সামাদ হত্যার পর সরকারের অবস্থান
সর্বশেষ ঢাকায় অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘মুক্তচিন্তার নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া বিকৃত রুচি ও নোংরা রুচির পরিচয়৷” পাশাপাশি তিনি এ ধরনের লেখালেখির কারণে হামলার শিকার হলে তার দায় সরকার নেবে না বলেও জানিয়েছেন৷
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে শ্রদ্ধা করি আপনি আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে, আর ভালোবাসি- বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলে। তাই আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানিয়ে বলছি। এটা আপনার কেমন অবস্থান হলো? ‘মুক্তচিন্তার নামে কারো ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত দেয়া বিকৃত রুচি, নোংরা রুচির পরিচয়’?
কেউ যদি কাউকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, যদি সেটা উভয় পক্ষেই হয়, তাতে যদি কেউ হামলার শিকার হয় তবে আপনার সরকার দায় না নিলে একটা কথা ছিলো। কারণ এই গালাগালি, ধর্ম, দলিয় সাপোর্ট, নারীঘটিত, নানান ব্যক্তিগত বাক্যালাপ থেকে দুইজন ইন্ডিভিজুয়াল একে অপরের উপর হামলা করতে পারে। তাতে রাষ্ট্রীয় আইনে যে দোষী সাব্যস্ত হবে তার সাজা হবে। সেখানে সরকারের আলাদা দায় নেই। কিন্তু, কনস্ট্রাকটিভ ক্রিটিসিজমের কারণে কারো ধর্মীয় অনুভূতি আহত হলেই সে হত্যার বা হামলার রাইট পেয়ে যাবে না, এই দায়তো সরকারকে নিতেই হবে। বাড়ির ছেলে যদি অন্য বাড়ির ছেলেকে গালি দেয়, তাহলে বাড়ির লোক তার দায় নাই নিতে পারে। কিন্তু বাড়ির ছেলে যদি যুক্তি সঙ্গত বিতর্ক বা লেখালেখির কারণে হত্যা হয়, এই দায় বাড়ির লোক কীভাবে এড়ায়? একটি দেশে মুক্তচিন্তা করা যাবে না, ধর্মীও বিষয়ে লেখা যাবে না, তাহলে সেই দেশ পিছাবে না আগাবে? মুসলিম কান্ট্রিগুলোর কথাতো আমার চেয়ে আপনার অনেক ভালো জানার কথা। ঐসব দেশের হিউম্যান রাইটস বা আর্থসামাজিক অবস্থা কী ভালো? আপনি বলুননতো পৃথিবীর ইতিহাসে কোন লেখক বা বিজ্ঞানী, বা দার্শনিক একজনও মুসলিম প্রিচারকে হত্যা করেছে? অথচ দেখুন পৃথিবীতে কত শত লেখক মুক্তচিন্তার মানুষ, মুসলমানদের হাতে নির্মম ভাবে নিহত হয়। আপনি যখন বলেন সরকার দায় নেবে না, তাহলে মুক্তচিন্তার বাংলাদেশের মানুষদের একটি লিস্ট করে ১৯৭১ এর মতো বাড়ি থেকে ধরে ধরে বদ্ধভুমিতে নিয়ে মেরে ফেলে দিতে বলুন মৌলবাদীদের। ঝামেলা চুকে যাক। আপনারাও দায় নিয়েন না। একজন লেখক কত পরিশ্রম করে কত পড়াশোনা করে তারপর একটি লেখা লিখে। আর একজন ধর্মান্ধ মানুষ সেই লেখা পড়ে অফেন্ডেড ফিল করলেই ধর্মীয় আবেগে তাকে হত্যা করবে? আপনার সরকার এই জনগণের অসহিষ্ণুতার দায় নেবে না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মসজিদে, খুতবায়, ওয়াজ মাহফিলে, অন্যান্য ধর্মের প্রতি যে ঘৃণা যে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, নাস্তিকদের হত্যার বয়ান দেয়া হয়, আপনার কানে কি তা একটিও পৌছায় না? আমি জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতার কথা বাদই দিলাম। কোন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, নাস্তিক তাদের কথায়, বা লেখায়, বা গালিতে অফেন্ডেড হয়ে, একজন মুসলিমকে ধরে গালে একটি থাপ্পড় মেরেছে বলতে পারেন? না মারেনি। কিন্তু তারা কি প্রতিনিয়ত এইসব বয়ান মাইকে শুনে ওয়াজ শুনে- লেখা পড়ে অফেন্ডেড হয় না? কই তারাতো হামলা করে না। আজ আপনি মুক্তচিন্তার মানুষদের দায় নিচ্ছেন না। কিন্তু এরাই কিন্তু দেশ প্রেমিক। দেশকে ভালোবাসে। মেধাবী সব ছেলে মেয়ে, জাতীয় সঙ্গীত গায়, শোনে, বাজলে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু মোল্লারা কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত শুনলে উঠে দাঁড়াতে চায় না, পতাকা উত্তোলন করতে চায় না। এদের মন পড়ে থাকে মক্কায় আর মদিনায়। মুসলিমলীগ থেকে আওয়ামীলীগ একটি আধুনিকতা, কিন্তু আওয়ামীলীগ থেকে ফের আবার মুসলিমলীগ কিন্তু একটি ব্যর্থতা হবে। এই দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই উল্টো পায়ে উল্টো সময়ের দিকে হাঁটছে। আপনার নৌকাও কী ওই উল্টো স্রোতে ভেসে যাবে? হাল ধরার কেউ কী নেই? আপনি যখন বলেন- দায় নেবেন না, তখন মুক্তচিন্তা ডিফিউজ না, পুরোপুরি ফিউজ হয়ে যায়। আপনি উন্নতির প্রদীপের আলোটুকু দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু এই ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল প্রদীপের নিচে যে আত্মিক অন্ধকার সেটাকে দেখছেন না। যেই দেশে মুক্তচিন্তা নেই সেইদেশ ইন্টারনালি মানবিক দিক থেকে কলাপ্স হতে বাধ্য। সে ইরাক, হোক ইরান হোক, সিরিয়া হোক, পাকিস্তান হোক, আর বাংলাদেশ হোক। হয়তো আপনি দেখে যেতে পারবেন না। কিন্তু আপনার সন্তানরা দেখবে এই বাঙলা কীভাবে আফগান, পাকিস্তান হয়। আপনার সন্তানদের সামর্থ্য আছে, তারা অন্য দেশে সেটেল করবে, কিন্তু যে জনগণের নেই তারা কী করবে ?
হেফাজতে ইসলাম যে ১৩-দফা দাবি তুলেছিল সেটি নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ১৩ দফার মধ্যে ইসলাম অবমাননা কটূক্তিকারীদের মৃত্যুদণ্ডের আইন, দেশে ভাস্কর্য স্থাপন নিষিদ্ধ এবং শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি ছিল উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া ২০১৬ সালে পাঠ্যবইয়ে ১৭টি বিষয় সংযোজন ও ১২টি বিষয় বাতিলের সুনির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলন করেছিল সংগঠনটি। ২০১৭ সালে নতুন পাঠ্যবই প্রকাশের পর দেখা গেছে এসব সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। হেফাজত এজন্য সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদও জানিয়েছে।
ইসলামপন্থী এ সংগঠনের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারের অবস্থান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ. টি. ইমাম বলেন, “রাজনীতিতে বলুন, সরকার পরিচালনায় বলুন সবসময়ই ছোটখাটো অনেকসময় আপোষ করতে হয় বৃহত্তর স্বার্থে। যেমন, এর আগে নারী নীতি নিয়ে কথা হয়েছিল তখন আমি নিজেই আলেম ওলামাদের সঙ্গে বসেছি, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি।”
“তারপর শিক্ষানীতি নিয়ে যখন কথা হয়েছে তখন আমাদের সরকারের থেকে ক্যাবিনেটেই সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে যে, এই নীতিমালাগুলোতে এমন কিছুই থাকবে না যেটি শরিয়া পরিপন্থী, কোরান হাদিসের পরিপন্থী। আসলে থাকেও নি।
বিবিসি নিউ বাংলা।
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ.টি ইমাম যখন বলেন-
We practice secularism, and the enemies of secularism are those people the bloggers and those who kill them.
হত্যাকাণ্ড যখন চলছে তখন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ধর্ম নিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে ‘বাড়াবাড়ি’ করলে সরকার সেটি সহ্য করবে না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলছেন তাদের দল কোন ধর্মকে অবমাননা করে কোন লেখার বিষয়ে কখনোই নীরব ভূমিকা পালন করতে পারে না।
মি: হানিফ বলেন,
“আমরা মুসলমান হিসেবে আমাদের ধর্মের প্রতি সমর্থন থাকবে। যে দেশের নব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান, সে দেশের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কেন তার বিপক্ষে যেতে হবে?আমাদের ধর্মের প্রতি যেমন সমর্থন থাকবে তেমনি অন্য ধর্মের প্রতিও আমাদের শ্রদ্ধা আছে।”
অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র দিক থেকেও তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- ব্লগারসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে তারা কিভাবে দেখছেন?
মি: রিজভী বলেন,
“যে শক্তি এ কাজটি করছে তারা দেশ ও মানুষের শত্রু। বিচারের দায়িত্ব সরকারের। যারা এসব কাজ করছে তাদের সমূলে ধ্বংস করতে হবে। ”
হত্যাকাণ্ডর শিকার হওয়া ব্লগারদের কারও কারও নাস্তিক হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অনেকেই তাদের নাস্তিক হিসেবে বিবেচনা না করে ইসলাম-বিদ্বেষী হিসেবে মনে করেন। কারণ তাদের বিভিন্ন লেখায় ইসলাম ধর্মের সমালোচনা উঠে এসেছে।
এসব ব্লগারদের ক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ধর্ম নিয়ে সমালোচনার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।
মি: রিজভীর বর্ণনায়,
“একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনে আঘাত দিয়ে কোন কিছু লেখা খুবই দু:খজনক।”
আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী দশম মন্ত্রীসভার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে, তিনি মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় ভিত্তি হজ্ব সম্পর্কে কটূক্তি করেন ফলে ইসলামপন্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। মুফতি ফয়জুল্লাহ, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব তারপরও পাব্লিক্যালি বলেন-
‘বক্তব্য পরিষ্কার। শেখ হাসিনা, আপনি লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রীপরিষদ থেকে অপসারণ করেছেন, আপনাকে স্বাগতম জানাই। কিন্তু আমাদের দাবী এখানে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের দাবী হচ্ছে- লতিফ সিদ্দিকী মুরতাদ। মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার।’
(ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ)
উপরে ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ে যা পড়লাম, এরপরেতো বলার আর কিছু নেই। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ব্লগার হত্যার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে ক্ষমতাসীন দলের নেতার বক্তব্য, উপদেষ্টার বক্তব্য, বিরোধী দলের বক্তব্য এবং ইসলামি দলগুলোর মুখপাত্রের প্রতিক্রিয়াও দেখলাম। একজন মন্ত্রীকেই যখন মন্ত্রিত্ব থেকে জোড় পূর্বক অপসারণ করা হয়, তখন এই জঙ্গিদের শক্তিতো বোঝাই যায়। বাংলাদেশে কতটা ইসলামাইজেশন হয়েছে সেটাও বোঝা যায়। এখানে তরুণ, নাম পরিচয়হীন নাস্তিক ব্লগার, সেক্যুলারের যে কী ভবিষ্যৎ সেটা আর বুঝিয়ে বলার নেই।
এখন চলুন দেখি দেশের ভিতরে যারা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কিছু লিখেনি, বলেনি, শুধু তাদের নাম আর পরিচয়তেই মুসলমানের অনুভূতি সারাক্ষণ আহত হচ্ছে- সেইসব বিধর্মী ও সংখ্যালঘুদের নীরবে কী অবস্থা।
আবারো তথ্য, এবং খবর:
আমরা মুসলিম, মূর্তি ভাঙতে জন্ম নিয়েছি, মূর্তি গড়তে জন্ম নেইনি।
– আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ
একের পর এক মৌলবাদী ইসলামি সংগঠনের উত্থান, তাদের রেডিক্যাল ফতোয়া, সরকারের তাদের সাথে আপোষনীতি, এবং প্রায় নিয়মিত বিধর্মীদের ঘর-বাড়ি ধর্মীয় অনুভূতি তথাকথিত অবমাননার নাম করে (মিথ্যা রটনা রটিয়ে) জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া একটা স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে এই দেশে। সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের কিছু তথ্যসূত্র হুবহু তুলে ধরা হলোঃ
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে হত্যার মধ্য দিয়ে মন্দিরের পুরোহিত ও সেবায়েত হত্যাকাণ্ডের শুরু। বছর জুড়ে হত্যা-জখম-নির্যাতনের এই ধারা অব্যাহত ছিল। ধর্মীয় গুরুদের পাশাপাশি সাতক্ষীরার আশাশুনিতে হিন্দুধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষ নির্যাতনের শিকার হন বছরের প্রথমার্ধে। বছর শেষ হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বছর শেষে মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের দিক থেকে ২০১৬ সাল ছিল উদ্বেগজনক।
গতকাল শনিবার আসক বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৬ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আটটি জাতীয় দৈনিক ও নিজেদের অনুসন্ধান থেকে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করে আসক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ১৯২টি বাসস্থান, ২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ১৯৭টি প্রতিমা, পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, ৫টি জমি ও বসতবাড়ি দখলের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ৬৭ জন আহত ও ৭ জন নিহত হন। এর বাইরে পঞ্চগড়, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঝিনাইদহ, পাবনা, যশোর ও বগুড়ায় মঠের অধ্যক্ষ ও সেবায়েতরা খুন হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে যশোরের কেশবপুর থেকে প্রবীণ মল্লিক নামের একজন মন্দিরের সেবায়েত নিখোঁজ হওয়ার ১৩ দিন পর বাড়ির পাশ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার হয়।
এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর সহিংসতায় সাতক্ষীরার আশাশুনির চার গ্রামের ১০০ হিন্দু পরিবার ঘরছাড়া হয়। ২৯ মে কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের শতাধিক বাড়িঘর, মন্দির ভাঙচুর করাসহ পিটিয়ে ৩০ জনকে আহত করেন। ‘ধর্মীয় অবমাননা’র ধুয়া তুলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায়। নাসিরনগর সদর ও হরিণবেড় গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৫টি মন্দির ও অর্ধশতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও প্রশাসনের পাহারার মধ্যেও আরও তিন দফায় মন্দির ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। একই অভিযোগ তুলে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে সংসদ সদস্যের সামনে কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়। ইসলামপন্থী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের তস্করেরা এবং তাদের ইসলামী মিত্র জামাআতে ইসলামী হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধদের পিটুনি দিয়ে চলেছে। জাতীয়তাবাদী ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনীতিতে জড়িত হওয়া ঘোরতর ভাবে অপছন্দ করে। হিন্দুদেরকে ভয় দেখিয়ে অথবা ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে নির্বাচনে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয় ( দি ডেইলি স্টার, ৪ জানুয়ারি, ২০০৬) প্রায়ই হিন্দুদেরকে ভয় দেখানো হয় যে তারা ভোট দিলে তাদের মহিলাদের সম্ভ্রমহানি ঘটবে, তাদেরকে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করা হবে। হিন্দুদেরকে ভোট প্রদানে বিরত রাখার তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে শারীরিকভাবে বাধা দেওয়া। জাতীয়তাবাদী-ইসলামপন্থী দুর্বৃত্তরা পাহারা দেয় যাতে হিন্দুরা ভোট কেন্দ্রে যেতে না পারে। প্রধানত গ্রামীণ এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে। (রায়, ২০০৭, পৃঃ ৩৫৯, ১৫২ অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য সরকার কিছুই করে না।
