০
১৪৯৩ বার পঠিত
গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাসের (৪৬০-৩৭০ খ্রিস্টপূর্ব) কণাবাদে সৃষ্টিজগতের মূলে রয়েছে অবিভাজ্য মৌলিক কণা যা নিসীম শূন্যে ঘুর্ণায়মান। সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিক দর্শনে লুসিপ্পাসের কণাবাদ অন্যতম মতবাদ, ডেমোক্রিটাস এ মতবাদকে পূর্ণাঙ্গ দর্শনে পরিণত করেন। কণাবাদের মৌলিক ধারণাসমূহঃ
১) প্রকৃতিতে আছে কেবল সত্ত্বা এবং শূন্যতা, কণা এবং স্থান (স্পেইস)। শুন্যতা চিরন্তন, শুন্য থেকে কিছু সৃষ্টি হয় না, এবং যা আছে সেটাকে শুন্যতায় পর্যবসিত করা সম্ভব নয়, প্রাচীন সূত্রানুযায়ী, “nothing can arise out of nothing; what is cannot be reduced to nothing”। কেবল কণা বা এটম চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়।
২) কণা সবচেয়ে সূক্ষ, অদৃশ্য কণিকা যা শুন্যে বিচরণ করে।কণা অবিভাজ্য, ক্ষুদ্র, তাদের ভেতরে কোন শুন্যতা বা ফাঁকা স্থান নেই, সুতরাং তাদের চাপ দিয়ে আরো ক্ষুদ্র করা সম্ভব নয়। কণা পূর্ণ, কঠিন এবং অভেদনযোগ্য।
৩) কণাদের পরস্পরের মধ্যে পৃথক করা সম্ভব নয়, তাদের মধ্যে পরিমাণগত পার্থক্য ছাড়া অন্য কোন পার্থক্য নেই। বিশ্ব জগতে কণার পরিমাণ অসংখ্য।
৪) কণাগুলো অসীম শুন্যতায় বিচরণ করে, যার কোন উপর-নীচ, কেন্দ্র বা পরিসীমা নেই। সময়ের শুরু থেকে তারা একে অপরকে চিরন্তন গতির দ্বারা চাপ প্রয়োগ করে, আঘাত সৃষ্টি করে, যার ফলে বন্ধন এবং জমাটবদ্ধ হয়। এরকম সংঘর্ষের ফলে বিভিন্ন সংখ্যক কণার সমন্বয়ে জগতের সৃষ্টি নানান আকার, আকৃতি পায়। এর জন্য গতি অত্যাবশ্যক, গতির প্রকৃতির কারণে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে এবং গতির কারণে জগত সৃষ্টি হয়।
৫) বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে জগতের সংখ্যা অসংখ্য। দৈবক্রমে (chance) তাদের সৃষ্টি, এর কারণ খোঁজার কোন দরকার নেই, কারণ সব সময়ই আছে। সময়, গতির মত এর কোন শুরু নেই।
৬) কেবল কণা এবং শুন্য চিরন্তন। জগত এবং এর সমুদয় সৃষ্টি একবার উদয় হয় এবং আবার বিলীণ হয়ে যায়, কারণ তারা কণার নানাবিধ সমন্বয় ছাড়া আর কিছু নয়। যা কিছু চিরন্তন তার কোন পরিবর্তন নাই। আর যা পরিবর্তিত হয় তা হল কণার নির্দিষ্ট স্তর-বিন্যাস এবং সমাবেশ, এদের শুরু যেমন আছে তেমনি শেষও আছে।
Democritus by Hendrick ter Brugghen, 1628
জগতের উদ্দেশ্যঃ পারমাণবিক গতির এ জগতের কোন উদ্দেশ্য নাই, কোন মানে নাই, কোন শৃঙ্খলা নাই, কেবল গতি এবং দৈব সংযোগ এবং বিচ্ছিন্নতা।
আত্মাঃ গোলাকার, মসৃণতম, সূক্ষতম, সর্বোচ্চ গতিশীল কণা দিয়ে আত্মার সৃষ্টি। এসব গোলাকার পরমাণুগুলো তাদের গতি দিয়ে সারা শরীরকে সচল করে। এসব কণাগুলো তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী কখনই স্থির থাকে না।
এমনকী আমাদের চিন্তাও শারীরিক প্রক্রিয়ার অংশ, কণাগুলো সঠিকভাবে মিশ্রিত হলে চিন্তার উদয় হয়, আর মিশ্রণ ঠান্ডা হয়ে গেলে চিন্তা পরিবর্তিত হয়।
