ধারাবাহিক অনুবাদ
(১ম পর্ব)
ভূমিকাঃ
একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ একটি প্রয়োজনীয় ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে প্রণীত প্রথম সংবিধানে গণতন্ত্র, শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ এর নিশ্চয়তা দেয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের ওপর কোন রকমের হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং একের পর এক সরকারগুলোর অনিচ্ছার কারণে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা অধরা থেকে যায়। তাছাড়া, নির্বাচিত সরকারগুলো, সেটা সামরিক স্বৈরাচার বা বেসামরিক সরকার যেই হোক না কেন, সবাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারে ছিল উদাসীন। সরকারগুলো কোনভাবেই বিচার বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের অবৈধ হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা কমে আসুক এটা চাইত না। একইসাথে এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ যে গত চার দশকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এ সময়ে বিচার বিভাগে উঁচু মাত্রার প্রশিক্ষিত পেশাজীবীদের আগমন ঘটে, তার সাথে নতুন প্রযুক্তির অন্তর্ভূক্তি, নাগরিকদের সমানভাবে দেখার প্রবণতা, যুদ্ধাপরাধী এবং জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ার বাধা অপসারণ, নাগরিকদের আইনী স্বাধীনতা রক্ষা করা ইত্যাদি নানা বিষয়ে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
আমার জীবনে সেই ১৯৭৪ সালে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলার নিম্ন আদালতের আইনজীবী থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বাংলাদেশের বিচার-ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং বাধাগুলো খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ ও সম্মান ঘটেছে। কিন্তু ২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে ঐতিহাসিক রায় দেবার পরে বর্তমান সরকার কর্তৃক আমাকে পদত্যাগ ও জোরপূর্বক দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এবং নেতৃত্ব নিয়ে পর্যবেক্ষণসহ সর্বোচ্চ আদালত থেকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রকাশিত এ রায় দেশের আপামর জনগণ, আইনজীবী ও সুশীল সমাজের দ্বারা আদৃত হয়। স্বাধীন বিচার বিভাগ নিয়ে এ রায় দেশে-বিদেশে নানা মিডিয়ারও নজর কাড়তে সক্ষম হয়। কিন্তু এটি ক্ষমতাসীন সরকারের রাগ আরো উসকে দেয়।
বাংলাদেশে বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগের মধ্যকার বিভেদ এবং যার কারণে একজন গদীনসীন প্রধান বিচারপতিকে অবৈধভাবে সরিয়ে দেবার মত এমন অভূতপূর্ব ও দূর্ভাগ্যজনক অবস্থার শুরু হয় ২০১৪ সালে, যখন জাতীয় সংসদে সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের দ্বারা উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিসংশনের ক্ষমতা দেয়া হয়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সদস্যদের দ্বারা বিচারকদের অপসারণের ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অভিযুক্ত বিচারকের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ প্রক্রিয়ায় বিচার বিভাগের সুরক্ষা নিশ্চিত থাকে এবং বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ মুক্ত থেকে তাদের সেবা না করে জনগণের পক্ষে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত হয়। তাই ২০১৬ সালের ৫ মে হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ থেকে বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হয়। এ রায় ঘোষণার পর পরই সংসদ সদস্যরা বিচারকদের হেনস্থা করে এবং আদালতের প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন শুরু করেন। রাষ্ট্র এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে এবং সাত সদস্যের এক বেঞ্চে তার শুনানী হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখে আদালত সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। সে বছর আগস্ট মাসের প্রথম দিন আদালতের সর্বসম্মত রায় এবং পর্যবেক্ষণ জনগণের জন্য উম্মুক্ত করা হয়।
গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর সংসদে আদালতের রায় বাতিল করার জন্য আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী, তার দলের অন্যান্য সদস্যরা, মন্ত্রীরা আমাকে সংসদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় ভীষণভাবে তিরষ্কার করেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্যরা আমাকে বিভিন্ন দূর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন। আমাকে নিজের সরকারি বাসায় অন্তরীণ করে রাখা হয়, সে সময় আইনজীবী এবং বিচারকদের আমার কাছে আসতে বাধা দেয়া হয়। মিডিয়াকে বলা হয় আমি অসুস্থ, আমি স্বাস্থ্যগত কারনে ছুটিতে আছি। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী বলতে লাগলেন আমি নাকী সরকারী ছুটি নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব, এবং এমতাবস্থায় অক্টোবরের ১৪ তারিখে আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। দেশ ছাড়ার আগে পরিস্থিতি কিছুটা পরিষ্কার করতে আমি জনগণকে জানাই যে, আমি মোটেও অসুস্থ নই এবং চিরতরে দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি তখন ভেবেছিলাম আমার শারীরিক অনুপস্থিতি ও কোর্টের নিয়মিত ছুটি কাটানোর পরে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হবে এবং সবার মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সরকারও বুঝতে পারবে যে এ রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত হবে এবং সেটা দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভাল হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই (ডাইরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স) এর মাধ্যমে আমার পরিবারকে ভয়-ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করার কারণে আমি বিদেশে অবস্থান করা অবস্থায় বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদ থেকে অবসর নিতে বাধ্য হই।
এ বইয়ে আমি আমার জীবনের প্রথম দিককার অস্তিত্বের সংগ্রাম, বিচারকের জীবন ও অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জঃ এর স্বাধীনতার সংগ্রাম, বিচার ব্যবস্থা ও রাজনীতিকদের মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও গনতান্ত্রিক শৈশব; বিভিন্ন বিষয়ে আমার বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গী, পাবলিক কৌশলীদের (পিপি) মামলা পরিচালনার ধরন নিয়ে ভৎর্সনা, পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার, জরুরী অবস্থা এবং ডিজিএফআই কর্তৃক ব্যবসায়ীদের ওপর চাঁদাবাজি, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছি। এছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে বার কাউন্সিল এর ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা দলীয় বিভেদের জন্য আদালতের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি যেটা বিচার ব্যবস্থায় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের সমতুল্য।
এ বইয়ে আমি বাংলাদেশের আইন এবং শাসন বিভাগের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের বিকাশের একটা ঘনিষ্ঠ বর্ণনা এবং বিচার বিভাগ থেকে আমাকে জোরপূর্বক অপসারণের বর্ণনা দিয়েছি। এ বর্ণনায় আমি আমার দীর্ঘ বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং ন্যায় পরায়ণতা থেকে বলার চেষ্টা করেছি, এতে দেশের সরকার ব্যবস্থা বা জাতির জন্য ভবিষ্যত কোন দিক-নির্দেশনা নেই। সেটা দেশের মানুষ ঠিক করবে, যারা স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও সাম্যের প্রশ্নে কখনও আত্মত্যাগ করতে পিছু হটেনি। এটা আমার অসমাপ্ত আত্মজীবনী যাতে আমি বলার চেষ্টা করেছি কীভাবে আমার মতো ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষ একটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রধান বিচারপতি হতে পেরেছি। এছাড়া এ বই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় আমি কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি তার বিবরণ। আমার এ ঝড়-ঝঞ্ঝাময় ভ্রমণ কাহিনী জাতীয় জীবনেরও ঘূর্ণাবর্তের কাহিনী। যার ফলে যারা সমসাময়িক বাংলাদেশ, এর কষ্ট ও দূর্দশাকে বুঝতে চান এ বই তাদের জন্য পাঠ্য। তাছাড়া যে কেউ উন্নয়নশীল দেশের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যকার সম্পর্ক এবং গণতান্ত্রিক শৈশবস্থায় বিচার বিভাগের চ্যালেঞ্জ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী এ বই তাদেরও কাজে আসবে। এ বই স্বার্থক হবে যদি এর দ্বারা পাঠক অনুপ্রাণিত হোন, তিনি হতে পারেন আইনজীবী বা আইনের শিক্ষক, অথবা একজন সাধারণ মানুষ। বইটি যদি পাঠকের মধ্যে এ বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে পারে যে, আইন পেশা একটি সম্মানজনক পেশা যাতে সততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রয়োজন, যেটা রাজনীতিক বা বিচারকের জন্যেও প্রযোজ্য। বইয়ের রেফারেন্সে কিছু ভুল-ত্রুটি আছে, সেটা আমার বইয়ের স্বল্পতা এবং দেশ থেকে বই আনাতে অপারগতার জন্য হয়েছে। কিছু রেফারেন্স স্মৃতি থেকে দিয়েছি, আশা করছি পরের সংস্করণে সেগুলো সংশোধন করব।
(চলবে…)
পরবর্তী পর্ব পড়তে পর্বের উপরে ক্লিক করুন এখানে-
A Broken Dream সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (২য় পর্ব)
A Broken Dream সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (৩য় পর্ব)
A Broken Dream সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (৪র্থ পর্ব)
A Broken Dream সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (৫ম পর্ব)
==================================
একটি স্বপ্নভঙ্গের কাহিনীঃ আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা
প্রধান বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত), সুপ্রিম কোর্ট, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮; ৮:২৪ পূর্বাহ্ন
সরকার আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে: নতুন বইয়ে বিচারপতি সিনহা
নিউজ ডেস্ক: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
যাকে ঘিরে এক বছর আগে বাংলাদেশের বিচারঙ্গনে রীতিমত ভূমিকম্প ঘটে গিয়েছিল, সেই বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে বসে একটি বই লিখেছেন, যেখানে দেশত্যাগ ও পদত্যাগ নিয়ে এসেছে বেশ কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য।
‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে আত্মজীবনীমূলক এই বইয়ে বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধান বিচারপতি দাবি করেছেন, তিনি দেশ ছেড়েছেন ‘হুমকির মুখে’; একই কারণে বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
আর সেই হুমকি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা– ডিজিএফআইয়ের তরফ থেকে এসেছিল বলে দাবি করা হয়েছে বইটিতে।
বিচারপতি সিনহার অভিযোগের বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীদের কারও বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। আর ডিজিএফআই বলেছে, কাওকে হুমকি ধামকি দেওয়ার মত কাজ তারা কখনোই করে না।
৬১০ পৃষ্ঠার এই বইটি অ্যামাজনের কিন্ডেল সংস্করণে বিক্রি হচ্ছে। বইয়ের কিছু অংশ অ্যামাজনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
বিচারপতি সিনহা ভূমিকায় লিখেছেন, ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনে যুক্ত থাকার সুবাদে এর রূপান্তর এবং বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সিলেটের নিম্ন আদালতের একজন আইনজীবী হিসেবে শুরু করে বাংলাদেশের বিচারালয়ের শীর্ষ অবস্থানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য হয়েছে তার।
“কিন্তু ২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে ঐতিহাসিক এক রায় দেওয়ার পর বর্তমান সরকার আমাকে পদত্যাগ করতে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে।”
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়াকে ওই রায়ের মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট। আর তারপর যা ঘটেছে, তাকে বিচারপতি সিনহা বর্ণনা করেছেন ‘নজিরবিহীন ঘটনা’ হিসেবে।
পৌন তিন বছর প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করা বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। কিন্তু কার্যকাল শেষ হওয়ার ৮১ দিন আগেই তাকে ‘নজিরবিহীন’ ওই পরিস্থিতির মধ্যে পদত্যাগ করতে হয়।
বাংলাদেশে আর কখনও কোনো প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এত আলোচনা হয়নি; আর কোনো প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগও করতে হয়নি।
অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মীর সঙ্গে বাদানুবাদ, বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ আনা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেট প্রকাশ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধ, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে উত্তেজনা- এরকম বহু ঘটনায় বিচারপতি সিনহা বহুবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন।
সর্বশেষ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে তিনি ছুটিতে যান। সরকারের পক্ষ থেকে অসুস্থতার কথা বলা হলেও ১৩ অক্টেবর তিনি রীতিমত বোমা ফাটিয়ে বিদেশে চলে যান।
বিচারপতি সিনহা বলে যান, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি ‘বিব্রত’। তার ছুটির মেয়াদ শেষে ১১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারপতি সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পদত্যাগ করার পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়। বলা হয়, ওইসব অভিযোগের কারণে আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি নন। সেসব অভিযোগ নিয়ে দুদক পরে অনুসন্ধানও শুরু করে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সে সময় বলেন, একজন বিচারপতির মাধ্যমে দেশে জুডিশিয়াল ক্যু করার চেষ্টা হয়েছিল। আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, শৃঙ্খলা বিধির নামে তা কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন বিচারপতি সিনহা।
বিচারপতি সিনহার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সময়ে বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেট নিয়ে সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের টানাপড়েনের অবসান ঘটে।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়া অবৈধ ঘোষণার যে রায় নিয়ে সঙ্কট জটিল মাত্রা পেয়েছিল, সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্যও সরকার আবেদন করে।
অবশ্য সরকার সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দিলে আপিল বিভাগের তখনকার জ্যেষ্ঠতম বিচারক ওয়াহহাব মিঞাও চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বিদায় নেন।
https://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2017/10/13/c.j.-s-k-sinha-to-airport-2-.jpg/ALTERNATES/w640/C.J.+S+K+Sinha+To+Airport+%282%29.jpg
২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর দেশ ছাড়ার আগে বিচারপতি এস কে সিনহা সাংবাদিকদের বলে যান, তিনি অসুস্থ নন, পালিয়েও যাচ্ছেন না, আবার ফিরে আসবেন। ‘দুর্ভাগ্যজনক, নজিরবিহীন
বিচারপতি সিনহার বইয়ের ভূমিকাসহ ১০টি অধ্যায় অ্যামাজানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
আইন পেশায় এস কে সিনহার টিকে থাকার সংগ্রাম, নানা অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের নৈতিকতার ‘অবক্ষয়’, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বাংলাদেশের ‘শিশু গণতন্ত্রের’ অবস্থা, পুলিশের ‘বাড়াবাড়ি’, জরুরি অবস্থার প্রভাব এবং জরুরি অবস্থার প্রভাব, এবং ‘ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ডিজিএফআইয়ের অর্থ আদায়ের’ বিষয়ে আলোকপাত করার কথা বলা হয়েছে ভূমিকায়।
শৈশব থেকে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়েও এ বইয়ে লিখেছেন বিচারপতি সিনহা।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদে থাকা অবস্থায় কোন পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছিল, কোন পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, আর কেন বিদেশে থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল- সে বিষয়ে নিজের ভাষ্য এ বইয়ে তুলে ধরেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি।
তিনি লিখেছেন, ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে যখন বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হল তখন থেকেই টানাপড়েনের শুরু।
২০১৬ বছরের ৫ মে হাই কোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পরের বছর জুলাইয়ে আপিল বিভাগের রায়ে তা বাহল থাকলে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় পড়েন বিচারপতি সিনহা।
পরের মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে তাতে বিচারপতি সিনহার ৪০০ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ দেখে শুরু হয় ব্যাপক বিতর্ক। সাবেক প্রধান বিচারপতি বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ওই রায়কে ‘ভ্রমাত্মক’ বলেন।
ওই পর্যবেক্ষণে সংসদ ও সরকার এবং জাতির জনককে খাটো করা হয়েছে অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা; অন্যদিকে বিএনপি প্রধান বিচারপতির পক্ষে দাঁড়ায়।
সেই সময়ের কথা তুলে ধরে বিচারপতি সিনহা তার বইয়ে লিখেছেন, “আপিল বিভাগের রায়ের পর ১৩ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাতিলের জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী, তার দলের লোকজন এবং সরকারের মন্ত্রীরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আইনমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনতে থাকেন।”
বিচারপতি সিনহা অভিযোগ করেছেন, ওই সময় তাকে তার বাসভবনে আটকে থাকতে হয়। আইনজীবী ও বিচারপতিদেরকে তার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছিল না। সংবাদমাধ্যমকে বলা হচ্ছিল- তিনি অসুস্থ, ছুটির আবেদন করেছেন।
“কয়েকজন মন্ত্রী বলছিলেন যে, আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর আমি যখন দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম, একটি বিবৃতি দিয়ে আমি বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করলাম যে আমি অসুস্থ নই, চিরতরে দেশ ছেড়েও যাচ্ছি না।
“আমি আশা করছিলাম, আদালতে আমার অনুপস্থিতি আর আদালতের নিয়মিত অবকাশের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা থিতিয়ে আসার সুযোগ পাবে এবং সুবিবেচনার উদয় হবে, সরকার হয়ত ওই রায়ের মর্ম বুঝতে পারবে, তারা বুঝবে যে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্র ও দেশের জন্যই দরকার।
“শেষ পর্যন্ত আমার পরিবার আর স্বজনরা যখন দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যাকে বলা হয় ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স, তাদের হুমকির মুখে পড়ল, তখন আমি বিদেশ থেকেই পদত্যাগপত্র জমা দিই।”
বিচারপতি সিনহার অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডিজিএফআইয়ের পিআরএমসি বিভাগের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বইটি তারা এখনো হাতে পাননি, সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
“তবে স্পষ্ট কথা হল, ডিজিএফআই কখনো কোনো ব্যক্তিকে হুমকি দেয় না বা এ ধরনের কোনো কাজও করে না।”
বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা বিভাগ। বুধবার রাতে বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান প্রবাহে বিচারপতি সিনহা ওই সময়ের পরিস্থিতি এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়েও কথা বলেন।
ওই সাক্ষাৎকারের অডিও বিবিসি বাংলার ফেইসবুক পেইজেও দেওয়া হয়েছে।
https://www.facebook.com/BBCBengaliService/videos/2276031525958794/
https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1541557.bdnews