প্রায় আড়ইশ বছর আগে থেকে শিক্ষিত, ধনী পুরুষদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য তখনও বাবু শব্দের ব্যবহার মোটামুটি ধনী, শিক্ষিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
‘বাবু’ পদ পূর্বে নিজে থেকে কারো ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। এটা ছিল নবাব প্রদত্ত উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ভিন্ন নবাবেরা অন্য কাউকে এই উপাধি দিতেন না।
বঙ্গদেশে ইংরেজ শাসন চালু হবার পর ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামে এক নতুন শ্রেণীর উদ্ভব হয়। ইংরেজ আমলে সকলেই যত্রতত্র ‘বাবু’ বনে গেলেন। পুরনো ধনী সম্প্রদায় বিদায় নিলেন। আবির্ভাব হলো এক নব্য ধনী সম্প্রদায়ের। এরাই তখন ‘বাবু’।
সাদাসিধা জীবনযাত্রায় অভ্যেস্ত মানুষ ‘বাবু’ হতে পারে না। বাবু হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করা, চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান করতে যাওয়া, দু-একটি রাঁড় রাখা, রক্ষিতাদের দালানকোঠা করে দেওয়া, পায়রা ওড়ানো, বিদ্যাসুন্দরের আসর বসানো, শনিবারের রাতে বাঈ বেশ্যা নিয়ে আসর বসানো ইত্যাদি করতে হয়। বহু বাবু পাল্লা দিয়ে লোক দেখানো এসব করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। মোট কথা বাবু শুধু ভোগ করতে চান না, খ্যাতি চান। সকলের সঙ্গে টাকা ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করে সবার উপরে থাকতে চান।
‘বাবুআনি’ যার অর্থ হল সৌখিনতা। যার বিত্ত আছে অথচ সৌখিনতা নেই, তিনি আর যাই হোননা কেন অন্ততঃ বাবু নন।
সেকালে ছিল বাঈজিগানের ঘর। বাবুরা জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে, কবজিতে বেলফুলের মালা জড়িয়ে, গায়ে আতর মেখে, গিলে-করা পাঞ্জাবি আর চুনট-করা ধুতি পরে নামতেন বাঈজিগানের ঘরে। দেদার উড়ত টাকা। থাকত বিস্তর মদ-মাংস। রাত গভীর হলে বাবুদের নেশা চড়লে বাবুরা আপনাপন মাথায় আপনাপন গেলাস চাপিয়ে আপনাপন কিংবা বাঈজির কটি দুলিয়ে নৃত্য করতেন।
সেকালের ‘বাবু’রা মদন-দহণে কেমন দগ্ধ হতেন তার নমুনা স্বরূপ একটি গান বাবুকাহিনীতে যুক্ত হয়ে আছে, তারই কয়েকটি পঙতি,
মদন-আগুণ জ্বলছে দ্বিগুণ, কি গুণ কল্ল ঐ বিদেশী,
ইচ্ছা করে উহার করে প্রাণ সঁপে সই হইগো দাসী।
দারুণ কটাক্ষ-বানে, অস্থির করেছে প্রাণে,
মনে না ধৈরজ মানে, মন হয়েছে তাই উদাসী ৷৷
শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় ‘বাবু’দের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখেছেন,
”বাবু মহাশয়েরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার, এস্রাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, ফুল আখড়াই, হাফ আখড়াই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রিকালে বারাঙ্গণাদিগের গৃহে গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদ-প্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গণাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইতেন।”
হঠাৎ কোন বাঈজী বা গণিকার নাম ছড়িয়ে পড়লে তাকে বাঁধা মেয়েমানুষ হিসেবে রাখবার জন্য বাবুদের মধ্য শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতা। এই গণিকা চর্চাতো বাবু কালচারেরই অঙ্গ।
ঘোড়ায় টানা গাড়িতেই তখন বাবুদের বাবুআনির মেজাজ বহাল থাকতো। আর সে কত্ত রকমের ভ্যারাইটি… ব্রিৎস্-কাস, বারুচ্চ-ল্যাণ্ডোলেট, চ্যারিয়ট, ফীটন্, বগী, প্যালানকুইন, পালকী ঘেরী, ব্রাউন বেরী, ক্রহানচি বা কেরাঞ্চি, এ সবই ঘোড়ায়টানা গাড়ির রকমফের! সৌখিন বাবুরা আবার নামি-দামি সুগন্ধি-সাবান ইত্যাদি যেমন, ‘ল্রাভেন্ডার’, ‘গসনেলের সাবান’ ইত্যাদি ব্যবহার করতেন।
কাস্মীরী গালিচার থেকেও এঁদের বেশী পছন্দ ছিল, ফরাসী গালিচা। ‘অসলার’ এর ঝাড়বাতি, ম্যাকেবের খুখু ঘড়ি।
কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা থেকে জানা যায়, রাজারাজড়ারা রাত্রে নিজ বিবাহিত স্ত্রীর মুখ দেখতেন না। বাড়ির প্রধান আমলা, দারওয়ান, মুৎসুদ্দিরা যেমন হুজুরের বিষয়কর্ম দেখেন স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তাঁদের উপর বর্তায়। সুতরাং তাঁরা ছাড়বেন কেন? এই ভয়ে কোনো কোনো বুদ্ধিমান স্ত্রীকে বাড়ির ভিতর ঘরে পুরে চাবি বন্ধ করে সারারাত রাঁড় নিয়ে বা বাঈদের নিয়ে ফুর্তি করে সকালে বাড়ি ফেরেন।
কলকাতার বিখ্যাত আট বাবু ছিলেন এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কলকাতার আট বাবুর মধ্যে ছিলেন নীলমনি হালদার, রামতনু দত্ত, গোকুল চন্দ্র মিত্র, রাজা রাজকৃষ্ণ, কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখময় রায় এবং চোরাবাগান মিত্র বংশের এক বাবু, এঁরাই ছিলেন আট বাবু। পরবর্তীকালে নামডাক সম্পন্ন আরও বাবু এসেছিলেন কিন্তু উপরেউল্লিখিত আটবাবুই হলেন ‘কলিকাতার প্রথম বাবু’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে এর অন্যথা হয়নি। তিনি গোমাংস খেতেন, ইংরেজদের সঙ্গে একত্রে বসে মদ আর নারী নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতেন তাঁর বাগানবাড়িতে বাঈজিদের নাচ-গানের আসর বসত প্রায় রাতেই। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ঘরে বা অন্দরমহলে বসে ধর্মকর্ম পালন করতেন। হিন্দুধর্মের সকল আচার-অনুষ্ঠান দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাড়িতে নিয়ম মেনে পালিত হতো। তাঁর ধর্মপ্রাণ স্ত্রীর নির্দেশেই অন্দরমহলে পুরোহিত রেখে সকল পূজা-অর্চনা চলত আর অন্দরমহলের বাইরে হিন্দুধর্মের সকল শাস্ত্রকে উপেক্ষা করতেন দ্বারকানাথ। প্রথম জীবনে ব্রিটিশের চাকরি করলেও পরের দিকে দ্বারকানাথ ছিলেন একজন জমিদার, খনি ও জাহাজ ব্যবসায়ী এবং ব্যাঙ্কার। কলকাতা শহরের এই যে রঙ্গ ঘরে এক বাইরে আর এক এটা আঠারো-উনিশ শতকের একটা সাধারণ ঘটনা উচ্চবিত্ত ভদ্রপরিবারে। সাধারণ মানুষ ধর্ম নিয়ে যত বাড়াবাড়ি করছিল বাবুরা ততধিক ধর্মবিচ্যুত হচ্ছিল। বঙ্গদেশের কলকাতা শহরে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এইরকম নানা বৈপরীত্যে কলকাতা শহর তখন উচ্চকিত।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘বাবু’ নামের রম্যরচনায় লিখেছেলেন, ‘যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।’
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সমসাময়িক কালের বর্ধিঞ্চু ধনিক শ্রেণী ও সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে লিখেছেন,
“স্ত্রীলোকদিগের উপর যে রূপ কঠিন শাসন, পুরুষদিগের উপর সেরূপ কিছুই নাই। ভ্রষ্ট পুরুষের কোন সামাজিক দণ্ড নাই। একজন স্ত্রী সতীত্ব সম্বন্ধে কোন দোষ করিলে তিনি মুখ দেখাইবার অযোগ্য হইয়া পড়েন। আর একজন পুরুষ প্রকাশ্যে সেইরূপ কার্য্য করিয়া, রোশনাই করিয়া, জুড়ি হাকাইয়া রাত্রিশেষে পত্নীকে চরণরেণু স্পর্শ করাইয়া আসেন, পত্নী পুলকিত হয়েন। সেই পুরুষ লোকসমাজে যেমন প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, সেইরূপ প্রতিষ্ঠিত থাকেন।”
বঙ্কিমচন্দ্রের সময়ে এবং তৎপরবর্তীকালে কোলকাতার বাবু সমাজের বিত্তবান পুরুষেরা রক্ষিতা অধবা বাঈজী বাড়িতেই নিশিযাপন করতেন। তাঁদের এই মাধুকরী প্রবৃত্তিকে কখনই নিন্দিত হতে দেখা যায়নি। বরং এটাই ছিল তৎকালীন সমাজে বিত্তবান শ্রেণীর মর্যাদা এবং অহং প্রকাশক …। আর এই বিত্তবান বাবুমশাইরা চাটুকার পরিবেষ্টিত হয় নিজেরা বড়ই আহ্লাদিত বোধ করতেন।
ধারণা করি, কলকাতার বাবুদের এই স্বভাবের কারণে তাঁদের স্ত্রীগণ প্রায়শই স্বামীসঙ্গ থেকে ছিলেন বঞ্চিতা। তাই সম্ভবত ‘সম্মাদ সুধাকর’ পত্রিকায় নিচের এই সম্পাদকীয়টি লেখা হয়েছিল:
“কস্যচিৎ ‘চেতো পরগণা নিবাসিনঃ বিপ্রসন্তানস্য’ ইতি সাক্ষরিত এক পত্র আমরা গত সপ্তাহে প্রকাশিত করিয়াছি।”
“চেতো পরগণা নিবাসী বিপ্রসন্তান লিখিয়াছেন যে, ইঙ্গরেজী বিদ্যা শিক্ষাকরণাশয়ে তিনি স্বদেশ পরিত্যাগপূর্ব্বক কলিকাতায় উপনীত হইয়া সুযোগক্রমে এতন্নগরস্থ কোন প্রধান ব্যক্তির ভবনে বাসা করিলেন। দিবা অবসানে যখন ঐ বিপ্রসন্তান সায়ংসন্ধ্যা করিয়া বসিয়াছিলেন তখন প্রথমতঃ বাটির বৃদ্ধ কর্তা, তৎপরে তাঁহার জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম পুত্র ও পরে তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্রও, ইহারা একে একে তাবতেই বাটী হইতে বহির্গমণ করিলেন, তৎপরে দুইজন দৈবারিক ও অন্য কোন কোন চাকর অন্দর মহলে প্রবেশ করিয়া নিশাবসান করিল, যাবৎ কর্ত্তা ও তাঁহার পুত্রেরা বাহিরে যামিনী যাপন করিয়া প্রাতঃকালে গৃহে প্রত্যাগমণ করিলেন।”
নারী জাতির মদন পুরুষাপেক্ষা অষ্টগুণ প্রবল (এইরূপ অনেকে কহিয়া থাকেন), তাহাতে অস্মদ্দেশের কঠিন রিত্যানুসারে বিদ্যারূপ যে জ্ঞান তাহা তাহাদিগকে বঞ্চিত করাতে ঐ দুর্ব্বার মদন অজ্ঞান অবলাদিগের উপর পূর্ণতা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইয়া তাহাদিগের কামানল উজ্জ্বল করিয়া যে তাহারদিগকে অতি ঘোরতর দুষ্কর্ম্মে প্রবৃত্ত করাইবেক ইহার বাধা কি? আর ইহাতে যে তাহাদিগের সতীত্বও বিনাশ হইবেক ইহারইবা অসম্ভাবনা কি আছে? কিন্তু ইহা জানিয়াও যদি পুরুষেরা স্বপত্নীদিগকে অবহেলা করিয়া উপপত্নীদিগের বশীভুত হইয়া কেবল তাহারদিগের সহিত আলাপে/বিলাপে রত হন তবে সব স্বপত্নীদিগের সতীত্বধর্ম বিনাশ জন্য যে অনুযোগ তাহা ঐ অবোধ পুরুষদিগকে বই আর কাহাকে অর্শিতে পারে? বাস্তবিক যে তাহারাই কুরীতির মূলাধার, অতএব ইহাদিগকেই আমরা অনুযোগ করিতে পারি।”
(১৮৩১ সনের ৫ নভেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সম্মাদ সুধাকর’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে লিখিত)
নতুন জমিদারদের সম্পর্কে হুতোম প্যাঁচার নক্সায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন,
‘ক্ষুদ্র নবাব,ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে দুধে আলতার মতো রং,আলবার্ট ফ্যাশানে চুল ফেরানো, চীনের শূয়রের মতো শরীরটি ঘাড়ে-গদ্দানে, হাতে লাল রুমাল ও পিচের ইস্টিক, সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা,হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজারাজড়ার পৌত্তর; কিন্তু পরিচয়ে বেরোবে ‘হৃদে জোলার নাতি!’
ঐ সময়ে প্রচলিত দু-একটি বচন থেকে উঠতি বাবুসমাজের স্খলনের চিত্রটি ভাল ভাবেই ফুটে উঠেছে।
“আজব শহর কলকেতা, রাঢ়ি-বাড়ি-জুড়িগাড়ি মিছে কথার কী কেতা!
এটা ক্ষ্যামা খানকির কোঠাবাড়ি আর ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা।৷” (হুতোম)
“জাল জুয়াচুরি মিথ্যা কথা
এই তিন নিয়ে কলকাতা।”
সহায়ক গ্রন্থসমূহ:
(১) ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’- বিনয় ঘোষ।
(২) ‘পুরনো কলকাতার অন্য সংস্কৃতি’- বিশ্বনাথ জোয়ার্দার।
(৩) ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’- কালীপ্রসন্ন সিংহ।
(৪) ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী’- সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত।
(৫) ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান- সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
(৬) ‘বাবু গৌরবের কলকাতা’- বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়।