আমাদের বোধগম্যতায় এবং স্বপ্নে ইমেজ বা চিত্র আত্মায় প্রবেশ করে সব ধরণের জিনিসের প্রতিরূপ তৈরি করে। এর ফলে জীবিত মানুষ, প্রাণি, গাছপালা সহ বিভিন্ন বস্তুকে স্বপ্নে দেখি।
বোধঃ যদি সত্ত্বার সৃষ্টিতে কেবল কণা এবং শুন্যস্থানই থেকে থাকে তাহলে আমরা যা দেখি সেটা শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপ। আমাদের ইন্দ্রিয় প্রকৃত বাস্তবতা দেখাতে পারে না। আমরা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝি না, বুঝার জন্য আমাদের চিন্তা করতে হয়। বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগে যে ছবি তৈরি হয় তাতে আমাদের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হয়, তাই ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের শুধু এ ছবিগুলো দেখাতে পারে কিন্তু কণার প্রকৃত স্বরুপ বলতে পারে না। আমরা শুধু তাদের সংখ্যাগত সংযোগ, বিয়োজন বা পরিবর্তনের ছবি ধরতে পারি। চিন্তার মাধ্যমে যেহেতু আমাদের বোধ তৈরি হয়, তাই সত্যকে জানতে চিন্তার আধিপত্য বেশি।
সত্যের সন্ধানে ডেমোক্রিটাস তিন স্তরের অনুসন্ধানের প্রস্তাব করেনঃ অদৃশ্য বিষয়কে জানতে দৃশ্যজগতের সাহায্য নিতে হবে, চিন্তা হল এ অনুসন্ধানের পদ্ধতি, কোন বিষয় নিয়ে জানতে হবে আর কোনটা বাদ দিতে হবে সেজন্য আবেগের সাহায্য নিতে হবে।
“Miserable mind, you get your evidence from us, and do you try to overthrow us? The overthrow will be your downfall.”
আমাদের বোধশক্তির দুটি সীমাবদ্ধতা আছে, প্রথমত, আমরা বাস্তবতার কিছুই জানি না; সত্য গভীরে লুক্কায়িত,“We know nothing in reality; for truth lies in depth”। দ্বিতীয়ত, বাস্তবতা সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান কখনোই প্রতারণা থেকে নিরাপদ নয় বরং আমাদের শারীরিক গঠন এবং পারিপার্শ্বিকতার কারণে পরিবর্তনশীল।
“Our knowledge of actuality is never safe from deception but changeable according to the constitution of our bodies and of those things that flow toward and impinge upon it.”
Democritus meditating on the seat of the soul by Léon-Alexandre Delhomme (1868)
ঈশ্বরের ধারণাঃ
ডেমোক্রিটাস ঈশ্বরকে অস্বীকার করেননি। ঈশ্বর (daimon) হল ছবির মত, এবং তারা বস্তুজগত থেকে পৃথক, নির্দিষ্ট প্রকৃতির কণার সমষ্টি। আমাদের জাগ্রত এবং স্বপ্নাবস্থায় তারা আমাদের আত্মায় প্রবেশ করে।
মানুষ তার নিজের প্রকৃতির কারণে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। যদি ঈশ্বরকে সন্দেহ করা হয়, এবং যদি মানুষের চিন্তা এবং অনুসন্ধানের প্রকৃতিকে সন্দেহ করা হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে ঈশ্বরে বিশ্বাস শুরু হল কোথা থেকে। তাই এমনকী ঈশ্বর না থাকলেও ঈশ্বর বিশ্বাস মানুষের জন্য একটা বাস্তবতা।
নীতিঃ
মানুষ নিজে একটা ক্ষুদ্র মহাবিশ্ব, মাইক্র কসম। তার মুক্তির জন্য বাইরের কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল হবার কোন প্রয়োজন নেই। মানুষ কী করবে, কী হবে সেটা সম্পূর্ণ তার নিজের চয়েস।
মানুষের অন্তিম লক্ষ্য হল একটা ভাল ডাইমনকে পথ প্রদর্শক হিসেবে নিয়ে জীবনে পূর্ণতা লাভ করা। “The soul is the dwelling place of daimon।”
নৈতিক জীবনের লক্ষ্য আত্মার প্রশান্তি লাভ (euthymia), সুন্দর বিষয় নিয়ে বিশুদ্ধ চিন্তা থেকে সুখ আহরণ করা, স্বাধীন জীবন যাপন করা।
তাই দেখা যাচ্ছে ডেমোক্রিটাসের কণাবাদ নাস্তিক্যবাদী নয়, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। গোল বাঁধে যখন কেউ এটমকে ঈশ্বরের জায়গায় প্রতিস্থাপিত করে। ডেমোক্রিটাসের দর্শনের অসঙ্গতি বিবেচনা করে কণাবাদকে বিজ্ঞান মনে করলে কোন সমস্যা থাকে না।
চিন্তার জগতে ডেমোক্রিটাসের কণাবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের পারমাণবিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি অনু-পরমাণুর ধারণা থেকেই শুরু হয়। এছাড়া উনিশ শতকে ডাল্টনের কণাবাদ বস্তুর আনুপাতিক সংমিশ্রণের পরিমাপ পদ্ধতি, যার মাধ্যমে গ্যাসের সূত্র এবং বহুবিদ অনুপাতের সূত্র (law of multiple proportion) প্রণয়ন করা সম্ভব হয়।
বৈশেষিক দর্শনের প্রবক্তা মহর্ষি কণাদ।
বৈশেষিক দর্শনঃ ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম বৈশেষিক দর্শনের প্রবক্তা কণাদ তাঁর দর্শনে ছয়টি পদার্থের উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে পঞ্চম হল: ‘বিশেষ’ (particular)। এই বিশেষ পদার্থটি অপর কোনও দর্শনে স্বীকৃত হয়নি। সুতরাং বিশেষ পদার্থ স্বীকার করার জন্যই দর্শনটির নাম বৈশেষিক। বৈশেষিক সূত্র বইতে কণাদ বিশ্বের যাবতীয় পদার্থকে দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় এবং অভাব এই ৭টি category তে বিভক্ত করেছেন। পদার্থকে ৭টি বর্গে বিভক্ত করা ছাড়াও কণাদ নয়টি পরম পদার্থের কথা উল্লেখ করেছেন। পঞ্চভুত এবং দিক, কাল, আত্মা এবং মন এ নয়টি পদার্থ নিত্য। পরমাণু সৎ-স্বরুপ নিত্য পদার্থ; তার কারণ নেই। দৃশ্যমান যাবতীয় পদার্থ পরমাণুর দ্বারা সৃষ্টি। বিশেষ নামক পদার্থের কারণে পরমাণুতে ভিন্নতা দেখা দেয়।
নয়টি পদার্থের মধ্যে পাঁচটি হল ভৌত এবং চারটি অ-ভৌত। পাঁচটি ভৌত পদার্থ হল: ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরূৎ এবং ব্যোম। এবং চারটি অ-ভৌত পদার্থ হল: স্থান, কাল (সময়), আত্মা ও মন। এদের মধ্যে পৃথিবী পানি আগুন ও বাতাস হল আণবিক। কিন্তু আকাশ হল অ-আণবিক এবং শাশ্বত। এছাড়া স্থান ও কালও শাশ্বত এবং অনন্ত। আত্মার বৈশিষ্ট্য অনেকটা সত্তার মতোই। কণাদ মনে করতেন চৈতন্য হল দৈব । যখন আত্মা শরীরে সংলগ্ন হয় তখনই শরীর চৈতন্য লাভ করে। “Thus, consciousness is not considered an essential quality of the soul”। মন হল আণবিক কিন্তু অবিভাজ্য এবং শ্বাশ্বত পদার্থ। জগতে যে সব বস্তু রয়েছে মন তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করে। কণাদ বেদকে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে মানতেন এবং তার বৈশেষিক দর্শন আস্তিক্য ধারার ন্যায় দর্শনের অনুসারী।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন