জীন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপন্ন খাবার, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফুড‘ বা জিএম ফুড। এ খাবারের ক্ষতিকর দিক এবং সুফল নিয়ে অনেক দিন ধরে বিতর্ক চলছে। জীন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপন্ন খাদ্যের পেছনে প্রধান যুক্তিগুলো এবং তাদের জবাবঃ
১) আমাদের বিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
– – জিএম ফুডের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের উন্নয়নের চেয়ে ব্যবসায়িক উন্নয়নই (প্যাটেন্ট) বেশি মূখ্য। বড় বড় কৃষি, বীজ, কীটনাশক এবং সার কোম্পানিগুলোর লোভ এর জন্য দায়ী।
২) দুনিয়ার সাত বিলিয়ন লোককে খাওয়ানোর জন্য বেশি উৎপাদনশীল, পচন নিরোধক জিএম খাবারের প্রয়োজনীয়তা আছে।
— দুনিয়ার সাত বিলিয়ন লোককে প্রাকৃতিকভাবে উচ্চফলনশীল জাতের শস্য এবং প্রাণিজ খাবার দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব। দুনিয়াতে এখনো প্রচুর পরিমানে খাবার অপচয় হয়, খাবার নষ্ট করে ফেলা হয়। খাবার উৎপাদনে সমস্যা নাই, সমস্যা হলো ডিস্ট্রিবিউশানে। এখনো খাবার এত উদ্বৃত্ত হয় যে, কিছু কিছু উন্নত দেশে কৃষককে চাষ না করার জন্য ভর্তুকি দেয়া হয়।
৩) মানুষ প্রাচীনকাল থেকে প্রাণি এবং উদ্ভিদের নির্বাচন করে বেশি ফলনশীল, ভাল জাতের উদ্ভিদ এবং প্রাণিকে সৃষ্টি করে এসেছে। যেমন, এখনো কুকুর আর পায়রার ব্রিডিং করে নানান আকার-আকৃতি, বৈশিষ্ট্যের কুকুর ও কবুতর সৃষ্টি করা হচ্ছে।
— ব্রিডিং আর জীন প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবর্তনের মধ্য তুলনা হয় না। যৌন প্রজনন বা কলম এর মাধ্যমে যে পরিবর্তন করা হয় তাতে ডিএনএ তে কোন পরিবর্তন করা হয় না। এবং সেসকল প্রাণি ও উদ্ভিদের চাষের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক, আগাছানাশক, এন্টিবায়োটিক লাগে না।
৪) জিএম ফুডের মধ্যে যে বিষ ঢোকানো হয় তা অন্যান্য ছোট-খাট প্রাণির জন্যে ক্ষতিকর, কিন্তু মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়।
— কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। মানুষের বিশালাকৃতির শরীরের জন্য ছোট্ট পোকামাকড়ের বিষ তেমন ক্ষতিকর নয়, সামান্য পরিমানে হয়ত কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু কথা হলো, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর শরীরে এসব বিষাক্ত কীটনাশক, ভাইরাস- ব্যাক্টেরিয়ার জীন জমতে থাকলে তখন কী হবে ? বিটি বেগুনের বিষ পোকার শরীরে গেলে তাদের পাকস্থলী বিস্ফোরিত হয়, মানুষের জন্য হয়ত সেটা হবে না। কিন্তু মানুষ তো শুধু বেগুন খায় না, তার অন্যান্য খাবারেও জীন প্রযুক্তির বিষ আছে, আর এসব বিষ জমতে জমতে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন কিন্তু আর বলা যায় না যে পোকার জন্য যা ক্ষতিকর মানুষের জন্য সেটা ক্ষতিকর নয়। আফটার অল, আমরা এবং পোকা-মাকড়, বা ‘আগাছা’ সবাই জীব, বিষাক্ত পদার্থ, ক্ষতিকর জীন আমাদের সবার উপরে একইভাবে কাজ করে।
৫) জিএম খাবার খারাপ এর কোন সরাসরি প্রমান পাওয়া যায় নি। এটা খারাপ হলে সরকার সেটার অনুমোদন দিত না।
— জিএম খাবারের কুফলের সরাসরি প্রমান পাওয়া যায় নি এটা বলা যাবে না। জীন প্রযুক্তির খাবার চালু হয়েছে মাত্র ৩০ বছর হলো। কোন একটা রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব বুঝতে অনেক সময় লেগে যায়। আজকে যা ক্ষতিকর মনে হচ্ছে না, ১০ বছর পরে হয়ত জানা যাবে সেটা ক্যান্সার উৎপাদন করে। ৩০ বছর আগেও রসায়নবিদেরা কোন প্রটেকশান ছাড়া সমানে ক্লোরোফিল, বেনজিন, ডাইক্লোরোমিথেন, পারদ ইত্যাদি রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করত, আজকে কেউ সেটা করে না, কারণ এসব কেমিক্যালস শরীরে ক্যান্সার উৎপাদন করে এটা আজকে প্রমাণিত সত্য। আরেকটা উদাহরণ দেয়া যায়, গাড়ীর জ্বালানী তেলে সীসা মেশানোর ৭০ বছর পরে আমরা জানতে পারলাম সীসার বিষক্রিয়া কথা এবং এর সাথে সমাজের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে।
তারপরেও প্রশ্ন তোলা যায়, জীন প্রযুক্তির খাবার খাওয়ার পরে গত ৩০ বছরে আমাদের স্বাস্থ্যের মান বেড়েছে না কমেছে? ‘ইউ আর হোয়াট ইউ ইট’, তা আগের চেয়ে মানুষের রোগ-বালাই বেড়েছে না কমেছে? বিজ্ঞানীরা জীন প্রযুক্তির খাবারের সাথে ফুড এলার্জির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন। বর্তমান ক্রমবর্ধমান অবেসিটি, ক্যান্সার, অটিজমের সাথে খাবারের বিষের সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। যার কারনে জীন প্রযুক্তির চাষাবাদে ব্যবহৃত আগাছানাশক রাউন্ড আপ (গ্লাইফসেট) এখন ইওরোপের অনেক দেশে এবং আমেরিকার কয়েকটি রাজ্যে নিষিদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা জীন প্রযুক্তির খাবারে যদি কোন সমস্যা নাই থাকে তাহলে এত আন্দোলনের পরেও খাবারের লেবেলে সেটা উল্লেখ করতে সমস্যা কোথায়?
– জীন প্রযুক্তির গাছ যেমন সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, সরিষার ডিএনএ তে ভিন্ন প্রাণির জীন ঢোকানো হয়, যেটা সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া থেকে নেয় হয়। মানুষের খাবারে এই প্রথম ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের উপাদান যুক্ত হলো।
– গবেষণাগারে ইঁদুরকে জিএম খাবার খাওয়ানোর পরে তাদের লিভার ছোট হয়ে যেতে দেখা গেছে। অপরদিকে জিএম সরিষার তেল খেয়ে ইঁদুরের লিভার ১২-১৬% বেড়ে গেছে।
– জিএম খাবারের সাথে শিশু মৃত্যু এবং প্রজননের সমস্যার সম্পর্ক আছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এমনিতে কেউ কিছু বলে না, কিন্তু ডাক্তাররা গর্ভবতী মায়েদের জিএম খাবার এড়িয়ে চলতে বলেন। সমাজের সচেতন মানুষদের দেখা যায় অর্গানিক খাবারের দোকান থেকে খাবার খাচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ইঁদুরকে গর্ভাবস্থায় জিএম সয়া খাওয়ানো হয়েছে তাদের বাচ্চারা তিন সপ্তাহের মধ্যে মারা গেছে। ছেলে ইঁদুরের যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
– ভারতে বিটি তুলার ক্ষেতে ঘাস খেয়ে হাজার হাজার ভেড়া, মহিষ, ছাগল মারা গেছে। বিটি দিয়ে মডিফায়েড শস্য খাওয়ার সাথে বন্ধ্যা হয়ে যাবারও সম্পর্ক আছে। আমেরিকায় বিটি তুলার কারণে শুয়োর এবং গরু বন্ধ্যা হবার রিপোর্ট আছে।
– সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হলো ঔষধের মত জিএমও খাবারের তেমন মূল্যায়ন হয় না। এরকম একমাত্র পরীক্ষায় দেখা গেছে জীন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপন্ন সয় থেকে ব্যাক্টেরিয়ার জীন আমাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াতে প্রবেশ করেছে এবং কাজ করে যাচ্ছে।এর মানে খাবার গ্রহণের অনেক পরেও জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল আমাদের শরীরে থেকে যাচ্ছে। এন্টিবায়োটিক জীন শরীরে পরিবাহিত হলে শরীর এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে যাবে। বিটি বিষ সৃষ্টিকারী জীন শরীরে গেলে আমাদের অন্ত্র কীটনাশক কারখানায় পরিণত হবে। প্রাণির উপরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে খাবার থেকে ডিএনএ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে এমনকী গর্ভস্থ শিশুর শরীরে পৌঁছাতে পারে।
– আরেকটা ব্যাপার হলো, কিছু মানুষের সরকারের উপর মারাত্মক ভরসা, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমেরিকাতে সরকার এবং কর্পোরেটের মধ্যে পার্থক্য নেই বলতে গেলে চলে। মনস্যান্টোর বিজ্ঞানীই হয়তো সরকারি অফিসে এসে জিএম ফুডের মূল্যায়ন করছে, তার উপরে এ দেশে লবিয়িং করা বৈধ।
জীন প্রযুক্তির জন্য দায়ী মূল কারণ হলো, কোন প্রাণিকে জীন প্রযুক্তি দিয়ে পরিবর্তন করা হলে কোম্পানীগুলো তার জন্য প্যাটেন্টের আবেদন করতে পারে। এটা তখন তাদের জন্য নতুন আবিষ্কার, পরিবর্তিত ঐ প্রাণি বা উদ্ভিদে তখন তাদের সত্ত্ব জন্মায়, এবং তারা এর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাজারজাত করে। এজন্য জিএমও কে অনেক সময় ঠাট্টা করে বলা হয় ‘genetically modified organization’।
গত চার দশক ধরে জীন প্রযুক্তির গবেষণায় প্রাণি এবং উদ্ভিদের জীনে কৃত্রিম কিছু পরিবর্তন এনে সেটাকে প্যাটেন্ট করে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো সেটার মালিকানা দাবী করে আসছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, আমেরিকাতে জীন প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিবর্তিত প্রাণের প্রথম প্যাটেন্টের সাথে এক বাঙালি জড়িত। ভদ্রলোকের নাম আনন্দ মোহন চক্রবর্তী, জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানির জীন বিজ্ঞানী। জিই কোম্পানির পক্ষে প্রাণসত্ত্বার প্যাটেন্ট নিয়ে তার করা বিখ্যাত মামলা ‘ডায়মন্ড বনাম চক্রবর্তী‘ নামে খ্যাত। ১৯৮০ সালে করা বহুল আলোচিত এ মামলার মাধ্যমে প্রথমবারের মত কোন প্রাণকে প্যাটেন্ট করে কোন মানুষ বা কর্পোরেশানের জন্য চিরস্থায়ীভাবে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
ডায়মন্ড বনাম চক্রবর্তী মামলার রায়ে মানুষ যেকোন প্রাণি বা উদ্ভিদকে কিছুটা পরিবর্তিত করে নিজের সম্পত্তিতে পরিণত করতে পারছে। যার ফলে বর্তমানে কৃষিজাত উদ্ভিদ এবং প্রাণির জীনে পরিবর্তন করে সেগুলো প্যাটেন্ট করার হিড়িক পড়ে গেছে। কোন প্রাণই ব্যবসা, মালিকানার বাইরে থাকবে না। ১৯৯৫ সালে ইওরোপ আমেরিকায় নিম গাছের প্যাটেন্ট করা হয়। নিম গাছ ঐতিহাসিক ভাবে ভারতে জন্মায়, ভারতের সংস্কৃতির সাথে এ গাছের নিবিড় সম্পর্ক। সেই নিম গাছ এবং গাছ থেকে উৎপাদিত দ্রব্য পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানী প্যাটেন্ট করে নিজেদের দখলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ভারত টানা দশবছর আইনী লড়াই চালিয়ে ২০০৫ সালে নিম গাছকে জীন-প্রযুক্তির বহুজাতিক থাবা থেকে মুক্ত করে।
জীন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাণের প্রকাশের উপর নির্বিচার অত্যাচারের কারনে বর্তমান বিশ্বে জীন প্রযুক্তির থাবা থেকে মুক্ত উদ্ভিদ অথবা প্রাণির সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। জীন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত ফসল এবং উৎপাদনের জন্য সার, কোম্পানি নির্দিষ্ট বীজ ও কীটনাশক প্রাণের প্রতি ভয়াবহ হুমকি। আমাদের লোভের কারণে সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ও নিরাপদ খাদ্য-শৃঙ্খল ধ্বংস হচ্ছে।
জীন প্রযুক্তির একটা বড় সমস্যা হলো এতে চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় কৃষকের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। কৃষককে প্রতিবছর কোম্পানীর কাছ থেকে বীজ কিনতে হবে, শস্যের জন্য নির্দিষ্ট আগাছানাশক, কীটনাশক কিনতে হবে। সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন গাছের পরিবেশের সাথে যেরকম অভিযোজন ক্ষমতা থাকে, জিএম গাছের সেটা থাকে না। আগাছানাশকও কয়েকবছরের মধ্যে কার্যকারিতা হারায় এবং ‘সুপার উইড’ এর জন্ম হয়।
এ প্রক্রিয়া থেকে বাঁচতে যারা জীন প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, গবেষক, তাদের উপর ভরসা করা যায় না। কারণ, রুটি রুজির সাথে কোন কিছু জড়িয়ে পড়লে মানুষ তা নিয়ে নিরপেক্ষ থাকতে পারে না, উদাহরণ, আনন্দমোহন চক্রবর্তী। শিক্ষিত মানুষেরাও নানা সংস্কার এবং ভয়-ভীতি থেকে চুপ থাকেন, ক্যারিয়ারে সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন।
অনেকে আবার এর মধ্যে বিজ্ঞানের অবারিত ‘উন্নয়ন’ মনে করে সমস্যাটা বুঝে উঠতে পারে না, বুঝলেও কোন অবস্থান নেয় না, প্রতিরোধ বা সমালোচনা করে না। কর্পোরেট উন্নয়নের জোয়ারের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে তারা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের উপর নির্ভর করতে চায়। অর্থাৎ, প্রকৃতিতে কোন কিছুই নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালো বা খারাপ নয়, খারাপের মাঝে ভালো লুকিয়ে আছে।
আশার কথা হলো, সমাজে এখনো একটা শ্রেনী আছে যারা জীন প্রযুক্তির বিষাক্ত খাবারের বিরুদ্ধে নিজেরা সচেতন, পাশাপাশি তারা জনসচেতনতাও বাড়াচ্ছেন। খাবারের জন্য নিজেরা সমিতি করে নিয়ে নিজেদের খাবার নিজেরা উৎপাদন করছেন, কোন বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের কৃত্রিম খাবারের উপর নির্ভর করছে না। খুব বেশিদিন হয়নি, কিন্তু জীন প্রযুক্তির বিষবৃক্ষের ফল ইতোমধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে। বাঁচতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে, জানার কোন বিকল্প নেই। জ্ঞানেরও বিষ আছে, জানাটা অনেক সময় আপসেটিং, কিন্তু এর উপশমের ক্ষমতা অনেক বেশি।
লিঙ্কঃ
https://billmoyers.com/segment/vandana-shiva-on-the-problem-with-genetically-modified-seeds/
http://www.risingbd.com/risingbd-special-news/79350
https://www.rt.com/news/monsanto-nepal-crops-maize-seeds-095/