০
৬৮৪ বার পঠিত
ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে এবছরের আগস্ট থেকে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের টানাপোড়েন চলছে। যা চূড়ান্ত রূপধারণ করে অক্টোবর মাসের শুরুতে, যখন সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের (সাভার ডিভিশন) জিওসি মেজর জেনারেল আকবর হোসেনের নেতৃত্বে একদল অস্ত্রধারী বিচারপতি সিনহার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ছুটির দরখাস্তে সাক্ষর নেয়। পরে ওই দরখাস্ত ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিচারপতি সিনহাকে জোরপূর্বক ‘ছুটি’তে ও পরে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এর আগে গত ২২ আগস্ট বিচারপতি সিনহার নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ আপীল বিভাগ বর্তমান সংসদের ১৫৪ জন সদস্যকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন, এবং সেটির ওপর গ্যাগ অর্ডার দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেন।
ফোর্স লিভ শেষে ১০ নভেম্বর বিচারপতি সিনহা যখন দায়িত্ব নেয়ার জন্য দেশে প্রত্যাবর্তন করার চেষ্টা করেন, তখন তাঁকে বাংলাদেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে এয়ারলাইন্সগুলিকে নির্দেশনা জারী করে সরকার। বিচারপতি সিনহার দু’জন ঘনিষ্ট আত্মীয় (ছোট ভাই এবং শ্যালককে) জিম্মি করে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা। এর আগে বিচারপতি সিনহার পারিবারিক বন্ধু কুটনীতিক অনিরুদ্ধ রায়কে আটক করে। এদেরকে মারপিট ও নির্যাতন করে বিচারপতি সিনহার ওপরে চাপ প্রয়োগ করা হয় পদত্যাগের জন্য।
সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধতন কর্তারা সিনহাকে উপর্যুপরি চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে সিনহার ভাই ও শ্যালককে ক্রস ফায়ারের জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শুক্রবার মধ্যরাতে। এ অবস্থায় সেখান থেকে ফোনে ধরিয়ে দেয়া হয় সিনহার স্ত্রী সুষমাকে। অবশেষে সিনহার ভাই ও শ্যালকের জীবন বাঁচানোর জন্য সিনহাকে পদত্যাগ করতে বলেন স্ত্রী, অন্যথায় তিনি সুইসাইড করার হুমকি দেন। অগত্যা সিনহা বাধ্য হন পদত্যাগপত্রে সাক্ষর করতে।
অতি উৎসাহী গোয়েন্দারা সাথে সাথেই বিষয়টি ঢাকায় মিডিয়াকে জানিয়ে দেয়। ফলে শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে দেশের তিনটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখায়- ‘বিচারপতি সিনহা পদত্যাগ করেছেন’। অথচ তখনও বিচারপতি সিনহার পদত্যাগপত্র দেশে আসেনি। পরেরদিন শনিবার সকালে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় পদত্যাগপত্র হাতে পেয়েছে বঙ্গভবন। অতি দ্রুততার সাথেই জানানো হয়, মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সিনহার ‘পদত্যাগপত্র’ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরবর্তী তিন দিনেও এর কোনো গেজেট হয়নি বা পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সূত্রমতে জানা গেছে, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার পদত্যাগ নিয়ে জটিল সংকটে পড়েছে সরকার। এর কারণ হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দু’টি রায়।
প্রথমত: পদত্যাগ সংক্রান্ত আপিল বিভাগের একটি রায়ে বলা হয়েছে,
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বহস্তে লিখিত পদত্যাগপত্র নিজে উপস্থিত হয়ে জমা দিতে হবে।
১৯৯৪ সালে সংসদ সদস্যদের গণপদত্যাগের পরে পদত্যাগ সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের এরূপ একটি রায় দেয়া হয়েছে। এবং এটি অনুসরণ করা হচ্ছে।
ফলে, বিচারপতি সিনহাকে পদত্যাগ করতে হলে রাষ্ট্রপতির নিকট তাঁকে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজ হস্তে লিখিত পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে, অন্যথায় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে তা রাষ্ট্রপতির নিকট জমা দিতে হবে। দূতাবাসের মাধ্যমে বা বিদেশ থেকে ই-মেইলে বা কোনো আত্মীয় স্বজনের মারফত কোনো পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে পদত্যাগ করা যাবে না।
অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির মতো সর্বোচ্চ পদাধিকারীর পদত্যাগের জন্য যেনো-তেনো উপায় অবলম্বন করা যায় না।
দ্বিতীয়তঃ ষোড়শ সংশোধনীর চূড়ান্ত আপিল রায় অনুসারে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের কোনো সুযোগ নাই।
কেননা ওই রায়ে আপিল বিভাগ পদত্যাগ সংক্রান্ত ৯৬(৪) অনুচ্ছেদটি বাতিল করে দিয়েছেন। তা ছাড়া ৯৬(১) অনুচ্ছেদও বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। ফলে এখন থেকে ৬৭ বছরে বিচারপতিদের অবসর হবে না। বরং আমৃত্যু বিচারপতি থাকতে পারবেন।
এ অবস্থায়, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কাছ থেকে যে পদত্যাগপত্র নেয়া হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে, তা যথাযথ পদ্ধতিতে নেয়া হয়নি। তাছাড়া ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ের পরে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ করারও কোনো আইন নাই। ফলে, বিচারপতি সিনহার কথিত পদত্যাগ আইনগতভাবে সংকট সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সে কারণেই এ নিয়ে সরকারের কার্যক্রমে ধীরগতি। এরপরেও যদি আওয়ামীলীগ সরকার তথাকথিত ওই পদত্যাগপত্র ব্যবহার করে গেজেট জারী করে, তা হবে আইনের ব্যত্যয় এবং অবৈধ। তাহলে ভবিষ্যতে অনুরূপ অবৈধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকেও পদত্যাগ করানো সম্ভব হবে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন