০
২৬৫৫ বার পঠিত
আমি ভাত খাই => আঁই ভাত খাই।
আমি বই পড়ি => আঁই বঁই হড়ি।
আমি কি করেছি => আঁই কিচ্ছি।
তুমি এখন কী কর? => তুঁই অন কিয়ার?
আপনারা ভাল আছেন? => আন্নেরা বালা আছেন্নি?
তোর পেটে কী মানিক ঢুকছে? => তোর হ্যাড কী মানিক হান্দাইছে নি?
এই বাক্যগুলোতে নোয়াখাইল্লা ভাষায় ব্যঞ্জন ধ্বনির রূপান্তরের কারণে একটা ইন্টারেস্টিং টোন তৈরি করে যেটা অন্য অনেক আঞ্চলিক ভাষা থেকে আলাদা কিন্তু অতটুকু আলাদা নয় যে কেউ বুঝতে পারবে না। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা খুব সহজেই অন্যান্য বাঙালিরা বুঝতে পারে। প্রচুর পরিমাণে নাসিক্যীভবন এবং হকারীভবনের কারণে নোয়াখাইল্লা ডায়ালেক্ট হাস্যরসের উদ্রেক ঘটায়।
ব্যঞ্জন ধ্বনির রূপান্তরের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ‘হকারীভবন’, যার কারণে পানি হয়ে যায় হানি।
হেনি কলেজের টিঁয়া লই চুদুর-বুদুর চইলত ন।
হায় বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানের জিলানী, তোমারি নামের গুনে আগুন হইয়া যায় হানি।
একইভাবে সম্বন্ধি > হমন্দি, সোন্দর > হোন্দর, সোনা> হোনা, সোনাপুর> হোনাহুর, সদাই > হদাই, পাটোয়ারী > হাডারি, বিষ্ণুপুর > বিশ্নুহুর, ফুফাতো > হুয়াতো, ফিটকিরি > হিটকিরি, সোনালু > হনালু, পুকুর > পুকুইর> হুইর।
নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, ‘অল্পপ্রাণের মহাপ্রাণতা’। আপনি তখন হয়ে যায় আফনে, ‘অপরাধ’ থেকে ‘অফরাধ’। ‘হারিকেন’ শব্দটিতে হকারীভবন হয়েছে মনে করে নোয়াখাইল্লা ভাষায় শুদ্ধ করে প্রথমে পারিকেন পরে অল্পপ্রাণের মহাপ্রাণতা ঘটিয়ে ‘ফারিকেন’ বলতেও শোনা গেছে। হারিকেন > পারিকেন >ফারিকেন। 😛
মহাপ্রাণের অল্পপ্রাণতাঃ দশঘরিয়া> দশ গইরগা , ঘুম > গুম, ঘাম > গাম, ভালো > বালো > বালা।
অঘোষের ঘোষভাবঃ মাটি > মাডি, কাটি > কাডি, বটি> বঁডি (নাসিক্য), চিঠি > চিঁডি, মাঠা > মাডা, কাঁঠাল > কাঁডাল > কাঁডল। আজকে > আইজকা > আইজগা।
নাসিক্যীভবনঃ ধোঁয়া >ধুমা, কোথায়> কোনাই, যাইতাম না > যাইতান্ন, খাব না > খাইতান্ন, মরিব না> মইতান্ন, আপনি > আমনে > আন্নে।
বর্ণলোপঃ আমি > আঁই, বেপারি > বেয়ারি> বেরি, লক্ষ্ণীধরপাড়া > লইধাড়া, মাহাজন > মাজন, হাজী সাহেব > আজি সাব, নারিকেল > নাইল, সুপারি > শুয়ারি> হুয়ারি, শুটকি > হুটকি> হুরি, চাকরি> চারি।
অপিনিহিতিঃ স্বরধ্বনির রূপান্তরের মধ্যে অপিনিহিতি অন্যতম। জানিয়া > জানি, শুনিয়া> শুনি> হুনি। এছাড়া স্বরসংকোচ এর ব্যবহারও অনেক দেখা যায়। যেমন, ননদ > নন্দ, ডুবিলে > ডুবলে, নিরালা > নিরল।
নামের ক্ষেত্রে অপিনিহিতির সাথে, বর্ণলোপ এবং বর্ণদ্বিত্ব প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার হতে দেখা যায়।
রহিম > রইয়া, করিম > কইরগা, রশিদ > রইশ্যা, রুবেল > রুবেইল্লা, সিরাজ > সিরাইজ্জা, আজিজ> আইজ্জা, দুলাল > দুলাইল্লা, মানিক > মানিক্কা, ফিরোজ > ফিরিজ্জা, আজহার> আজাইরগা, মজিব> মইজ্জা।
ভাষার ক্ষেত্রে ব্যঞ্জনবর্ণ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যঞ্জনবর্ণের উপরে ভর করে ভাষা দাঁড়িয়ে থাকে। স্বরবর্ণ দিয়ে আহ, উহ করা ছাড়া তেমন বেশি ভাব প্রকাশ করা যায় না। কোথায় যেন একটা উপমা শুনেছিলাম, ব্যঞ্জনবর্ণ হলো হাতীর পায়ের মত, স্বরবর্ণগুলো হাতীর পায়ের চারপাশে ইঁদুরের মত ঘোরাঘুরি করে একটা কানেকশান তৈরি করে।
ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে আবার শক্ত এবং নরম ব্যঞ্জনবর্ণ আছে, বাংলায় যেমন প্রতিটি বর্গে ঘোষ-অঘোষ , অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ এবং নাসিক্য ধ্বনি আছে।
প্রতিটি বর্গের ১ম ও ২য় বর্ণ অঘোষ বর্ণঃ ক-খ-চ-ছ-ট-ঠ-ত-থ-প-ফ। এবং বর্গের ৩য়-৪র্থ বর্ণ ঘোষ বর্ণঃ গ-ঘ-জ-ঝ-ড-ঢ-দ-ধ-ব-ভ।
প্রতিটি বর্গে ঘোষ এবং অঘোষ বর্ণের প্রথমটি অল্পপ্রাণ, পরেরটি মহাপ্রাণ। যেমন, ‘ক’ অল্পপ্রাণ কিন্তু ‘খ’ মহাপ্রাণ বর্ণ, কিন্তু দুজনেই অঘোষ বর্ণ।
নোয়াখাইল্লা ডায়ালেক্টে দেখা যায় দীর্ঘ শব্দ সঠিকভাবে উচ্চারণে অনীহা, যতটুকু সম্ভব সরল করে নেয়ার একটা চেষ্টা দেখা যায়। এর সাথে অতিরিক্ত নাসিক্য ধ্বনি ব্যবহার। উচ্চারণ প্রক্রিয়াকে আরামদায়ক করা মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয়, ঘোষ বর্ণকে অঘোষ করা, অল্পপ্রাণকে মহাপ্রাণ করে প্রয়োজনে বাহুল্য বর্জন আবার উচ্চারণের সুবিধার্থে বর্ণদ্বিত্ব ব্যবহার করা নোয়াখাইল্লা ভাষার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন