(প্রিয় পাঠকবৃন্দ, শিরোনামটির জন্য পূবাহ্নেই ক্ষমা চাইছি। আসলে সব ধর্ষণই সমান ঘৃণ্য, অপরাধ, মানবাত্মার অপমান। সমান নয় আমাদের মনন, আমাদের বোধ। সেই বোধের সন্ধানই এই লেখাটির প্রয়াস)
টেলিভিশনে, খবরের কাগজে রোজই ধর্ষণের খবর বেরোয়। কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব পায় না। কাগজের ভিতরের পাতায় এক কোনায় ঠাঁই পায়। আর গুরুত্ব পাবেই বা কোনো, ধর্ষণ আমাদের দেশে এখন আর কোনো খবর নয়, নৈমিত্তিক ঘটনা। ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রেকর্ড অনুযায়ী প্রতি বছর ভারতবর্ষে নথিভূক্ত ধর্ষণের সংখ্যা ৩৪৬৫১ এবং যৌন আক্রমণের সংখ্যা ১৩০১৯৫।
তার মানে যতক্ষণ এই লেখাটি পড়ছেন ততক্ষণে আমাদের দেশে অন্তত একটি ধর্ষণ হয়ে গেছে, ততক্ষণে আমাদের দেশে অন্তত চার জন মহিলার উপর যৌন নির্যাতন সংগঠিত হয়ে গিয়েছে। এই হিসেবটা কিন্তু খণ্ডিত। কারণ যত ঘটনা ঘটে তার অনেকটাই পুলিশে অভিযোগ পর্যন্ত পৌঁছায় না, পৌঁছলেও নথিভূক্ত হয় না। নথিভূক্ত হলেও ঘুষ, হুমকি, অত্যাচারে বিচারের চৌকাঠ পেরোয় না। কত শত অশ্রু, ঘৃণা, ক্ষোভ, ক্রোধ, বেদনা, আত্মহত্যা আমাদের চোখের আড়ালে, বোধে বিন্দুমাত্র ছাপ না ফেলে ঘটে যাচ্ছে, তার খবর কে রাখে।
এর মধ্যেও কিছু খবর কাগজের শিরোনাম হয়, প্রতিবাদী জনতার রোষ রাজপথে আছড়ে পড়ে, মানুষ সহমর্মী, সহযোগী হয়। প্রশাসন বিচার ব্যবস্থা নড়েচড়ে বসে। এখন মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কী এমন ব্যাপার যাতে কিছু ঘটনায় জনসাধারণ আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে, নিরাপদ গৃহকোণ ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। আবার কিছু ঘটনায় একেবারে নিস্পৃহ খোলোশে নিজেদের গুটিয়ে নেয় যেন কিছুই হয় নি। সাধারণ মানুষের এই অদ্ভুত আচরণ কেন?
আসুন আমরা ঘুরে আসি সমাজ মননের সেই গলি ঘুঁজিতে। এই আপাত দ্বিচারিতায় খণ্ডিত সমাজ জীবনে। দেখি এ রহস্যের সুলুক সন্ধান করে ভেদ করতে পারি কীনা।
২।
এ বিষয়ে লেখা শুরুর পর বন্ধুদের কাছ থেকে যে মতামতগুলো পেয়েছি তাতে তারা ধর্ষণের কারণ এবং সমাজ থেকে কীভাবে এই মানবতাবিরোধী বর্বর কাজ দূর হবে তা নিয়ে তাদের ক্ষোভ হতাশা ব্যক্ত করেছেন। যে কোনো অনুভবী মানুষের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার এখানে লেখার বিষয়বস্তু ভিন্ন। আমি এখানে সমাজে প্রতিদিন ঘটে চলা অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে জন সাধারণের দু’একটি ঘটনায় অতি সংবেদনশীলতা অতি সক্রিয়তা, আবার বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে অতি উদাসীনতা, এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি।
আপনারা যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত তা অতি সঙ্গত। আমিও তার বাইরে নই। আপনাদের কথা দিচ্ছি এ বিষয়ে আমার মতামত ও বিশ্লেষণ অবশ্যই শীঘ্র আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো। এবং বর্তমান লেখাটিও তার সহায়ক হবে।
যে সমাজে আমরা আছি:
আর দশটা অপরাধের মতই ধর্ষণ নিছক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একক বা কয়েকজন ব্যক্তির ঘটা অপরাধ নয়। এটি সমাজ থেকে উদ্ভূত সামাজিক অপরাধ। বরং খুন জখম ডাকাতির চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক অপরাধ, তা আমরা পরে কয়েকটা কেস স্টাডিতে দেখবো। এখন যখন এটা একটা সামাজিক অপরাধ, তাই যে সমাজে তা সংগঠিত হচ্ছে তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে আছেন বড় বড় শিল্পের মালিক, তা সে উৎপাদন বা পরিষেবা যাই হোক না কেন। তারা জনসংখ্যায় খুব কম কিন্তু দেশের বেশিরভাগ সম্পদই তাদের হাতে। এরাও সকলে সমান সম্পদশালী নন বা প্রভাব প্রতিপত্তিতে সম স্তরের নন। তবুও এরা সামাজিকভাবে সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। মানুষ খবরের কাগজে এদের খোঁজ খবর পেয়ে কৌতূহল নিবৃত্তি করে।
সমাজের একেবারে নিচের তলায় থাকে কোটি কোটি গরিবের দল।
এদেরও নানা স্তর বিন্যাস। কেউ ফুটপাথবাসী ভিখারি, তো কেউ অরণ্যচারী পিঁপড়ের ডিম খেয়ে কোনোমতে জীবন ধারণ করেন। কেউ বাসের খালাসী কেউ চাষের দিন মজুর। কেউ রেল হকার তো কেউ ঠেলাওয়ালা। মুটে, জোগালে, রিকশা ভ্যানচালক, জেলে, কুমোর, কত বৃত্তিতেই না এরা আছেন। এদের বেশিরভাগ মানুষই আদিবাসী জনজাতি দলিত। ভারতবর্ষের সিংহভাগ মানুষই এরা। এদের সঙ্গে সমাজের উচ্চ কোটির মানুষের কোনো যোগ নেই, উভয় তরফেই।
আর এদের মধ্যবর্তী স্তরে আছেন মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী। ভারতে এই শ্রেণিটার জন্ম বেশি দিনের নয়। এই দেড়শো দুশো বছর। ডাক্তার উকিল অধ্যাপক শিক্ষক, বড় চাষি, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, আমলা, পলেটিশিয়ান, ছোটো মাঝারি ব্যবসায়ী, সাংবাদিক , সরকারি চাকুরে, ইনজিনিয়ার, এরকম হরেক পেশায় নিযুক্ত এরা। ভারতবর্ষে এরাও বিপুল সংখ্যায়, বিশ পঁচিশ কোটি তো হবেই । এবং এটা ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। এই যে এখানে যারা লিখেছেন বা যারা পড়ছেন তারা মূলত এই স্তরের বাসিন্দা। মধ্যবর্তী স্তরে থাকার জন্যে সমাজের উঁচু আর নীচু দুই স্তরেই এদের মিশতে হয়। উঁচুর লোকেরা মূলত এদের দ্বারাই তাদের সাম্রাজ্য রচনা করেন। কারখানার ম্যানেজার থেকে সুপারভাইজার এরাই, প্লেনের পাইলট থেকে বিমানবালা, হাসপাতালের ডাক্তার থেকে ম্যানেজার, ব্যাঙ্কার থেকে কেরানি, সব এরাই।
আবার মজার কথা, মালিকদের ব্যবসার মূল উপভোক্তা আবার এই মধ্যবিত্তরাই। এরাই প্লেনে চাপেন, বিলাস দ্রব্য কেনেন, ব্যাঙ্কে টাকা রাখেন, ফ্ল্যাট কেনেন, গাড়ি, প্রচুর প্যাকেটজাত খাবার কেনেন। মোদ্দা কথা ভারতের একশো কোটি গরীব মিলে যত না পণ্য কেনেন তার চেয়ে ঢের বেশি কেনে কুড়ি কোটি মধ্যবিত্ত।
উত্তমের যদিও অধমের সংস্পর্শে আসতে হয় না, মধ্যমের কিন্তু আসতেই হয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
মধ্যবিত্ত ফুটপাত থেকে সবজি কেনে, বাসে মেট্রোয় ওঠেন, ‘কাজের মাসি’র সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই হয়, কখনো ফ্ল্যাটের গার্ডের সাহায্যের দরকার হয়। এমনকী পরিষেবা পেতে মধ্যবিত্ত গরিবকে বাবা বাছা করছে, এ দৃশ্যও বিরল নয়। অর্থাৎ কাছে আসতেই হচ্ছে। এবং এর ফলে কিছু সাংস্কৃতিক আদান প্রদানও ঘটছে।
উল্টো দিক থেকে গরিব মধ্যবিত্তের জীবনটাকে তার স্বপ্ন বলে ধরে নেয়, এবং ওই জীবনকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। আমি নিজে দেখেছি, গরিব মানুষেরা সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে মধ্যবিত্তের মতকে খুবই অনুসরণ করে।
আবার এই মধ্যবিত্তেরা সমাজে খুব উচ্চকণ্ঠ এবং সুবিধাভোগী। এরা চাষি ফসলের দাম না পেলে চুপ করে থাকে, কিন্তু নিজেদের স্বার্থ বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন হলে চেঁচিয়ে বাজার মাত করে। এরা নিজেদের সাধারণ মানুষ বলে চিহ্নিত করে, নিজেদের দাবিগুলোকে আম জনতার দাবি হিসাবে প্রতিস্থাপিত করে। আর সংবাদ মাধ্যম, আদালত, সংসদ, বিধানসভা, প্রশাসন, সর্বত্র এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় জোরে মহা সংকীর্তন শুরু করতে পারে। সরকার বাহাদুরও এদের দাবিগুলো প্রায়শই মেনে নেয়। আর হ্যাঁ, স্বীকার করতে কোনো বাধা নেই; অবস্থানগত ভাবে আমিও এই শ্রেণিতেই পড়ি।
এই যে বিন্যাসটি আমি করলাম তা একান্তই আলোচনার সুবিধার্থে। এতে কূটতর্ক করার সুযোগ অনেক আছে। আর আমাদের সমাজটাও গাছের লাউ নয় যে কেটে সমান তিনটে টুকরো করে দিলাম। এর মধ্যে ধূসর এরিয়া অনেক আছে, সেসব প্রশ্ন স্বতন্ত্র ।
আর একটা কথা, সবকটা শ্রেণি বিন্যাসেই মেয়েদেরকে আলাদা করে পিছনে এবং পীড়নে রাখা হয়, এটা গোটা আলোচনাতেই মাথায় রাখতে হবে।
এখন প্রশ্ন, ধান ভানতে শিবের গীত কেনো? হচ্ছে ধর্ষণের কথা, সমাজ নিয়ে এতো কচকচি কেনো? সেটাই বলতে চাইছি। প্রেক্ষাপট না উল্লেখ করলে আসল আলোচনাটা করা যায় না।
৩।
প্রশ্ন উঠে, প্রতিদিন এতো ধর্ষণের ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পরও মানুষ উদাসীন ও নিশ্চুপ থাকে কেনো? আবার কোনো কোনো ঘটনায় মানুষের স্বতস্ফূর্ত ক্ষোভ ফেটে পড়তে দেখি কেনো? কোনো কোনো বন্ধু এর কারণ হিসেবে ঘটনার নৃসংশতার মাত্রাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার বাস্তবতা কতটুকু আমরা পরে দেখবো।
এখানে আর্থ সামাজিক ভাবে ভারতের মানুষের একটা সংক্ষিপ্ত স্তর বিন্যাস করার চেষ্টা করছি।
জাতীয় ক্রাইম ব্যুরোর রেকর্ড অনুযায়ী আমরা জানি ভারতবর্ষে প্রতিদিন গড়ে একশোটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে (বাস্তবে সংখ্যাটি অনেক বেশি)। এখন প্রশ্ন হলো আমাদের দেশের এই বিরাট সংখ্যক অপরাধের অসহায় শিকার, তারা কোন শ্রেণির মানুষ? আমার কাছে এই মুহুর্তে সঠিক পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু আমি নিশ্চিত এদের নব্বই শতাংশের বেশি সমাজের আর্থিকভাবে সবচেয়ে পিছনের সারিতে থাকা মহিলারা। আরও সুচিহ্নিত ভাবে বললে আদিবাসী, দলিত, জনজাতি মহিলা।
আর এই ছবি শুধু আজকের নয়। চার হাজার বছর ধরে এই অসভ্য অত্যাচার চলে আসছে। শূদ্রকে অস্পৃশ্য অশুচি চিহ্নিত করে শূদ্রাণী ভোগে অতি তৎপর। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য যদি শূদ্রাণীকে ধর্ষণ করে তাহলে শাস্তি নামমাত্র অর্থদণ্ড। এখানকার খাপ পঞ্চায়েতে যেমন কিছু টাকার বিনিময়ে মিটিয়ে নেওয়ার বিধান দেওয়া হয়।
আর শূদ্র যদি অপর তিন বর্ণের মহিলাকে ধর্ষণ করে তাহলে একমাত্র শাস্তি প্রাণদণ্ড। প্রাচীন স্মৃতি শাস্ত্রে এই বিধান মেলে ভুরি ভুরি। একেবারে ক্রীতদাসীদের মতো দাসীদের হস্তান্তর করা হতো। স্বয়ং রামচন্দ্রও তার বিয়েতে কয়েকশো দাসী উপহার পেয়েছিলেন।
তারপর ভারতবর্ষে বহু পরিবর্তন হয়েছে । এখন ইসরোর মুহুর্মুহু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের যুগ। কিন্তু আজও আদিবাসীরা থাকেন জঙ্গলে আর পাহাড়ে। আজও দলিতেরা থাকেন নগরের প্রান্তে ঝুপড়ি বস্তিতে কিংবা গ্রামের বাইরের প্রান্তরে। তথাকথিত উন্নয়নের চাঁদমারিতে অবস্থা সেদিনকারের চেয়েও ভয়াবহ। প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় আদিবাসী দলিত নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছেন, সে খবর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত ভারতবর্ষের জানাই নেই। এই ধর্ষণ সবসময়ই যে কামুক পুরুষের পৈশাচিক অপরাধ তা কিন্তু নয়। কখনও তা দলিত সম্প্রদায়ের আপন অধিকার বুঝে নেওয়ার ইচ্ছেকে সবক শেখানোর জন্যে, কখনও ‘উচ্চ’বর্ণের জন্যে নির্দিষ্ট কুয়ো থেকে জল নেওয়ার অপরাধে, কখনও বা আধাসামরিক বাহিনীর সন্দেহের কারণে যে এরা দেশদ্রোহীদের খবর ইচ্ছে করে চেপে যাচ্ছে। একটা সম্প্রদায়, একটা জনগোষ্ঠীকে মানসিকভাবে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল গোষ্ঠীর মহিলাদের উপর প্রকাশ্য বলাৎকার (এ বিষয়ে ধর্ষণ সম্পর্কে পৃথক একটা লেখায় বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রয়েছে)।
এখানে শুধু একটি কথাই উল্লেখ করবো, খুন ধর্ষণ অত্যাচারে মার্কিন সেনাবাহিনী জগতে খুবই নিন্দিত। তাদেরও কিন্তু নিজের দেশবাসীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের ভুরি ভুরি অভিযোগ নেই।
আবারও বলছি, ভারতবর্ষে ধর্ষণ নিরবিচ্ছিন্ন এবং ব্যাপকভাবে সংগঠিত হচ্ছে সমাজের একেবারে পিছিয়ে থাকা নারীদের প্রতি। আর নৃশংসতার দিক থেকে সেগুলি এতো ভয়ানক যে, কোনো মানুষের পক্ষে তার বিবরণ দেওয়া অসম্ভব। উলঙ্গ করে দল বেঁধে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া, সেই অবস্থায় যৌন উৎপীড়ন, ধর্ষণ, তারপরে আবার হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া। যুগপৎ ধর্ষণ এবং ইলেকট্রিক শক প্রদান, ধর্ষণের পর পাথর কুচি ভরে দেওয়া, হাজারো রকমের পৈশাচিক আবিষ্কার।
পাঠকবৃন্দ আমাকে ক্ষমা করবেন, এইরকম মনকে পীড়া দেওয়ার কথা লিখতে। কিন্তু যারা বলেন নৃশংস ঘটনা হলেই মানুষ আন্দোলনে নামে, তাদেরকে বোঝানোর জন্যেই এই কথাগুলো লিখতেই হলো।
কিন্তু এতো অপরাধ, এতো নৃশংসতা, তবু মানুষ পথে নামে না কেনো? আসাম, মনিপুর, কাশ্মীর, বিহার, ছত্রিশগড় শুধু নয়, ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজ্যে প্রতিটি জনপদে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বার বার ঘটছে, কিন্তু নাগরিক সমাজের আচরণে যেন মনে হয় কিছুই হয় নি, কিছুই ঘটে নি। এরকমটা কেনো?
৪।
আগেই আলোচনা করেছি ভারতবর্ষে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক ধর্ষণের অপরাধ ঘটে, তার সিংহভাগ ঘটে সমাজের একেবারে দরিদ্র, প্রান্তিক, আদিবাসী, দলিত নারীর ওপর। নৃশংসতা, ভয়াবহতা, মানবিকতার চরম লজ্জাজনক ঘটনাগুলি স্তম্ভিত করে দেবার মতো। কিন্তু আসল সত্যি হচ্ছে এটাই যে, সেগুলো সংবাদপত্রে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয় না। যেটুকুবা প্রকাশিত হয় শিক্ষিত নাগরিকসমাজ তাতে বিচলিত হয় না। তার কারণ কী?
কারণ, নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। এই মহিলারা তাদের আত্মজন নন। কোরাপুট জেলার বনের পাতা সংগ্রহ করে বেঁচে থাকা নারী আধুনিক মধ্যবিত্ত মননের কাছে বহু দূর গ্রহের প্রাণী। এমনকী বাড়ির কাছের কোনো গ্রামের কলমি শাক সেদ্ধ খেয়ে বেঁচে থাকা অপুষ্ট যুবতী তাদের কাছে হয়তো মানুষের পদবাচ্য নয়।
গুয়াহাটির রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে আদিবাসী তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, কেউ দাঁড়িয়ে মজা দেখেছে, কেউ ছিছি এটা কী হচ্ছে বলে চোখ ফিরিয়ে চলে গেছে। ওই তরুণীর সঙ্গে মধ্যবিত্ত তার বোন, স্ত্রী, কন্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারে নি। তার বোন জঙ্গলে থাকে না, তার স্ত্রী এতো কালো নয়, তার মেয়ে খাবার জলের জন্যে দশ কিলোমিটার হাঁটে না। আর মধ্যবিত্ত যেখানে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবে না, খবরের কাগজে ছাপবে কেনো? খবরের কাগজগুলো টিকেই রয়েছে মধ্যবিত্তের পয়সায়। মধ্যবিত্তের যা ভালো লাগবে না, সংবাদপত্র তা ছাপাবে না।
এসব নিয়ে অজস্র উদাহরণ দিয়ে বিস্তৃত লেখা সম্ভব, আপনাদের কাছেও নানা উদাহরণ আছে। ‘আপনারে লয়ে সদা ব্যস্ত’ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ জাগে নি। অদ্ভূত উদাসীনতার খোলসে তারা নিজেদের মুড়ে নিয়েছে। পীড়িত মায়েদের আর্তনাদ মধ্যবিত্ত বিদ্যা-বুদ্ধি জ্ঞানের চৌকাঠ পেরিয়ে বোধে আঘাত হানতে পারে নি।
তবুও মধ্যবিত্ত প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে। যতখানি প্রতিবাদ করা উচিত, যতোটা লড়াকু হওয়া উচিত, যতোটা হৃদয়াবেগ, যতোটা ত্যাগ থাকা উচিত, কোনোটারই বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলো না। মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে সেই আন্দোলনেই আমরা পথে নামতে দেখলাম।
তিনটি আন্দোলনের কথা এখানে উল্লেখ করবো। যেখানে ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং শাস্তির দাবিতে বেশ বড় ধরনের আন্দোলন হয়েছিলো ।
১) দিল্লিতে নির্ভয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা
২) হেতাল পারেখ ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনা এবং
৩) কামদুনিতে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা।
এই তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রে যে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, তার মাত্রায় তারতম্য থাকলেও চরিত্র ও মেজাজে অনেকটাই একই রকম।
এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা এতে নড়েচড়ে বসেছে। দিল্লির তাবড় রাজনৈতিক দলের নেতারা আন্দোলনের সমর্থনে রাস্তায় নেমে এসেছিল। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী আক্রান্ত পরিবারের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন। নিউজমিডিয়া তোলপাড় করেছিল, পুলিশ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা অতি সক্রিয় হয়েছিল।
এরকমটাই তো হওয়া উচিত। একেবারে সর্বস্তরের ঘটনাতেই এরকম হওয়া উচিত। কিন্তু তা হয় না। এরকম কিছু ঘটনা ব্যতিক্রম হিসেবেই থেকে যায়।
৫।
ধর্ষণ নিয়ে প্রথম বড় ধরনের আন্দোলন ঘটল দিল্লির নির্ভয়া হত্যা ঘটনায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কোনো ধর্ষণের বিরুদ্ধে এতোবড় আন্দোলন ইতোপূর্বে দেখা যায় নি। ঘটনাটি সকলেই জানেন। মেয়েটি তার বন্ধুর সঙ্গে বাসায় ফেরার পথে বাসে ওঠে। বাসের অন্যান্য যাত্রীরা নেমে যাবার পর বাসের ড্রাইভার, কন্ডাকটর, খালাসি মিলে তাদের দুজনকে মারধর করে। মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে। এখানেই শেষ নয় তারা মেয়েটির উপর নানা নৃশংস ও পৈশাচিক অত্যাচার করে, যা সাধারণভাবে কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব। তারপরেও দুজনকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে চাকার তলায় পিষে হত্যা করার চেষ্টা করে। ছেলেটি কোনো মতে রক্ষা করে। গুরুতর জখম নির্ভয়াকে অর্ধমৃত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার মৃত্যু ঘটে।
এই ভয়াবহ ঘটনা গোটা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। সাধারণভাবে নিস্পৃহ দিল্লিবাসী বিদ্যুতপৃষ্টের মতো জেগে ওঠে। দলে দলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা কেউ ছাত্র, কেউ চাকুরে, কেউবা ব্যবসায়ী। বিরাট সংখ্যায় তরুণ তরুণী। তাদের কেউই সংগঠিত করে রাস্তায় নামায় নি। তারা এসেছে নিজেদের প্রাণের টানে। এইসব তরুণ তরুণীদের বৃহৎ অংশ এর আগে কোনোদিন মিছিল বিক্ষোভ করে নি। ভবিষ্যতেও কোনোদিন করবে কীনা সন্দেহ। তারাও প্রাণের আবেগ নিয়ে বিক্ষোভে উপস্থিত। আর এই আন্দোলনের আরও একটা বিশেষ দিক হচ্ছে, বিপুলসংখ্যায় মধ্যবিত্তের উপস্থিতি। দলমত, জাত, ধর্ম নির্বিশেষে মধ্যবিত্ত।
রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ মিছিল মধ্যবিত্তের নের্তৃত্বে হলেও তাতে অংশ নেয় মূলত গরিব দৈহিক পরিশ্রমের সঙ্গে যুক্ত মানুষ। কিন্তু এ এক অন্য ধরনের আন্দোলন। আবেগী, স্বতস্ফূর্ত, মধ্যবিত্তের নাছোড় প্রতিবাদ। রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রথমে এর গুরুত্ব বুঝতে পারে নি। ভেবেছিল এটা নিছকই ছাত্রছাত্রীদের সৌখিন আন্দোলন। পুলিশি চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পালিয়ে যাবে। তাই বড় সংখ্যায় পুলিশ মোতায়েন হলো, লাঠিচার্জ হলো। বিক্ষোভ বেড়ে গেলো। পুলিশ জলকামান ছুড়লো। বেশীসংখ্যায় মানুষ যুক্ত হতে থাকলো। সরকারের কানে জল গেলো। তারা বুঝতে পারল তাদের ভুল হচ্ছে। এ বিক্ষোভ তো চেনা ছকের রাজনৈতিক বিক্ষোভ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, যারা এই বিক্ষোভ করছে তারা অবস্থানগতভাবে রাষ্ট্রের বিরোধী তো নয়ই, বরং সহযোগী। তাছাড়াও তখন সদ্য ঘটে যাওয়া পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনাগুলি শাসকের বিবেচনায় ছিলো।
খুব তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক দলগুলো ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামে। পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়। সারাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকে। রাজনৈতিক নেতারা ঘটনার গুরুত্ব স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করে। দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। পরবর্তীকালে দেখা যায় বিচার ব্যবস্থাও অত্যন্ত সক্রিয় হয়।
(চুম্বকে এটিই হল ঘটনার বিবরণ। পুরোটাই স্মৃতি থেকে লিখলাম। তথ্যগত ভুল থাকলে আশাকরি কেউ ধরিয়ে দেবেন)
এই ঘটনার সঙ্গে আরেকটা বিষয় জড়িয়ে যায়, সেটা হল ধর্ষণকারীদের মধ্যে একজন ছিল বয়সে ‘নাবালক‘। এবং সেও ধর্ষণোত্তর ভয়ংকর নিপীড়নে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। এই বিষয়টিও সারাদেশে আলোড়ন ফেলে দেয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে নাবালকদের বিচার আদৌ প্রচলিত ভারতের আইন অনুযায়ী হওয়া উচিত কীনা এ নিয়েও প্রবল বিতর্ক শুরু হয়। (এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখানে আলোচ্য নয়)
আলোচ্য হলো সাধারণভাবে নিস্পৃহ আপনারে লয়ে ব্যস্ত দিল্লিবাসী কোন যাদুর বলে আপসহীন সংগ্রামী হয়ে উঠল।
৬।
অনেকেই বলেন, দিল্লিবাসী মধ্যবিত্ত, তাঁরা নাকী সহজে কোনো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়ান না। নিজ ক্যারিয়ার, রোজগার আর সংসার নিয়ে তারা ব্যস্ত, তাহলে কোন যাদুকাঠির ছোঁয়ায় এতোবড় মরিয়া আন্দোলনে নামলেন তারা? এই মেয়েটি তো তাদের পরিবারের পরিচিত কেউ নয়।
এখানেই আসল রহস্য। এই মেয়েটিকে তারা পরিবারের একজন মনে করলেন। বিগত পনেরো কুড়ি বছরে তথ্য প্রযুক্তি এবং অন্যান্য পরিষেবা শিল্পে বেশ বড় সংখ্যায় নারী কর্মী যুক্তি হয়েছে। বিশেষত বড় বড় শহরগুলোয়। তাদের প্রায় পুরোটাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। তারা ভাবলেন, আরে এতো আমার পরিবারেরই মেয়ে। আমার কন্যা, আমার স্ত্রী, আমার পুত্রবধূ, আমার বোন। প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কোনো না কোনো মহিলা রোজ নানা প্রয়োজনে রাত করে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন। কেউ কর্মস্থল থেকে, কেউ পড়াশোনা করে, নানা কাজে, দরকারে। আমার প্রিয়জনের নিরাপত্তা কোথায়? অর্থাৎ যে আকস্মিক দুর্ঘটনা মধ্যবিত্ত নিরাপদ দূরত্বে থেকে টিভিতে দেখেছে, খবরের কাগজে পড়েছে, সেই বিপদ আজ ঘরের ভিতরে এসে উপস্থিত! একটা আতঙ্কের হিমস্রোত শিরদাঁড়ায় বয়ে যায়। আতঙ্ক থেকে মানুষ মরিয়া হয়ে উঠে।
তার মানে মধ্যবিত্ত মানুষ নির্ভয়ার সঙ্গে নিজেকে ‘সংযুক্ত‘ করলো। তার সঙ্গে আরও ভয় পেয়ে গেলো, যারা ধর্ষণ করলো তারা সমাজের কোন স্তরের মানুষ সেটা দেখে। তারা সেই স্তরের মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যাদের ওপর মধ্যবিত্তদের সবসময়ই নির্ভর করতে হয়। ড্রাইভার, কনড্যাক্টর, দারোয়ান, পরিচারক, লিফটম্যান, কেয়ারটেকার, ইত্যাদি।
অতি অল্প অর্থের বিনিময়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরা এদের কাছ থেকে পরিষেবা নিয়ে থাকেন। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন মধ্যবিত্ত জীবনের যা কিছু স্বাচ্ছন্দ্য আরাম বিলাসিতা সবই এই শ্রেণিটার জন্যে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ভারতবর্ষে সুলভ শ্রমলভ্যতার জন্যে। সমাজের এই স্তর থেকে যদি নিরাপত্তাহীনতা আসে, আস্থার অভাব ঘটে, মধ্যবিত্ত সমাজের ভিত তখন কেঁপে ওঠে। আমাদের দেশের দৈহিক শ্রমে নিযুক্ত মানুষেরা যারা উদয়অস্ত খেটেও স্বাভাবিক জীবন-যাপনের রসদটুকু জোগাড় করতে পারেন না, তারা সাধারণভাবে সৎ এবং সরল মূল্যবোধে চলেন। কিন্তু তার যখন ব্যত্যয় ঘটে, যেটা এই ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের সমাজে প্রায় স্বাভাবিক, তখনই গেল গেল রব উঠে যায়।
এইসব কথার মধ্যদিয়ে মধ্যবিত্ত সমাজের এই আন্দোলনকে আমি কখনোই ছোট করে দেখছি না, বরং তার আপসহীন মেজাজকে বারবার স্যালুট জানাচ্ছি। কিন্তু আন্দোলনের প্রেক্ষিত এবং তার আভ্যন্তরীণ কাঠামো না জানলে, কেন এই আন্দোলন একটি শক্তিশালী সম্ভাবনা সত্ত্বেও স্ফুলিংয়ের মতো মিলিয়ে গেলো, তার কারণ বিশ্লেষণ করা সহজ হবে না। সেটি ধরতে পারলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, সনি সোরি একজন শিক্ষিকা হলেও থানার মধ্যে তার যোনিতে গুচ্ছ পাথরের টুকরো গুঁজে দিলেও মধ্যবিত্ত সমাজে কেনো আলোড়ন ওঠে না। কারণ আমাদের বোন বা স্ত্রী আদিবাসী নয়, দুর্গম জঙ্গলের এক স্কুলে তারা পড়াতে যায় না। সনি সোরি আমাদের কেউ নন।
আমাদের কেউ নয় মনিপুরের উপজাতি মায়েরা, আসামের আদিবাসী বোনেরা, ইট ভাটায় কাজ করতে আসা ভিন রাজ্যের শ্রমিক মহিলারা। তারা সংবাদপত্রের ক্রেতা নয় যে তাদের কথা লিখতে হবে, টিভির ক্রেতা নয় যে মহামূল্য টাইম স্লট বরাদ্দ হবে। তাই সেসব ধর্ষণের ঘটনা হলো – ‘বিপুলা পৃথিবীর আর কতটুকু জানি’। কিংবা ‘তোর হাতে নাই ভুবনের ভার’।
৭।
দিল্লিতে নির্ভয়া ঘটনার অনেক আগেই কলকাতায় একটা ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সেটা হলো হেতাল পারেখ ধর্ষণ ও হত্যা, যে ঘটনাকে মানুষ ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হিসেবে বেশি মনে রেখেছে। কলকাতার এক ব্যবসায়ী পরিবার একটা বহুতল আবাসনে বসবাস করতো। ফ্ল্যাটে যখন হেতাল একা ছিলো, সেই আবাসনের কেয়ারটেকার ধনঞ্জয় তাকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। ভয়ংকর এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ স্তম্ভিত হয়ে যায় ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ধনঞ্জয়ের ফাঁসির দাবিতে কলকাতা উত্তাল হয়ে ওঠে। পুলিস ও প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে, দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা হয়। বিচারে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির আদেশ হয়। এবং তা কার্যকরও করা হয়।
এই ঘটনাটি কয়েকটা কারণে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, এইপ্রথম কোনো ধর্ষণের ঘটনায় নাগরিক সমাজ বড়সংখ্যায় পথে বেরোলো। এর আগে নানা ধর্ষণের ঘটনায় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, ব্যথিত হয়েছে, কিন্তু রাস্তায় এসে নামেনি। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখলাম যেকোনো অপরাধে এইপ্রথম মধ্যবিত্ত নাগরিকসমাজ দলবেঁধে ফাঁসির দাবি তুললো। তাছাড়া একটা অবাক করার মতো ঘটনা নিম্নতর আদালতে ফাঁসির আদেশ হলো, এবং তা কার্যকর হয়ে গেল। তদ্বিরের অভাবে তা উচ্চ আদালতেও গেল না। এরকম ব্যাপার আর কোনো মামলায় হয়েছে কীনা আমার জানা নেই।
আসলে নির্ভয়ার ঘটনার মতো এই ঘটনাটিও কলকাতাবাসী নাগরিক সমাজ নিজেকে সংযুক্ত করেছিল। মধ্যবিত্ত সমাজের বড় অংশই ফ্ল্যাটবাড়িতে ছোটো পরিবারে থাকে। স্বামী স্ত্রী বাইরে থাকলে তাদের আদরের মেয়ে একা থাকে। সর্বনাশ, যে বিপদ তারা খবরের কাগজে পড়েছে তা আজ নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সুতরাং ফাঁসি চাই। আমার বেশ মনে আছে, তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্ত্রী ধনঞ্জয়ের ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই ঘটনার আগে বা পরে আর কখনও তিনি পথে নেমেছিলেন বলে মনে করতে পারছি না। লক্ষ করুন তার অবস্থানটি। তিনিও ফ্ল্যাটে থাকতেন এবং তাদের মেয়েকেও দিনের দীর্ঘ সময় একা থাকতে হতো। মধ্যবিত্ত সমাজ যেন আত্মরক্ষার্থে পথে নেমে এসেছিল।
তবু তো তারা প্রতিবাদ করেছিলো। তা করা কী অন্যায়? না অবশ্যই অন্যায় নয়। যে যখন আক্রান্ত হবে, প্রতিবাদ তো করবেই। কিন্তু এই প্রতিবাদকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সংগ্রাম, জনগণের সমবেত লড়াকু চেতনা, ইত্যাদি বলে মহান বানানোর অপচেষ্টা। এটা মধ্যবিত্ত সমাজের একটা আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা। সে আঘাত আবার উপর থেকে আসে নি। রাষ্ট্র নয়, উঁচু তলার মানুষ নয়, নিচুতলার মানুষ যাদের পরিশ্রম এবং নিঃশর্ত বিশ্বস্ততা অতি অল্প পয়সায় কিনছি তারা এই কাজটা করেছে। মধ্যবিত্ত সমাজের ভিতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
এর উল্টোদিক দিয়ে ভাবুন। ধরা যাক মধ্যবিত্ত পরিবারের কোনো একটি কিশোরী কলেজ যাওয়ার রাস্তায় কোনো এক কোটি টাকা দামের মোটর গাড়িতে অপহৃত হলো। পরদিন ধর্ষিতা মেয়েটির মৃতদেহ পাওয়া গেল রাস্তার ধারে। জানা গেল অপরাধী এক ধনী প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে ও তার ইয়ার দোস্ত। এই ঘটনায় কী মধ্যবিত্ত মানুষ নিজেদের সংযুক্ত করবে না? অবশ্যই করবে, প্রাথমিক প্রতিবাদও শুরু হবে। কিন্তু দু‘এক দিনের মধ্যে দেখতে পাবেন এক অন্তসলিলা উল্টো স্রোত। ঘটনার ‘অন্তর তদন্তে‘ এসে হাজির হবে এক ত্রিকোণ প্রেমের উপাখ্যান। কিংবা ভোলেভালা ছেলেটিকে ফাঁসিয়ে দেবার চক্রান্ত। এমনকী চক্রান্তকারী মেয়েটিও হতে পারে। মেয়েটির স্বভাব চরিত্র নিয়ে নানা সংবাদ মাধ্যমে নানা খবর বেরোবে। যে অভিনেত্রীর অভিনয়ে আপনি পাগল, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন আমি ছেলেটিকে চিনি, ও এরকম কাজ করতে পারে আমার বিশ্বাস হয় না। আপনার প্রিয় লেখক খবরের কাগজকে বলবেন, আমি জানি ছেলেটিকে, ও নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্রের শিকার। নিট ফল, মধ্যবিত্ত দ্বিধা বিভক্ত। বেচারা মেয়েটির শিক্ষক শিক্ষিকা পিতামাতা। তারা দোষীর শাস্তি চাইবেন না সত্যিই তাদের মেয়েটি নিরাপরাধ তার প্রমাণ দেবেন। শোক ক্ষোভ কুৎসার আগুনে দগ্ধ হতে থাকবেন। আর মধ্যবিত্ত, আর একটা আই,পি,এল এলেই সব ভুলে যাবে। আসলে মধ্যবিত্ত কার জন্যে বলিপ্রদত্ত সেটা বুঝবেন ওই অসহায় বাবা আর মা।
না ধনঞ্জয়ের বেলা এরকম কোনো সম্ভাবনার কথা কেউ মাথায়ও আনে নি। এসব চিন্তাকে কখনো লাই দিতে নেই যে।
৮।
এই কলকাতার উপকন্ঠে পর পর ঘটে যাওয়া দু’টো ধর্ষণের ঘটনা এখানে উল্লেখ করবো। একটা কামদুনির ঘটনা, অপরটা মধ্যমগ্রামের। সুধী পাঠকবৃন্দ, আপনাদের মনে হতেই পারে কামদুনির ঘটনা তো আমরা সবাই জানি, কিন্তু মধ্যমগ্রামের ঘটনাটা কী?
ঘটনা এটাই যে, একটা ঘটনার দুঃখস্মৃতি মানুষের মনে আজও বয়ে যাচ্ছে। আর একটা ঘটনা চলে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে।
নতুন গড়ে ওঠা মেগাসিটি রাজারহাটের পাশের গ্রামগুলো গ্রামের সারল্য হারিয়েছে আর শহরের অন্ধকার জগত তাদের বুকে গেড়ে বসেছে। জমি মফিয়া, ঠিকেদার, মস্তান রাজনৈতিক দাদাদের শাকরেদদের লীলাভূমি। এইরকম একটা গ্রাম কামদুনি। এখানে একটি মেয়ে কলেজ থেকে ফেরার পথে ধর্ষিতা হয়। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর অতি নৃশংসভাবে তাকে খুন করা হয়। এই ঘটনা সারা পশ্চিমবঙ্গে অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। স্থানীয় মানুষ একত্রিত হয়ে এক বড় আন্দোলন সংগঠিত করে। এই আন্দোলনের সমর্থনে ও বিরোধিতায় নানা রাজনৈতিক জল ঘোলা করার কারবার চলে। সরকারও নানা কৌশলের পথ নেয়। এতদ্বসত্ত্বেও এই আন্দোলন অত্যন্ত দৃঢ় এবং লড়াকু ছিল।
বিশেষ ব্যাপার ছিল এই আন্দোলন শুধুমাত্র মধ্যবিত্তের ছিল না। পরবর্তীতে মধ্যবিত্তরা এর নেতৃত্ব দিলেও শুরুটা কিন্তু স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষেরাই করেছিল। দ্রুত মধ্যবিত্তরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। কারণ এটাও তারা তাদের জীবন–যাপনের সংকট বলে মনে করেছিল। আন্দোলন এতোটাই তীব্র হয়েছিল যে, বারাসাত জজ কোর্টের কোনো উকিল অভিযুক্তের পক্ষে আইনগত লড়াইয়ে দাঁড়াতে অস্বীকার করেন। কোর্টে এতো ভিড় এবং বিক্ষোভ হয় যে, বাধ্য হয়ে বিচারক মামলাটা কলকাতা কোর্টে স্থানান্তরিত করেন। এবং বিচার প্রক্রিয়াও চলে দ্রুততার সঙ্গে।
কামদুনির কয়েক কিলোমিটার দূরে প্রায় সমসাময়িক সময়ে আরও একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে মধ্যমগ্রামে। বিহার থেকে আগত একটা পরিবার যার রোজগেরে সদস্য কলকাতায় ট্যাক্সি ড্রাইভার। তার মেয়ে বাবাকে টিফিন দিয়ে আসার পথে ধর্ষিতা হয়। প্রাথমিক দ্বিধা, ভয় কাটিয়ে পরিবারটি দু‘এক দিন পরে সাহস করে থানায় অভিযোগ করে। অভিযোগ করে ফেরার পথে মেয়েটি ওই একই দুষ্কৃতিদলের দ্বারা পুনরায় গণধর্ষিত হয়। আবার পরিবারটি থানায় অভিযোগ জানায়। যথারীতি থানা তাদের বাঁধা গতে ‘আইনমাফিক‘ তদন্ত করতে থাকে। পরিবারটির ওপর মস্তানদের হুমকিও বাড়তে থাকে। ক্রমাগত হুমকির মুখে কোনোরকম সহায়তা না পেয়ে পরিবারটি মধ্যমগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু জীবন জীবিকা ছেড়ে কোথায় যাবে তারা? কয়েক কিলোমিটার দূরে এয়ারপোর্টের সামনে মাইকেল নগরে বাসা ভাড়া নেয়। কিন্তু দুষ্কৃতিদের হাত অনেক বেশি লম্বা। একদিন মেয়েটির বাবা মা যখন কাজে বেরিয়ে যায়, মেয়েটিকে ঘরে দরজা বন্ধ করে দুষ্কৃতির দলটি আগুন লাগিয়ে দেয়। মেয়েটি মারা যায়। এতোদিন পরে পুলিশ সক্রিয় হয়। না, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার নয়, ময়নাতদন্তের পর মেয়েটির পরিবার যখন তার দেহটি নিয়ে ফিরছিলো, আইন শৃঙ্খলার অবনতি হবার অজুহাতে পুলিশ সেই মৃতদেহটি কার্যত ছিনতাই করার চেষ্টা করে। পরিবারের দৃঢ়তায় সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হয় ( আমার অনেক বন্ধুরা অভিযোগ করেন যে আমার লেখা পড়লে তাদের মন খারাপ হয়ে যায়, কান্না পায়; তাই এ বিবরণ আবেগ বর্জিতভাবে, একেবারে কাঠ কাঠ করে দিলাম। কিন্তু অশ্রু বাঁধ মানে কই?)।
এই ঘটনার শেষ পরিণতিও বন্ধুরা জেনে রাখুন। ওই ট্যাক্সি ড্রাইভার চলে গিয়েছেন চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভারতের এই সাংস্কৃতিক রাজধানী ছেড়ে। প্রগতিশীলতার প্রতিমূর্তি কলকাতা ছেড়ে, মধ্যবিত্ত বাঙালির অহংকারের শহর ছেড়ে।
জানি না বিহারের কোনো এক অখ্যাত গ্রামের এক বৃদ্ধ দম্পতির এই শহরের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা আছে কীনা। যে শহরের প্রতিটি রাজপথ, প্রতিটি গলি সে তিল তিল করে চেনে দিনের আলোয়, রাতের মায়াবী আঁধারে, সূর্যের প্রথম প্রকাশে।
সত্যি কথা বলতে কী, আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। আত্ম-ধিক্কারে মাথা নীচু হয়ে আসে। এই পোস্টের প্রতিটি শব্দ আমাকেই যেন ব্যঙ্গ করে।
শেষ কথা:
আমি এতোক্ষণ ধরে এই কথাটাই বলার চেষ্টা করে এসেছি যে ধর্ষণ একটা ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি। এটা কোনো ব্যক্তি বিশেষের ইন্দ্রিয়লিপ্সা বা পদস্থলন বা অপরাধী মনের ফসল নয়। এই ব্যাধি থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে সামগ্রিকভাবে গোটা বিষয়টা নিয়েই ভাবতে হবে, সক্রিয় হতে হবে। কোনো ঘটনায় অতি সক্রিয় আবার কোনো ঘটনায় শীতঘুমে চলে যাওয়ায় অবস্থার কোনো হেরফের হবে না। গ্রামে আগুন লাগলে দেবালয়ও ছাড় পাবে না।
সমাজে যারা নিচের তলার মানুষ, নিত্য যাদের ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই, ধর্ষণ সবচেয়ে বেশি সংগঠিত হয় তাদের বিরুদ্ধে। এই অপরাধের প্রতি চোখ বুজে থেকে ক্ষেত্র বিশেষে যখন চোখ খুলে মাঠে নামা দরকার, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আর যাদের প্রতি অন্যায়ের সময় চোখ বুজে থেকেছি, তারা আমাদের লড়াইয়ের সময় প্রতিবারও যে পাশে থাকবে, এটা আশা করাটা কী একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না কী?