পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীর অধ্যাপক ওয়ারেছ মীরের ছেলে। অধ্যাপক মীর সেই একাত্তর সালে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাকে পাকিস্তানী খুনে সেনারা সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে, অধ্যাপক ওয়ারেছ মীর ‘গাদ্দার’ হিসেবে উপহাসিত হয়ে মানসিক নির্যাতনের পীড়নে অসুস্থ হয়ে মারা যান। গাদ্দারের ছেলে হিসেবে বেড়ে ওঠেন হামিদ মীর। কিন্তু যোগ্যতার কারণে পাকিস্তানের সেরা সাংবাদিক হয়ে ওঠেন। প্রতিভাবান মানুষকে রুখবে এমন সাধ্য কার আছে। সংবাদপত্র ও টিভিতে উর্দু – ইংরেজি দুটি ভাষায় দুঃসাহসী রিপোর্ট করে নায়ক হয়ে ওঠেন তিনি। এবং বাবা ওয়ারেছ মীরের পদাংক অনুসরণ করে ইসলামাবাদ প্রেসক্লাবের সামনে; একাত্তরে বাংলাদেশের মানবতার পক্ষে সক্রিয় পরিবারের সদস্য আসমা জাহাঙ্গীর, তাহেরা আবদুল্লাহ, কবি সেলিম প্রমুখকে নিয়ে ‘৭১-এর বাংলাদেশ গণহত্যা’-র প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে; এই মানববন্ধনে বাংলাদেশের শোকাহত জনতার কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়।
এরমাঝে ডন পত্রিকা; একাত্তরের ট্র্যাজেডি নিয়ে ‘হামদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট ছেপে ফেলেছে। সেনাবাহিনীর ঝোলা থেকে অপরাধের কালো বেড়ালটি বের হয়ে এসেছে।
এ সময় হামিদ মীর আল-কায়েদার সন্ত্রাসী নেতাসহ তোরাবোরায় লুকিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ইন্টারভিউ করে বিশ্বমিডিয়ায় আলোচিত হন।
জেনারেল পারভেজ মুশাররফ পতনে হামিদ মীরের লাইভ শো বড় ভূমিকা রাখে। ফলে অধ্যাপক ওয়ারেছ মীরের অপমানের প্রতিশোধগাথা হয়ে ওঠে সাংবাদিক হামিদ মীরের এই লাইভ শো।
অন্যদেশের সেনাবাহিনী থাকে; আর সেনাবাহিনীর একটি দেশ আছে; সেইখানে হামিদ মীরের জীবনের প্রতিটি দিনই মাইনপাতা জলপাই বনে হেঁটে বেড়ানো যেন।
হামিদ মীর যাপিত জীবনে উদারপন্থী; বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বৈরথে মাঝে মাঝে মোল্লাদের সঙ্গে ভারসাম্যের খেলা তাকে খেলতে হয়েছে। বাংলাদেশে একাত্তরের মাস্টারমাইন্ড গোলাম আজমের বিচারের সময় জামায়াতের লোকেদের অনুরোধে মীর লেখেন, বুড়াটাকে মাফ করে দিলে কেমন হয়।
অমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির তরুণ তাকে ‘রাজাকার পাকি’ বলে গালাগাল শুরু করে।
ই-বাংলাদেশ ওয়েব পোর্টালের সম্পাদক হিসেবে, আমি একটি আর্টকেল লিখি প্রশ্ন রেখে, মীর কী ইংরেজিতে বাংলাদেশের পক্ষে আর উর্দুতে গোলাম আজমের পক্ষে লিখে আমাদের বোকা বানাচ্ছেন!
লেখাটি লুফে নেয় পাকিস্তানে মীরের শত্রুরা; আমার স্ত্রী মীরের স্নেহভাজন সাংবাদিক। মীর শুধু হেসে বলেন, কী করে টিকে আছি এইদেশে তা তো লেখক জানে না। তাই অমন লিখেছে। লেখার স্পিরিটের সঙ্গে উনি সহমত পোষণ করেন। আর কখনো জামায়াতের অনুরোধে সাড়া দেননি তিনি।
বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির পাকিস্তান সফর করেন একাত্তরে পাকিস্তানে বসে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানানো পরিবারগুলোকে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার সহমর্মিতা পৌঁছে দিতে। বাংলাদেশ সরকার ৩০ টি পরিবারকে ‘মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুর সম্মাননা’ দেয়। শাহরিয়ার কবির ‘একাত্তরের ইতিহাসকে পাকিস্তান তারুণ্য কতটুকু জানে; তা যাচাই করতে প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেন। হামিদ মীর আন্তরিক সহযোগিতা করেন এই গবেষণামূলক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে।
একাত্তর ইস্যুতে হামিদ মীরের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে মীরের লড়াইয়ের তো কোন অন্ত নেই। তিনি করাচিতে গুলিবিদ্ধ হন। যে জিও টিভিতে তিনি কাজ করেন; সেই টিভি ফুঁসে ওঠে ক্রোধে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা কেবল টিভি অপারেটরদের বলে, জিও টিভিকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শুধু অনলাইনে ওয়েব টিভি হিসেবে চলতে থাকে এর প্রচার।
এরপর সেনাবাহিনী শান্ত হলে; ইমরান খান ক্ষমতায় এলে হামিদ মীর কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। মোটামুটি ভালোই কাটছিলো তার। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দুইদেশের নাগরিক সমাজকে নিয়ে ‘শান্তির জন্য সংলাপ’ করতে থাকেন তার ক্যাপিটাল টক অনুষ্ঠানে।
বয়স ৫০ পেরোলে সাংবাদিকেরা আমলাদের মতো ডেস্কে বসে যান। কিন্তু হামিদ মীর সক্রিয় থাকেন স্পেশাল রিপোর্টিং-এ, একটিভিজমে। ফায়েজাবাদে মোল্লাদের ধর্ণায় সেনাবাহিনীর লোক টাকা বিতরণ করছে এই ভিডিও ভাইরাল হলে; হামিদ মীর আবার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে দ্বৈরথে যান। আদালত গোয়েন্দা সংস্থার লোকেদের বিচার শুরু করে।
সাংবাদিকদের তুলে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখানোর কাজটা ছোট চুল-সুঠাম দেহীরা করতে থাকে। এই ধারাবাহিক গুম ও চুপ করিয়ে দেয়া কাণ্ডের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ইসলামাবাদে আসাদ তুর নামের এক তরুণ সাংবাদিকের বাসায় সাদা পোশাকের লোকেরা ঢুকে তাকে মারধোর করে। হামিদ মীর আবার পথে নামেন, মানববন্ধনে বলেন, আমাদের ভয়-ভীতি দেখানো হলেও আমরা দেশেই থাকি। অথচ পারভেজ মুশাররাফের মতো জেনারেলরা দেশ থেকে পালিয়ে যান। আপনাদের কাছে অস্ত্র আছে; আপনারা আমাদের বাসায় ঢুকে মারতে পারেন; আমাদের হাতে কলম আছে; আমরা আপনাদের নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখতে থাকবো।
আবার সেনাবাহিনী ও তাদের ‘সহমত ভাই’দের তোপের মুখে পড়ে যান হামিদ মীর। সহমত ভাইয়েরা বলে, “হামিদ মীর দেশের শত্রু; তারে পাকিস্তান থিকা বাইর কইরা দেওয়া হোক।”
আমি এসব সহমত ভাইকে পরামর্শ দিয়েছি, তারা যেন বলে, ‘মীরের ল্যাঞ্জা ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু হাইড। পাকিস্তান পছন্দ না হইলে হামিদ মীর তার বাপের দেশ বাংলাদেশে চইলা যাউক।’ আফটার অল; উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘৃণার ফ্যাক্টরির শ্রমিক সহমত ভাইদের ডায়ালগগুলি জমজ ভাইয়ের মতো হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের শাসক-শোষক-পরিতোষক-স্থূল সৌন্দর্য্য ধারক সহমত রাজভোদড়গুলো তেলের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পে দেশের পোকিত মালিক হয়ে; এরে-ওরে অর্ডার দেয়; অই তুই দেশের শত্রু; দেশ থিকা বাইরাই যা; সুতরাং সেই অশ্লীল কলতলা কলিং-গুলো এদের জীনগত দালালির খিস্তিগাথা হয়ে বিরাজ করে অন্ধকার এই উপমহাদেশে।