১৫৬৪ বার পঠিত
নবম শতকের বাগদাদে খলীফা হারুন–অর–রশীদের দরবারে এক ভাঁড়ের সন্ধান মিলে, যার নাম ছিল বাহালুল আল মজনু বা বাহালুল পাগলা। কয়েক শতাব্দী যাবত তার পাগলামির খ্যাতি ছিল। তার নামে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, কোন কোন সংকলণে তাকে সাধু-সন্তুদের সাথে তুলনা করা হয়। দশম শতকে প্রকাশিত এক আরবী গল্প সংকলণে অন্যান্য পাগলদের (ওয়াইজ ফুল) সাথে বাহালুলের গল্পও স্থান পায়। গল্পগুলোতে বাহালুলকে বাগদাদ নগরীর গোরস্থানে, কুয়োর পাশে দেখা যেত, বাচ্চারা তাকে উত্যক্ত করতো। কিন্তু তার গল্প বলার দক্ষতা এবং ঐতিহ্য ও চারিত্রিক বিশ্লেষণে সবাই মুগ্ধ হতো। খলীফার সাথে তার প্রায়ই সাক্ষাত হতো এবং নির্মম সমালোচনার দ্বারা সে খলীফাকে সবসময় আক্রমন করতো, এমনকী একবার দরবারে খলীফার নির্বুদ্ধিতার প্রমান করে বাহালুল খলীফাকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। এতে দরবারের এক সভাসদ তাকে তিরষ্কার করলে বাহালুল তাকে বলে, তোমাদের মত লোক খলীফাকে নষ্ট করে ফেলছ, তোমাদের অবিরাম চাটুকারিতার কারণে খলীফা আসল সত্য জানতে পায় না। খলীফা বাহালুলের আচরণে ক্ষুন্ন না হয়ে তাকে বরং পুরষ্কৃত করতে চান কিন্তু বাহালুল ধর্মীয়/আধ্যাত্মিক কারণে তা নিতে অপারগতা জানায়।
একবার খলীফা তাকে কুফা নগরীতে সফরে নিয়ে যান, সেখানে তিনি বাহালুলকে কালো কাপড় আর লম্বা টুপিতে সজ্জিত হয়ে খলীফার জন্য প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেন। বাহালুল খলীফার নির্দেশ মেনে যথারীতি তার জন্য প্রার্থনা শুরু করে, কিন্তু মোনাজাতে সে উলটাপালটা বলতে শুরু করে যে, খলীফা টাকা ছাড়া আর কোন কিছুর কদর করে না। এতে কুফার গভর্নর তাকে প্রহার করে কিন্তু খলীফা কিছু না বলে শুধু হাসেন।
জীবিতকালে বাহালুল খুব উঁচুস্তরের সাধক হিসেবে খ্যাত ছিল কিন্তু মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তার সে পরিচিতি লোপ পায় এবং রাজসভার ভাঁড় হিসেবেই তার পরিচতি বাড়তে থাকে। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তাঁর বিখ্যাত ‘মোকাদ্দামা’ গ্রন্থে বাহালুলকে আধ্যাত্মিক সাধুরুপে বর্ণনা করেন। তার মতে বাহালুলের মত পাগলেরা তাদের মুখের কথা গায়েবী জগত থেকে এনে বলেন। এতে পাগলামির একটা দার্শনিক ব্যাখ্যাও তিনি দাঁড় করান। ই ডব্লিউ লেইন তার ‘এরাবিয়ান সোসাইটি ইন মিডল এইজেস’ বইতে পাগলদের বর্ণনা করেন যারা সমাজের চোখে সাধু হিসেবে সম্মানিত ছিল। তাদের লম্বা ঢিলেঢালা পোষাক, শতচ্ছিন্ন আলখাল্লা,গলায় মালা, ছেঁড়া পাগড়ী আর লাঠি দেখে চেনা যেত।
খলীফা একবার বাহালুলকে তার রাজ্যের সব মাথামোটাদের তালিকা করতে বলল। জবাবে বাহালুল জানাল, সেটা খুব সহজ কাজ হবে না, অনেকদিন লাগবে। তবে খলীফা যদি জ্ঞানী লোকদের তালিকা চান তাহলে সেটা দু’মিনিটে দেয়া সম্ভব।
আরেকবার খলীফা রহস্য করে বাহালুলকে তার রাজ্যের সকল ভাল্লুক,নেকড়ে, বানর এবং গাধাদের উপর রাজত্ব করার অধিকার দেন। বাহালুল তখন বলে, ‘এটা আমার জন্য অনেক বেশি হয়ে যাবে, খলীফার প্রজাদের উপর খবরদারী করার মতো উচ্চাকাঙ্খা আমার নেই।’
একদিন বাহালুল খলীফার দরবারে ঢুকে দেখল সিংহাসন খালি তাই সে খলীফার আসনে বসে দেখতে চাইল রাজসিংহাসনে বসলে কেমন লাগে। বাহালুলকে সিংহাসনে বসে খলীফা হারুনের মত অভিনয় করতে দেখে নিকটস্থ দারোয়ানেরা সব হইহই করে ছুটে আসল। তারা বাহালুলকে দ্রূত খলীফার আসন থেকে টানতে টানতে নামিয়ে এনে পেটাতে লাগল। বাহালুলের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে খলীফা সেখানে এসে হাজির হয়ে এর কারণ জানতে চাইলেন। বাহালুল তখন বলল, “আমি নিজের জন্য কাঁদছি না বরং খলীফার জন্য আমার করুণা হচ্ছে। কারণ আমি মাত্র পাঁচ মিনিট সিংহাসনে বসেছি তাতে ব্যথা-বেদনায় আমার শরীরে জ্বর এসে গেছে। আপনি তাহলে প্রতিদিন সিংহাসনে বসার জন্য কি পরিমান যন্ত্রনা সহ্য করেন সেটা ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছে।”
একসময় বাহালুলের মনমরা ভাব দেখে খলীফা তাকে বিয়েশাদি করে ঘর-সংসার পেতে থিতু হবার পরামর্শ দিলেন। বাহালুল খলীফার নির্দেশ মতো বিয়ে করল তারপরে বউ নিয়ে বাসায় ঢুকে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর সে বলল এরকম ভয়ংকর ঝামেলার কথা সে জীবনে শুনে নাই, এ কথা বলেই সে একবস্ত্রে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল, কয়েকমাসের জন্য নিরুদ্দেশ। ইতোমধ্যে বউটি বাহালুলের জন্য অপেক্ষা না করে তালাকের ব্যবস্থা করল। বাহালুলও সময় বুঝে আবার খলীফার দরবারে হাজির হলো। খলীফার প্রশ্নের মুখে বাহালুল জবাব দিল, আমার জায়গায় আপনি হলেও একই কাজ করতেন। ঝামেলার ভয়ে আমি পাহাড়ের ওপারে লুকিয়ে ছিলাম।
খলীফা জানতে চাইলেন, কিসের ঝামেলা?
বাহালুল বলল, আমার বউ যখন বাসায় তার রূমে ঢুকছিল তখন আমি তার কণ্ঠ থেকে অনেক শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এরমধ্যে কিছু কিছু আমি বুঝতে পারলাম, ভাড়া ! ডাক্তার! ছেলে! মেয়ে! স্কুল! পোষাক! সিল্ক! মসলিন! স্লিপার! টাকা! আরো টাকা! ঋণ! কারাগার! খলীফার হাম্মামে বাহালুলের ডুবে মরা! এসব সতর্কবাণী এবং খলীফার বাথটাবে ডুবে তা নোংরা করা থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমি বিপদ পার না হওয়া পর্যন্ত পালিয়ে বেড়ালাম। ঝামেলা থেকে উদ্ধার হবার পর আবার এসে হাজির হলাম, এখন আমার কোন ঋণ নাই, ডুবে মরার বাসনাও নাই।
বাহালুলই খলীফার দরবারে একমাত্র ভাঁড় ছিল না, অন্যদের মধ্যে যার নাম শোনা যায় সে হলো ইবনে ওয়াজ। তার নামে তেমন গল্প শোনা যায় না কিন্তু একটা গল্প চালু আছে যেটা বেশ মজার। খলীফা তার বেগমকে দরবারের শ্রেষ্ঠ রসিকতার প্রমান দেখিয়ে তাকে ইম্প্রেস করার জন্য ইবনে ওয়াজকে ডাকলেন। তাকে বলা হলো এমন একটা ওজর বের করতে যেটা মূল অপরাধের চেয়ে বেশি অপমানজনক। একথা শুনে ওয়াজ কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর সভা থেকে বেরিয়ে গেল। দরবারের সবাই ইবনে ওয়াজের অযোগ্যতা নিয়ে কানাঘুষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে খলীফা জোরে চিৎকার করে লাফ দিয়ে সিংহাসন থেকে নেমে কষ্টে মুখ বাঁকা করে দাঁড়িয়ে রইলেন। খলীফার কি হয়েছে বুঝতে না পেরে পুরো দরবার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আসলে হয়েছে কি ইবনে ওয়াজ দরবার থেকে বেরিয়ে সিংহাসনের পেছন দিয়ে এসে খলীফার পাছায় কষে এক চিমটি কাটে, খলীফার পশ্চাৎদেশে সেটা বর্শার মত বিধেঁ। রাগে ক্ষোভে খলীফা দুষ্কৃতিকারীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার নির্দেশ দেন। ইবনে ওয়াজ তখন রক্ষীদের থামতে ইশারা করে বলল, জাঁহাপনা আমার ওজর শুনুন, আমি ক্ষমা চেয়ে বলছি যখন আপনার পাছায় চিমটি কাটি আমি ভেবেছিলাম সেটা বোধ হয় বেগমসাহেবার পাছা। খলীফা হারূণ দেখতে পেলেন ওজর আসলেই মূল অপরাধের চেয়ে খারাপ, তখন অতিকষ্টে মুখে হাসি এনে সিংহাসনে বসার আগে বেগমকে বললেন, এ জোকস ভুলতে তার অনেক সময় লাগবে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন