০
১৫৮০ বার পঠিত
নারী এক আশ্চর্য সৃষ্টি। আজকের আলোচনা শুধু ‘নারী’ নামের ‘বস্তুটি’কে নিয়ে। ভার্জিনিয়া উলফ বলেছেন,
“নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত পশু”
বস্তু থেকে পশু। এইটুকুই শুধু ক্রমবিবর্তন। তার বেশী নয়। মহাবিশ্বে হাজার হাজার বছরের পরম্পরায় নারীকে দেখা হয়েছে বস্তু হিসেবে। না হয়, উন্নতপশু হিসেবে। মানুষ হিসেবে নয়। নারী শুধুই নারী, মানুষ নয়। সিমোন দ্য বোভোয়ার বলেছেন,
“কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে”।
নারী কী হয়ে জন্ম নেয় তা বড় কথা নয়, তবে তাকে মানুষ হিসেবে থাকতে দেয়া হয় না, তাকে রূপান্তরিত করে নেওয়া হয় নারীরূপে। বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“শুধু বিধাতার সৃষ্ঠ নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী
আপন অন্তর হতে।“
নারীকে বিধাতার পূর্ণ সৃষ্টিরূপে দেখতে চাননি রবীন্দ্রনাথ। হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন পুরুষের এক মহৎ প্রতিনিধিরূপে। তিনিও নারীকে দেখেছেন শুধু দয়িতা আর মানস-প্রতিমা রূপে। নারী তাঁর কাছে কাব্যলক্ষ্মী-পূর্ণ মানবী নয়। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের,
“চোখে পড়েছে শুধু নারীর চারপাশের বর্ণ, গন্ধ, ভূষণ, যাতে নারীকে সাজিয়েছে পুরুষ। নারীর প্রতি পুরুষসুলভ করুণা এবং পুরুষ হওয়ার গর্বও তিনি বোধ করেছেন গভীরভাবে। পুরুষ প্রেম আর আলিঙ্গনেও ভুলতে পারে না সে প্রভু, নারীর স্রষ্টা,… নারী সৃষ্টিতে তিনি বিধাতার সাথে পুরুষের ভাগ দাবি করেছেন এবং অস্বীকার করেছেন নারীর সম্পূর্ণ বাস্তবতাকে“।“
রবীন্দ্রনাথের কাছে নারী ‘অর্ধেক মানবী তুমি অর্দ্ধেক কল্পনা’। এখানে কবিগুরু যেন ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন বিধাতাকে। রবীন্দ্রনাথ পুরুষকে বলেছেন নারীর দ্বিতীয় বিধাতা।
দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন,
“নারী কিছু গুণের অভাববশতই নারী। আমরা মনে করি স্বাভাবিক ভাবেই নারীস্বভাব বিকারগ্রস্ত”।
অ্যারিস্টটল নারীকে স্বাভাবিক মানুষরূপে দেখতেই চান নি, দেখেছেন অসম্পূর্ণ ও বিকারগ্রস্তরূপে। তাই নারী পূর্ণ মানুষ নয়। অর্দ্ধ মানুষও বোধহয় নয়। তার চেয়েও কম, দার্শনিক প্লেটোকে অনেকে মনে করেন নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত, কিন্তু তাঁর এই সংলাপটি তো বিখ্যাত,
“ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন, বর্বর করেননি। তাঁকে ধন্যবাদ তিনি আমাকে মুক্ত পুরুষ করেছেন, স্ত্রীলোক বা ক্রীতদাস করেন নি”।
প্লেটোর কাছে এথেন্স ছাড়া আর সব জায়গা ছিল বর্বরদের স্থান। দাস ও স্ত্রীলোকের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখেননি প্লেটো। তিনি বলেছেন মানব চরিত্র দুটো ভাগে বিভক্ত- উচ্চতর ভাগটি পুরুষ চরিত্র। প্লেটো আরো বলেছেন- দুষ্ট ও ভীত পুরুষ পরজন্মে নারী হয়ে জন্মায়। সন্ত টমাস মনে করেছেন,
“নারী হচ্ছে বিকৃত মানুষ, এক আকস্মিক সত্তা”
সন্ত টমাস, প্লেটো কিংবা অ্যারিস্টটলের অনুভুতি আলাদা নয়। তাঁরা সকলেই পুরুষতন্ত্রের উজ্জ্বল প্রতিনিধি। সন্ত টমাস না হয় পুরুষ বিধাতার প্রতিনিধি। তিনি নারীকে ‘বিকৃত পুরুষ’ রূপেই দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু মহৎ, পূজনীয় দার্শনিকরা কেন নারীকে নিগুর্ণা ভাবলেন তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। তাঁরা শুধু পুরুষের জয়গান গেয়ে গেলেন, নারীর নয়।
মধ্যপ্রাচ্যের তিন সেমেটিক ধর্ম- ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম। তিন ধর্মেই নারী সৃষ্টির একটি সাধারণ কাহিনী রয়েছে। খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিল, যার উল্লেখ বারবার দেখা যায় কোরানে। সেখানে বিধাতা পুরুষের নারী সৃষ্টির বর্ণনা রয়েছে,
“সদাপ্রভু ঈশ্বর আদি মানব আদমকে নিদ্রায় মগ্ন করলে তিনি নিদ্রিত হলেন, ঈশ্বর তখন আদমের পাঁজরের একটা হাড় নিয়ে তা মাংস দিয়ে পূরণ করেন। সদাপ্রভু আদম হতে গৃহীত সে পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করে আদমের কাছে নিয়ে আসেন, তখন আদম বলেন এই স্ত্রী তাঁর অস্থির অস্থি। এঁর নাম হবে নারী। কেননা তিনি নর হতে তৈরি হয়েছেন।“
এই কাহিনীটি দেখা যায় কোরানেও। আদম কোনও নারী সন্তান নন, তাঁর কোনও জননী নেই, স্বয়ং বিধাতা তাঁকে সৃষ্টি করেছেন মাটি হতে। মানবের আদি পিতার জন্ম মৃত্তিকা হতে। সেমেটিক ধর্মসমূহের স্রষ্টা তা বারবার ঘোষণা করেছেন ধর্মপুস্তকে। তৌরাত, ইঞ্জিল, কোরানে। ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলাম, তিন ধর্মেই অস্বীকার করা হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জন্মপ্রক্রিয়া।
শুধু তাই নয়, নারীকে করে তুলেছে তার সৃষ্টির জন্যে পুরুষের দেহের কাছে ঋণি। পুরুষের পঞ্জর না হলে নারী সৃষ্টি হতো না। পুরুষ তার অন্য বিধাতা। ঈশ্বরের ধর্মগ্রন্থে নর নারীর জন্মদাতা। যে অস্থিপঞ্জর থেকে নারীকে সৃষ্টি করা হল সেই পঞ্জরও আবার সহজসরল নয়- বক্র। বক্র হাড় থেকে জন্ম বলে নারীর স্বভাবও বক্র! তাকে নিন্দা করেই এরপর ধরনীর ধূলায় নেমেছেন ঈশ্বরের প্রেরিত দূত- নবি রসুলরা, বিধাতাপুরুষের সাথে তাঁরাও কণ্ঠ মিলিয়েছেন নারী নিন্দায়।
যে নারীনিন্দা তাঁদের অনুগামী পুরুষদের কাছে হয়ে উঠেছে পবিত্র ধর্মপুস্তক, কখনও তা ঈশ্বরের ঐশীবাণী, কখনও তা প্রেরিত পুরুষের জীবনবিধান ও কর্মনির্দেশ। যাকে অবনত মস্তকে শুধু মেনে নিতে হয়। অবহেলা কিংবা অস্বীকার করা যায় না। করলেই ধর্মচ্যুতি। যার জন্যে রয়েছে চরম জাগতিক শাস্তির বিধান। এইসব ধর্মপুস্তক, বিধি-বিধান হয়ে উঠেছে সব সামাজিক ও জাগতিক আইনের উৎস। যা ক্রমাগতভাবে পুরুষকে তৈরি করে দিয়েছে নারীর বিধাতারূপে। তাকে আষ্টে-পৃষ্টে করেছে শৃঙ্খলিত। নারী সেই শৃঙ্খল খুলতে পারে নি। কারণ আইন হল বিধাতার। নির্দেশও তাঁর প্রেরিত পুরুষ দ্বিতীয় বিধাতার।
শুধু সেমেটিক ধর্ম নয়- পৃথিবীর কোনও অঞ্চলের কোনও ধর্মই নারীকে মানুষরূপে দেখে নি। উদার, মানবতাবাদী বলে প্রচারিত অবতার, প্রেরিত পুরুষ, ধর্মসংস্কারক, শাস্ত্রকার বা মহাপুরুষ নামে যাঁরা নিজেদের পূজনীয় করে তুলেছেন মানুষের কাছে, তাঁদের রচিত প্রচারিত ধর্মগ্রন্থ বা শাস্ত্রগ্রন্থ দিয়ে তাঁরা নারীকে কেবলই শৃঙ্খলিত করেছেন, মুক্তির চেষ্টা করেন নি।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন