০
১৪৪৫ বার পঠিত
কলকাতার একজনের লেখা পড়লাম। যিনি পশুপ্রেমি এবং প্রগতিশীলতার দাবিদার। তার লেখা পড়ে এটুকু অন্তত বুঝতে পারলাম তিনি সত্যিকার অর্থেই পশুপ্রেমি, মানুষপ্রেমি নন। কেরালার মৃত হাতি নিয়ে লিখতে গিয়ে তার সে পশুপ্রেমই প্রমানিত হয়েছে। তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন যে অঞ্চলে হাতিটি মারা হয়েছে, সেটা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। আর হিন্দুরা হাতি হত্যা করতে পারে না, তারা হাতিকে দেবতা জ্ঞান করে। তিনি বোধহয় এসময় ভারতে হাতির দাঁতের ব্যবসাদার কারা তা ভুলে গিয়েছিলেন। তার লেখা যেটা প্রমান করেছে তা হলো পশুপ্রেম ও প্রগতিশীলতার আড়ালে পরিষ্কার মানুষ তথা মুসলিম বিদ্বেষ এবং ধর্ম তথা গণেশ প্রীতি। তেনারা মূলত হেটার। ঘৃণা ছড়ানোই এদের কাজ। তারা নামে প্রগতিশীল হলেও মূলত ‘ছুপা রুস্তম’ মানে পরিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক। যার ফলে কোনো না কোনো ভাবে প্রগতিশীলতার চাদরের আড়ালে গেরুয়াটা বেড়িয়েই পড়ে। যেমন বেড়িয়ে পড়েছে হাতি প্রেমের আড়ালে। শুধু কলকাতা নয় আমাদের দেশেও এমন অনেক ছুপা রুস্তম রয়েছেন।
দুদিন আগে, গণমাধ্যমে দেখলাম বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কোন এক জায়গায় একটি মেছোবাঘকে হত্যা করা হয়েছে। সেই মৃত বাঘ কাঁধে চাপিয়ে বীরদর্পে সামাজিকমাধ্যমে ছবি দিয়েছে একদল উজবুক। আর সামাজিকমাধ্যমের পেছনে দৌড়ানো দেশের গণমাধ্যম সেই ছবি নিয়ে খবর করেছে। অথচ দেশে বিরল প্রায় এই মেছোবাঘের মৃত্যু নিয়ে কোথাও কোনো পশুপ্রেমির লেখা পেলাম না। গণমাধ্যমেতো নয়ই সামাজিকমাধ্যমেও এক লাইনের কোনো স্ট্যাটাস প্রসব করতে দেখিনি কাউকে। তবে কি পশুপ্রেম হাতির জন্যেই বরাদ্দ এবং সেটা ভারতীয় হাতি বলেই! ‘বীর বাহাদুরে’র ক্ষেত্রে যেমন দেখেছি। প্রাণির প্রতি নৃশংসতা নতুন কিছু নয়। এ বছরের শুরুতেই পাঁচ হাজার উট গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে অস্ট্রেলিয়াতে। কারণ উটের কারণে পানি ঘাটতি দেখা দিয়েছিলো। সব মিলিয়ে পনেরো হাজার উটকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে। আর তা মানুষকে বাঁচানোর জন্য।
এরকম উদাহরণ অনেক দেয়া যায়। এসব উদাহরণের চেয়ে যে কথা বড় হয়ে উঠেছে, মানুষের উপর অত্যাচারে এসব অনেক পশুপ্রেমির উচ্চকন্ঠ কিন্তু শোনা যায়নি। কাশ্মির থেকে দিল্লি, মুসলিমদের উপর ভারতে অত্যাচার কম হয়নি। অন্তঃসত্ত্বা নারী থেকে শিশু, বাদ যায়নি কেউ। তারপরও এদের অনেকের কন্ঠ ছিলো নিশ্চুপ। সেদিন এক ভারতীয় চিকিৎসক বললেন, করোনায় মুসলিমদের চিকিৎসা না দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতে। এর বিরুদ্ধাচরণ করেননি এসব প্রগতিশীল পশুপ্রেমিরা! এজন্যেই আমি এদের পাশবতাবাদী বলি, মানবতাবাদী নয়। এরা মানবতাকে ধারণ করেন মুখে, আর মনে ধারণ করেন পশুতা।
একজন মানুষের পরিচয় শুধু মানুষ, এটা তারা ভুলে যান। তারা মানুষকে নানা ভাবে বিভক্ত করেন। কখনো ধর্মের নামে, কখনো বর্ণ, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, রাজনীতি ইত্যাদি সবের নামে। এদের কাজ হলো বিভক্ত করা। দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মটা মানুষের আবেগকে বেশি টানে তাই তারা সব কিছুর বিভক্তিটা সেদিকেই টেনে নিয়ে যান। সেই দাবিদার প্রগতিশীল পশুবাদীও হাতির মৃত্যুকে হিন্দু মুসলমানের বিভেদের দিকে টেনে গিয়েছেন। উনি কেরালার সে অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত হিসাবে বলেছেন এবং সেখানে চার ভাগের তিনভাগ মানুষই মুসলিম তাও নিশ্চিত করেছেন। তারপর হাতিকে হিন্দুদের দেবতা গণেশের সাথে তুলনা করে প্রমান করার চেষ্টা করেছেন হিন্দুদের পক্ষে হাতি মারা সম্ভব নয়। অথচ এদের কে বোঝাবে গণেশকে বাঁচানোর জন্যই হাতির মাথাকে গণেশের কাটা মাথায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছিলো। হাতিকে বাঁচানোর জন্য গণেশের মাথা প্রতিস্থাপন করা হয়নি। এরা ধর্মটাকেও ঠিকমত বোঝে না।
গরুর ব্যাপারেও এনাদের একই মত। গরু হিন্দুদের দেবতা তারা গরু হত্যা করতে পারে না। অথচ ভারত গরুর গোশত রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম তিনটি দেশের একটি। আর সেই গরুর গোশতের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক হিন্দু ধর্মালম্বী সতীশ সভারওয়াল। যার তেলেঙ্গানাতে চার’শ একর জমির উপর রয়েছে কসাইখানা। ভারতের চোরা হাতি শিকারীরাও হিন্দু। ওনাদের কে বোঝাবে, অর্থ আর ক্ষমতার মোহ ধর্ম মানে না, মানে লোভের দেবতাকে। লোভের দেবতাকে মানাগণ হিন্দু কিংবা মুসলমান থাকে না, তাদের কাছে অর্থই হয়ে উঠে ধর্ম, ক্ষমতাই ঈশ্বর।
দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে প্রগতিশীলতা এক ধরণের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণও রয়েছে, প্রগতি কী তাকে না বুঝেই গতিশীল হতে শুরু করা একদল মানুষ জড়ো হয়েছেন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। আর তার পেছনের উদ্দেশ্যটা হলো ব্যক্তিগত প্রাপ্তি। প্রগতিশীলতা যে এক ধরণের প্যাশন, যে প্যাশন মানুষের মঙ্গলের লক্ষ্যে, এটা বোঝার মতন ইচ্ছা হয়তো তাদের নেই, কিংবা বোঝার বোধটাও নেই। থাকলেও তা বলি হয়েছে ব্যক্তিস্বার্থের কাছে। অথচ প্রগতিশীলতা এমন এক প্যাশন যেখানে ব্যক্তিকে গত করেই এগুতে হয়।
এদের কাজ হলো নানা ইস্যুতে ক্যাওজ সৃষ্টি করা। সেকুলারিজম, ফেমিনিজম ইত্যাদি নানা ইজমে’র নামে তারা অহেতুক ক্যাওজ সৃষ্টি করেন। আর সেই সৃষ্ট ক্যাওজে লাভবান হন তাদের পৃষ্ঠপোষকরা। অন্যার্থে নিয়োগকারীরা। ফেমিনিজম প্রসঙ্গে এদের কথা বলি। এই উপমহাদেশের নারী নিগৃহের কথা এরা বলেন নিয়ত। যেনো নারী নিগৃহই দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি। অথচ এই সংস্কৃতিতেই সন্তানরা সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে তাদের মা’কে। বাবার তুলনায় প্রায়োরিটিও পান সেই মা-ই। নারীর ক্ষমতায়নের রূপটাও এদের অগোচরে থেকে যায়। এরা ভুলে যান এই উপমহাদেশের অর্থনীতির পেছনে নারীশক্তির অবদানের কথা। বিস্মৃত হন পশ্চিমা নারীদের চেয়ে অনেক আগে পূবের নারীরা পুরুষের সাথে সমানতালে মাঠে কাজ করতে নেমেছে। এই উপমহাদেশে নারীরা যখন থেকে মাঠে-ঘাটে পুরুষের সাথে কাজে হাত লাগিয়েছে পশ্চিমের নারীরা তখন তা চিন্তাই করতে পারেনি। এদের দৃষ্টির আবদ্ধতা রয়েছে এমন আরো অনেকখানে। তবে মুশকিল হলো এদের সাথে আপনি তর্কে পারবেন না। হ্যাঁ, তর্কের কথাই বলছি, যুক্তিহীন তর্ক। হুমায়ূন আহমেদ যেমন বলেছিলেন, তর্ক করতে গেলে এরা তোমাকে তাদের পর্যায়ে নামিয়ে আনবে, তারপর হারিয়ে দেবে। তাদের শক্তিটাই এখানে, তর্কের। বলতে পারেন, কলতলার ঝগড়া। যে ঝগড়া বা তর্কের শক্তির উৎস মগজ নয় জিহ্বা। সাপের মতন, জিহ্বাই যার শক্তির আধার।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন