সম্প্রতি কিছু আলোচনা চোখে এলো- যেখানে কোন কোন বিক্ষুব্ধ নারী নাকী ‘ইচ্ছে’ পোষণ করেছেন- তারাও পুরুষকে ধর্ষণ করবেন, কিংবা কেউ কেউ ভাবছেন- নারীদেরও পাল্টা এগিয়ে এসে পুরুষদের ধর্ষণ করা উচিত হবে। বলাই বাহুল্য- নারীদের এ ধরনের আলোচনাগুলো পুরুষদের জন্যে বেশ মুখরোচক ও উপাদেয় (এ আলাপ আমার চোখে এসেছে- সেরকম পুরুষদের পোস্টের মাধ্যমেই)! সবমিলিয়ে আমার কাছে শিরোনামের প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে বিধায় আমার মত উপস্থাপন করার জন্যই এই লেখা।
ধর্ষণের বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত সংজ্ঞা ও অর্থ মোতাবেক আমরা এমনটা ভেবে অভ্যস্থ যে- ধর্ষণ কর্মটি ঘটায় পুরুষ এবং যার ওপরে এটি ঘটানো হয়- সে হচ্ছে নারী। এই প্রচলিত ধারণার একদম সম্পূর্ণ বিপরীতটি সম্ভব কী না- সেটিই মূল প্রশ্ন; তবে সেটিকে আমরা একটু ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেখতে চাই। অর্থাৎ ধর্ষিত হিসেবে নারীর জায়গায় পুরুষ এবং ধর্ষক হিসেবে পুরুষের জায়গায় নারী- হতে পারে কী? সেক্ষেত্রে, প্রশ্নগুলো এরকম হবেঃ
১) একজন পুরুষ কী আরেক পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারে?
২) একজন নারী কী আরেক নারীকে ধর্ষণ করতে পারে?
৩) একজন নারী কী কোন পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারে?
মূল শিরোনামের প্রশ্ন, অর্থাৎ ৩ নম্বর প্রশ্ন থেকেই শুরুর আলোচনায় প্রবেশ করা যাক (প্রসঙ্গক্রমেই অন্য দু‘টো প্রশ্নও চলে আসতে পারে)।
নারী কী পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারে?
হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী গ্রন্থে ‘ধর্ষণ‘ শীর্ষক প্রবন্ধের শুরুতেই জানিয়েছেন-
“নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের চরম রূপ ধর্ষণ, যাতে পুরুষ নারীর সম্মতি ছাড়া তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। …ধর্ষণ একান্ত পুরুষের কর্ম; নারীর পক্ষে পুরুষকে খুন করা সম্ভব, কিন্তু ধর্ষণ করা সম্ভব নয়। পুরুষের দেহসংগঠন এমন যে পুরুষ সম্মত আর শক্ত না হলে নারী তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক পাতাতে পারে না; কিন্তু উত্তেজিত পুরুষ যেকোনো সময় নারীকে তার শিকারে পরিণত করতে পারে।”
এখানে ধর্ষণের সংজ্ঞায় যেমন জানানো হয়েছে- নারীর সম্মতি ছাড়া তার সাথে পুরুষের বলপূর্বক যৌন সঙ্গম ধর্ষণ (অর্থাৎ- নারী ধর্ষিত, পুরুষ ধর্ষক), তেমনি আলাদাভাবে উল্লেখও করা হয়েছে, নারীর পক্ষে ধর্ষণ করা সম্ভব নয়- এটি একান্তই পুরুষের কাজ (অনেক পুরুষ মনে করেন- পুরুষালী), কেননা পুরুষ সম্মত ও তার যৌনাঙ্গ শক্ত না হওয়া পর্যন্ত নারীর পক্ষে এই যৌন সঙ্গম সংঘটন সম্ভবই না। অর্থাৎ- ধর্ষকের রূপে আমরা কেবল পুরুষকেই পাচ্ছি, নারীকে নয়। যদিও এই শারীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যায় এটা বলা যাবে না যে- কেবল নারীই ধর্ষিত হতে পারবে, পুরুষ পারবে না। কেননা, একজন উত্তেজিত পুরুষ যে প্রকারে অসম্মত নারীকে বলপ্রয়োগ করতে পারে, তেমনি অসম্মত পুরুষের ওপরেও বলপ্রয়োগ করতে পারে বৈকি।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। নারী কর্তৃক পুরুষকে ধর্ষণ করা সংক্রান্ত আলোচনায় ব্যাপকভাবেই লক্ষণীয়- প্রচুর পুরুষ দাঁতকেলিয়ে জানান দিচ্ছে যে, তারা নারীর হাতে ধর্ষিত হতে ইচ্ছুক। এই বিষয়টিও আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, কেননা- ইচ্ছুক বা সম্মত কাউকে তো ধর্ষণ করা সম্ভব না, মানে যৌন সঙ্গম সম্ভব, কিন্তু সেই যৌন সঙ্গমকে তো আর ধর্ষণ বলা যাবে না। তারচেয়েও আরেকটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ- আমাদের সমাজে ধর্ষণ বিষয়টি ভয়ানক- কেননা সেটি ধর্ষিতকে কলংকিত করে, প্রচলিত ভাষায় ধর্ষিতের ‘সম্ভমহানি‘ ঘটে। এবং এই কলংকিত হওয়ার বা সম্ভমহানির ব্যাপারটি কেবলমাত্র নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলেই- পুরুষ প্রকাশ্যে নারীর দ্বারা ধর্ষিত হতে এমন আগ্রহ পোষণ করতে পারে। সুতরাং নারীর ক্ষেত্রেও এই বাঁধাটি ভাঙ্গা খুবই জরুরী যে, ধর্ষণ আদতে ধর্ষিত’র জন্যে কলংকজনক কিছু নয়, তার সম্ভ্রমহানি বা সম্মানহানির এখানে কিছু নেই- এখানে যা কলংক বা সম্মানহানি-সম্ভ্রমহানি সব ধর্ষকের জন্যে প্রযোজ্য।
সেদিক দিয়ে দেখলে, নারীর পাল্টা পুরুষকে ধর্ষণ করার ওই আলোচনাকে অনুৎসাহিতই করি। কিন্তু, ধর্ষণকে কেন্দ্র করে নারীর সম্মান নষ্ট হওয়ার ধারণার সাথে কেবল ধর্ষণ নয়, বিবাহ বহির্ভূত যৌনক্রিয়ায় অংশ নেয়া যুক্ত। আমাদের দেশে সে কারণে আমরা দেখি- বিবাহিত স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হলে স্ত্রীর সম্মান যায় না, কিংবা ধর্ষণের পরে ধর্ষিত‘র সম্মান ফিরে পাওয়ার উপায় হয়ে দাঁড়ায় ধর্ষণকারীকে বিয়ে করা। বিবাহিত স্ত্রীর অসম্মতিতে জোর করে যৌন সঙ্গম অবশ্য আমাদের দেশের আইনে ধর্ষণ হিসেবেই বিবেচিত নয়, যদি বিবেচিতই হতো তাহলে ১৬ বছরের নিচের বিবাহিত শিশুর সাথে যৌন সম্পর্ককেও ধর্ষণ বলে গণ্য করা হতো। এরকম ক্ষেত্রেও ধর্ষক স্বামীকে অনেকসময় পাষণ্ড বলা হতে পারে, কিন্তু শিশুর মান-সম্মান-সম্ভ্রম এসব হারানোর কোন ভয় নেই- কেননা ওইকর্মটি তো তার ‘স্বামীদেবতা‘ই করেছে।
সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে- নারীর সম্ভ্রমহানির সাথে মূল যোগাযোগ ‘বিবাহ‘ নামক সম্পর্কের, বিবাহের মাধ্যমে পুরুষের ‘কুমারি‘ বা ‘ভার্জিন‘ নারীকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার, নিজ স্ত্রীর পরপুরুষের স্পর্শহীন অবস্থায় পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার (অসূর্যস্পর্শ্যা নারীকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে নারীকে অন্তঃপুরে বন্দী করা, পর্দায় আবদ্ধ করা এইসব চলের শুরু)। সুতরাং ধর্ষণকেন্দ্রিক সম্ভ্রমহানির ধারণা ভাঙ্গতে গেলে এসব ধারণাও ভাঙ্গা খুব জরুরী এবং সে জায়গা থেকে নারীর যৌনআকাঙ্ক্ষা, নারীর যৌনঅভিজ্ঞতা, নারীর যৌনচাহিদা- এসবের আলোচনাও প্রকাশ্যে আসা জরুরী। সেদিক দিয়ে দেখলে- নারীর ধর্ষণ করার প্রকাশ্য ইচ্ছের মধ্যে- নারীর যৌনতাকে বোতলবন্দী করে রাখার সামাজিক ট্যাবুকে কিছুটা হলেও আঘাত করা হয় বৈকি!
যাই হোক, মূল আলোচনায় আবারো ফেরা যাক। এখন আইনের প্রেক্ষাপটে দেখা যাক। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের সংজ্ঞা/ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-
“যদি কোন পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিকবয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।”
এই সংজ্ঞায় দেখা যাচ্ছে- কেবলমাত্র পুরুষ ধর্ষণ করতে পারে এবং কেবলমাত্র নারীর সাথে এই অপরাধটি সংঘটিত হতে পারে। একইভাবে পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী-
“A man is said to commit ‘rape’ who except in the case hereinafter excepted, has sexual intercourse with a woman under circumstances falling under any of the five following descriptions…”
এখানেও ’A man’ বা পুরুষই ধর্ষণ অপরাধটি সংঘটন করে এবং ‘a woman’ এর সাথে এটি ঘটতে পারে। ফলে, আমাদের আইন অনুযায়ী উপরোল্লিখিত তিনটি প্রশ্নের জবাবই হচ্ছে ‘না বোধক‘। অর্থাৎ পুরুষ পুরুষকে, নারী নারীকে কিংবা নারী পুরুষকে ধর্ষণ করতে পারে না। সে জায়গা থেকে- বিভিন্ন সময়ে বাচ্চাদের ছেলেদের উপরে নানারকম নির্যাতনের যে খবরগুলো পত্রিকার পাতায় দেখি- সেসবও আইনত ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। তখন প্রশ্নটি আসে- তাহলে সেটি কী যৌন নিপীড়নমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে কী? সেটি দেখতে গেলে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তিনটি হচ্ছেঃ
১) একজন পুরুষ কী আরেক পুরুষকে যৌন নিপীড়ন করতে পারে?
২) একজন নারী কী আরেক নারীকে যৌন নিপীড়ন করতে পারে?
৩) একজন নারী কী কোন পুরুষকে যৌন নিপীড়ন করতে পারে?
আগেই আলোচনা করেছি, আমাদের দেশের কোন আইনেই ধর্ষণের সংজ্ঞায় নারীর হাতে পুরুষ, পুরুষের হাতে পুরুষ কিংবা নারীর হাতে নারীর জোরপূর্বক (অসম্মতিক্রমে) যৌন সম্পর্ক/ সঙ্গমকে ধর্ষণ বলার উপায় নেই। তাহলে প্রশ্নটি হচ্ছে, নারী পুরুষকে- পুরুষ পুরুষকে কিংবা নারী নারীকে কী যৌন নিপীড়ন করতে পারে? আমাদের প্রচলিত আইন কী বলে? বিভিন্নক্ষেত্রে কিশোর-বালকরা যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সে সম্পর্কে আমাদের আইন কী বলছে? শুনতে যেমনই লাগুক- এ সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট আইন খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। নারীর ওপর যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত বিধান ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ এ অন্তর্ভূক্ত, কিন্তু পুরুষের ওপর যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা কোন আইন নেই। ধর্ষণের সংজ্ঞায় ’ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারী‘ এর স্থলে ’ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন শিশু‘ উল্লেখ করলেও কিন্তু অন্তত ছেলে শিশুদের ওপরে সংঘটিত যৌনসঙ্গম ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে গণ্য হত, যেমনটি ১০ নম্বর ধারায় কেবল নারী না উল্লেখ করে ‘নারী বা শিশু’র কথা উল্লেখ থাকায় ছেলে শিশুর ওপর সংঘটিত যৌন নিপীড়নও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ফলে, বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে- ছেলে শিশুর সাথে বলপূর্বক বা সম্মতিছাড়া যৌনসঙ্গম করলেও সেটি যৌন নিপীড়ন হিসেবে গণ্য হবে, যার শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাভোগ।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত ধারাটি হচ্ছে ১০ নম্বর ধারা-
“যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌনকামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানি করেন তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যুন তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।”
এই ধারা অনুযায়ী আমরা দেখতে পাই যে, যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন- নারী বা শিশু, কিন্তু যৌন নিপীড়কের লিঙ্গ এখানে বলা নেই, বলা হয়েছে ‘কোন ব্যক্তি‘। অর্থাৎ যৌন নিপীড়ক যেমন হতে পারে একজন পুরুষ, তেমনি হতে পারে একজন নারী। আবার ২ (ট) নম্বর ধারার ‘শিশু‘র সংজ্ঞায় আমরা দেখি-
“শিশু অর্থ অনধিক ষোল বৎসর বয়সের কোন ব্যক্তি”
ফলে, এ পর্যন্ত আলোচনায় আমরা দেখতে পারি যে- আমাদের আইনানুযায়ী-
১) পুরুষ ১৬ বছরের কম বয়সের পুরুষকে যৌন নিপীড়ন করতে পারে
২) নারী নারীকে যৌন নিপীড়ন করতে পারে
৩) নারী ১৬ বছরের কম বয়সের পুরুষকে (শিশুকে) যৌন নিপীড়ন করতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ১৬ বছরের ওপরের কোন পুরুষকে কী যৌন নিপীড়ন করা সম্ভব? অপর কোন পুরুষ, কিংবা নারীর দ্বারা? দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের আইনে এমন কোন বিধান আমি এখনো খুঁজে পাইনি। কেবল পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারায় প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌন সঙ্গমকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে, যেখানে জোর করে বা সম্মতিছাড়া এমন কোন বিষয়ের উল্লেখ নেই।
৩৭৭ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে-
“Whoever voluntarily has carnal intercourse against the order of nature with any man, woman or animal, shall be punished with 2 [imprisonment] for life, or with imprisonment of either description for a term which may extend to ten years, and shall also be liable to fine. Explanation: Penetration is sufficient to constitute the carnal intercourse necessary to the offence described in this section”।
এটি হচ্ছে আমাদের পেনাল কোডের সেই কুখ্যাত ধারা যার মাধ্যমে সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ধারা মোতাবেক পুরুষের সাথে পুরুষের বা নারীর সাথে নারীর যৌনসঙ্গম (যদিও যৌন সঙ্গম হওয়ার জন্যে যে পেনিট্রেশন দরকার, সেটি নারী দ্বারা সংঘটিত হবে কীভাবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখানে নেই) শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার সাজা যাবজ্জীবন কিংবা দশ বছরের কারাভোগ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের দেশের আইনে ধর্ষণ যে মাপের অপরাধ, সমকামিতাও একইমাপের শাস্তিযোগ্য অপরাধ!
যাহোক, আবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক। কোন পুরুষের সাথে বলপূর্বক, সম্মতিছাড়া যৌনসঙ্গম করা হলে, যেহেতু আর কোন আইন নেই- সেহেতু এই ৩৭৭ ধারা মোতাবেক মামলা করা যায়। তবে, এখানে একটি বিপদ আছে- আসামীপক্ষ যদি প্রমাণ করতে পারে যে, এই যৌনক্রিয়ায় ভিকটিমেরও সম্মতি ছিল (যেটি যেকোন ধর্ষণের মামলায় আসামীপক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে), তবে উভয়েই সাজা পেয়ে যেতে পারে। আরেকটি ব্যাপার এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। আমাদের কোন আইনেই হিজড়াদের ব্যাপারে কোন সুরক্ষা নেই- অথচ হিজড়ারাও ভয়ানকভাবে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার।
অতএব, যৌনঅপরাধ সংক্রান্ত আমাদের আইনসমূহের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে- এখানে সব ধরনের অপরাধকে আমলে নেয়া হয়নি, লিঙ্গ নির্বিশেষ সকলের সমান সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আমি মনে করি, যৌন অপরাধসমূহের জন্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটি আইন দরকার। পেনাল কোডের এসংক্রান্ত যাবতীয় ধারাগুলোকে বাতিল করে এবং ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ এর যৌন অপরাধ সংক্রান্ত ধারাগুলোকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে এসে এই স্বতন্ত্র আইনে যুক্ত করেই ‘যৌন অপরাধ দমন আইন‘ করা উচিত।
উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাজ্যের ২০০৩ সালের একটি আইনের (Sexual Offences Act 2003) দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। এই আইনের সূচির দিকে তাকালেও বুঝা যাবে, যৌন অপরাধের যাবতীয় প্রকরণকে এই আইনে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। Rape (১ টি ধারা), Assault (দুটি ধারাঃ Assault by penetration এবং Sexual assault), Causing sexual activity without consent (১ টি ধারা), Rape and other offences against children under 13 (৪টি ধারা), Child sex offences (৭ টি ধারা), Abuse of position of trust (৯ টি ধারা), milial child sex offences (৫ টি ধারা), Offences against persons with a mental disorder impeding choice (৪ টি ধারা), Inducements etc. to persons with a mental disorder (৪ টি ধারা), Care workers for persons with a mental disorder (৭ টি ধারা), Indecent photographs of children (২ টি ধারা), Abuse of children through prostitution and pornography (৫ টি ধারা), Exploitation of prostitution (৫ টি ধারা), Trafficking (৭ টি ধারা), Sex with an adult relative (২ টি ধারা), Other offences (৬ টি ধারা, যার মধ্যে আছে- Exposure, Voyeurism, Voyeurism: interpretation, Intercourse with an animal, Sexual penetration of a corpse, Sexual activity in a public lavatory)।
একইসাথে আরেকটি ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে মনে হয়েছে- সেটি হচ্ছে, এই আইনে ধারাগুলোর বর্ণনায় অপরাধী কিংবা ভিকটিম, কারোরই কোন লিঙ্গ কিংবা বৈবাহিক অবস্থার সরাসরি কোন বিবরণ নেই। অর্থাৎ যৌন অপরাধ নারী- পুরুষ যেকেউই যেমন করতে পারে, এই অপরাধ নারী ও পুরুষ যে কারোর উপরে সংঘটিত হতে পারে। এই পোস্টে- এই আইনটির ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ কম, সংক্ষেপে ধর্ষণ এবং নিপীড়ন সংক্রান্ত তিনটি ধারা নিয়ে আলোচনা করে- এই লেখার সমাপ্তি টানবো।
ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হচ্ছেঃ
A person (A) commits an offence if-
(a) he intentionally penetrates the vagina, anus or mouth of another person (B) with his penis,
(b) B does not consent to the penetration, and
(c) A does not reasonably believe that B consents.
এখানে, দেখাই যাচ্ছে- ধর্ষক তিনিই যার ‘পেনিস’ আছে। সে হিসেবে এই আইনে নারীর পক্ষে ধর্ষক হওয়া সম্ভব নয়, তবে সম্মতি ছাড়া ‘পেনিস’ অঙ্গটি যোনী, পায়ু কিংবা মুখে প্রবেশ করালে যেহেতু ধর্ষণ হবে এবং পায়ু ও মুখ নারী ও পুরুষ উভয়েরই আছে- সেহেতু নারী বা পুরুষ, কিংবা হিজড়াও এই আইনে সুরক্ষা পাচ্ছে। এই ধর্ষণের সাজা হচ্ছে- যাবজ্জীবন কারাভোগ, অর্থাৎ ধর্ষণ হচ্ছে সর্বোচ্চ অপরাধ হিসেবে গণ্য। এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, সংজ্ঞা অনুযায়ী ধর্ষণ অপরাধটি কেবল পুরুষ করতে পারলেও- সংজ্ঞায় পুরুষ উল্লেখ না করে একজন ব্যক্তি (A person) উল্লেখ করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই আইনে কেবল পুরুষ ধর্ষক হচ্ছে, কিন্তু নারীও কী অনুরূপ কোন অপরাধ সংঘটিত করতে পারে না? সেটি বুঝতে গেলে ২ ও ৩ নাম্বার ধারা দুটোর দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।
2 Assault by penetration:
(1) A person (A) commits an offence if-
(a) he intentionally penetrates the vagina or anus of another person (B) with a part of his body or anything else,
(b) the penetration is sexual,
(c) B does not consent to the penetration, and
(d) A does not reasonably believe that B consents. …
3 Sexual assault:
(1) A person (A) commits an offence if—
(a) he intentionally touches another person (B),
(b) the touching is sexual,
(c) B does not consent to the touching, and
(d) A does not reasonably believe that B consents. …
অর্থাৎ এই আইনে নিপীড়ন দুই প্রকার। পেনিট্রেশন সংক্রান্ত নিপীড়ন এবং যৌন নিপীড়ন। কারো যোনী- পায়ু- মুখে সম্মতি ছাড়া পেনিস প্রবেশ করালে- সেটি ধর্ষণ, আর কারো যোনী- পায়ু কিংবা মুখে যৌন উদ্দেশ্যে (ডাক্তারি কিংবা অন্য উদ্দেশ্যে নয়) সম্মতি ছাড়া শরীরের অন্য অঙ্গ (যেমন হাত বা পায়ের আঙ্গুল, জিহবা) কিংবা অন্য কিছু (যেমন সেক্সটয় বা কলম, কাঠি বা অন্য কিছু) প্রবেশ করালে- সেটি ধর্ষণ হবে না- কিন্তু সেটিও ‘Assault by penetration‘ অপরাধ হবে। এই অপরাধের সাজাও হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাভোগ, অর্থাৎ এটিও ধর্ষণের সমপর্যায়ের অপরাধ।
বোঝাই যাচ্ছে- এই অপরাধের ক্ষেত্রে যেহেতু অপরাধীর ‘পেনিস’ থাকা আবশ্যক নয়- সেহেতু নারী- পুরুষ নির্বিশেষেই এই অপরাধটি ঘটাতে পারবে। ৩ নম্বর ধারায় যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে- যৌন উদ্দেশ্যে এক ব্যক্তি আরেকব্যক্তির শরীরে সম্মতি ছাড়া স্পর্শ করলেই সেটি যৌন নিপীড়ন হবে। এটার সাজার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সাজার একটা ব্যবস্থা আছে- যেখানে ছোট অপরাধের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট তাৎক্ষণিকভাবে সাজা দিতে পারে, যার পরিমাণ সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাভোগ ও জরিমানা। বড় অপরাধের ক্ষেত্রে (সেটা আদালতে সাক্ষী-প্রমাণ-বিচার সাপেক্ষ) সর্বোচ্চ সাজা হচ্ছে দশ বছর। বলাই বাহুল্য- এই অপরাধ পুরুষ নারীর ওপরে, পুরুষ পুরুষের ওপরে, নারী পুরুষের ওপরে কিংবা নারী নারীর ওপরে সংঘটিত করতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ
1) A CRITICAL APPRAISAL OF LAWS RELATING TO SEXUAL OFFENCES IN BANGLADESH: A Study Commissioned by the National Human Rights Commission Bangladesh by Lyal S. Sunga, Special Advisor on Human Rights and Humanitari- an Law, International Development Law Organization (IDLO), and Kawser Ahmed , Advocate, Supreme Court of Bangladesh.
ডাউনলোড করুন: Study Report on Sexual Offences
মে ২৪, ২০১৭; ৯:২৬ অপরাহ্ন
লেখার শিরোনামটা বেশ কৌতুহলোদ্দীক হলেও পোস্টের বিষয়বস্তু সিরিয়াস। আরেকটু বিস্তারিত লিখলে বুঝতে সহজ হতো। পড়তে গিয়ে মনে হলো হয়তো আরও লেখার প্ল্যান ছিল লেখকের। লেখকই ভাল বলতে পারবেন। ধন্যবাদ সমসাময়িক বিষয়টা নিয়ে আলোকপাত করার জন্য।