্ক্স করে গেছেন, আজও অনেকে করছেন। সুদের চর্চা কেবলই ইহুদিদের সৃষ্টি, এমন উদ্ভট বিদ্বেষমূলক প্রচারণার কোন ভিত্তি নেই। দুনিয়ার সব জাতির মানুষই যুগে যুগে তা চর্চা করেছে। ইহুদিরা অনেকটা পরিস্থিতির শিকার হয়ে এ ব্যবসায় ঢুকতে বাধ্য হয় খ্রিস্ট্রিয় ১০০০ শতকের দিকে, যখন ইউরোপে ইহুদিরা ঘরের বাইরে গেলেই আক্রমণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে পরে। পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বেও ইহুদিরা প্রায় একই পরিস্থিতিতে পরে। এর আগের যুগে ইহুদিদের সব ধরনের পেশাতেই নিযুক্ত দেখা যায়, ঠিক পোস্ট-ইম্যান্সিপেশন যুগের মতো। বলা আবশ্যক কিছু ইহুদি ঋণ ব্যবসায় সফল হলেও ইহুদি সমাজের বড় অংশ যুগে যুগে চরম আর্থিক দূর্দশা ভোগ করেছে।
জুলাই ১, ২০১৭; ১২:৫৫ অপরাহ্ন
‘সূদের চর্চা শুধু ইহুদিদের সৃষ্টি’ এটা বলা হয় নি। ইহুদিরা সূদ, ব্যাংকিং ব্যবসাকে কে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ রূপ দিয়েছে। তারা সবকিছুকে টাকার মূল্যে বিচার করে টাকাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছে।
জুলাই ২, ২০১৭; ৮:১২ পূর্বাহ্ন
টাকা জিনিশটাকে সবার ওপরে স্থান দেওয়া অন্তত বৈজ্ঞানিক দিক থেকে ভুল বলা চলে না। মানবসমাজ টিকে রয়েছে বিনিময়ের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ গিভ অ্যান্ড টেক পলিসির উপর। তাই বিনিময়ের মাধ্যমকে যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই-ই মানবসমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। এটাই বাস্তবতা।
জুলাই ২, ২০১৭; ৯:৩৩ পূর্বাহ্ন
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। মানুষ ছাড়া সব শুন্যাকার। টাকা মানুষের তৈরি মাধ্যম,কিন্তু টাকা সবার উপরে স্থান পাওয়ায় আজকে মানুষের মূল্য নাই। মানুষ হয়ে গেছে টাকার গোলাম। যার টাকা আছে, সে যার টাকা নাই তাকে মানুষ বিবেচনা করে না, তাকে কিনে নিতে পারে।
জুন ৩০, ২০১৭; ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন
সুন্দর আলোচনা চলছে, আলোচনা চলুক।