০
৭৯৩ বার পঠিত
পৃথিবীর কোন ধর্মই তার আশ্রিত মানুষকে তাদের জীবনধারা ও আচরণকে বিশুদ্ধ হয়ে উঠতে দিবে না, যদি তা সেই ধর্মশাস্ত্রের বিধানকে অতিক্রম করে। সব ধর্মের প্রবক্তারাই চায় তার ধর্মাশ্রিত মানুষজন বিশুদ্ধ শাস্ত্রনির্ভর হয়ে জীবনযাপন করুক।
২.
এক ধর্মের শাস্ত্র প্রণীত বা নির্দেশিত বিধিবিধান ও সদাচার বেশিরভাগ সময়ই অন্য ধর্মের শাস্ত্রবিধি ও সদাচার পরিপন্থী। প্রত্যেকটি ধর্মের ধর্মগ্রন্থে পরস্পরবিরোধী সদাচার পালনের নির্দেশ বিদ্যমান। আর এ কারণেই ধর্মাশ্রিত সদাচার নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসী মানুষজনদের মধ্যে মতভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তাই পৃথিবীতে ‘বিশুদ্ধ ধর্ম‘, ‘আসল ধর্ম‘ কিংবা ‘নকল ধর্ম‘ বিষয়ক যাবতীয় ধারনা মানুষের কল্পনাশ্রিত মিথমাত্র।
৩.
যে মানুষ তার নিজ নিজ ধর্মশাস্ত্রের বিধিবিধান ও সদাচার অনুসরণ করে জীবন-যাপন করে থাকেন তিনিই ধার্মিক। যে মানুষ তা অনুসরণ করেন না, তাকে ধার্মিক বলা যায় না। ধার্মিকদের ভাষায় ওই ব্যক্তি ‘অশুদ্ধ’ কিংবা ‘বিশুদ্ধ নয়’ হিসেবে পরিগণিত।
৪.
যে মানুষ তার ‘নিজের‘ ধর্মশাস্ত্রের বিধিবিধান কেবল অস্বীকারই করে না, সেই ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও অনাচার নিয়েও আলোচনা করে সেই মানুষ ধর্মাশ্রয়ী সমাজের জন্য ‘ক্ষতিকর‘ হিসেবে পরিগণিত। ফলে ধর্মাশ্রয়ী সমাজের নিয়ন্ত্রকরা ওই মানুষকে সমাজচ্যুত কিংবা জীবনচ্যুত করার সংকল্প করে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সবরকম কৌশল প্রয়োগ করে।
৫.
প্রত্যেক ধর্মেই নিজ নিজ উপাসনাস্থল বিদ্যমান, যাকে তারা ‘পবিত্র‘জ্ঞান করে। এবং প্রত্যেকটি ধর্মেই তার নিজ নিজ ধর্মশাস্ত্রের বিধিবিধান ও সদাচার সুরক্ষার জন্য একজন ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) থাকে। ধর্মশাস্ত্রের এইসব ম্যানেজার হলো নিজ নিজ ধর্মের ঈমাম, মৌলানা, পুরোহিত, পাদ্রি, যাজক প্রভৃতি। এরা সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষজনের বোঝার জন্য ধর্মশাস্ত্রের ‘ধারাভাষ্য‘ রচনা করেন। সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষজনকে ধর্মশাস্ত্রের বিধিবিধান ও সদাচারগুলো বুঝিয়ে দেন। এক কথায় এই ম্যানেজাররা নিজ নিজ ধর্মের শাস্ত্রগুলোর সুরক্ষা করেন।
৬.
কোন ধর্মেই জাগতিক এইসব ধর্মীয় ম্যানেজারদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করা না থাকলেও বস্তুতপক্ষে এরাই ধর্মাশ্রয়ী সংগঠন (নিজ নিজ ধর্ম) পরিচালনা করেন। যার কারণে প্রত্যেকটি ধর্মেরই একটি সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। এবং প্রত্যেকটি ধর্মশাস্ত্রের মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক কাঠামো বা আদর্শ বাস্তবায়নের আবছা ইংগিত রয়েছে। ধর্মের ম্যানেজাররা সমসাময়িক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপরে নির্ভর করে এইসব আবছা ইংগিতকে স্পষ্টীকরণ, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে থাকে।
৭.
যদি ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক কাঠামো না থাকতো তাহলে পৃথিবীতে এতো এতো ধর্মাশ্রয়ী সমাজ ও গোষ্ঠীর জন্ম হতো না। প্রত্যেকটি মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, সে মানুষের আচরণ ও কর্মকাণ্ড তার নিজ ব্যক্তি পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকতো। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাশ্রয়ের কারণেই মানুষ তার সমগোত্রীয়দের সংগঠিত করে বিশ্বব্যাপী তৈরি করে নানানরকম মানবগোষ্ঠী। কেবলমাত্র ধর্মের পরিচয়েই এই মানবগোষ্ঠীর সবকিছু পরিচিত হয়।
৮.
ধর্মাশ্রয়ী এইসব মানুষরা যখন কোন একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে তখন সেই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রকদের নিকট তারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা ও পুষ্টিবর্ধনের কাজে ওইসব ধর্মাশ্রয়ী মানুষ ব্যবহৃত হয়। আর রাজনৈতিক বলয়ের সংস্পর্শে থাকা ধর্মাশ্রয়ী মানুষদের ক্ষমতাও অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। কোন মানুষের সাথে সামান্যতম মতবিরোধ ঘটলে ধর্মরক্ষা, অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত কিংবা অন্যান্য নানান অজুহাতে সেই মানুষকে নিশ্চিহ্ন করা তার অধিকারের মধ্যে পড়ে। যে কারণে সেই ভূখণ্ডের আইন-আদালত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রকাঠামোর কোন স্তরেই ধর্মাশ্রিত মানুষের বিপরীতে কেউ ন্যায্যতা পায় না।
৯.
সৃষ্টিশীল ও চিন্তাশীল মানুষমাত্রই সমাজের ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী‘।
কোন সমাজ? যে সমাজ ধর্মাশ্রয়ী। আর সৃষ্টিশীল মানুষ কখনোই পারলৌকিক জীবনের স্বপ্নে বিভোর নয় বলেই সে সহজেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে জীবন বিসর্জন দিতে চায় না, সে বাঁচতে চায়। তাই বাঁচার তাগিদেই তখন সে হয় পলায়নপর, বাস্তুচ্যুত ও দেশত্যাগী। চিন্তাশীল মানুষের যেমন নির্দিষ্ট কোন ধর্ম নেই, তেমনি নেই তার কোন দেশ। প্রত্যেকটি চিন্তাশীল মানুষই এই পৃথিবীতে এক একজন উদ্বাস্তু।
১০.
ফলে- ধর্মের ম্যানেজার ও ধর্মাশ্রয়ীরা তাদের ভূখণ্ডে ‘মানুষ‘ ও বিপরীত চিন্তার সৃষ্টিশীলরা ‘অমানুষ‘ বলে পরিচিত।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন