জেএমবি সাড়ে চার বছরে (সেপ্টেম্বর ২০০১ থেকে ডিসেম্বর ২০০৫) দেশে ২৬টি হামলা চালায়। এসব ঘটনায় ৭৩ জন নিহত এবং প্রায় ৮০০ জন আহত হন। একই সময়কালে হরকাতুল জিহাদও (হুজি-বি) বেশ কয়েকটি নাশকতামূলক হামলা চালায়। সব মিলিয়ে তখন দেশে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
পাকিস্তান-আফগানিস্তানকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হুজি ও জেএমবির মধ্যে ধর্মীয় মাজহাবগত পার্থক্য রয়েছে। হুজি সদস্যরা ছিলেন হানাফি মাজহাবের এবং দেওবন্দ ধারার কওমি মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া করা। আর জেএমবির সদস্যরা বেশির ভাগ এসেছেন মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে থাকা মাদ্রাসা থেকে এবং আহলে হাদিস ধারার মাদ্রাসা থেকে। জেএমবির নেতা-কর্মীরা সবাই এসেছেন আহলে হাদিস বা ‘লা মাজহাবি’ (মাজহাববিরোধী) ধারা থেকে। প্রতিষ্ঠাকালীন শীর্ষ নেতাদের একজন মো. ফারুক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ ছিলেন হানাফি মাজহাবের এবং সাবেক হুজি সদস্য। তিনি জেএমবিতে আসার আগে আহলে হাদিস মতাদর্শ গ্রহণ করেন।
আহলে হাদিস ধারাটি আগে ‘ওহাবি’ নামে বেশি পরিচিত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যসহ বহির্বিশ্বে এরা সালাফি হিসেবে পরিচিত। ধারাটি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হলেও মধ্যপ্রাচ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সৌদি আরবের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে সালাফি ধারার ‘জিহাদি’ সংগঠন প্রতিষ্ঠার ধারণা পান বা আগ্রহী হন জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শায়খ আবদুর রহমান।
জেএমবির লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। তারা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে প্রচারপত্রে বলেছিল, তারা এ দেশে ‘আল্লাহর আইন’ বা শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করতে চায়।
জেএমবিকে ‘হোমগ্রোন’ বা দেশজ সংগঠন বলা হলেও শুরু থেকেই এর প্রতিষ্ঠাতা শায়খ রহমানের লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের সহযোগিতা নিয়ে এ দেশে সশস্ত্র লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি করা। এর মধ্যে পাকিস্তান, ভারত ও যুক্তরাজ্যকেন্দ্রিক সালাফি মতাদর্শের একাধিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ স্থাপনও করেছিলেন। নিজে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন পাকিস্তানে জঙ্গিদের একটি আস্তানায়। গ্রেপ্তার থাকা অবস্থায় তিনি এর বিস্তারিত বিবরণ দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।
প্রাক-তৎপরতা: শায়খ আবদুর রহমানের বাড়ি জামালপুরের চরশী এলাকায়। বাবা মরহুম মাওলানা আবদুল্লাহ ইবনে ফজল ছিলেন আহলে হাদিস মতাদর্শীদের কাছে একজন প্রখ্যাত আলেম ও জনপ্রিয় বক্তা।
শায়খ রহমান জামালপুরের কামাল খান হাট সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৭৮ সালে ফাজিল (স্নাতক সমমান) পাস করেন। রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ ইসলামিয়া মাদ্রাসায় তিনি কামিল পড়েন। ১৯৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে যান মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে তিনি লিসান্স (ইসলামের মূলনীতি ও ধর্ম প্রচার বিষয়ে স্নাতকোত্তর) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে আসেন ১৯৮৫ সালে।
২০০৬ সালের ২ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে শায়খ আবদুর রহমান বলেছেন, ‘সৌদি আরবে থাকাকালীন মিসরভিত্তিক মুসলিম ব্রাদারহুডের (ইখওয়ানুল মুসলিমিন) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। বিশ্বজুড়ে জিহাদি কর্মকাণ্ড পরিব্যাপ্ত হওয়ার কারণে বাংলাদেশেও ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে জিহাদকে বেছে নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি। পড়াশোনা শেষে বাংলাদেশে ফিরে এসে জামায়াতে ইসলামীর কার্যপদ্ধতি তথা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে আমার নীতিগত পার্থক্যের কারণে আমি তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে না পেরে আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশে ইসলামিক আইন কায়েমের জন্য আলাদা জিহাদি সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা করি।’
দেশে ফেরার পর শায়খ রহমান প্রথমে জামালপুরে তাঁর শ্বশুরের প্রতিষ্ঠিত মির্জা কাশেম সিনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে একটি সাবান কারখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর ১৯৮৬ সালে সৌদি দূতাবাসে চাকরি নেন তিনি। সেখানে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চাকরি করেন। এরপর কখনো সারের ব্যবসা, কখনো বিদেশ থেকে ছোলা ও মসুরের ডাল আমদানি, কখনো আরবি অনুবাদ প্রতিষ্ঠান—এমন নানা ব্যবসা করেন। ব্যবসার আড়ালে ‘জিহাদি’ সংগঠন করার প্রাক-প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন ছদ্মনামে ‘জিহাদি’ বই লেখা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এসব বই জেএমবির সদস্যদের পাঠ্য ছিল।
জেএমবি প্রতিষ্ঠার আগে শায়খ আবদুর রহমান ১৯৯৫ সালে হরকাতুল জিহাদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। জবানবন্দিতে তাঁর ভাষ্য ছিল এমন—‘প্রাথমিকভাবে আমার হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ধর্মীয় মতাদর্শগত, বিশেষত মাজহাবি পার্থক্যের কারণে আমি হরকাতুল জিহাদ সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার প্রাথমিক চিন্তাধারা থেকে সরে এসে নিজস্ব দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিই।’
সংগঠন তৈরির প্রস্তুতিপর্বে শায়খ রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভারতের জঙ্গিনেতা আবদুল করিম টুন্ডার সঙ্গে। শায়খ রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন ঢাকার যাত্রাবাড়ী আহলে হাদিস মতাদর্শের বড় মাদ্রাসার পাশে একটি ছাত্র মেসকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন পাকিস্তানের ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার নেতা টুন্ডা। ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে টুন্ডার ব্যবস্থাপনায় বিমানযোগে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যান শায়খ রহমান। এরপর তাঁকে লাহোরে অবস্থিত মার্কাজ আদ-দাওয়া ওয়াল ইরশাদের (পাকিস্তানের একটি আহলে হাদিস সংগঠন এবং লস্কর-ই-তাইয়েবার মাতৃসংগঠন) প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান টুন্ডা। সেখান থেকে পরে মুজাফফরাবাদে গিয়ে লস্কর-ই-তাইয়েবার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ২০ দিন অস্ত্র, বিস্ফোরক, রণকৌশল ও গোপনীয়তা রক্ষার কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
সংগঠন তৈরি: জবানবন্দিতে শায়খ রহমান বলেছেন, ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাসে জেএমবি প্রতিষ্ঠা করেন আবদুর রহমান। ২০০২ সালের প্রথম দিকে আবার পাকিস্তানে যান তিনি। সেখানে লস্কর-ই-তাইয়েবার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমির আবদুস সালাম ভাট্টিসহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন তাঁদের জেএমবির গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য ও কর্মসূচিসংবলিত আরবিতে লেখা চার পৃষ্ঠার একটি লিখিত পুস্তিকা দেন শায়খ রহমান। ওই পুস্তিকায় বাংলাদেশে কেন কিতাল বা জিহাদ প্রয়োজন, তার কারণ উল্লেখ করা হয়। কারণগুলো হলো ১. বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমত কায়েম নেই, ২. ভারতের আগ্রাসী মনোভাব, ৩. বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের তৎপরতা, ৪. সারা দেশে বিভিন্ন পশ্চিমা মিশনারির ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড।
জেএমবি প্রতিষ্ঠা করে নিজেই আমির হন শায়খ রহমান। ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি ভাড়া বাসায় বসে প্রথম শুরা কমিটি হয়। তাতে শায়খ আবদুর রহমান ছাড়া বাকি সদস্যরা ছিলেন খালেদ সাইফুল্লাহ, হাফেজ মাহমুদ, সালাউদ্দিন, নাসরুল্লাহ, শাহেদ বিন হাফিজ ও টাঙ্গাইলের রানা। অবশ্য পরে শাহেদ বিন হাফিজ ও রানা মতবিরোধের কারণে দল ছাড়েন। ২০০১ সালে শুরা কমিটিতে যুক্ত হন ফারুক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুল্লাহ, আসাদুজ্জামান হাজারী, আতাউর রহমান সানি (শায়খ রহমানের ভাই), আবদুল আউয়াল (জামাতা) ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই। তাঁদের মধ্যে ২০০২ সালে নাসরুল্লাহ রাঙামাটিতে বোমা বিস্ফোরণে মারা যান। ২০০৩ সালে আসাদুজ্জামান হাজারী অসুস্থতার কারণে সংগঠন ছেড়ে দেন। অন্যদের মধ্যে এখন সালাহউদ্দিন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। সালাহউদ্দিনকে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা করে ছিনিয়ে নেন জঙ্গিরা।
বিস্তার: জেএমবি দেশকে মোট ছয়টি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত করে কার্যক্রম শুরু করে। মূলত আহলে হাদিস-অধ্যুষিত এলাকায় দাওয়াতি কাজ বা সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে কাজ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের ১৫ জেলার বাইরে জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ ও সাতক্ষীরার কিছু এলাকায় আহলে হাদিস মতাদর্শের লোকজনের বসবাস। তাই প্রথম কয়েক বছরে আবদুর রহমানসহ শুরা সদস্যরা এসব এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। বিভিন্ন আহলে হাদিস মসজিদ ও মাদ্রাসায় বক্তৃতা করেছেন। ২০০৪ সাল থেকে পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে এই প্রতিবেদক ওই সব এলাকা ঘুরে এমন তথ্য পান।
শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মূলত ওই সব এলাকার আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের একটি অংশের ওপর ভর করেই জেএমবির বিস্তার লাভ করেছে। এর মধ্যে বগুড়া, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রংপুর থেকে সবচেয়ে বেশি সদস্য সংগ্রহ করেছে বর্তমানে নিষিদ্ধ এই সংগঠন। প্রশিক্ষণকেন্দ্রও গড়ে তোলে এসব এলাকার চরাঞ্চলে।
তিন ধরনের প্রশিক্ষণ শেষে বাছাই করা সদস্যদের বোমা তৈরি ও অস্ত্র চালনার তালিম দেওয়া হতো। সদস্য সংগ্রহের পর প্রত্যেকের ছদ্মনাম বা সাংগঠনিক নাম দেওয়া হয়। এরপর ‘কাট আউট পদ্ধতিতে’ ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে কার্যক্রম চালানো হয়। বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে নানা ‘কোড’ শব্দ ব্যবহার করে জেএমবি। আর এসব সাংগঠনিক গোপনীয়তা রক্ষার কৌশল লস্কর-ই-তাইয়েবা থেকেই শিখেছেন বলে শায়খ আবদুর রহমান জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। কারও দায়িত্ব বা কর্ম এলাকা যতবার পাল্টায়, ততবার নতুন নতুন ছদ্মনাম ধারণ করতেন তাঁরা। শায়খ রহমানের নিজের ছদ্মনাম ছিল এহসান। শুরুর দিকে তাঁরা কয়েকজন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীর ক্যাম্পে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালনা শিখে এসেছিলেন। বিনিময়ে তাঁদের বোমা তৈরির (আইইডি) প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
অবশ্য জেএমবির প্রথম পর্বে আগ্নেয়াস্ত্রের খুব একটা ব্যবহার ছিল না। তারা মূলত বোমার ব্যবহার করেছে, যার বেশির ভাগ উপাদান দেশ থেকে নেওয়া। বিস্ফোরক জেলসহ কিছু কিছু উপাদান ভারত থেকে সংগ্রহ করা হতো। শায়খ রহমান বলেছেন, তাঁরা কিছু ওয়ান শুটারগান (হাতে তৈরি দেশীয় অস্ত্র) ভারত থেকে এনেছিলেন। এর বাইরে বাংলা ভাই একটি এসএমজি ব্যবহার করতেন, সেটা বাগমারায় চরমপন্থীদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া।
জেএমবির প্রথম পর্বে, অর্থাৎ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ফাঁসির আগ পর্যন্ত কত সদস্য ছিলেন, তার কোনো প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। জোট সরকারের আমলে বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কখনো ৫ হাজার, কখনো ২৫ হাজার সদস্য থাকার কথা বলা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করেন, এমন ব্যক্তিদের তখনকার ধারণা ছিল, এহসার (সার্বক্ষণিক কর্মী), গায়রে এহসার (সাধারণ সদস্য বা সমর্থক) ও তাঁদের স্ত্রীদের সদস্য হিসেবে ধরলে মোট সদস্য ৫ হাজার হতে পারে। এর মধ্যে ২০০৫ সালে দেশব্যাপী বোমা হামলার পর সাত শতাধিক গ্রেপ্তার হন।
২০০২ সালে ভারতের মালদহে জেএমবির ৬৫তম কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সহায়তায় ভারত থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহ করা হতো বলে পরে জঙ্গিনেতারা জবানবন্দিতে বলেছেন। ২০১৪ সালে ভারতের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনার পর সে দেশে জেএমবির উপস্থিতির কথা আলোচনায় আসে।
নাশকতার শুরু: ২০০৫ সালে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা ফাটিয়ে ও প্রচারপত্র ছড়িয়ে আনুষ্ঠানিক জানান দেওয়ার আগ পর্যন্ত জেএমবি খুব একটা পরিচিত ছিল না মানুষের কাছে। যদিও এর আগের বছর ২০০৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে রাজশাহীর বাগমারা ও পাশের দুই জেলার দুই উপজেলা রানীনগর ও আত্রাইয়ে কথিত বাম চরমপন্থী দমনে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে অভিযানের পর থেকে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে এই উগ্র গোষ্ঠীর তৎপরতার কথা আসছিল। তখন তারা জেএমবি নামটি প্রচার করেনি। তখন তারা নাম বলেছিল জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি।
তবে পরবর্তী সময়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাস্তবে জেএমবির প্রথম নাশকতার শুরু ২০০১ সালে। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার রক্সি সিনেমা হল ও সার্কাস মাঠে বোমা হামলা চালায় তারা। এতে ৩ জন নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হন। এরপর ২০০২ সালের ১ মে নাটোরের গুরুদাসপুরে কিরণ সিনেমা হলে ও ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের আগ পর্যন্ত ১৮টি ঘটনা ঘটায় তারা। তারপরও তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের টনক নড়েনি। বরং দেশে জঙ্গি নেই, এসব মিডিয়ার (গণমাধ্যম) সৃষ্টি বলে দায় এড়াতে চেয়েছিল তারা। বিস্ময়করভাবে ময়মনসিংহের সিনেমা হলের বোমা হামলা মামলায় আসামি করা হয় শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের।
২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে জেএমবি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকে ডাকাতি শুরু করে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশের চাপের মুখে তৎকালীন সরকার ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জেএমবি ও জেএমজেবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ফিদায়ি আক্রমণ: জেএমবির প্রধানের দাবি, তাঁদের দলে আলাদা করে আত্মঘাতী বা ফিদায়ি ইউনিট ছিল না। তবে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বোমা হামলার পরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সদস্য ফিদায়ি (আত্মঘাতী) হতে উদ্বুদ্ধ হয়।
জেএমবির নেতাদের ধারণা ছিল, ১৭ আগস্ট হামলায় ব্যবহৃত বোমায় যেহেতু স্প্লিন্টার দেওয়া হয়নি এবং এতে হতাহত হবে না, তাই সরকার খুব একটা কিছু করবে না। এ ছাড়া এক বছর আগে রাজশাহীর তিন উপজেলায় তাদের তৎপরতায় স্থানীয় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ-মন্ত্রীরা যেভাবে সহযোগিতা দিয়েছিলেন, তাতেও জেএমবির নেতাদের মধ্যে এমন প্রত্যাশা জন্মেছিল।
কিন্তু ১৭ আগস্টের হামলার পর নানামুখী চাপে র্যাব-পুলিশকে ব্যাপকভাবে অভিযানে নামতে হয়। কিন্তু নভেম্বর-ডিসেম্বরে জেএমবি ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নেত্রকোনায় পাঁচটি আত্মঘাতী হামলা চালায়। ওগুলোই ছিল দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রথম আত্মঘাতী হামলা। জেএমবি সাড়ে ৪ বছরে ২৬টি হামলায় ৭৩ জনকে হত্যা করে। এসব ঘটনায় আহত হন প্রায় ৮০০ মানুষ।
বিদেশি যোগাযোগ: শুরু থেকেই জেএমবি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একাধিক এনজিওর সহযোগিতা পেয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। এর মধ্যে কুয়েতভিত্তিক রিভাইবাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি অন্যতম। এ বিষয়ে প্রথম আলোতে একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একপর্যায়ে ২০০৫ সালের শেষ দিকে সরকার রিভাইবাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
শায়খ আবদুর রহমান জবানবন্দিতে বলেছেন, তাঁদের সঙ্গে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তাইয়েবার বাইরে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আল মুহাজেরুন নামের একটি জিহাদি সংগঠনের যোগাযোগ ছিল। এর প্রধান সিরীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শায়খ ওমর বাক্রি। সংগঠনটি বাংলাদেশে তাদের সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য জেএমবিকে অনুরোধ করেছিল। তারা এসে চরাঞ্চলে জেএমবির প্রশিক্ষণ সরেজমিনে দেখেও যায়। পরে ১৭ আগস্টের হামলার পর জেএমবি চাপে পড়লে টেলিফোনে আল মুহাজেরুনের নেতারা জেএমবিকে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসে হামলা, র্যাবের ওপর আক্রমণ এবং বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অপহরণ বা তাঁদের ওপর হামলা চালানোর পরামর্শ দিয়েছিল বলে জানান শায়খ রহমান।
২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটে সপরিবার গ্রেপ্তার হন শায়খ রহমান। এর আগে-পরে বাংলা ভাইসহ জেএমবির তখনকার শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা ধরা পড়েন। ২০০৬ সালে জোট সরকারের শেষ দিকে জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ ছয় জঙ্গির ফাঁসির আদেশ হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর ২০০৭ সালের ৩ মার্চ তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে জেএমবির প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটে। এরপর হবিগঞ্জের মাওলানা সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন কমিটি করে সংগঠনটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ২০১০ সালে তিনিসহ নতুন নেতৃত্বের অনেকে ধরা পড়ায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এর পরপরই সক্রিয় হয় আল-কায়েদার অনুসারী আরেক সংগঠন আনসার আল ইসলাম। ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার মধ্য দিয়ে এরা আলোচনায় আসে। আর ভঙ্গুর জেএমবির গর্ভ থেকে জন্ম নেয় আরেকটি জঙ্গিগোষ্ঠী। এরাই এখন নিজেদের আইএস দাবি করে দেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
কলম্বোভিত্তিক রিজিওনাল সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, ‘সারা বিশ্বে এখন যে সন্ত্রাসবাদ আমরা দেখছি, সেটার মূলে রয়েছে সালাফিবাদ। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।’ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিগত শতকের সত্তরের দশক থেকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু ধনী সালাফিবাদ প্রসারে বিনিয়োগ শুরু করে। এরপর গত সাড়ে তিন দশকে সালাফিবাদের পাশাপাশি উগ্র মতাদর্শ ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। এ থেকে ইউরোপ-আমেরিকাও বাদ যায়নি।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমরা শান্তির ধর্ম ইসলামের কথা বলি। কিন্তু সেটা মুখে মুখে। উগ্রবাদের বিপরীতে সহিষ্ণু ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য কোনো উদ্যোগ, বিনিয়োগ নেই। এ বিষয়ে রাষ্ট্রও মনোযোগ দেয়নি।’
/////////
সাত বছর বিরতির পর আবার হামলা ও হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে দুটি জঙ্গিগোষ্ঠী। আগের দুটি সংগঠনের ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এ দুই সংগঠন গত সাড়ে তিন বছরে ৬২টি হামলায় জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে ৯৪ জন। এর মধ্যে সর্বশেষ গুলশানে হামলার মধ্য দিয়ে চরম নৃশংসতা নিয়ে হাজির হয়েছে আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী গোষ্ঠীটি। এ হামলার পর বাংলাদেশের নাম সন্ত্রাসবাদী হামলার বৈশ্বিক মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০১৩ সাল থেকে মাঠে নামা দুই জঙ্গি সংগঠনের একটি হলো আল-কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (বর্তমান নাম আনসার আল ইসলাম) এবং অপরটি সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ‘নব্য জেএমবি’, যারা নিজেদের আইএস দাবি করে। লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেট এখন পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন হলেও দুটি সংগঠনই সালাফি বা আহলে হাদিস মতাদর্শী। দুই গোষ্ঠীরই সদস্যদের বড় অংশ তরুণ এবং ইংরেজিমাধ্যম স্কুল ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করা সচ্ছল পরিবারের সদস্য।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইংরেজিমাধ্যমে পড়ুয়া ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এ দেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়েছে অন্তত দেড় দশক আগে। আর এর শুরুটা করেছে ধর্মভিত্তিক আরেক সংগঠন বর্তমানে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীর। এর পরপর যুক্ত হয় জামাআতুল মুসলেমিন নামে আরেক সালাফিবাদী সংগঠন, যার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।
সূচনায় হিযবুত তাহ্রীর: খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশে সক্রিয় আন্তর্জাতিক সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে ২০০১ সালে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে যুক্তরাজ্য থেকে হিযবুত তাহ্রীর মতাদর্শ এ দেশে আসে।
সম্পূর্ণ নগরকেন্দ্রিক এই সংগঠন শুরু থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তু করে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৩ সাল থেকে হিযবুতের কার্যক্রম দৃশ্যমান হতে শুরু করে। শুরুর দিকে মূলত ঢাকার বিভিন্ন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে ঘরোয়া সভা-সেমিনার করত তারা। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করে ঢাকায় মিছিল-সমাবেশ করে সংগঠনটি প্রথম দেশের গণমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) কয়েকজন শিক্ষকের নেতৃত্বে দেশে হিযবুত তাহ্রীরের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে সংগঠনটি ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তার লাভ করে। এর মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
হিযবুত তাহ্রীর মনে করে, গণতন্ত্র একটি ‘কুফরি’ মতবাদ। তাই গণতন্ত্র ‘অবশ্য পরিত্যাজ্য’। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংগঠনটির পোস্টার, পুস্তিকা, প্রচারপত্রেও একই রকম কথা বলা হয়।
সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে হিযবুতের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার কথা হয়। তাঁরা দাবি করেন, তাঁরা অন্য জঙ্গি সংগঠনের মতো নাশকতা বা সশস্ত্র পন্থায় লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বাসী নন। তাঁরা মনে করেন, মুসলিমপ্রধান দেশে সরকারি বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ জন্য সরকারি বাহিনী ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের সন্তানদের প্রতি সংগঠনটির বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে-পরে সরকারি বাহিনীর উদ্দেশে পোস্টার, প্রচারপত্রও প্রকাশ করে হিযবুত তাহ্রীর।
২০০৮ সালে সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেছিলেন, তখন পর্যন্ত তাঁদের সদস্যসংখ্যা ১০ হাজারের অধিক। যাঁদের অধিকাংশই রাজধানীকেন্দ্রিক। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও কুমিল্লায় সংগঠনটির কার্যক্রম আছে, সদস্যসংখ্যা খুব বেশি নয়।