নারী ও শিশুদের অপহরণ ও ধর্ষণ, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরকে জোর করে বিয়ে করা, জিজিয়া করের নামে টাকা আদায়, জোর করে ধর্মান্তর করা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে হত্যা করা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই হিন্দু বিধবাদেরকে নিজ হাতে তাদের গরু হত্যা করে এবং তার মাংস রান্না করে সবার সামনে খেয়ে মুসলমান হতে বাধ্য করা হয় (রায়, ২০০৭, পৃঃ ১২০,১২৫)শারীরিক নিরাপত্তার জন্য অনেক পরিবার বহু আগে থেকে তাদের’স্বদেশভূমি’ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ এই ’হিন্দু গণহত্যা’ পুরোপুরি ইচ্ছাকৃত এবং প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে সরকার কর্তৃক সমর্থিত। এর লক্ষ্য হচ্ছে সকল সংখ্যালঘুকে নিশ্চিহ্ন করে বাংলাদেশকে খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা। পরিস্থিতি এতটা উদ্বেগজনক যে,বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের দুর্দশা বর্ণনা করে প্রকাশিত এক নিবন্ধের (২৯ নভেম্বর,২০০৩) শিরোনাম ছিল: ’বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঃ কেবলমাত্র বহির্গমন লাউঞ্জই নিরাপদ।’ (উদ্ধৃতি, দত্ত, ২০০৫) বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর একটা তালিকা নীচে দেয়া হল:
হিন্দু মহিলারা (৮ থেকে ৭০ বছর বয়সী) প্রায়ই গণধর্ষণের শিকার হন। প্রায় ২০০ হিন্দু মহিলা একই স্থানে এক রাতে ভোলার চরফ্যাশনে মুসলমানদের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন (দি ডেইলি স্টার, ১৬ নভেম্বর, ২০০১ইসলামী সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করে বলেছে, কর দিতে না পারলে তাদের স্ত্রী, বোন ও কন্যাদেরকে মুসলমানদের হাতে তুলে দিতে হবে। (সূত্র ঃ ক্রিশ্চিয়ান সলিডারিটি ওয়ার্ল্ডওয়াইড, ১৩ ডিসেম্বর,২০০১)মুসলমান সন্ত্রাসীরা মা ও মেয়েকে একত্রে একই বিছানায় ধর্ষণ করেছে,বাবা-মা এবং সন্তানদেরকে এ দৃশ্য দেখতে বাধ্য করেছে, তারা সন্তানদের সামনে মা’দেরকে ধর্ষণ করেছে। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২, ২২ এপ্রিল,২০০২)।১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী গ্রামগুলোর প্রায় ৪০০ মুসলমান কুমিল্লার দাউদকান্দিতে সোবহান গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালায়। মুসলমানরা তাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ’সরকার ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করেছে। সুতরাং তোমাদের হয় মুসলমান হয়ে যেতে হবে নতুবা দেশত্যাগ করতে হবে।’ তারা লুটপাটের পর প্রতিটি হিন্দু বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মন্দিরগুলো ধ্বংস করে এবং মহিলাদের উপর গণধর্ষণ চালায়। (সূত্র, বৈষম্যের শিকার বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়, মতিউর রহমান ও আজিজুল হক সম্পাদিত,১৯৯০, উদ্ধৃতি দত্ত, ২০০৫)প্রায়ই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার চালান। যেমন, গোপালপুরে থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন ’মাঝরাতে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি ২টি আশ্রম, ১টি কালী মন্দির ও ৩টি বাড়ী ভাংচুর করে। এ সময় তাদের প্রহারে ৭/৮ জন আহত হয়’ (দি ডেইলি স্টার, ৩ জুন, ২০০৩)।