৮৬০ বার পঠিত
পৃথিবীতে দু’রকম মানুষ আছে। একদল অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে; আরেকদল কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। যারা কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না; তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই ইতিবাচক মানুষ। ইতিবাচকতা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে ইতিবাচক করে তোলে। আর যারা বিদ্বেষ পোষণ করে; তারা নেতিবাচক মানুষ। এই নেতিবাচকতা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে নেতিবাচক করে তোলে।
আজকাল পপুলিজম বা জনমনোরঞ্জনবাদ নামে যে নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি হয়েছে; তা আসলে বিদ্বেষরঞ্জনবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে এই বিদ্বেষরঞ্জনবাদ। হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট বলে পরিচিত যারা ট্রাম্পের সমর্থক; তারা একদল নেতিবাচক মানুষ। ব্যক্তিগত নেতিবাচকতার কারণে জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলায়; ট্রাম্পের বিদ্বেষরঞ্জনবাদ এদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বিদ্বেষরঞ্জনবাদ দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান সামাজিক বৈশিষ্ট্য। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ সতত প্রতিবেশির প্রতি ঈর্ষা পোষণ করে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিদ্বেষরঞ্জনবাদের উর্বর ভূমিতে গত সাতটি দশকে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নেতিবাচকতার এই লীলাভূমিতে রাজনীতিক ও তাদের উগ্র সমর্থকরা নানা রকম আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের নামে বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক দল ফেঁদে বসেছে। কিছু নেতা ব্যতিক্রমি সৎ ও অহিংস হবার চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ নেতাই বিদ্বেষের কারবারি। রাজনীতি ও ক্ষমতা-কাঠামোর কারবারিরা ‘রাজনীতি-রাজনীতি’ খেলায় সাতটি দশকে জনমানুষকে বিন্দুমাত্র স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ দেয়নি। যারা নিজেরাই বিদ্বেষ আক্রান্ত তারা বিদ্বেষ ছাড়া আর কোন শিক্ষা জাতিকে দিতে পারে না।
এরফলে নানারকম রাজনৈতিক আদর্শ ব্যর্থ হয়ে সম্প্রতি বিদ্বেষরঞ্জনবাদই হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ক্ষমতায় যাবার ও টিকে থাকার একমাত্র মন্ত্র। বিদ্বেষের মুখমণ্ডলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ ইত্যাদি পরিচয় লেখা থাকলেও; এর শরীর জুড়ে রয়েছে ভাষা-সংস্কৃতি-আঞ্চলিকতা ইত্যাদি নানারকম পরিচয়। সবগুলো পরিচয়ই একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় সুব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মতো নেতৃত্ব প্রথম থেকেই অনুপস্থিত ছিলো। বৃটিশের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হবার লড়াইয়ে দক্ষিণ এশিয়ার নেতাদের মুক্তির আকাংক্ষা যতটা ছিলো; তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিলো ক্ষমতা-কাঠামো দখল করে বৃটিশ আদলের উপনিবেশ চালিয়ে যাওয়ায়। খুব অল্প সংখ্যক আন্তরিক নেতা ছিলেন; যারা নিঃসঙ্গ শেরপার মতো লড়ে জনগণকে মুক্তির স্বাদ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে সাত-দশকের ইতিহাস মানবতা বিরোধী অপরাধের ইতিহাস। পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মুক্ত হওয়া বাংলাদেশেও খুব অল্প সংখ্যক আন্তরিক নেতা নিঃসঙ্গ শেরপার মতো লড়ে জনগণকে মুক্তির স্বাদ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই ব্যর্থ তিনটি দেশেই রাষ্ট্রিক বিশৃংখলা ও নিষ্ঠুরতায় এতো মানবতা বিরোধী অপরাধ ঘটেছে যে; জনমানুষের জীবন নৈরাশ্য আর নেতিবাচকতায় বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ঠিক সেই বিদ্বেষ বিষাক্ত পটভূমিতে বর্তমানে রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কাল্পনিক উন্নয়নের গল্প-গুজব আর বিদ্বেষরঞ্জনবাদই রাজনীতির জ্বালানি।
ভারতের বিদ্বেষরঞ্জনবাদের প্রবাদপুরুষ নরেন্দ্র মোদি অনেক উন্নয়নের কাল্পনিক গল্প শুনিয়ে আর উগ্রহিন্দুত্ববাদ উস্কে দিয়ে ক্ষমতায় এসে; উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাস্তবিক কোন অর্জনে ব্যর্থ হলেও; উগ্রহিন্দুত্ববাদের ঘোড়ায় চড়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে এবার মুসলমান অধ্যুষিত ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির জবর দখল করলেন। এই বিদ্বেষমনোরঞ্জক সিদ্ধান্ত হিন্দুত্ববাদের পতাকা উড়িয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে গোটা ভারত।
পাকিস্তানে আগে থেকেই ইসলামি কট্টরপন্থার কারণে দেশটির অর্থনীতি মুখথুবড়ে পড়ায়; অনেক উন্নয়নের কাল্পনিক গল্প শুনিয়ে ইমরান খান যখন কূল-কিনারা পাচ্ছেন না; তখন মোদির ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির দখল ইমরান খানের জন্য তৈরি করেছে বিদ্বেষমনোরঞ্জনের বিরাট সুযোগ। ইসলামি কট্টরপন্থার ঘোড়ায় চড়ে বাস্তবিক ক্ষেত্রে কোন অর্জন ছাড়াই ইমরান খান টিকে থাকবেন ক্ষমতায়।
ভারতের হিন্দুত্ববাদি আর পাকিস্তানের ইসলামপন্থী দুটি বিদ্বেষপ্রিয় শিবির পেটে রুটি না পড়লেও বিদ্বেষের জ্বালানিতে চালিয়ে নেবে শরীর। গত সাতটি দশকে রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের নীতি-নির্ধারকরা বার বার খুঁজে ফিরেছে কাশ্মির অজুহাত। কাশ্মির হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্বেষরঞ্জনের রাজনীতির প্রধান জ্বালানি কেন্দ্র।
স্বাধীনতার সাত দশক পরেও পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষের বসবাস ভারত ও পাকিস্তানে। ঘৃণা-বিদ্বেষের মাদকাসক্তি দিয়ে মাতিয়ে রাখা হয় দুটি দেশের সাধারণ মানুষকে।
ফলে এখন যুদ্ধ-যুদ্ধ উত্তেজনার এই নরভোজিকালে উভয় দেশের হিন্দু ও মুসলমানরা কুঁচকুঁচ করে বিদ্বেষের গল্প করে কাটাবে। এদের প্রত্যেকের কুঁচকুঁচানি ন্যারেটিভ আছে। কিন্তু গত সাতটি দশকে এরা যে ক্যানিবাল হয়ে উঠেছে; সে ছবির দেখা মিলবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
যুদ্ধে যাবার সাহস এদের নেই। যে সামরিক ও পারমানবিক অস্ত্রের শক্তি আছে; তাতে দুটি দেশের যুদ্ধ হলে; উভয়েই হারবে; মানে দেশদুটি বিলুপ্ত হবে। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে তাই হিন্দুত্ববাদি ও ইসলামপন্থীদের যুদ্ধটি বাস্তবে সম্ভব হবে না। কিন্তু যা হয়; বিদ্বেষের ঘোড়ায় চড়ে প্রতারক দুটি গোষ্ঠী ঘৃণার সওদা করবে। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে যারা সম্পদ লুন্ঠন ও পাচার করেছে ও করছে; তারা বিদ্বেষমনোরঞ্জনের সওদাগর আর নরভোজি।
এ সময় দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকটি মানুষের সংযম ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষা চলবে। দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্বেষ নামের মাদকাসক্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখা; নরভোজের পাশবিক লোভটিকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। সাত দশক ধরে ঘৃণা-বিদ্বেষের কারবারে দ্রুত ধনী হওয়া অভিশপ্ত লোকগুলো; আর তাদের লাগিয়ে দেয়া দাঙ্গায় নিহত লাখ লাখ মানুষ হারানোর দৃষ্টান্তগুলো মাথায় রেখে পাড়ি দিতে হবে এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়। মানুষের শুভবোধই পারে এই উদগ্র বিদ্বেষ রাক্ষসদের পরাজিত করতে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন