০
১০১২ বার পঠিত
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের গল্পটা যে মিথ্যা এইটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই গল্পের একটা মিথ্যা ক্রসফায়ারের সবচেয়ে কট্টর সমালোচকরাও মেনে নিয়েছেন। ক্রসফায়ারের প্রবর্তকদের এইটা একটা বড় সাফল্য। আর ব্যর্থতা হইলো ওয়েস্টার্ন-লিবারাল হিউম্যান রাইটস ডিসকোর্সের যেটা পোস্টকলোনিয়াল স্টেট টেরর বোঝার জন্য যথেষ্ট না।
মিথ্যাটা হইলো এমন যে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ একধরনের শাস্তি যেটা সাধারণ বিচার ব্যবস্থার বাইরে বিচারিক শাস্তির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সত্যটা হইলো এই যে ক্রসফায়ার কোন শাস্তি না বা বিচারিক শাস্তির বিকল্প বা অল্টারনেটিভ না বরং প্যারালাল। আরেকটু অন্যভাবে বললে বিচার বিভাগের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র খুন করে সেই রাষ্ট্র বিচার বিভাগের বাইরেও খুন করে। বিচারিক হত্যাকান্ড আর বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ড দুইটাই রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ড। ইংরেজীতে জুডিশিয়াল এক্সিকিউশন আর এক্সট্রাজুডিশিয়াল এক্সিকিউশন দুইটাই কিন্তু এক্সিকিউশন। এইখানে বিচারিক হত্যাকান্ডের ফ্রেমওয়ার্ক আর ফাঙ্কশনটা শাস্তির কিন্তু বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ফ্রেমওয়ার্ক আর ফাঙ্কশনটা ভিন্ন।
যদিও দুইটারে গুলায় ফেলাটা খুবই সহজ। যে সমাজে কয়েকহাজার লোকের একটা মব বিচারিক হত্যাকান্ডের দাবী তুলে সফল হইতে পারে সেই সমাজে আরেকটা মব বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের দাবী তুলে সফল হবে এইটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে কিছু লোকের ফাঁসী হইলে যে তথাকথিত প্রগতিশীলরা আনন্দের ঠেলায় কাচ্চি বিরিয়ানী খান তাদের সাথে নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারের পরে যারা রসগোল্লা আর চমচম খাইতেছে তাদের কি পার্থক্য? শামসুদ্দীন মানিকের মতো লোকের হাতে যদি রাষ্ট্র ফাঁসীর হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা দিতে পারে তাইলে বেনজীর আহমদের হাতে কেন রাষ্ট্র ক্রসফায়ারের হুকুম দেওয়ার ক্ষমতা দিতে পারবেনা? এইখানে আইন-কানুনের একটা কথা তুলে তর্ক করা যায় এবং আইনবাদীরা সেটা করেনও কিন্তু আইন যে একটা ওয়েল-কন্সট্রাকটেড মিথ এইটা আম পাবলিক যতোটা ভালো বোঝে আইনজীবিরা সেটা বোঝেননা।
বাংলাদেশে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ফাঙ্কশন বোঝার জন্য সাম্প্রতিক দুইটা কেইস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা কেইস হইলো অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মূল আসামী মুকুল রানার বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা। সিটিটিসি গঠিত হওয়ার ঠিক শুরুর দিকেই মুকুল রানা আটক হয় এবং তাকে গুম করে রাখা হয়। অনেক নাটকের পরে তাকে বন্দুকযুদ্ধের নামে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের অন্য আসামীরাও কিন্তু মুকুল রানার আগে-পরেই ধরা পড়ে এবং অনেক নাটকের পরে আদালতে প্রেরিত হয়। একই মামলায় দুই ট্রিটমেন্ট কেন? বন্দুকযুদ্ধের নামে মুকুল রানাকে যে খুন করলো রাষ্ট্র এইটা কি শাস্তি ছিলো? তাইলে একই মামলার অন্য আসামীদের শাস্তির জন্য আদালতে পাঠানো হইলো কেন? আরেকটা কেইস হইলো হোলি আর্টিজান হামলার অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী নুরুল ইসলাম মারজানকে বন্দুকযুদ্ধের নামে খুনের ঘটনা। মুকুল রানার মতো নুরুল ইসলাম মারজানও সিটিটিসির হাতে আটক হয় এবং তাকে গুম করে রাখা হয়। আজকে যে আদালতে হোলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় মামলা চলতেছে এবং বেশ কিছু আসামী জবানবন্দীও দিতেছে তাদের মধ্যে মারজান নাই কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়াটা কিন্তু খুব একটা কঠিন না। আমি নিচে সূত্র বা ফর্মুলাটা বলে দিতেছি আপনারা নিজেরাই উত্তর পেয়ে যাবেন।
১) এলিমিনেশন অফ বার্ডেনস:
যে বা যারা ক্ষমতাসীনদের (সরকার, পার্টি, এজেন্সী) জন্য কুকর্ম করছে কিন্তু কোনও না কোনও কারণে বার্ডেন বা বোঝা হয়ে গেছে তাদের ক্রসফায়ারের নামে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া। খালেদা জিয়ার সময় থেকেই এইটা ক্রসফায়ারের প্রধান দুই ফাঙ্কশনের প্রথম ফাঙ্কশন। এইখানে একটা থিওরী আছে যে ছাত্রদলের ক্যাডার যারা বিএনপির জন্য বোঝা হয়ে গেছিলো তাদের ঝামেলাটা মিটানোর জন্যই ৱ্যাবের জন্ম হইছিলো যদিও এই থিওরীটা পুরোপুরি ঠিক না।
২) এলিমিনেশন অফ পলিটিক্যাল অপোজিশন:
যে বা যারা ক্ষমতাসীনদের (সরকার, পার্টি, এজেন্সী) রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের ক্রসফায়ারের নামে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া। খালেদা জিয়ার সময় থেকেই এইটা ক্রসফায়ারের প্রধান দুই ফাঙ্কশনের দ্বিতীয় ফাঙ্কশন। খালেদা জিয়া ডিজিএফআইর কথায় যে ৱ্যাব রাক্ষসের জন্ম দিছিলো সেই ৱ্যাব রাক্ষস খালেদারেই আজকে খাইতেছে। অথচ তার পার্টির লোকজন ইদানীং খালেদারে বলে গণতন্ত্রের মা!
৩) বাণিজ্য:
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে মানুষ খুন এখন একটা ব্যবসাও বটে। বাংলাদেশে পুলিশ আর ৱ্যাব হইলো সবচেয়ে বড় দুইটা ক্রিমিন্যাল গ্যাং এবং ক্রসফায়ারের নামে এরা টাকার বিনিময়ে হায়ার্ড গান হিসাবে মানুষ খুন করে অথবা ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা নেয়। আর এই দুই ক্রিমিন্যাল গ্যাং-এর গডমাদার হইলো শেখ হাসিনা যারে ইদানীং তার পার্টির লোকজন বলে মাদার অফ হিউম্যানিটি!
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন