গত বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার পেলেন একজন আচরণবাদী অর্থনীতিবিদ। এছাড়া চারিদিকে আজকাল মেশিন লার্ণিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ( আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) এর কথা শোনা যাচ্ছে। অর্থনীতি,মনোবিদ্যা, গণিত বা কম্পিউটার যে যেখান থেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন, তাদের সবার মূল কিন্তু এক জায়গায়। সেটা হলো মানুষকে মানুষের মর্যাদা না দিয়ে স্থূল মেশিনের পর্যায়ে নামিয়ে আনা, মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা, ভিন্নভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাকে কমিয়ে এনে তাকে ম্যাকানাইজড রোবট বা নিম্নস্তরের প্রাণির মত কাজ বা আচরণের জন্য শাস্তি এবং পুরষ্কারের ব্যবস্থায় ফেলে দেওয়া। এটা ঠিক যে মানুষ একটি প্রাণি, অন্যান্য প্রাণির মত সেও সংবেদনশীল, যেকোন আচরণের জন্য শাস্তি পেলে সে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে আর পুরষ্কৃত হলে সেটা আরো বেশি করে করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাই বলে মানুষকে তার মানবিক গুনাবলী, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে বাদ দিয়ে তাকে নিছক ইন্সটিংক্ট ওয়ালা প্রাণি ভাবা যায় না, কিন্তু বিজ্ঞান তাই ভাবছে, আর তারই ধারাবাহিকতায় উপরোক্ত বিষয়গুলো এখন গবেষণার নতুন দিগন্ত হিসেবে হাজির। দুঃখজনক হলেও আধুনিক মানুষও আজ যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্থ হয়ে নিজেকে যন্ত্রই ভাবছে।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে মানুষ তার তার নিজের লাভের কথা মাথায় রেখে দৈনন্দিন সিদ্ধান্তগুলো নেয়। নিজের ভাল পাগলেও বুঝে! ক্লাসিক অর্থনীতি সেরকমই বুঝত। কিন্তু আচরণবাদী অর্থনীতিবিদ জানাচ্ছেন এটা নাকী ভুল। গরীব মানুষ যে কীনা সারাক্ষণ দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করছেন তার সঠিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কম। আচরণবাদীর কাছে কেন আপনি গরীব সে প্রশ্ন অবান্তর। তারা মনে করেন, দারিদ্র্যের জন্য আপনার আচরণ দায়ী। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপনার চিন্তাহীনতা দায়ী।
পাশ্চাত্য আচরণবাদের এ পুরো ব্যাপারটা শুরু হয় দার্শনিক রেনে দেকার্তের মাধ্যমে। আধুনিক যুগে এসে ব্রিটিশ দার্শনিক গিলবার্ট রাইল এর সূচনা করেন।
মানুষের মন এক জটিল বিষয়। সতের শতক থেকে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারনে আমরা মহাবিশ্বের নানা অজানা তথ্য জানতে পারছি। আজকে এমনটা আশা করা যায় ভবিষ্যতে আমরা বিজ্ঞানের দ্বারা আরো অনেক অজানা তথ্য জানব, প্রকৃতির গোপনতা আর আমাদের কাছে আর গোপন থাকবে না। কিন্তু আসলে কী তাই? বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা এখনও মানুষের মন সম্বন্ধে একমত হতে পারিনি।
আমাদের চেতনা সম্পর্কে আমরা খুবই সচেতন। আমাদের সবারই নিজস্ব চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। নিজের জগতে আমরা সবাই ব্যক্তিগত মতামত নিয়ে আছি। বিজ্ঞানের কর্ম্ পদ্ধতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত, বিজ্ঞান পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক, আমাদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে বিজ্ঞানের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু চেতনা এবং মানসিক অবস্থাকে আমরা তাহলে কীভাবে ভৌত জগতের সাথে সম্পৃক্ত করব?
পাশ্চাত্য দর্শনে রেনে দেকার্ত প্রথমে মানুষের মনকে একটা আলাদা সত্ত্বা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর মতে মানুষের একটা অবস্তুক মানসিক সত্ত্বা আছে যার কাজ হল চিন্তা করা। মন বাদে বাদ-বাকি সব আসলে বস্তু,যাদের আকার-আকৃতি আছে। দেকার্তের এ বিভাজন দর্শনের ইতিহাসে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে, যাকে বলা হয় ‘সাবস্ট্যান্স ডুয়ালিজম’।
দেকার্তের মন এবং শরীরকে দুটি আলাদা ডোমেইনে স্থাপনের অনেক সমালোচনা হয়। শরীর এবং মন আলাদা নয়, তারা একে অপরের সাথে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত। মানসিক ক্রিয়ার ফলে শারীরিক প্রতিক্রিয়া যেমন দেখা যায় তেমনি শারীরিক ক্রিয়া থেকে মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়।
কিন্তু মন এবং শরীরের পারস্পরিক সম্পর্ক দেকার্তের তত্ত্বের ভিত্তিকে দূর্বল করে দেয়। বিজ্ঞানের মতে, যে কোন ভৌত পরিবর্তনের জন্য ভৌত কারন থাকে। কিন্তু মন এবং বস্তুকে আলাদা করে দেকার্তে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া অসম্ভব করে তোলেন। দেকার্তে নিজেও এ সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তার দর্শনে সেজন্য ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ছাড়া এর থেকে কোন মুক্তির দিশা পাওয়া যায় নি।
দেকার্তের সমসাময়িক ম্যালেব্রঁনশ এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। তাঁর মতে মন এবং শরীরের (বস্তু) মধ্যেকোন সংযোগ আসলে হয় না, যখন তাদের মধ্যে সংযোগের পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন ঈশ্বরের সহায়তায় সেটা সম্ভব হয়, যার ফলে যেকোন ঘটনাতে আমরা কার্য-কারণ তত্ত্বের উপস্থিতি টের পাই। ম্যলেব্রঁশের এ্মন অদ্ভূত তত্ত্ব ‘অকেশানালিজম’ নামে পরিচিত, এ তত্ত্ব তেমন সমর্থন তো পায় নি বরং আসল সমস্যার গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে তোলে।
দেকার্তের সম-সাময়িক ওলন্দাজ দার্শনিক স্পিনোজা মন এবং জড়বস্তুর এ সমস্যাকে ভিন্নভাবে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন। ‘প্রপার্টি ডুয়ালিজম’ নামে খ্যাত তাঁর তত্ত্ব মতে মন এবং শরীরের এ দ্বন্দ্ব বস্তুগত নয়, এটি তাদের বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য। একই মানুষের দুটি পৃথক বৈশিষ্ট্য, একটি ভৌত বৈশিষ্ট্য, আরেকটি মানসিক বৈশিষ্ট্য। তাদের একটিকে দিয়ে অপরটিকে বুঝা যাবে না। কিন্তু একই মানুষের এরকম সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বলা হলেও একটা সন্দেহ ঠিকই থেকে যায় ‘প্রপার্টি ডুয়ালিজম’ আসলে বস্তুগত পার্থক্যেরই নামান্তর। এতে সমস্যা স্থানান্তরিত হয়েছে কিন্তু সমাধান হয়নি।
মন আর শরীরের এ দ্বন্দ্ব থেকে উত্তরণের একটা উপায় হলো, শুধু একটাকে স্বীকার করা। দুনিয়াতে কেবল মানসিক বিষয় আছে, (The World is made of mind stuff), অথবা এতে কেবল ভৌত বিষয়াদি আছে। কিছু দার্শনিক যেমন, জর্জ বার্কলি ভাববাদী পথে গিয়ে ঘোষণা করেন, বাস্তবতা কেবল মানসিক ভাব ধারনা দিয়ে তৈরি। কিন্তু বেশিরভাগ দার্শনিক যে কোন প্রকারের ভৌত ব্যাখ্যার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। আজকে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারনে, ভৌতবাদীরা (ফিজিক্যালিস্ট) দাবী করেন মনকেও বিজ্ঞানের আওতায় আনা যাবে। এবং যেহেতু বিজ্ঞান জড়বস্তুনিয়ে কাজ করে তাই মনও স্বাভাবিকভাবে জড়বস্তু। কিন্তু মনের গহীন গোপন স্বকীয়তা, কর্তাস্বভাবকে কীভাবে আমরা ভৌত বিষয়াদির সাথে একসাথে ফেলে পরিমাপ করব?
ভৌতবাদ তাই নানা রূপ গ্রহন করে, তাদের মধ্যেকার মিলের জায়গা হলো, তারা সবাই মনে করে মানসিক ঘটনাকে ভৌত বিষয় দিয়ে সম্পূর্নভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যাবে। নিউরো সায়েন্সের অগ্রগতির কারনে আজকে আমরা জানি মানসিক অবস্থার সাথে মস্তিষ্কের ভৌত অবস্থার একটা সম্পর্ক আছে। ভৌতবাদীদের মতে তাই মানসিক অবস্থা আসলে পরিপার্শ্বের ভৌত ঘটনাবলী এবং মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাথে জড়িত, এবং এদের উপর নির্ভরশীল। “ Your issues are in your tissues।” এভাবে ভৌতবাদ ‘কার্য-কারণ’ সহ অনেক সমস্যার সমাধান করে, কিন্তু মূল সমস্যা থেকেই যায়, সেটি হল, মানুষের সচেতন অভিজ্ঞতা এবং কর্তার উপস্থিতি।
১৯৪৯ সালে ইংরেজ দার্শনিক গিলবার্ট রাইল তাঁর ‘ দ্য কনসেপ্ট অফ মাইন্ড’ বইতে দেকার্তের কড়া সমালোচনা করেন। দেকার্তের ভুলকে রাইল ‘ক্যাটেগরির ভুল’ বলে মনে করেন। একটা উদাহরণের সাহায্যে তিনি বিষয়টি তুলে ধরেন। ধরা যাক, একজন পর্যটককে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো কলেজ, লাইব্রেরি এবং অন্যান্য দালানগুল দেখানো হল। সব দেখানো শেষ হলে পর্যটক জানতে চাইল, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে কোনটা? আমি তো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দেখিনি। পর্যটক বিশ্ববিদ্যালয় এবং যে বিল্ডিংগুলো নিয়ে সেটি গঠিত তাদেরকে এক কাতারে ফেলতে গিয়ে তাদের মধ্যকার সম্পর্কে গোল পাকিয়ে ফেলে। মন ও শরীর নিয়ে দেকার্তে একই ভুল করেন, তাদেরকে দুটি ভিন্ন বস্তু সাব্যস্ত করেন। মন ও জড়বস্তু নিয়ে অধিবিদ্যার এ সমস্যা থেকে রাইল ‘Ghost in the Machine’ তত্ত্ব দাঁড় করান, যাতে শরীরের ভেতরে নির্বস্তুক মন বা আত্মা বাস করে জড় শরীররূপী ‘মেশিন’ কে পরিচালনা করে। এভাবে দেকার্তের তত্ত্বকে হটিয়ে দিয়ে ভৌতবাদী রাইল মন ও শরীর নিয়ে তাঁর নিজস্ব সমাধান নিয়ে হাজির হন যেটা হলো ‘আচরণবাদ’।
রাইলের সমালোচনা হিসেবে বলা যায়, মন কোন ভূত নয় এবং মানব শরীর কোন মেশিন নয়। ভূতের ধারনা হলো একট মৃত কিছু যেটা জীবিতদের সাথে সাময়িক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করতে পারে। অপরদিকে মন হলো মানুষের শরীরের একটা অনির্দিষ্ট অংশ, চিন্তা করতে পারে এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্যকলাপে অংশ নিতে পারে। মনের জন্য শরীর আবশ্যক, যেখানে ভূত অশরীরি।
মানুষের শরীরকে মেশিনও বলা যায় না,যদিও এতে অনেক জটিল কল-কব্জা আছে। অন্যান্য প্রাণির মত মানুষের শরীরের প্রধান কাজ একটা নির্দষ্ট সময় পর্যন্ত বেঁচে থেকে সন্তান উৎপাদন করা। আজ পর্যন্ত কোন মেশিন এই উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়নি যেটা নিজের প্রতিরূপ সৃষ্টি করা শেষে নিজেকে ধ্বংস করবে। ফলে দেকার্ত যে ভুল করেছেন রাইল সেখান থেকে বের হতে পারেননি।
আচরণবাদের মূলকথা হলো, মানসিক ঘটনাকে কোনরূপ তথ্যের ঘাটতি না ঘটিয়ে সম্পূর্ণভাবে ভৌত ও শারীরিক ঘটনা দিয়ে বুঝা যাবে। শারীরিক অঙ্গ-ভঙ্গী এবং আচরণ দিয়ে মানসিক ঘটনার উপযুক্ত প্রতিফলন ঘটানো যাবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় রক্তপাত বা কাঁচুমাচু মুখ দেখে বুঝা যায় যে কারো ব্যথার অনুভূতি হচ্ছে। ভিন্নভাবে বলা যায়, মানসিক ঘটনাকে পর্যবেক্ষণযোগ্য বাহ্যিক আচার-আচরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। আউটপুট এবং ইনপুট, একটা দেখে আরেকটা বুঝা যায়। কিন্তু দার্শনিক জন সারলের ‘চাইনিজ রুম’ নামের বিখ্যাত, বহুল আলোচিত মানসিক পরীক্ষায় ইনপুট এবং আউটপুটের এ সরল হিসেব ভুল প্রমাণিত হয়।
‘চাইনিজ রুম’ বহুল আলোচিত একটা আর্টিকেল, এবং ট্যুরিং টেস্টের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। ট্যুরিং টেস্ট হলো বিখ্যাত গণিতবিদ এলান ট্যুরিং এর লেখা একটি প্রবন্ধ যাতে তিনি একটা পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন যার দ্বারা কোন মেশিন চিন্তা করতে পারে কীনা সেটা বুঝা যাবে। এ টেস্ট আসলে একটা ‘পার্টি গেইম’ যাকে বলা হয় ‘ইমিটেশান গেইম’। এতে একজন পরীক্ষক থাকেন যিনি আড়ালে থেকে না দেখে শুধুমাত্র ইলেকট্রনিক সংযোগের মাধ্যমে একজন মানুষ এবং একটি যন্ত্রকে প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করবেন কে মানুষ আর কে যন্ত্র। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রশ্ন করার পরেও যদি পরীক্ষক বুঝতে না পারেন কোনটা মেশিন তাহলে মেশিন পাস করবে। ট্যুরিং মনে করেছিলেন বিশ শতকের শেষের দিকে এসে কম্পিউটারের অগ্রগতির কারনে কোন পরীক্ষকের জন্য ৫ মিনিটের মধ্যে মেশিন সনাক্ত করার সম্ভাবনা শতকরা ৭০ ভাগের মত হবে। অর্থাৎ মেশিন জিতে যাবার সম্ভাবনা বাড়বে। ট্যুরিং এর ভবিষ্যদবাণী মিলেনি, আজ পর্যন্ত কোন যন্ত্র ট্যুরিং টেস্ট পাশ করতে পারেনি।
ট্যুরিং তার পরীক্ষার মাধ্যমে যে প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন সেটা হলো, ‘যন্ত্র কী চিন্তা করতে পারে?’ সরাসরি এ প্রশ্ন করাটা তার কাছে সঠিক মনে হয়নি। কিন্তু বর্তমানে একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম চিন্তা করতে পারে কীনা সেটা নির্ণয়ের জন্য ট্যুরিং টেস্ট একটা অন্যতম উপায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা (এ আই) প্রমাণের জন্য এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।
এবার আসি দার্শনিক সার্লের ‘চাইনিজ রুম’ নামক মানস পরীক্ষায়। এতে সার্ল নিজেকে একজন ইংরেজি ভাষা জানা মানুষ হিসেবে কল্পনা করেন যে কীনা মোটেও চাইনিজ ভাষা জানে না। তিনি একটা বিচ্ছিন্ন কক্ষে অনেক চাইনিজ বই-পুস্তক নিয়ে বসে আছেন। তার কাছে চাইনিজ ভাষার বিভিন্ন প্রতীক, নিয়ম সংবলিত ইংরেজি ভাষার (রুল বুক) অনেক বইও আছে। এগুলোর দ্বারা সে জানতে পারবে কীভাবে শব্দ, প্রতীক দিয়ে ভাষাটাকে সাজাতে হবে, এবং চাইনিজ ভাষায় তার কাছে করা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এভাবে কিছুদিন প্রশ্ন পেয়ে তার কাছে থাকা নিয়ম মেনে সেগুলোর জবাব দিতে দিতে তার দক্ষতা বাড়তে থাকে। কিছুদিন পরে কক্ষের বাইরে থেকে বুঝাই যাবে না যে তিনি আসলে একজন ন্যাটিভ চাইনিজ নন। আরো ভালভাবে বলা যায় কক্ষের ভেতরে যাওয়া ‘ইনপুট’ এবং কক্ষ থেকে বের হয়ে আসা ‘আউটপুট’ একেবারে সঠিক, একজন সত্যিকারের চাইনিজ ভদ্রলোক থাকলে যেরকম হত ঠিক সেরকম। কিন্তু সে জা করেছে সেটা হলো, না বুঝে তার কাছে থাকা গাইড বই অনুযায়ী প্রতীকগুলোকে ব্যবহার করেছে, এতে তার বোধের কোন পরিবর্তন হয়নি।
একটা প্রোগ্রামের নিয়ম অনুসরণ করে ইনপুটের জবাবে সঠিক আউটপুট বের করাটাই ডিজিটাল কম্পিউটারের কাজ। দার্শনিক সার্ল তাই বলেন, তার চাইনিজ রূমের মানুষটার মত একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম তা সেটা যতই জটিল বা কঠিন হোক না কেন শেষ পর্যন্ত সেটা আসলে ‘mindless manipulator of symbols’। কম্পিউটার প্রোগ্রাম কার্যত একটা syntactic পদ্ধতি, এর দ্বারা নিয়ম অনুসরণ করে প্রতীকের ব্যবহার করা সম্ভব,কিন্তু কোন মিনিং, বোধ বা semantics অসম্ভব। চাইনিজ রূমের লোকটির যেমন চাইনিজ ভাষা সম্বন্ধে কোন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়না, তেমনি কম্পিউটার প্রোগ্রামেরও কোন আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয় না, প্রোগ্রামের কোন বুদ্ধি নেই,কোন মন নেই।
ট্যুরিং টেস্ট পাশ করা মানে তাই আসলে যেকোন ইনপুটের জন্য সঠিক আউটপুট দেয়া, যেটা চাইনিজ রুমে করা সম্ভব। তাহলে কোন যন্ত্র এ পরীক্ষায় পাস করলেও তাকে একটা চিন্তাশীল যন্ত্র বলা যাবে না। এদিকে ট্যুরিং টেস্ট সফল না হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বাও প্রশ্নবিদ্ধ।
এখানেই শেষ নয়, সার্লের চাইনিজ রুম পরীক্ষা কেবল ট্যুরিং পরীক্ষা বা এ আই কে প্রশ্নবিদ্ধ করে তা নয়। এটি আচরণবাদকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। আচরণবাদের মতে মানসিক ঘটনাকে বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝা যাবে, অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রে আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য ‘ইনপুট’ এবং ‘আউটপুট’ আছে, চাইনিজ রুমের পরীক্ষা থেকে আমরা ইতোমধ্যে জানি যেটা আসলে কোন বিষয়কে বুঝার জন্য পর্যাপ্ত নয়, মনের মত জটিল বিষয় তো মোটেই নয়। আচরণবাদ তাই এরমধ্যে তার খোলস ছেড়ে ‘ক্রিয়াবাদ’ (functionalism) এবং আরও অনেক রকমের মতবাদের মধ্যে সেঁদিয়ে আছে। আচরণবাদ, যান্ত্রিক মতবাদের মূল সমস্যা হলো সমগ্রকে চিন্তা না করে রিডাকশনিস্ট ‘ইনপুট’ এবং ‘আউটপুট’ নিয়ে ব্যস্ত হওয়ায় এটি মূল বিষয়টাকেই হারিয়ে ফেলে এবং আমাদের আবারও চাইনিজ রূমের বাস্তবতায় নিয়ে যায়।