কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন, আইন, এবং নারী ও পুরুষের জন্য সমাজ কর্তৃক আরোপিত ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকার কারণে আমাদের সমাজে পুরুষকে শ্রেষ্ঠ ও নারীকে পুরুষের অধীনস্ত ভাবা হয়। পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের এমন ধারণাই সারা পৃথিবীতে যুগে যুগে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা, নীপিড়ন, বৈষম্য ও সব ধরনের নির্যাতনের (শারীরিক, আর্থিক, মানসিক, যৌন) কারণ।
জাতিসংঘের মানদণ্ডে নারীর প্রতি অর্থনৈতিক নির্যাতনের মাপকাঠি হচ্ছে, স্বামীর হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত সংসার খরচের টাকা না দেওয়া। আর আমাদের বাংলাদেশের মানদণ্ডে নারীর প্রতি অর্থনৈতিক নির্যাতন হচ্ছে, স্ত্রীকে নিয়মিত হাতখরচ না দেওয়া, যৌতুক দাবি করা, বাবার বাড়ী থেকে টাকা বা জিনিশপত্র আনতে স্ত্রীকে চাপ দেওয়া, স্ত্রীর বেতন, সম্পদ বা অর্থ কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি।
মানসিক নির্যাতন হলো কাউকে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া। আমাদের ভদ্র সমাজে শারীরিকের চেয়ে মানসিক নির্যাতনের হার বেশী। মানসিক নির্যাতনের তালিকাটা দীর্ঘ। যেমন – অকারণ সন্দেহ করা, স্বাধীন চলাফেরায় বাধা দেয়া, গালি দেয়া, বাইরের লোক বা সন্তানদের সামনে হেয় করা, প্রতিটা কাজের কৈফিয়ত চাওয়া, কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া, ইত্যাদি।
নারীর চেয়ে পুরুষকে কিছু কারণে শক্তিশালী ও শ্রেষ্ঠ বলা হলেও কারণগুলোর কোন সত্যতা ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। যেমন –
১) নারীর ওপর পুরুষের শারীরিক নির্যাতনের কারণ হিসেবে বলা হয়, পুরুষের শক্তিশালী হওয়া। পুরুষের গায়ে জোর বেশী। তাই নারী তার সাথে শক্তিতে পারেনা।
আমি মনে করি, নারী ও পুরুষের শারীরিক শক্তিতে কোন পার্থক্য নেই। নারীকে যুগে যুগে বাড়ীর কাজে আটকে রাখার কারণে দিনে দিনে নারী তার শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সে পুরুষের চেয়ে দূর্বল হয়ে গেছে। পুরুষ ও নারীর ক্ষমতা যে সমান, প্রকৃতিতেই তার প্রমাণ আছে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশে মেয়েরা পারেনা, এমন কোন কাজ নেই। ওসব দেশে ‘মেয়েদের কাজ‘ বা ‘ছেলেদের কাজ‘ বলে কাজের কোন শ্রেণিবিভাগ নেই। সব কাজ সবার। সবাই সব কাজ করে, করতে পারে। অনেকে বলেন, পুরুষরাই শুধু কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে পারে, নারীরা নয়। কিন্তু আমাদের দেশের সাঁওতাল মেয়েদেরকে আমি কৃষিকাজসহ সব কাজ পুরুষের সমান, কখনও কখনও পুরুষের চেয়ে বেশিই করতে দেখেছি। অন্য উপজাতিদের মেয়েদের বেলায়ও তাই। নারীরা শারীরিকভাবে দূর্বল হলে উপজাতি মেয়েদেরও দূর্বল হবার কথা। আমি নিজে ছোটবেলায় আমার খালাতো ভাইবোনদের সাথে পাল্লা দিয়ে ভরা নদী সাঁতরে পার হতাম, গাছে চড়তাম (সুপারি গাছেও), সাইকেল চালাতাম, ভেলা চালাতাম, আরও কত কী! এখন কী গাছে চড়তে পারবো? পারবনা। অভ্যাস থাকলে ঠিকই পারতাম।
২) বলা হয় পুরুষরা একাধিক স্ত্রী রাখতে পারে, নারীরা নয়।
এটাও ভুল ধারণা। সারা পৃথিবী জুড়ে পতিতারা তার প্রমাণ।
৩) ধর্মমতে ও আইনমতে পুরুষরা শ্রেষ্ঠ। কারণ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বেশী। স্ত্রী -সন্তান, ভাইবোন, আত্মীয় ও বৃদ্ধ বাবামার ভরনপোষণের দায় পুরুষদের। এজন্যই পুরুষরা পিতার সম্পত্তি বেশী পায়।
মেয়েরা কম দায়িত্বশীল, একথা কোনদিক থেকেই ঠিক নয়। বরং তারাই বেশী দায়িত্ববান। নারীই তার পরিবারকে আগলে রাখে, সবার দেখভাল করে। রাতদিন পরিশ্রম করে সন্তান লালন পালন, বাড়ীর যাবতীয় কাজ, স্বামীর কৃষিকাজে সাহায্য, পশুপালন, রান্না…। কী করেনি মেয়েরা? এখনও কী করেনা? কর্মজীবী নারীরাও ঘরে, বাইরে সব দায়িত্ব সমানভাবে সামলে যাচ্ছে রোজ। দুনিয়াজোড়া মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি সমান কাজ করে সমান আয় করে। বৃদ্ধ বয়সে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই আজকাল বাবা-মা’র দেখাশোনা বেশী করে।
৪) পুরুষরা আয় করতে পারে, নারীরা আজীবন শুধু বসে বসে খেয়েছে। তাই পুরুষ নারীর ওপর কর্তৃত্ব ফলাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, পুরুষ আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান হয় নারীকে বঞ্চিত করে। পুরুষরা পিতার সম্পত্তি বেশী পায়, মেয়েদেরকে তাদের বাবা ও স্বামীর সম্পত্তির অংশ ঠিকমত দেওয়া হয়না, দিলেও তা স্বামী দখল করে। স্ত্রীর বাবার দেয়া সম্পদ, বেতন বা সঞ্চয় কেড়ে নেয় স্বামী। মোহরানা, তালাকের পর খোরপোষ…. এসব ঠিকমত দেয়া হয়না। ফলে নারী আর্থিক দিক থেকে পুরুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশী দূর্বল হয়ে যায়। নারীরা পরিশ্রম করে টাকা আয় করতে পারেনি, কারণ মেয়েদেরকে আয় করতে বাইরে যেতে দেয়া হয়নি। কারণ তাকে ঘর সামলাতে বাধ্য করা হয়েছে। নাহলে সেও কী ছেলেদের সমান আয় করতে পারতো না?
৫) সামাজিকভাবে নারীর সামাজিক মর্যাদা ও গুরুত্ব কম। তাই তার মতের গুরুত্বও কম। তার জীবনের সব গুরুত্বপপূর্ণ সিদ্ধান্ত সে নিজে নিতে পারেনা। তাকে নিতে দেওয়া হয়না, নেয় পুরুষ। কারণ মেয়েদের বুদ্ধি কম।
এ কথাটিরও কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নারীকে দাবিয়ে রাখার জন্য এটি পুরুষের আরেকটি অপপ্রচার ছাড়া কিছু না।
একটি অনুষ্ঠানে আমি ও আরেকজন আলোচক কথা বলার পর ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্বে এক ছাত্র প্রশ্ন করলো,
“আপনারা বলছেন আমাদের দেশে মেয়েরা বৈষম্যের শিকার। তাদেরকে সব সুবিধা কম দেয়া হয়। কিন্তু আমার বাসায় আমি দেখি আমার বাবা সবসময় আমার চেয়ে আমার বোনকে খাবার, জামা, হাতখরচ সব আমার চেয়ে বেশী দেয়। তাহলে মেয়েদের প্রতি বৈষম্য কীভাবে হল?”
উত্তরে আমরা বললাম,
“খাবার, জামা, হাতখরচ বেশী দিলেও সম্পত্তি, বাড়ী, টাকা দেবার সময় তোমার বাবা ঠিকই তোমাকেই বেশী দেবেন। তাছাড়া বিয়ের আগে বাবার বাড়ীতে মেয়েরা যতদিন থাকে, ততদিন বাবা-মা একটু বেশী ভালবাসা দেন। কারণ মেয়েটি চিরদিন বাবা-মা’র কাছে থাকতে পারবেনা, তুমি থাকবে। এটিও বৈষম্য। বাবার সম্পত্তি কম পাবার কারণে বিয়ের পর বাবার বাড়ীর ওপরে তার কোন অধিকার থাকবেনা। সে হবে পরগাছা। আর মেয়েকে বাবা-মা যতোটা ভালবাসেন, শ্বশুর-শাশুড়ী ননদরা ততোটা ভালোবাসেননা। তাই বিয়ের পর তার কপালে ভালবাসা জুটবে কীনা, এই আশংকায় বাবামা বেশী বেশী ভালবাসেন।”
আরেকজন প্রশ্ন করলো,
“মেয়েদের জন্য কোটা পদ্ধতি থাকার কারণে একটি ছেলে পরীক্ষায় মেয়েদের চেয়ে ভাল করেও চাকরি পায়না, মেয়েরা পায়। কিন্তু একটি মেয়ের চেয়ে একটি ছেলের চাকরি পাওয়া বেশী জরুরী। কারণ একজন ছেলে চাকরি পেলে বিয়ে করে একটি বেকার মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারে। একটি মেয়ে তা করেনা। চাকরি করলেও একটি মেয়ে বেকার কোন ছেলেকে বিয়ে করেনা। চাকরি না পেলে একটি ছেলে বিয়ে করতে পারেনা, কিন্তু একটি মেয়ে পারে। তাহলে একটি ছেলের চেয়ে একটি মেয়ের চাকরি কী বেশী জরুরী না? তাহলে এক্ষেত্রে ছেলেরাই কী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে না?”
এর উত্তর – মেয়েরা চাকরি করতে আসার সুযোগই কম পায়। তার আগেই মেয়েরা বহুবার বহু বৈষম্যের শিকার হয়। ছেলেদের পড়াশোনা জরুরী। কারণ বাবামাকে দেখার দায়িত্ব ছেলেদের। তাই বাবা-মা ছেলেদেরকে পড়ান, মেয়েদের পড়ান না বা অল্প পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ী পাঠিয়ে দেন। কোটা পদ্ধতি রাখা হয়েছে মেয়ে ও মেয়েদের বাবা-মা’কে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যাতে ‘চাকরি পাওয়া সহজ‘, এটা বুঝে হলেও যেন বাবা-মা মেয়েদেরকে পড়ান বা মেয়েরা পড়ে।
সকার মেয়ে বেকার ছেলেকে বিয়ে করেনা – একথা ঠিক। সে দোষ মেয়েদের নয়। পরিবার, সমাজ ও স্বয়ং পুরুষের। বউকে কাজে পাঠিয়ে স্বামীরা কী বউয়ের মত সংসারের সব কাজ করবে? করবেনা। বউয়ের আয়ে বসে বসে খেতে তাদের সম্মানে বাধে। কিন্তু চাকরি করা বউদের টাকা নিতে বাধেনা। বউ, বাচ্চা ফেলে যখন স্বামীরা চলে গিয়ে আবার বিয়ে করে, তখন মা কতো কষ্ট করে, লোকের বাড়ী কাজ করে, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে সন্তানদের দেখাশোনা করে। নিজের সন্তানের দায় বউকে দিতে সম্মানে বাধেনা। বউয়ের বাপের দেয়া টাকা, সম্পদ, এটা সেটা হাত পেতে ভিখারীর মত (এমনকী বউকে নির্যাতন করে হলেও) নিতে বাধেনা। বাসা-বাড়ীতে কাজ করা মেয়েদের কারো কাছেই তো শুনিনা যে তাদের স্বামীরা বউয়ের টাকা নেয়না!
একজন বলল,
“ম্যাডাম, আমরা তো প্রায়ই দেখি শাশুড়ি-ননদ, মানে মেয়েরাই মেয়েদের নির্যাতন করে বেশী। যৌতুকের জন্য তো স্বামী একা বৌকে নির্যাতন করেনা। শাশুড়ি, ননদও করে। পতিতালয়ে মেয়েদের যৌনকর্মী বানাতে ভূমিকা রাখে এক নারী সর্দারনী। মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হবার পরও মেয়েকে স্বামী ছাড়তে প্রথম বাধা দেয় মা, যে কীনা নারী। কখনও অফিসে নারীকর্মীদের নির্যাতন করে নারী বসরাও। মা নারী হয়ে মেয়ের চেয়ে ছেলেকে বেশী প্রাধান্য দেন। তাহলে মেয়েরা কী পুরুষের চেয়ে নারীদের দ্বারাই বেশী নির্যাতিত ও বৈষম্যের শিকার হয় না?”
হয়। তবে প্রতিটা নারী দ্বারা অন্য কোন নারী যখন নির্যাতনের শিকার হয়, তখন সেই নারীর নির্যাতনকে সহায়তা করে একজন পুরুষ। যেমন – মোটরসাইকেল দেবার জন্য কোন শাশুড়ী বা ননদ যখন কোন বউকে নির্যাতন করে, তখন এই নির্যাতনকে উস্কে দেয় বউটির স্বামী বা শ্বশুর, যে কীনা একজন পুরুষ। কারণ মোটরসাইকেলটি তো শাশুড়ি বা ননদ চালাবে না। পরকীয়ার কারণে স্ত্রী একা স্বামীকে খুন করেনা। করে স্ত্রীর পরকীয়ার পুরুষ। এভাবে প্রতিটা নারী দ্বারা অন্য কোন নারী বা পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী নারীর পিছনে কোন না কোন পুরুষের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা থাকে।