পূর্ব প্রকাশিতের পর
‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’ নিবন্ধটিতে ৪ টি অংশ রয়েছে। যথা-
১) সূচনা পর্ব: কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং কিছু প্রশ্ন
২) পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যা: সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের ভূমিকা
৩) পাশ্চাত্য পাণ্ডিত্যের মূর্খতা কিংবা বদমায়েশী এবং উপমহাদেশীয় পাণ্ডিত্যের দাসত্ব এবং
৪) সমাপ্তি পর্ব: বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক পর্যালোচনা।
পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যা: সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের ভূমিকা
আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব এবং বিস্তার মূলত পশ্চিম ইউরোপ তথা পাশ্চাত্য থেকে। মানব সভ্যতায় আধুনিক কালে যে বিপুল অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার জন্য সর্বাধিক কৃতিত্ব পশ্চিম ইউরোপকে দিতে হবে। শুধু যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের পিছনে পাশ্চাত্যের অসংখ্য জ্ঞান সাধকের নিরলস ভূমিকা রয়েছে তা-ই নয়, অধিকন্তু জনকল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের সাধনা পাশ্চাত্যের অসংখ্য সাধক এবং যোদ্ধার জীবন ব্যাপী প্রয়াস দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং রাষ্ট্র চিন্তার উদ্ভবও পাশ্চাত্য থেকে। মানুষের অধিকার এবং নারী-পুরুষের সমাধিকার সংক্রান্ত আধুনিক কালের ধারণাগুলির জন্মস্থানও মূলত পাশ্চাত্য। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাশ্চাত্যের অবদান অতুলনীয়। সুতরাং আজকের পৃথিবীর মানব জাতি তার সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য পাশ্চাত্যের নিকট ঋণী।
কিন্তু এই ঋণ স্বীকারের সময় প্রাচ্যবাসী হিসাবে আমরা যদি আমাদের মত পাশ্চাত্য বহির্ভূত সমাজগুলির প্রতি পাশ্চাত্যের নেতিবাচক ভূমিকাকে ভুলে যাই তাহলে মারাত্মক ভুল করব। রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্য দিয়ে অলোকবাদ এবং অন্ধত্বজীবী ধর্মের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে পশ্চিম ইউরোপ আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথে যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রাপথ তাকে বিশ্বজয়ের পথে নিল। এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখ্য ঘটনা হচ্ছে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে ক্রীস্টোফার কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার। কলম্বাস স্পেনের পক্ষ থেকে আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন। স্পেনের পথ ধরে পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি ইউরোপীয় রাষ্ট্র যার যার মত করে আমেরিকা মহাদেশ দুইটির উপর দখল নিল এবং সেখানে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করল। পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি এর বাইরেও ক্রমে নিজেদের উপনিবেশ তথা সাম্রাজ্য বিস্তার করল সমগ্র পৃথিবীর বিশাল ভূভাগে। আগে পিছে থাইল্যান্ড, জাপানের মত ২/৪টি দেশ বাদে প্রায় সমগ্র এশিয়া মহাদেশ, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনস্থ হল। এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত বিরাট এবং সুপ্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ভারতবর্ষ দুই শত বৎসরের জন্য ব্রিটেনের অধীনস্থ হল। এশিয়ার বিশাল এবং প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী চীন দেশও কিছু কালের জন্য প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত কিংবা নিয়ন্ত্রণাধীন হল। পশ্চিম ইউরোপের পথ ধরে পূর্ব ইউরোপের রাশিয়াও পূর্ব দিকে মধ্য এবং পূর্ব এশিয়ায় তার সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটালো। ক্রমে তা পৌঁছালো প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল পর্যন্ত।
বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের বিশ্বব্যাপী এই জয়যাত্রার একপাশে যেমন রয়েছে সভ্যতার জয়যাত্রা তেমন অপর পাশে রয়েছে অপরিমেয় অমানবিকতা এবং অগণিত মানুষের ধ্বংস এবং উৎসাদনের করুণ ইতিহাস। উপনিবেশিক ইউরোপীয়দের হিংস্র থাবায় দেশের পর দেশ বিরান এবং জনশূন্য হয়ে গেছে, আমেরিকার আজটেক অথবা ইনকা সভ্যতার মত সভ্যতাগুলি ধ্বংস এমনকি বিলুপ্ত হয়েছে, এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীর বহু দেশের জাতির পর জাতি ধ্বংস এবং বিলুপ্ত হয়েছে। দূরে যাবার দরকার কী? আমাদের এই বঙ্গ বা বাংলার অভিজ্ঞতার কথাই বলা যাক। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজরা বাংলার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যে ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে এক ভয়ঙ্কর মহাদুর্ভিক্ষ (বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) সৃষ্টি করে তাদের নিজেদেরই হিসাব অনুযায়ী (গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের হিসাব) তৎকালীন বাংলার তিন কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটালো। বহিরাগত মুসলমান আক্রমণকারীরা ভারত এবং বঙ্গে বিপুল ধ্বংস এবং হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু সেটা দীর্ঘ সময় ধরে এবং সেটাও প্রধানত উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে। তাদের সকল বর্বরতা সত্ত্বেও বঙ্গে তাদের প্রায় সাড়ে পাঁচশত বৎসর শাসনকালে এমন একটি ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের কোনও উদাহরণই নাই। এমনকি ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গ বা বাংলার সমগ্র অতীত ইতিহাসে উল্লেখ করবার মত একটি বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ ঘটবার কথাও আমাদের জানা নাই।
ইংরেজ শাসকরা শুধু যে জনসংখ্যার বিপুল অংশকে ধ্বংস করল তাই নয়, অধিকন্তু উন্মত্ত লুণ্ঠন এবং বিভিন্ন কর্মনীতির মাধ্যমে বাংলার বিপুলভাবে সমৃদ্ধ কুটীর শিল্পকেও ধ্বংস করে বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে মূলত ভেঙ্গে ফেলল। ইংরেজ শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর বিস্ময় বাংলার মসলিন বস্ত্র অতীতের হারিয়ে যাওয়া একটি উপাখ্যানে পরিণত হল। এভাবে একটি বিপুলভাবে শিল্প ও কৃষি সমৃদ্ধ দেশকে সম্পূর্ণরূপে পশ্চাৎপদ কৃষি নির্ভর এবং শিল্পের ক্ষেত্রে বিদেশ নির্ভর তথা ব্রিটেন নির্ভর দেশে পরিণত করা হল। পুরাপুরি কৃষি নির্ভর হয়ে বঙ্গ পরিণত হল ব্রিটেনের শিল্পপণ্যের কাঁচামাল যোগাবার আর শিল্পপণ্য ক্রয় করবার মুক্ত বাজারে। ভারতবর্ষ থেকে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে বিদায় নিবার পূর্বে ইংরেজরা বঙ্গ এবং বাঙ্গালী জাতির প্রতি আর একটি গণহত্যা উপহার দিল। সেটা হল ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে ইচ্ছাকৃতভাবে এবং কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি আর একটি মহাদুর্ভিক্ষ, যাতে করে তৎকালীন বঙ্গের ৬ কোটির কিছু বেশী মানুষের মধ্যে (অবিভক্ত বঙ্গে ১৯৪১-এর লোকগণনার হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ৬,০৩,০৬,৫২৬) প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই দুই মহাদুর্ভিক্ষের মাঝখানের কালটাতে ব্রিটিশ সভ্য শাসকরা বঙ্গকে আরও কয়েকটি ছোটখাটো এবং বিশেষত আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন দুর্ভিক্ষ উপহার দিয়েছিল। এই হচ্ছে বঙ্গে ব্রিটিশ সভ্যতার অনেক অবদানের একটি। কুটীর শিল্পের উৎসাদনের কথা তো ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। সেটি হচ্ছে ব্রিটিশদের অপর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান। এ দেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও সভ্যতার ধ্বংস এবং অধঃপতনের জন্য ব্রিটিশদের আরও অনেক অবদানের কথা বলা যায়। তবে সে সব প্রসঙ্গ এখন থাক।
পাশ্চাত্য সভ্যতার অবদানের কথা উল্লেখের সময় উপরে উল্লিখিত এই কথাগুলিও কি স্মরণে রাখা উচিত নয় বিশেষত প্রাচ্য সমাজগুলির প্রতি পাশ্চাত্যের ভূমিকার স্বরূপ মনে করবার জন্য? পাশ্চাত্য ভূমিতে না দাঁড়িয়ে একবার যদি আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের ভূমিতে দাঁড়িয়ে আমরা পাশ্চাত্যের ভূমিকাকে বিচার করি তখন কোন্ সত্য সামনে চলে আসবে? বলা হয়ে থাকে ইউরোপীয়রা যাবার পূর্বে দুই আমেরিকা মহাদেশে পাঁচ থেকে দশ কোটি রেড ইন্ডিয়ান ছিল? তার মধ্যে যদি ৮০% থেকে ৯০% মানুষকে ধ্বংস করা হয়, যেটা করা হয়েছিল, তবে কয়জন টিকে থাকে? এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩২ কোটি ৬৫ লক্ষ। তার মধ্যে রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ৫০ লক্ষের কিছু বেশী। এই হচ্ছে নিজ ভূমিতে একটা জনগোষ্ঠীর বিনাশের সামান্য একটু চিত্র। সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী চরিত্রে আবির্ভূত পাশ্চাত্য সভ্যতার এ ধরনের মানুষ ধ্বংসী, সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী ও জাতি বিনাশী এবং মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। কয়টা বলব? সেগুলি এখন থাক। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু সেসব নয়। তবে পাশ্চাত্যের এ ধরনের ধ্বংসাত্মক ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই আজকের এই আলোচনা সম্পর্কিত।
আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বাস্তবতার চাপে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলি প্রাচ্যের দেশগুলিতে ক্রমে তাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটালেও তারা আমাদের মত সমাজ ও দেশগুলির উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে গেছে। বস্তুত বিদায় নিবার আগে তারা এখানে তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রাখবার প্রয়োজনে এখানে তাদের তৈরী অধস্তন শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। এভাবে তারা বিদায় নিলেও তাদের স্বার্থ রক্ষিত হল। কথিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলি পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির স্বার্থের প্রয়োজনে তৈরী করে দেওয়া ছকে আবদ্ধ হয়ে পথ চলতে বাধ্য হল।
ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেই এটা স্পষ্ট হয় যে, এই দেশগুলি স্বাধীনতার ছদ্মবেশে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য এবং ধারাবাহিকতাকে আজ অবধি তাদের আইন-আদালত-পুলিশ-প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ তাদের সমগ্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে বহন করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের এই নবতর রূপকে নয়া উপনিবেশবাদ বলা যেতে পারে।
এটা ঠিক যে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসকরা তাদের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এই উপমহাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। ফলে ব্রিটিশদেরকে এখন আর প্রত্যক্ষভাবে এখানকার রাষ্ট্রগুলির শাসন ক্ষমতায় দেখা যায় না। কিন্তু তাতে কী? দুই শত বৎসর ধরে যে উপনিবেশিক দমন, লুণ্ঠন, শোষণ এবং শাসনের ব্যবস্থা তারা এখানে নির্মাণ করেছিল এবং যাবার সময় চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেটাই প্রায় অপরিবর্তিত রূপে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলিতে বিশেষত ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বঙ্গে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ ঘটলেও ভারতের ভূমিকা এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কারণে সেটা যেমন সম্পূর্ণতা পায় নাই তেমন পাকিস্তানের মাধ্যমে ব্রিটিশ উপনিবেশিক ব্যবস্থার যে ধারাবাহিকতা ছিল তা থেকেও এ দেশ মুক্তি লাভ করে নাই। আজকের স্বাধীন হিসাবে কথিত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও ভারত এবং পাকিস্তানের মতই ব্রিটিশ উপনিবেশিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা মাত্র। অর্থাৎ রাষ্ট্রের চরিত্র বিচারে ভারতবর্ষের কোনও রাষ্ট্রই স্বাধীন তথা প্রকৃত অর্থে জাতীয় হয়ে উঠতে পারে নাই। সবই বিদেশী, বহিরাগত এবং পরশাসনমূলক আধিপত্য ও শাসনের ধারাবাহিকতা। যে আইনের শাসন আজ অবধি উপমহাদেশের জনগণের ঘাড়ের উপর চেপে বসে আছে তা প্রকৃতপক্ষে উপনিবেশিক আইনের শাসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
এভাবে আমরা আজ অবধি পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার জালে আবদ্ধ হয়ে আছি। এক সময় ব্রিটেন ছিল পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের প্রধান কেন্দ্র। ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে সেই কেন্দ্র হিসাবে জায়গা নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উপমহাদেশে ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে। সুতরাং উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে তা মার্কিন কেন্দ্রিক উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৪৭ থেকে।
এখন প্রশ্ন আসা সঙ্গত যে ব্রিটিশ শাসন অবসানের এতকাল পরেও আমরা কেন পরোক্ষ রূপে বিরাজমান পাশ্চাত্য উপনিবেশিক আধিপত্যের জাল ছিন্ন করে মুক্ত হতে পারি নাই। কেন তার রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার জঞ্জাল আজও টেনে নিয়ে চলেছি? উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ থাক, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কবলমুক্ত হয়ে পূর্ব বঙ্গের বুকে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ভারতীয় উপমহাদেশের আর সকল রাষ্ট্রের মত সেই ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের প্রায় সকল উত্তরাধিকার আমরা আজও বহন করে চলেছি।
কিন্তু কেন? এটা ঠিক যে, পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক যে বিশ্বব্যবস্থায় আমরা বসবাস করছি সেখানে মার্কিন কেন্দ্রিক পাশ্চাত্যের সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি একটা বড় ফ্যাক্টর পাশ্চাত্যের এই আধিপত্যমূলক ব্যবস্থা রক্ষার ক্ষেত্রে। সামরিক শক্তির জোরে যে ব্যবস্থা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামরিক শক্তি যে তার অস্তিত্ব বা স্থায়ীত্বের একটা বড় শর্ত তাতে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু শুধু কি সামরিক শক্তির জোরে কিংবা শুধু অর্থনৈতিক শক্তির জোরে আমাদের মত দেশগুলিকে এতকাল পদানত রাখা যাচ্ছে? তাও আবার এত দূর থেকে এবং প্রত্যক্ষ সামরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকেই?
এর একটা উত্তর আছে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের দ্বারা প্রবর্তিত ব্যবস্থার সুবিধাভোগী এবং অধস্তন শ্রেণীগুলির নিকট শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মধ্যে। এই শ্রেণীগুলিই স্বাধীনতার সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে উপনিবেশিক ব্যবস্থা রক্ষা এবং পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। এভাবে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলি আজ অবধি কখনও প্রত্যক্ষভাবে এবং কখনও পরোক্ষভাবে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের আউটপোস্ট বা ফাঁড়ি হিসাবে ভূমিকা পালন করছে। অর্থাৎ এই রাষ্ট্রগুলি এখানে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করছে। এবং এরই সঙ্গে বিজড়িত রয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণীগুলি।
কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকটাকে বুঝা খণ্ডিত হবে যদি একই সঙ্গে আমরা সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকটাকে বুঝতে না পারি। অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদীরা এ দেশ শাসনের সহায়ক হিসাবে এমন একটি শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তুলেছিল যারা ব্রিটিশ শাসনকে যথার্থতা অর্থাৎ নৈতিকতা দিবার কাজ করে যাবে। সামরিক শক্তির জোরে একটা দেশ দখল করা যেতে পারে। কিন্তু শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে একটা দেশকে দীর্ঘ কাল শাসন এবং পদানত রাখা সুকঠিন এবং এমনকি অসম্ভব হতে পারে যদি না সেই শাসনের সপক্ষে শাসিতদের মধ্যে মানসিক অনুমোদন তথা চেতনা গড়ে তুলা না যায়। অর্থাৎ শাসিতদের মধ্যে এই বোধ জাগাতে হয় যে শাসকরা সবদিক থেকেই শ্রেষ্ঠ এবং তারা শাসিতদের কল্যাণ এবং উন্নতির জন্য শাসিত জাতির শাসন ভার হাতে নিয়েছে। যদি আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মত উপমহাদেশের জাতিগুলিকে বিলুপ্ত করে এখানে ব্রিটিশদের বাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা যেত যেমনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডে করা গেছে তাহলে আর অধীনস্থ জাতি বা জনগোষ্ঠীর চেতনা বা বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের সমস্যা নিয়ে ব্রিটিশ বা ইংরেজদেরকে ভাবতে হত না। কিন্তু ভারতবর্ষের মানুষ এত পিছিয়ে পড়া ছিল না যে তারা বিলুপ্ত হবে। সুতরাং ব্রিটিশরা তাদের বিনাশ করে ভূমি দখলের উপর গুরুত্ব না দিয়ে তাদের শ্রমশক্তি লুণ্ঠন এবং তাদের দ্বারা উৎপাদিত সম্পদ দখল বা লুণ্ঠনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। তার জন্য তারা যেমন গড়ে তুলতে চেয়েছিল পরদেশী চরিত্রের লুণ্ঠনমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তেমন এই ব্যবস্থা পরিচালনা এবং রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিল পরদেশী চরিত্রের দমন মূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আর সেই সঙ্গে তারা গড়ে তুলল শুধু এই উপমহাদেশের শাসন কার্যে সহায়ক শিক্ষিত শ্রেণী গড়বার জন্য নয়, অধিকন্তু উপমহাদেশের সমগ্র শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এবং সেই সঙ্গে সমগ্র জনগোষ্ঠীকেও দাসত্বের চেতনায় ধরে রাখবার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা। সুতরাং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সহায়ক হিসাবেই তৈরী করা হল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার ছাঁচে ফেলে তৈরী করা হল এমন শিক্ষিত শ্রেণী যারা হবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদীদের অন্ধ অনুসারী এবং দাস। এই শিক্ষিত শ্রেণী হবে শুধু যে বাস্তবে দাস তা-ই নয়, মন এবং মননেও দাস। এভাবে এই দাসদের দিয়ে গড়ে উঠল আর একটি শ্রেণী — দাস শিক্ষিত তথা দাস বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। এই দাস বুদ্ধিজীবীদের শীর্ষে থাকল উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতবর্গ। ব্রিটিশ রাজনীতিক এবং ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষানীতির প্রতিষ্ঠাতা মেকলে এমন একটা শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তুলবার কথাই বলেছিলেন যারা হবে রঙ এবং চেহারায় ভারতীয় কিন্তু রুচিতে ও মননে ইংরেজ বা ইউরোপীয়। বাস্তবে এরা হবে ব্রিটিশদের দাস। অভিজ্ঞতা কী বলে? এই দাসদের দ্বারাই কি উপমহাদেশের জ্ঞান বা বিদ্যা চর্চার জগৎ তথা বুদ্ধিবৃত্তির জগৎ আজ অবধি অধিকৃত নয়? আর বুদ্ধিবৃত্তিই তো মানুষকে চালিত করে।
আমাদের এই ভূখণ্ড বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তি তথা চেতনার একটা সমস্যা তুলে ধরবার জন্য আমার এই আলোচনার অবতারণা। এই আলোচনার গভীরে যাওয়ার জন্য আমি ঋগ্বেদ প্রসঙ্গে আলোচনা করলাম. যা আমার জন্য প্রকৃতপক্ষে একটা কেস-স্টাডি। ব্রিটিশ তথা পাশ্চাত্য আধিপত্য এবং ভারতবর্ষের পরদাসত্বের মধ্যকার সম্পর্ক জ্ঞানের জগতের সত্যান্বেষাকেও কীভাবে বিপথগামী করেছে সেই সত্যকে এই কেস-স্টাডির সাহায্যে তুলে ধরতে চেয়েছি। বস্তুত এই কেস-স্টাডি যে ঘটনাকে দৃশ্যমান করে তা হল পাশ্চাত্য পাণ্ডিত্য তথা পণ্ডিতবর্গের অনেকের বুদ্ধিবৃত্তির মান কিংবা চরিত্রের স্বরূপ এবং সেই সঙ্গে উপমহাদেশের প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতদের এক বৃহদাংশের বুদ্ধিবৃত্তিরও সাধারণ মান কিংবা চরিত্র।
চলবে…
আগের পর্ব পড়ুন:
কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন (১ম পর্ব)