০
১৬৩৯ বার পঠিত
‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’, সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের সেই সাহসী লেখক আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত পাকটিকা প্রদেশে নিজ শ্বশুরবাড়িতে তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছিলেন ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩।
মনে পড়ে, ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ‘ বইটি পড়ি টরন্টোতে এসে। ২০০১-এ টরন্টোতে প্রথম অভিবাসী হয়ে একাকীত্বের সাথে চরম শীত আর শ্বেতশুভ্র তুষারপাতে একেবারে বিধ্বস্ত-বিষন্ন আমি। হেঁটে হেঁটে প্রায় দিনই চলে যাই ডয়েজ রোডস্থ টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরির শাখায়। কয়েকঘণ্টা বই-পত্রিকা নাড়াচাড়া করি। ভাল লাগলে মুখ গুজে পড়ি। কম্পিউটারে এটা ওটা সার্চ করি। কখনো হিন্দি ছবির ক্যাসেট নিয়ে আসি বাসায়। কারণ, তখন পুরান হিন্দি ছবিগুলোর ভালই কালেকশন ছিল টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে। এখন নাকী আনকোরা নতুন না হলেও দুএক বছরের পুরানো হিন্দি সিনেমার সিডিও মেলে টরন্টো ও তার আশপাশের শহরগুলোর পাবলিক লাইব্রেরিতে!
একদিন তেমনি এক অতৃপ্ত খোঁজাখুজির প্রহরে হঠাৎ করে একটি বাংলা বই হাতের কাছে পেলাম। নাম, ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’; লেখক সুস্মিতা বন্দোপাধ্যায়। আগে লেখকের নাম না শুনলেও বইয়ের নামটিতে এক চমক আছে মনে করে বইটি তুলে নিয়ে এলাম বাসায়।
বাড়ি ফিরেই বইটি গোগ্রাসে গিলে ফেললাম মনে হলো। এক সাহসী বাঙালি মেয়ের কলকাতার বাইরে সুদূর আফগানিস্তানে এক প্রথাবিরোধী জীবনযাপন নিয়ে অপূর্ব লেখা পড়ে যে আমি কী রকম বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলাম, সে রেশ এখনো স্মৃতিতে আছে। পরবর্তীতে বইটি পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল এবং কয়েকবার বেস্টসেলারও হয়েছিল শুনেছি। তাঁর কাহিনী নিয়ে হিন্দি ছবি তৈরি হয়েছিল ‘এসকেপ ফ্রম তালিবান‘।
https://www.youtube.com/watch?v=XyJLkVA8FQQ
আরো জানার সুযোগ এলো সুস্মিতা বন্দোপাধ্যায়ের সম্পর্কে। গোড়া রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে কলকাতাতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা সুস্মিতার। ১৯৯৫ সালে পরিবারের অসম্মতিতে এক আফগান ব্যবসায়ী যুবক জানেবাজকে বিয়ে করে পালিয়ে আফগানিস্তানে চলে যান। ভারতের সিভিল অ্যাক্ট মতে ধর্মান্তরিত না হয়ে বিয়ে করা সুস্মিতার ওপর নেমে আসে তালেবানি অত্যাচার। আর সেসবের কাহিনী নিয়েই তাঁর বই ‘কাবুলীওয়ালার বাঙালি বউ’।
তাঁর স্বামী কোনরকমে পালিয়ে ভারতে চলে আসেন। কিন্তু সুস্মিতাকে আটকে দেয় তখনকার তালেবান মোল্লা ওমরের সরকার। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পালাবার উদ্যোগ নিলেও ধরা পড়ে যান সুস্মিতা তালেবান বাহিনীর হাতে। একবার পাকিস্তানে পালিয়ে এসে ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি সুস্মিতার। ভারতীয় দূতাবাস এক অজ্ঞাতকারণে তালেবানদের হাতে সুস্মিতাকে তুলে দেয় তখন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮ সালে সুস্মিতা ভারতে ফিরে আসতে পারেন নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে।
তালেবান সরকার ও তালেবান শাসিত সমাজের বর্বরতার ভয়াবহ চিত্র বিধৃত আছে সুস্মিতার সবগুলো বইয়ে। একে একে সুস্মিতা অনেকগুলো বই লেখেন নিজের অভিজ্ঞতায়; ‘কাবুলীওয়ালার বাঙালি বউ’, ‘তালেবান আফগান বর’, ‘মোল্লা ওমর তালেবান ও আমি’ তাঁর উল্লেখযোগ্য বই।
আফগানিস্তান তালেবান শাসনে নারীরা কী নির্মমভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে তা সারা পৃথিবীতে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হোন সুস্মিতা। নিজেই পরিচালনা করেন এক হিন্দি সিনেমা ‘এসকেপ ফ্রম তালেবান‘। সুস্মিতার চরিত্রে অভিনয় করেন তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা মনীষা কৈরালা।
লেখার প্রতি অদম্য নেশা, সেইসাথে আফগানিস্তানের সাধারণ নারীদের প্রতি মমত্ববোধ সুস্মিতাকে আবার টেনে নিয়ে যায় চরম বিপদশংকুল আফগানিস্তানে। কলকাতার স্বজনদের বলে গিয়েছিলেন তিনি মাস ছয়েকের মধ্যেই ফিরে আসবেন। সেইসাথে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়ে গিয়েছিলেন মাতৃমংগল ও শিশু পরিচর্যার। আফগানিস্তানে গিয়েই তিনি নিজ শ্বশুরবাড়ির গ্রামে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা ও চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।
সুস্মিতা হয়তো ভেবেছিলেন, মোল্লা ওমরের তালেবান শাসন আর নেই। ফলে সভ্যতার একটু ছোঁয়া হয়তো পড়েছে আফগান সমাজে! কিন্তু সুস্মিতার ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। আফগানিস্তান সারা পৃথিবীর সাহায্য সহযোগিতা সত্বেও আজো সে তিমিরাচ্ছন্ন সমাজেই আছে সুস্মিতার মৃত্যু সেটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার শোক-বিবৃতিতে বলেছেন, সুস্মিতার আফগানিস্তানে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত ছিল আত্মঘাতি।
ধর্মান্ধ তালেবান ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে নারীকে আটকে রাখতে চায়। তাই মানবতার শত্রু তালেবান সুস্মিতার মতো নারীদের সহ্য করবে কেন? তাই রাতের অন্ধকারে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে বেঁধে রেখে সুস্মিতাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেছে গ্রামের মাদ্রাসায়। সেখানে বিশটি বুলেটে সুস্মিতাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েও খুশী হয়নি; চুল কেটে মুখমণ্ডল বিকৃত করে এক পৈশাচিক নারকীয়তায় গ্রামের নারীদের আপনজন ‘সাহেবকামাল’কে হত্যা করেছে তালেবান বাহিনী। সুস্মিতাকে শ্বশুরবাড়ির সবাই এবং গ্রামের লোকজন ভালবেসে ‘সাহেবকামাল’ বলে ডাকতো।
পাকিস্তানের সেই ইস্কুল ছাত্রী, নাম মালালা ইউসুফ। মেয়েদের ইস্কুলে যেতে উৎসাহিত করতো ব’লে তালেবানরা গুলি করেছিল মালেলা ইউসুফকে। পশ্চিমাদেশে উন্নত চিকিৎসার পর মালেলা ইউসুফ বেঁচে গেছে। কিন্তু সুস্মিতা বাঁচতে পারেননি তালেবানদের বর্বরতার হাত থেকে। সুস্মিতার নিহত হ’বার পর আরও ৪ বছর চলে গেছে কিন্তু আফগানিস্তান-পাকিস্তানসহ কোথাও পরিস্থিতির এতোটুকু পরিবর্তন হয়েছে কী?
সুস্মিতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন