০
৬৬৯ বার পঠিত
প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের একটা অংশ এবার বিসিএসে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। মুশকিল হলো যে আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে এমন ব্যাপারটি ঘটে, তা বিশ্বের কোথাও ঘটে না। অর্থাৎ বিশ্বের কোথাও প্রকৌশলী বা চিকিৎসকরা সাধারণত পেশা বদল করতে চান না। এই দেশে কেনো চান, সেই কথা বলি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি। পুলিশের একজন কর্মকর্তা গেছেন একজন চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক পদবীতে একজন সহযোগি অধ্যাপক। অবস্থানে বেচারি চিকিৎসক সেই পুলিশ কর্মকর্তার থেকে এগিয়ে থাকলেও, সব রোগীদের বাদ দিয়ে সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে আগে দেখতে হয়েছে তাকে। সাথে চা-বিস্কুট দিয়েও সমাদর করতে হয়েছে। কারণ অবস্থানে এগিয়ে থাকলেও ক্ষমতায় ঠুঁটো জগন্নাথ। চিকিৎসক কাউকে ধরে-বেঁধে নিয়ে আসতে পারবেন না, যা ওই পুলিশ কর্মকর্তা পারবেন।
অনেক দিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার ‘স্যার সিনড্রম’ নিয়ে লিখছি। এ ভূখন্ডের মানুষদের মনে শাসন করার একটি গোপন ইচ্ছা লুকিয়ে থাকে। এর কারণ হলো দাস মানসিকতা। বিশেষ করে এদেশের সাধারণ মানুষ সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত শাসিত এবং শোষিত তথা অত্যাচারিত হয়ে আসছেন। রাজার পাইক-বরকন্দাজ, জমিদারের পেয়াদা, হালের কথাতো সবার জানা। এদের অত্যাচার সয়েই বড় হয়েছেন এ ভূখন্ডের সিংহভাগ মানুষ। তারা দেখেছেন ক্ষমতার জোর। তাদের চিন্তায় গেড়ে বসেছে মানুষের জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকার স্থায়ী চিত্র। ফলে তারা চেতনে-অবচেতনে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন ক্ষমতাবান হবার, পূজো করেছেন ক্ষমতার। ‘ক্যাডার’ হবার চিন্তার শুরুটা এভাবেই।
প্রকৌশলী বা চিকিৎসক হলে সেই জাদুদন্ড পাবার সম্ভাবনা নেই। প্রকৌশলীদের সমঝোতা না করলেন মার খেতে হয়। সমঝোতা করলে ঘুষ খেতে হয়। দুটোই খেতে হয় ক্ষমতাবান ঠিকাদারদের হাতে। একজন মেধাবী হিসাবে পড়াশোনার সর্বোচ্চ স্তর পেরিয়ে যখন মেধা যোগ্যতায় তার থেকে নিচু কারো কাছে নিগৃহিত হতে হয়, তখন স্বভাবতেই নিজের যোগ্যতার উপর ক্ষোভ আর ঘৃণা জন্মে। শিক্ষা আর মেধাকে তার কাছে অর্থহীন মনে হয়, সফল মনে হয় সেই ঠিকাদারকে যারা অন্য অর্থে ‘ক্যাডার’ও। মনে হয় জাদুদন্ডটা সেই ঠিকাদারদের হাতে। মনে হয় তারা ক্ষমতারও ঠিকা নিয়েছেন!
একজন চিকিৎসক যখন চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে রোগীর স্বজনদের হাতে মার খেয়ে মারা যান, তখন অন্য চিকিৎসকরা নিজেদের হাত কামড়ান ক্ষোভে যন্ত্রণায়। কদিন আগেই ঘটেছে এমন ঘটনা। আমার ময়মনসিংহের একজন নারী চিকিৎসক করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজে সংক্রমিত হলেন। এলাকার ‘ক্যাডার’রা তাকে তার ভাড়া বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করলো। এবার তিনি বিসিএসে জায়গা পেয়েছেন। সামাজিকমাধ্যমে একজন মন্তব্য করলেন, ‘এখন উনি ম্যাজিস্ট্রেট এখন তাকে বাড়ি থেকে বের করতে যান দেখি কার কত ক্ষমতা।’ এটাই হালের রিয়েলিটি, বাস্তবতা।
তবে যে ক্ষমতার ‘ম্যাজিক স্টিক’ পাবার ইচ্ছা সবার মনের মধ্যেই থাকে। রাজনীতি সেই জাদুদন্ড পাবার সবচেয়ে সহজতম পথ। রাজনীতির মাধ্যমেই ম্যাজিকের সর্বোচ্চ স্টিকটা পাওয়া সম্ভব। উপরে যে ঠিকাদার বা রোগীর আত্মীয়স্বজনদের কথা বললাম তাদের সবার হাতেই ছোট হোক বড় হোক যে কেনো একটা সাইজের ‘ম্যাজিক স্টিক’ রয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া আলোচিত ঠিকাদার শামীমের কথাই ধরুণ। হাজার কোটি টাকার সাথে তার ছিলো প্রচন্ড ক্ষমতা। সাত জন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী থাকতো তার সাথে। অতীতের জমিদারদের মতন চালচলন ছিলো তার। অথচ শিক্ষা-দীক্ষায় একজন প্রকৌশলীর ধারে-কাছে তিনি নন। তাকেই তোয়াজ করে চলতেন প্রকৌশলীরা। টাকা আর ক্ষমতার ‘ম্যাজিক স্টিক’ দিয়ে সেই সব প্রকৌশলীদের নত রেখেছিলেন শামীম।
‘ম্যাজিক স্টিক’ পাবার ইচ্ছা সবার মনেই থাকে। যেমন অবসরপ্রাপ্ত ‘ক্যাডার’রা শেষ বয়সে এসে রাজনীতি ঢুকে যান। সংসদ সদস্য বনে যান। এমন নজির অসংখ্য রয়েছে। অর্থাৎ অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা আর প্রাপ্তির বাসনা এখানেও রয়েছে। প্রকৌশলী আর চিকিৎসকরা জাদুদন্ড পাবার জন্য ‘ক্যাডার’ হন। আর ‘ক্যাডার’রা আরো বড় ‘ক্যাডার’ হবার জন্য রাজনীতিবিদ হন। এই ‘ক্যাডার’ হলো সর্বোচ্চ, একরকমের মহীরূহ। ‘পাওয়ার এন্ড মানি প্ল্যান্ট’। এদের কাছে প্রশাসনিক ‘ক্যাডার’রাও নস্যি। মনের সুপ্ত বাসনার সবচেয়ে প্রকাশ্য রূপ হলো এই ‘পাওয়ার এন্ড মানি প্ল্যান্ট’।
তারপরেও কথা থেকে যায়। প্রশ্ন উঠে। জানতে মন চায়, যদি বিসিএস এর রাস্তায় পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশেই যেতে হয় তবে প্রকৌশল বা চিকিৎসা বিদ্যা শেখা কেনো! এরচেয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়লেই তো হতো। বাবা-মা’র কষ্ট আর খরচ দুটোই কমে যেতো। রাষ্ট্রের কাজ করার মনস্থ করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানই তো ভালো ছিলো।
তবে কি মানুষ গাছ হতে চায়? ‘পাওয়ার এন্ড মানি প্ল্যান্ট’? যে গাছের পাতাগুলো হয় টাকা, ফল ক্ষমতা। জানি না, এর উত্তর কার কাছে আছে।
পুনশ্চ: এ লেখা মূলত এক ধরণের প্রশ্নোত্তর বিষয়ক। দ্বন্দ্বের উত্তর খোঁজা। এছাড়া অন্য কোনো চিন্তা এতে নেই। জানি, রাজনীতিতে শুধু ‘পাওয়ার এন্ড মানি প্ল্যান্ট’ নয় ছায়াবৃক্ষও আছেন। যারা ছায়া দিয়ে রেখেছেন অতীতে। এখনকারও কেউ কেউ রাখেন, নিদেনপক্ষে রাখার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ অপারগতায় বাধ্য হয়েই হাত গুটিয়ে নেন। সবে ক্ষেত্রেই এমন মানুষেরা রয়েছেন। শঙ্কার কথা হলো এমন মানুষের সংখ্যা কমছে ক্রমাগত। সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব বাড়ছে নানা প্রশ্নে। এই পেশাবদলও তার একটি বড় প্রশ্ন। সেই দ্বন্দ্ব আর প্রশ্ন নিয়েই এ লেখা। এ নিয়ে বাড়তি ভাবার অবকাশ নেই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন