ঢাকায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। ওস্তাদ রশীদ খাঁ কিংবা কৌশিকী চক্রবর্তীর কণ্ঠে চরাচর উন্মনা করা ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে, হায় রাম ..’ ঠুংরী (ঠুমরি)টি আমরা অনেকেই সরাসরি শুনেছি। এই গানটির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে আরো একজন বিখ্যাত শিল্পীর নাম ও জীবন।
৫০০ বনাম ২৫০০০
লতা মঙ্গেশকর বা মোহাম্মদ রফির নাম জানেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একইভাবে মুঘল-এ-আজম সিনেমা দেখেননি এমন মানুষও খুঁজে পাওয়া কঠিনই হবে। ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার গান ‘প্যায়ার কিয়া
তো ডরনা কিয়া’ গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। এই গানও আজ মানুষ শোনে। এই গানটি গাওয়ার জন্যে লতা পেয়েছিলেন তখনকার দিনে ৫০০ রুপির কম পারিশ্রমিক। সিনেমাটিতে লতা মোট ৯টি গান গেয়েছিলেন, মোহম্মদ রফি গেয়েছিলেন একটি গান। লতা, রফি দুজনেই তখন বিখ্যাত নেপথ্য সঙ্গীত শিল্পী। তারা যেখান গান প্রতি ৫০০ রুপির কম পারিশ্রমিক পেয়েছেন সেখানে ওই সিনেমাতে দুটি গান গাওয়ার জন্যে এক শিল্পী দাবি করেছিলেন গান প্রতি ২৫০০০ রুপি। এবং সিনেমার প্রযোজক-পরিচালক-সঙ্গীত পরিচালকেরা সেই দাবি মেনে নিয়েছিলেন।
এই রকম আকাশ ছোঁয়া পারিশ্রমিক দাবিকারী শিল্পী কিন্তু কোনো তারকা খ্যাতির (যাদের আমরা স্টার বলি) শিল্পী ছিলেন না। তাঁর নাম বড়ে গোলাম আলি খাঁ। সোহিনী ও রাগেশ্রী রাগের ওপর নির্মিত গান দুটি হচ্ছে ‘প্রেম যোগান বন কে আয়ো’ এবং ‘শুভ দিন আয়ো রাজ দুলারা’।
দম–ফুরানো কলের গানে
“দম-ফুরানো কলের গানে
ছেলেবেলার আকাশপানে
বড়ে গোলাম। …”
বড়ে গোলাম আলি খাঁর নাম আমি এভাবেই জেনেছি – সুমনের ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন’ গানটি থেকে। তারপর কৌতূহল থেকে বড়ে গোলাম আলি খাঁর গান শোনা। গান শুনতে শুনতে একটু জানারও আগ্রহ হল, সঙ্গীতের এই ধারাটি নিয়ে, এসব শিল্পীদের নিয়ে। সেই আগ্রহ থেকে বিভিন্ন সময় পড়েছি কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের “কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী”, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের “তহ্জীব-এ-মৌসিকী”।
“কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী” বইটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানার ইতিহাস এবং শিল্পীদের জীবনের নানা ঘটনা মজলিশী ঢঙে তুলে ধরা হয়েছে এ বইতে। লেখনি অনেকটা সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো সরস এবং তথ্যবহুল। অন্যদিকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ নিজেই একজন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও তবলাবাদক। তিনিও নিজের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণ, সঙ্গীত সাধনা এবং বিভিন্ন শিল্পী সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন, লিখেছেন। বড়ে গোলাম আলি খাঁকে জানার জন্যে এ বই দুটি কাজে আসবে।
এখন তো বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসে। ইন্টারনেটের কল্যাণে জানা এবং শোনা দুটোই অনেক সহজ হয়ে গেছে। এসব শিল্পীদের নিয়ে জানার আগ্রহও নিশ্চয়ই বেড়েছে। সেই ভরসায় বড়ে গোলাম আলি খাঁ-কে নিয়ে যতটুকু জেনেছি সেটাই পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
জিসকে পাস সুর নহী, উসকো পাস কুছ ভী নহী
তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরের কাছে ছোট্ট শহর কাসুরে তাঁর জন্ম, যা বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ। ১৯০২ সালের ২ এপ্রিল কাসুরের একটি সঙ্গীত পরিবারে তাঁর জন্ম, গায়ক বাবা আলি বখ্শ খাঁ। পাঁচ বছর বয়সে পৈতৃক সম্পর্কীয় চাচা কালে খাঁর কাছে তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা শুরু। ১২/১৩ বছর বয়স পর্যন্ত এ শিক্ষা চলেছে। এছাড়া বাবার কাছেও তালিম নিয়েছেন।
তাঁর রেওয়াজ করা নিয়ে একটা ঘটনা জানা যায়। ১৭/১৮ বয়সে প্রচুর রেওয়াজ করে করে তাঁর মনে হল, বেশ দক্ষতা অর্জিত হয়েছে। একদিন বাবা আলি বখ্শ খাঁকে গান শুনিয়ে জানতে চাইলেন, গান কেমন হয়েছে। গান শুনে বাবা চুপচাপ উঠে গেলেন, কোনো কথাই বললেন না। রাতে দস্তরখানায় বসে বাবার কাছে আবার জানতে চাইলেন, বাবা আমার গান শুনে কেমন লেগেছে?
বাবা জবাব দিলেন : “ক্যা কঁহু, জিসকে পাস সুর নহী, উসকো পাস কুছ ভী নহী।” (যার কাছে সুর নাই তার কাছে কিছুই নাই।) আরো বললেন, তোমার গানের কথা মনে হলে আমার গলা দিয়ে ভাত নামতে চায় না। ছেলে নিরবে ভাতের থালা রেখে উঠে গেল।
গান শেখার সাধনা
এরপর থেকে বড়ে গোলাম আলি খাঁ নতুনভাবে সাধনায় মনোনিবেশ করতে লেগে গেলেন। বাড়িতে সাধনা করলে পাড়া-প্রতিবেশিরা বিরক্ত হয়ে অভিযোগ করে। তাই তিনি চলে যেতেন নির্জন স্থানে – শ্মশানে কিংবা পাহাড়ে। পাহাড়ে গলা ছেড়ে রেওয়াজ করতেন আর ফিরে আসা প্রতিধ্বনি থেকে নিজেই নিজের ভুলগুলো খুঁজে বের করতেন।
বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় মা ছোট ভাইকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান এবং সারেঙ্গী বাজানো শিখে সংসারের জন্য রোজগারের পথে নামেন। তখন তাঁর বয়স ১৮/১৯।
ভারতীয় রাগ সঙ্গীত বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা হতো ঘরানাকে কেন্দ্র করে। এই ঘরানার ব্যাপারটায় একটা আভিজাত্য ছিল। রাজা-রাজরাদের আশ্রয়ে ঘরানার শিল্পীরা থাকতেন। নিজেদের ঘরানার বাইরে বা রাজা-রাজরাদের সন্তানদের বাইরে কাউকে গান শেখানোর রেওয়াজ ছিল না। বড়জোর অন্য কোনো খানদানি ঘরানার কাউকে শিষ্য করতেন তারা।
বড়ে গোলাম আলি খাঁ গান শেখার জন্য গিয়েছিলেন কিরানা ঘরানার ওস্তাদ বহীদ খাঁর কাছে। কিন্তু বহীদ খাঁ তাঁকে গান শেখাননি। কারণ আর কিছুই নয়, গোলাম আলি তো আর কোনো খানদানি ঘরানার সন্তান নন। তখনকার দিনে পাঞ্জাবের শিল্পীদের নিচু চোখেই দেখা হতো। সুতরাং সেখানে আর তার গান শেখা হল না। পরবর্তীতে তিনি শিখেছেন দিলীপ চন্দ্র বেদীর (১৯০১-১৯৯২) কাছে।
নিজের প্রথম জীবনের গুরু কালে খাঁর শিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেছেন – “আমার গুরু, চাচা কালে খাঁ সাহেবের কাছে যদি কিছু শিখে থাকি, তো আওয়াজ তৈরি করা ও তানের রেওয়াজ পদ্ধতি।” এই বলে উনি গলা কীভাবে খুলতে হয়, কোন সুর কী প্রকারে লাগিয়ে গলা মোলায়েম করতে হয় তা দেখিয়ে দিলেন।
ঘুমানো আর খাওয়া ছাড়া সব সময়ই রেওয়াজ করতেন। পুরনো দিনের একটি যন্ত্রকে নিজের মতো করে বিকশিত করে নিয়েছিলেন, নাম দিয়েছিলেন স্বরমণ্ডল। তখনকার দিনে বড় শিল্পীরা বাড়িতে কাউকে গান শোনাতেন না। খুব অল্প শিল্পী এর ব্যতিক্রম ছিলেন। বড়ে গোলাম আলি খাঁ সেই ব্যতিক্রমদের একজন। কেউ অনুরোধ করলেই গান শোনাতে বসতেন।
আপনারা রামকে বাদ দিন, আমি আপনাদের বাদ দিলাম
১৯৪৭ সাল শেষ হতে চলেছে। ওস্তাদ খাঁ সাহেব তখন নিজের জন্মস্থানের সুবাদে পাকিস্তানের নাগরিক। পাকিস্তানেই থাকছেন। একের পর এক সঙ্গীত সম্মেলনে গান গাইছেন – কখনো পেশোয়ার, কখনো করাচি। এরই এক ফাঁকে গান রেকর্ডিং করলেন রেডিও পাকিস্তানের জন্য। রেকর্ডিং শেষে আবার ছুটলেন আসরের পানে।
কোনো এক আসর থেকে ফিরে একটি টেলিগ্রাম পেলেন, রেডিও পাকিস্তানের প্রোগ্রাম ডিরেক্টরের। খাঁ সাহেব যদি একবার অনুগ্রহ করে রেডিও স্টেশনে আসেন! রীতিমাফিক আদর-আপ্যায়নের পর অন্তত্য বিনীতভাবে নিবেদন পেশ করলেন রেডিও পাকিস্তানের কর্ণধার : ‘একটা ছোট্ট অনুরোধ ওস্তাদজি, গানের মুখড়া যদি একটু বাদ দেন।’
বিষয়টি বুঝতে পারলেন না খাঁ সাহেব। কোন গানের মুখরা? এবার রেকর্ডিং থেকে শোনানো হলো বড়ে মিয়া সাহেবের গাওয়া চরাচর উন্মনা করা ঠুংরির প্রথম কলি ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে, হায় রাম’! ব্যাখ্যা করে বললেন ডিরেক্টর : ‘এই দুটো শব্দ বাদ দিন ওস্তাদজি, দুটো শব্দ বাদ দিলে তো আপনার অনন্ত মুধভরা গান ফুরবে না!’ বুঝতেই পারছেন, ইসলামি পাকিস্তানে রামের নাম উচ্চারণ হারাম।
আপনারা রামকে বাদ দিন, আমি আপনাদের বাদ দিচ্ছি। সিংহ গর্জে উঠল রেডিও স্টেশনে। পরের দিনই চিঠি লিখলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদকে, তিনি চলে আসতে চান ভারতে। হৃদয় নিংড়ানো প্রেম, অপেক্ষা আর যন্ত্রণা দিয়ে যে গান রচিত হয়, ধর্মের দোহাই দিয়ে তাকে পাল্টানো যায় না। একজন শিল্পী তা করতে পারেন না। গানকে রক্ষা করাই শিল্পীর ধর্ম। এর চেয়ে বড় আর কোনো ধর্ম শিল্পীর নেই। ঠিক এক পক্ষ কাল পর ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব চিরদিনের জন্য জন্মভূমি পাকিস্তান থেকে এলেন কলকাতায়।
তাঁর কণ্ঠে সরস্বতীর অধিষ্ঠান
এবার আরো একটি ঘটনা – ভিন্ন অবস্থান থেকে। জি এন বালসুব্রহ্মনিয়ম্ (১৯১০-১৯৬৫) হলেন কর্ণাটকী সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ গায়কদের একজন। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে মাদ্রাজে, মাদ্রাজ একাডেমির জলসায় বড়ে মিয়ার গান শোনার পর বালসুব্রহ্মনিয়াম্ ‘You are the greatest’ বলে খাঁ সাহেবের পায়ের ধুলো নিয়েছিলেন।
আর যাবে কোথায়! ধর্মান্ধের দল কি শুধু একদিকে? এরা তো দুদিকেই আছে। একজন ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে একজন মুসলমানের পায়ের ধুলো নেয়া? মাদ্রাজের কট্টর ব্রাহ্মণ সমাজ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ওঠে। শুরু হয় হইচই। এসব হইচইয়ের জবাবে জি এন বালসুব্রহ্মনিয়ম্ বলেছিলেন – “কলাকারদের জাত নেই। গোলাম আলি খাঁ মুসলমান হতে পারেন। কিন্তু তাঁর গলায় দেবী সরস্বতীর অধিষ্ঠান। আমি তাঁকেই প্রণাম করেছিলাম।”
সুরের জাদুকর
বড়ে গোলাম আলি খাঁর মূল সম্পদ ছিল অসাধারণ কণ্ঠ মাধুর্য্য আর সেই কণ্ঠ খেলানোর ক্ষমতা। তাঁর কণ্ঠে ছিল মিস্টতা। আবার একই সঙ্গে এই কণ্ঠে ছিল রাবারের মতো নমনীয়তা (flexibility)। অতি চড়া অবস্থাতেও, তারসপ্তকেও, তাঁর কণ্ঠের মোলায়েমভাব বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন হতো না।
এ সম্পর্কে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ‘কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’-তে লিখেছেন : “বড়ে গোলাম আলি খাঁ কলাকার ছিলেন। [কলাকার মানে কলা সৃষ্টিকারী]। তাঁর পূর্বসূরীদের পাণ্ডিত্য তিনি পাননি, আর তা নিয়ে তিনি মাথাও ঘামাননি। উনি জোর দিতেন রেওয়াজের ওপর, দক্ষতা ও গলা খেলানোর ওপর। … মৌজুদ্দিন খাঁ, আবদুল করিম খাঁ, বড়ে গোলাম আলি খাঁ – এঁরা সাধারণ আর্টিস্টদের পর্যায়ে পড়েন না। এঁরা জিনিয়াসের পর্যায়ে পড়েন।”
আবার খাঁ সাহেবের গায়ন-রীতির কারণে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারকদের কেউ কেউ তাঁকে সমালোচনাও করতেন। সমালোচকেরা বলতেন, তিনি গলার সার্কাস দেখান। (Indian Musical Tradition – বামনরাও দেশপাণ্ডে) অর্থাৎ তিনি আসরে শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে ধ্রুপদ গানের বিকৃতি ঘটান। কিন্তু তাঁর কঠোর সমালোচকেরাও তাঁর কণ্ঠে ঠুংরী দাদরা শুনে চুপ মেরে যেতেন।
খাঁ সাহেবের গান গাইবার ধরন সম্পর্কে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, গান গাইতে অনেক শিল্পী অল্প বিস্তর হাত পা নাড়েন। [এই যেমন ধরুন রশীদ খাঁ বা কৌশিকী যখন ‘ইয়াদ পিয়া কে আয়ে’ গেয়েছেন তখন তাঁদের মুভমেন্ট বা নড়াচড়া স্মরণ করার চেষ্টা করুন] অনেক শিল্পীর অঙ্গভঙ্গি ও লম্ফঝম্ফ তাঁদের সঙ্গীতের মতোই খ্যাতি পেয়েছে। এঁদের বিপরীতে খাঁ সাহেবের গাইবার ভঙ্গি দেখে মনে হত, উনি বাথটাবে শরীর এলিয়ে দিয়ে গান করছেন। যোগী পুরুষরা যেভাবে সারা শরীরের পেশীকে শিথিল করে দিতে পারে, উনি সেভাবে গান গাইতেন।
“বড়ে গোলাম আলী খান সাহেবের স্বরপ্রয়োগ ও তানের মূলতত্ব ও নীতি ছিল Tension-এর অভাব। প্রত্যেক গাইয়েই জানেন, সামান্য চাপা উত্তেজনা বা সংশয় থাকলে গলার ভেতরকার পেশী টানটান হয়ে যায়। খান সাহেব গাইবার সময় যেমন মনে হত উনি বাথটবে সারা শরীর এলিয়ে দিয়ে গাইছেন। একবার খান সাহেব তার ডিক্সন লেন এর বাড়িতে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধ শোয়া অবস্থায় আছেন, নাপিত ক্ষুর দিয়ে ওনার দাড়ি কামাচ্ছে, এই সময় ওনার তান মারবার ইচ্ছে হলো। নাপিত ক্ষুর সরাবার চেষ্টা করতেই উনি ইশারায় বারণ করলেন, তারপর দু সপ্তকের সপাট তান মারতে লাগলেন। শরীর নড়ছে না, চোয়াল নড়ছে না, জিভ ও নড়ছে না, এদিকে ওনার ‘ডবল চিন’-এর ওপর ক্ষুর চলছে! কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী]
তাঁর এই অসাধারণ জাদুকরী কণ্ঠের কারণেই ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের নির্মাতা ও সঙ্গীত পরিচালকেরা তাঁকে বহুবার চলচ্চিত্রে গান গাইতে অনুরোধ করেছে। কিন্তু তিনি সেসব অনুরোধ উপেক্ষা করেছেন। অবশেষে চলচ্চিত্র পরিচালকত কে. আসিফের বিশেষ প্ররোচনা এবং উৎসাহে তিনি মুঘল-এ-আজম সিনেমাতে সঙ্গীত পরিচালক নওশাদের সাথে কাজ করতে সম্মত হন।
ওরকম গলা কোথায় পাব?
কুমারপ্রসাদ একবার বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী আমীর খাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি আসরে কখনও ঠুংরী গান না কেন? এই তো বাড়িতে বসে দিব্যি গাইছেন?” জবাবে আমীর খাঁ বলেছিলেন – “অ্যায়সা নহী কি কভী সোচা নহী, মগর গুলাম আলিসে অচ্ছা তো নহী গা সকতে হেঁ, ইস লিয়ে কোশিশ্ নহী কী।” অর্থাৎ আসরে ঠুংরী গাওয়ার কথা তিনি কখনোই ভাবেননি তা নয়, কিন্তু যেহেতু গোলাম আলি খাঁর চেয়ে ভালো গাইতে পারবেন না, তাই আর সে চেষ্টা করেননি।
আরেকবার গোলাম আলি খাঁর কণ্ঠ নিয়ে আমীর খাঁ বলেছিলেন – “গোলাম আলির সঙ্গে তো মোকাবিলা করতে হয় আমাদের শুধু মাথা দিয়ে। ওরকম গলা কোথায় পাব? আসরের ইমতিহানে (পরীক্ষায়) গলা খোলা মাত্র তো ও একশর মধ্যে সত্তর দিয়ে শুরু করে যেখানে অন্যান্য গাওয়াইয়ারা পায় বিশ তিরিশ চল্লিশ। ”
খাঁ সাহেবের শিখন–পদ্ধতি
বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে এক অবিস্মরণীয় নাম গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তিনি বড়ে খাঁ সাহেবের শিষ্যা ছিলেন। সন্ধ্যা মুখার্জীর স্মৃতিচারণে খাঁ সাহেবের শিখন-পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
১৯৪৯-১৯৫০ সালের দিকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিক্সন লেনের বাড়িতে একটি ঘরে থাকতেন খাঁ সাহেব। সে সময়ই কোনো একদিন খাঁ সাহেবের কাছে ‘গান্ডা’ বেঁধেছিলেন সন্ধ্যা। গুরুর মুখে মিষ্টি দিয়ে, প্রণাম করে তাঁকে বরণ করে নেন শিষ্য-শিষ্যা। গুরু তখন হাতে সুতো বেঁধে তার শিষ্যত্ব স্বীকার করেন। এই অনুষ্ঠানকেই বলে ‘গান্ডা’ বাঁধা
বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে উচ্চতর তালিম নিতে থাকেন সন্ধ্যা। সুরমণ্ডল হাতে সারাদিন ধরে গান শেখাতেন খাঁ সাহেব। দুপুরে ডিক্সন রোডের বাড়িতেই কিছু খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত হত। বিকেলে আবারও তালিম নেয়া। সন্ধ্যার সঙ্গে তালিম নিতেন মীরা চট্টোপাধ্যায়ও (পরে বন্দ্যোপাধ্যায়)। এক একটা রাগ বেশ কিছু মাস ধরে শেখাতেন খাঁ সাহেব। বলতেন : “একটা গুরুত্বপূর্ণ রাগ, যেমন ইমন – এই ইমন তুমি টানা চার-পাঁচ বছর ধরে শিখতে শিখতে এমনভাবে নিজেকে তৈরী করে ফেলতে পারবে যাতে সমস্ত রাগ সম্বন্ধেই একটা পরিষ্কার ধারণা তোমার এসে যাবে। এরপর ওই রাগগুলো তুমি সাধবে। যেটা তুমি ধরেছো তার ভিতরে ঢুকে গিয়ে একদম মনেপ্রাণে সাধবে। ওই রাগটাকে বারবার তুমি প্র্যাকটিস করে যাবে।”
কোনও রাগের বন্দিশ শিখিয়ে বলতেন : “দেখো বেটা, এ যো বন্দিশ তুমকো আজ শিখায়া এ লাখো রুপিয়ামে নেই মিলতা হ্যায়। আগে তুমি ভালোভাবে বুঝে নেবে। আমি প্রথমে পাঁচ-ছ’বার করে গেয়ে যাব। তারপর তুমি আমাকে শোনাবে।” গান শেখানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন খাঁ সাহেব। কনফারেন্সে ঠিক যেভাবে গাইতেন, শেখানোর সময়েও ঠিক সেভাবেই – আপন মনে, নানা কারুকার্য্যের মধ্য দিয়ে বিস্তার করতেন অপূর্ব রাগরূপ। সবসময় বলতেন, গান শেখার ক্ষেত্রে গান শোনার ভূমিকা বিরাট। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের যাবতীয় অনুষ্ঠানে শ্রোতার আসনে উপস্থিত থাকতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ‘বাবা’ বড়ে গোলাম আলি খাঁর নির্দেশে।
বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে একটানা অনেকদিন শিখতে পারেন নি সন্ধ্যা। খাঁ সাহেব তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কনফারেন্সে যেতেন – তখন কিছুকাল স্বাভাবিক কারণেই গান শেখানো সম্ভব হতনা। ওঁর সঙ্গে বেশ কিছু কনফারেন্সে গানও করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। উত্তরপাড়ার বিখ্যাত ‘সঙ্গীতচক্র কনফারেন্স’ শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। সে বছর সারারাত্রিব্যাপী উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। খাঁ সাহেবের কাছে শেখা নানা রাগের খেয়াল ও বেশ কিছু ঠুংরি বিভিন্ন সময় আকাশবাণীতে ও দূরদর্শনে পরিবেশন করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
বিশেষ কিছু অবদান
রেওয়াজ করার সময় বা গান গাইবার সময় খাঁ সাহেব ‘স্বরমণ্ডল’ নামের একটি যন্ত্র ব্যবহার করতেন। এ যন্ত্র খুব কম শিল্পীকেই ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এবং যন্ত্রটি তিনি নিজের মতো করে কারিগর দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিলেন।
বড়ে গোলাম আলি খাঁ চারটি সঙ্গীত-ধরণ প্রবর্তন করে গেছেন। সেগুলো হচ্ছে পাতিয়ালা-কাসুর, ধ্রুপদের বেহরাম খানি, জয়পুরের, গোয়ালিয়রের বেলাভাস। তাঁর রাগের বিষয়ে খানিকটা বিতর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ধ্রুপদী সঙ্গীতের সৌন্দর্য্য মূলতঃ অবসর বিনোদনের মধ্যে নিহিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, দর্শকেরা দীর্ঘকালীন সময়ে একগুঁয়েমিতে ভোগে। ফলে তিনি শ্রোতাদের চাহিদামাফিক গানকে পরিবর্তন করে থাকেন।
জীবনাবসান
খাঁ সাহেবের জীবনে একটি বিশেষ বিলাস ছিল – সেটি খাওয়া-দাওয়া। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর রাজকীয়। ঘি-মাখন-পেস্তা-বাদাম আর মাংস না খেলে গান গাওয়া যায় না বলেই তিনি মনে করতেন। আর দান-ধ্যানের ব্যাপারেও তাঁর স্বভাব রাজাদের মতোই। কেউ সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা থাকত সবই দিয়ে দিতেন।
জীবনের শেষের বছরগুলোয় দীর্ঘদিনের অসুস্থতাজনিত কারণে আংশিক পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়েছিল তাঁকে। তবে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পুত্র মুনাওয়ার আলী খানকে সহায়তার লক্ষ্যে গান পরিবেশন করেছিলেন।
২৩ এপ্রিল ১৯৬৮ তারিখে হায়দ্রাবাদের বাঁশেরবাগ প্যালেসে তাঁর দেহাবসান ঘটে।
কয়েকটি ইউটিউব ভিডিও
ইয়াদ পিয়া কি আয়ে:
https://www.youtube.com/watch?v=_S688x-UfBg
বেস্ট অফ বড়ে গোলাম আলি খাঁ:
https://www.youtube.com/watch?v=Gy75Hipt8IQ
ন্যায়না মোরে তারাস রাহে আজা বালাম পরদেশী:
https://www.youtube.com/watch?v=lDmEX_iAVwA
একটি সাক্ষাৎকার:
খাঁ সাহেবকে নিয়ে ডকুমেন্টারি:
https://www.youtube.com/watch?v=5Db_hwOwxGU