১৬৪৬ বার পঠিত
ভারতীয় রাজসভার ভাঁড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হল বীরবল (১৫২৮–১৫৮৬)। সে ছিল উত্তর ভারতের এক গরীব ব্রাক্ষ্মণ লেখক, তার হাস্য–কৌতুকে দক্ষতা এবং চালাকি দিয়ে সে আকবরের রাজসভা মাতিয়ে রাখত। সম্রাট আকবরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে বীরবল মারাত্মক পরিস্থিতিতেও হাস্যরসের উদ্রেক করে সম্রাটের মনোরঞ্জন করত। সমগ্র ভারত জুড়ে নানা বই–পুস্তক, কমিক, এবং চিত্রের মাধ্যমে বীরবলের কাজ খ্যাতি লাভ করে। যদিও তার সব গল্পের সত্যতা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু আকবরের রাজসভায় বীরবলের গল্পের মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান কঠোর বর্ণপ্রথা এবং সম্রাটের ক্ষমতার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ ফুটে ওঠে।
বীরবল ছিল জাত জোকার, সে তার কথাবার্তা, চালচলনে, ব্যঙ্গ–বিদ্রুপের মাধ্যমে সম্রাট এবং সভাসদদে্র ত্রুটি তুলে ধরে তাদের চিত্তভার লঘু করার চেষ্টা করত। বীরবলের কৃতিত্ব ছিল সে সম্রাটের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি তাকে তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গী বলতে পারত। রাজ বিদূষকের পদ খুব নড়বড়ে, তাকে সবসময় সভাসদদের কোপানলে থাকতে হয়। কৌতুকের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে জীবননাশেরও সম্ভাবনা থাকে। বীরবল সম্রাটকে না ক্ষেপিয়ে তাকে নিয়ে কৌতুক করার কৌশল রপ্ত করেছিল। এক গল্পে আকবর বীরবলকে তার সভায় সেরা দশজন ভাঁড়কে আনতে বলল। বীরবল নিকটস্থ গ্রামে গেল, তারপর যখন ফিরে আসল তখন তার সাথে আরো আটজনকে দেখা গেল। সম্রাট জানতে চাইল বাকি দুজন কোথায়, জবাবে বীরবল বলল, নিঃসন্দেহে সে এবং সম্রাট মিলে মোট দশজন। নিজের এবং সম্রাটের বোকামির প্রতি নির্দেশ করে বীরবল ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকেদের মধ্যে হাস্যরস এবং বোকামির পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম ছিল।
আরেকটি বিখ্যাত গল্পে বীরবল সম্রাটকে দেখিয়েছিল সমগ্র ভারতের অধিকর্তা হলেও তার সকল ইচ্ছা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। আকবর তার সভায় ব্রাক্ষ্মণদের দেখত, এতে তার নিজেরও ব্রাক্ষ্মণ হবার সাধ হয়। শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতায় তার সন্তুষ্টি হচ্ছিল না, আধ্যাত্মিক জগতেও সে রাজত্ব করতে চেয়েছিল। বীরবলকে ডেকে সম্রাট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাকে ব্রাক্ষ্মণত্ব দিতে বললেন। কয়েকদিন পরে বীরবল সম্রাটকে বলল, সে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, কিন্তু সেটা হবে নিকটবর্তী একটা মন্দিরে। আকবর এবং বীরবল গ্রামের রাস্তা দিয়ে মন্দিরের দিকে যাচ্ছে, পথিমধ্যে তারা দেখতে পেল এক লোক তার ঘোড়াকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করাচ্ছে। আকবর তার কাছে জানতে চাইল সে কী করছে ? জবাবে লোকটি বলল, সে তার ঘোড়াটাকে একটা গাধা বানাতে চাচ্ছে। সম্রাট খুবই তাজ্জব হয়ে তাকে বলল, দুনিয়ার নিয়ম পালটানো যায় না, যে যেভাবে জন্ম নেয় তাকে সেভাবে থাকতে হয়, তারপক্ষে অন্যরূপ নেয়া সম্ভব নয়। আকবর যখন এটা বলছিল, তখন বীরবল মিটমিট করে হাসছিল, তখন সম্রাট বুঝতে পারে সবটা বীরবলের পূর্ব পরিকল্পিত সম্রাটকে একই শিক্ষা দিতে বীরবল এর আয়োজন করে।
একবার সম্রাট আকবর শিকারে বের হয়, তখন কৃষকেরা বীরবলের কাছে তাদের কৈফিয়ত জানায়। পরবর্তীতে আবার শিকারে বের হলে সম্রাট এবং বীরবল একটা গাছের নীচে বিশ্রাম করছিল এমন সময় গাছের উপরে পাখির কিচির–মিচির শুনে সম্রাট বীরবলের কাছে জানতে চান তারা কি বলাবলি করছে। বীরবল কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনে রাজাকে বলল, এক মেয়ে পাখীর বাবা ২৫ টি নষ্ট ফসলের ক্ষেত যৌতুক না নিয়ে তার মেয়েকে বিয়ে দিবে না। ছেলের বাবা বলছে, আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে সে ৩০ টি নষ্ট ফসলের ক্ষেত দিতে পারবে। সম্রাট কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে জানতে চাইল, এখন যদি ২৫ টি ক্ষেত না থাকে তাহলে সে কিভাবে কিছুদিনের মধ্যে ৩০ টি নষ্ট ফসলের ক্ষেত দিতে পারবে? বীরবল তখন আবার মনোযোগ দিয়ে পাখীদের কথা শোনার ভান করল। তারপর বলল, “খুবই সহজ, ছেলের বাবা বলছে সম্রাট খুব শিকার করতে পছন্দ করেন। শিকারের সময় মাঠের মধ্য দিয়ে তারা পশুদের তাড়া করেন, এতে ইতোমধ্যে অনেক ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। সম্রাট শিকার না থামালে শীঘ্রই আরো অনেক ক্ষেত নষ্ট হবে।” শুনে সম্রাট আকবর খুব ব্যথিত হলেন, তিনি বললেন, “ আমি এটা মোটেই ভাবিনি, কেবল নিজের আনন্দের কথাই ভাবছিলাম, আর কখনো মাঠের মধ্য দিয়ে শিকারে যাব না।”
বীরবলের কিংবদন্তী তুল্য খ্যাতির অন্যতম কারণ হাস্য–কৌতুকের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন নিয়ম নীতির অসামঞ্জস্য তুলে ধরায় তার অসামান্য দক্ষতা। কৌতুকের মাধ্যমে সে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত, ক্ষমতাবানের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিত এবং সামাজিক সাম্যের পক্ষে দাঁড়াত। সে ছিল ছদ্মবেশ ধরায় ওস্তাদ, তার চেহারা, গলার স্বর এবং দেহভঙ্গী পরিবর্তন করে সে রাজা এবং সভাসদদের ফাঁকি দিত। এক গল্পে সম্রাট আকবর দেশের সেরা কবিদের তার সভায় আমন্ত্রণ জানালেন, কবিদের মধ্যে যে জয়ী হবে তাকে অনেক এনাম দেয়া হবে। বীরবল দেখতে পেল কবিরা সভায় আসার সময় এক দ্বাররক্ষী তাদের কাছ থেকে উৎকোচ দাবী করছে। দারোয়ানের কূকীর্তি ফাঁস করতে বীরবল কবির ছদ্মবেশ নিয়ে সভায় প্রবেশ করতে যায়। দারোয়ান তার কাছে ঘুষ চাইলে সে বলে তার কাছে তেমন কিছু নেই তবে সম্রাট তাকে যা দিবে তার সব সে দারোয়ানকে দিবে। দারোয়ান তাতে রাজী হয়ে তাকে যেতে দেয়। তারপর সম্রাট আকবর এবং সভাসদদের সে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়। সম্রাট খুশী হয়ে তাকে যা চাইবে তা দেবার অঙ্গীকার করেন। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বীরবল তার পুরষ্কার হিসেবে ১০০ চাবুক দাবী করেন। সম্রাট এতে খুবই তাজ্জব বনে যান কিন্তু তারপরেও রাজী হন। দারোয়ান যখন শুনতে পায় বীরবল প্রতিযোগীতায় জিতেছে, তখন সে সম্রাটকে বলে এই কবি তার সব পুরষ্কার তাকে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছে। দারোয়ানকে তখন তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শীঘ্রই বুঝতে পারে সে বীরবলের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে।
আকবর বীরবলের সঙ্গ, তার বুদ্ধিমত্তা, কৌতুক খুব পছন্দ করতেন এবং বেশির ভাগ সময়ই সম্রাট তার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। আকবের সাথে তার জীবনের শেষভাগে এসে বীরবল উত্তর–পশ্চিম ভারতের এক যুদ্ধে যান। কয়েক সপ্তাহ পরে সম্রাটের কাছে যুদ্ধে বীরবলের মৃত্যুর খবর আসে। প্রিয় সঙ্গীর মৃত্যুশোকে সম্রাট কিছুদিনের জন্য নাওয়া–খাওয়া ভুলে যান। বীরবলের সম্মানার্থে তিনি লিখেন, “ যখন আমি বিষাদগ্রস্ত হতাম, বীরবল আমাকে আরো দুঃখ দেয়া ছাড়া সবই দিত। আর এখন সে আমাকে দুঃখ দিচ্ছে। তাই এটা কখনো বলা যাবে না যে বীরবল আমাকে সব দেয়নি”। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরবলের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি, অনেকে তাই বিশ্বাস করেন সে গোপাল নাম ধারন করে বাংলায় চলে যান। গোপালের গল্পের সাথে বীরবলের গল্পের অস্বাভাবিক মিল থেকে এ ধারণার উৎপত্তি। যদিও এ ধরণের কোন সংযোগ কখনো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি, তবুও অনেক ভারতীয় বিশ্বাস করেন বীরবল এবং গোপাল একই লোক ছিল।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন