০
১৪২১ বার পঠিত
নিজেকে গবেষক দাবি করে যারা ‘সংগৃহিত’ শব্দটির উপর ভর করেন তাদের জন্য মায়া হয়। লীলা কীর্তন ধাঁচের একটি গান নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার প্রেক্ষিতেই বলছি। সরলপুর ব্যান্ড বনাম পার্থ বড়ুয়ার আয়োজনে গাওয়া গানটি নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। সরলপুর ব্যান্ড দাবি করছে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ শিরোনামের গানটি তাদের নিজস্ব এবং এর কপি রাইটটিও তাদের। এই দাবির বিপরীতেই গবেষণার আলাপ উঠে এসেছে। সেই সব গবেষকরা দাবি করেছেন গানটি সংগৃহিত।
কথা এসব গবেষকদের নিয়েই। গবেষণার কাজ কী? সংগৃহিতের উপর ভর করা নাকি সংগ্রহের উৎস জানা? হ্যাঁ, গবেষকদের কাজই হচ্ছে উৎস খুঁজে বেড়ানো। একটি প্রাচীন শিলালিপির অর্থ এবং উৎস খুঁজে বেড়ানোই প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের কাজ। তেমনি সাহিত্য রচনার উৎস ও লেখক খুঁজে বের করাই সাহিত্য বিষয়ে গবেষকদের কাজ। সংগৃহিত লোকগাথার উৎস খুঁজতে অনেকে সারাজীবন ব্যয় করেছেন। এখনো অনেকে করছেন। সেই প্রচেষ্টার তো ধারেকাছে নেই, উল্টো আমাদের গবেষক দাবিদাররা কাজ চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন ‘সংগৃহিত’ এর উপর! আজব না?
বৈষ্ণব পদাবলীর আদি রচয়িতা বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাস কিনা এ নিয়ে এখনো বিতর্ক চলে। অসংখ্য কবি পদাবলী লিখেছেন। এমন কী মুসলিম কবির নামও বাদ যায়নি। মুসলিম কবি আফজলের কথা উল্লেখ রয়েছে, যিনি পদাবলীর বেশ কিছু পদ রচনা করেছিলেন। কিছু পদ রচনার জন্যও তার নাম তুলে এনেছেন গবেষকরা। কথাটির নোট রেখে দিয়েন কথিত গবেষকগণ।
শ্রুত পদের কিছু কবির নাম জানা যায়নি। সে সব ক্ষেত্রে নাম জানার চেষ্টা চালু আছে। বন্ধ হয়নি। গবেষকরা কাজ করছেন প্রাচীন সেই সাহিত্য নিয়ে। আর আমাদের দেশের কথিত গবেষকরা ‘সংগৃহিত’ এর উপর দিয়েই কাজ চালিয়ে দিতে চান। অদ্ভুত! তাহলে আর গবেষণার দরকার কী!
সরলপুরের গান নিয়ে অনেকেই বলছেন, এর ত্রিশ ভাগ লোকগান থেকে সংগ্রহ করা। আমি তো বলি রাধা-কৃষ্ণের পুরো কাহিনিই সংগ্রহ করা। ধর্ম থেকে আসা এই কাহিনি নানা জনের মুখে নানা ভাবে গীত হয়েছে। চৈতন্য দেব জন্ম দিয়েছিলেন বৈষ্ণব সাহিত্যের। তিনি লিখে যেতে না পারলেও বিভিন্ন কবি তা লিখেছেন তাদের আঙ্গিকে। বিষয়, ঘটনাক্রম সব এক। সেই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা। সেই রাধা-কৃষ্ণ নাম, যমুনা ও তার জল, কদম গাছ আর বাঁশি, বৃন্দাবন, গোকুল, গোয়ালা এসব তো সবার ক্ষেত্রেই কমন। আর কাহিনি তো একটাই। লিখতে গেলে নিজেদের মত শব্দ ও ছন্দে বেঁধেই তা লেখা হয় এবং গীত হয়। এক্ষেত্রে আবার ত্রিশ ভাগ, চল্লিশ ভাগের প্রশ্ন আসে কোথা থেকে! পদাবলী যারা লিখেছেন, তারা কি রাধা কৃষ্ণের নাম পরিবর্তন করেছেন, নাকি যমুনার জায়গায় মেঘনা-পদ্মা লিখেছেন। বাঁশির জায়গায় সেতার বলেছেন। কদম গাছের জায়গায় কদলী বৃক্ষ বলেছেন। বলেননি তো। সুতরাং সাদৃশ্য নিয়ে এত হিসেব কেনো! একই কাহিনি নিজ মুন্সিয়ানায় বয়ান করাটাই প্রধান। সেটাই ব্যক্তির কাজ, কবির কাজ, গায়কের কাজ। আর সে কাজটাই করেছে সরলপুর ব্যান্ড। পদাবলী যেমন বিভিন্ন কবির, তেমনি সরলপুরের সে গান তাদের নিজস্ব। আর এর কপি রাইট তাদেরই। তারা যদি আনুষ্ঠানিক ভাবে সংগ্রহ না করতো তবুও তাদের। এতে তর্কের অবকাশ সৃষ্টির প্রয়াস অনেকটাই উদ্দেশ্য প্রণোদিত, না হয় বোকামি।
অবশ্য বোকামির চুড়ান্তটা করতে এই গানের বিয়াল্লিশ লাইনের মধ্যে কিছু সিমিলারিটি খুঁজে বের করেছেন সোকল্ড গবেষকরা। তাদের যদি প্রশ্ন করেন নচিকেতা রবি ঠাকুরের ‘একলা চলো রে’ গানের দুটো লাইন নিয়ে নিজে একটি গান করেছেন; সেই গান কি তাহলে নচিকেতার নয়? ওই দুই লাইনের জন্য ‘অল ক্রেডিট গোজ টু রবি ঠাকুর’? কথিত গবেষক ভাই সকল কি বলেন? বাংলাদেশের আরেক গায়িকা শায়ান তার একটি দেশাত্মবোধক গানে অন্য আরেকটি গানের বেশ কয়েকটি লাইন যোগ করেছেন। সেখানেও কি শায়ানের ‘ক্রেডিট গোজ টু’ সেই গানের লেখক সুরকারের? নিশ্চয় নয়, গানটি শায়ানের গান নামেই শ্রুত হয়। সেই গবেষকদের বলি বাউল গগন হরকরার নাম তো শুনেছেন? না শুনলে গুগল করে উইকিপিডিয়া দেখে নিয়েন, অনেক বিভ্রান্তি কেটে যাবে গান বিষয়ে। যদি গবেষণা করতে চান তাতেও কাজে আসবে।
সবশেষে বলি, কর্পোরেট ধান্ধা বাদ দিয়ে অন্যের সৃষ্টিকে মর্যাদা দিতে শিখুন। জনপ্রিয়তা, অবস্থান আর ক্ষমতা দিয়ে হয় তো অনেক কিছুই করা যায়, কিন্তু ইতিহাস মুছে দেয়া যায় না। যায়নি। আজ থেকে একশ বছর পরে এমন গানের উপর যারা গবেষণা করবেন, তথ্যগত কারণেই তাদের সরলপুর ব্যান্ডের নাম নিতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। আর সত্যের বিকল্প থাকতে নেই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন