০
১৬৩০ বার পঠিত
ফাগুন আইইএলটিএস এর জন্য কোচিং করবে। আমাকে জানালো। ওর কোন ইচ্ছেতেই বাধা দিইনি কখনো দু’একটা ব্যতিক্রম বাদে। আর বাধা দেয়ার মতন কোন ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি ফাগুন। বললাম, কর। ক্লাশের প্রথমদিনের অভিজ্ঞতার বলতে গিয়ে জানালো ওকে টিচাররা খুব একটা পাত্তা দেয়নি।
কেনো দেয়নি আমি বলি। ও পোশাকে কখনো জবরদস্ত ছিলো না। বাড়ির পোশাক পড়েই অনেক সময় বেরিয়ে পড়তো। ছেড়া টিশার্ট পড়েই চলে যেতো যে কোন জায়গায়। স্যুটেড-বুটেড হওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিলো না ওর। আগ্রহ ছিলো শুধু জানার। ইংরেজি শিখতে যাওয়া মানে রীতিমত ধোপদুরস্ত হয়ে যাবার ব্যাপার। টিচাররাও সেভাবেই টিউনড। এ রকম এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ের মধ্যে এমন উড়াধুড়া এক ছেলেকে কে প্রথমেই পাত্তা দিতে চায়। সে জন্যেই প্রথম দিনের দেখাতে গুরুত্ব পায়নি ফাগুন। তবে মনে মনে বুঝে নিয়েছিলাম, টিচারদের ভুগতে হবে। যে টিচার তাকে পাত্তা দেয়নি তাকে ভুলবে না ফাগুন। ভুলেওনি। ক্লাশের মধ্যে বিনীত ভাবে ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলো সেই টিচারের। তাও কয়েকবার।
এক মাস যেতে না যেতেই শুনি। তাকে শিক্ষক হিসাবে কাজ করতে বলছে কোচিং সেন্টার কর্তৃপক্ষ। আমি আবার মনে মনে বললাম, আগে চিনতে পারেননি ওকে। শেখ সাদির সেই পোশাকের গল্পের মতন অবস্থা দাঁড়িয়েছিলো। আউলাঝাউলা একটা ছেলেকে গুরুত্ব না দেয়ার ফল ছিলো টিচার হিসাবে কাজের প্রস্তাব। দু’একদিন বোধহয় ক্লাশ নিয়েছিলোও ফাগুন। তারপর ইতি। আমি জানতাম ওর পড়ানোর ধৈর্যটা নেই। কেনো নেই শুনুন। ও দুইবার একটা জিনিস বোঝাতে পারবে তৃতীয়বারই বিরক্ত হয়ে উঠবে। কারণ, তাকে কোন বিষয় কখনো দু’বার বোঝাতে হয়নি। অবশ্য বোঝানোর প্রশ্নও খুব একটা আসে না, সব কিছু সে নিজে নিজেই বুঝে নিয়েছে। টিচারদের উপর ভরসা করেনি। তাই কেউ দু’বারে না বুঝলেই বিরক্ত হয়ে উঠতো। ফাগুনের ধারণা ছিলো তাকে তো দু’বার বোঝাতে হয় না, অন্যকে কেন হবে। ফাগুন সবাইকে নিজের মতই ভাবতো।
যাকগে, যে টিচার তাকে গুরুত্ব দেয়নি। সে টিচারই এক সময় তাকে সেরা বলেছে। শুধু তাই নয় সেই বাচ্চা ছেলেটাকে নিজের কলিগ হিসাবে মানতেও আপত্তি ছিলো না ভদ্রলোকের। বন্ধুদের সাথে সে একবার কি একটা কোর্সে ভর্তির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলো। একজন সেনা কর্মকর্তা ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন। ওকে দেখে বললেন, তুমিতো বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র ইংরেজি বলতে পারবে না, তাই বাংলাতেই জবাব দাও। খুব খেপে গিয়েছিলো ফাগুন। পরে ওর ইংরেজি শুনে ‘সরি’ বলেছিলেন সেই কর্মকর্তা। তবে সেই কোর্সে ওভার কোয়ালিফাইড হওয়া সত্বেও তার সুযোগ হয়নি। তাকে বলা হয়েছিলো দুর্বীনিত। কারণ ও মুখের উপর বলেছিলো, তাও আবার চোস্ত ইংরেজিতে, ‘আপনি কী করে ভাবলেন বাংলা মিডিয়ামে পড়লে কেউ ইংরেজি জানবে না’। আমাদের এখানে যোগ্যদের এভাবেই নানা অজুহাতে বাদ দেয়া হয়। আর অযোগ্যরা পায় জাদুদন্ড, ‘খুল যা সিমসিম’।
আমার লেখার সবচেয়ে বড় ক্রিটিক ছিলো ফাগুন। নির্দয় সমালোচনা করতো এবং প্রশংসাও। আমি লিখে ভয়ে ভয়ে ওকে দেখাতাম। ও পড়তো আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম মন্তব্যের জন্যে। ভালো বললে নিশ্চিত হতাম যে লেখাটা হয়েছে। আর সমালোচনা করলে জায়গাগুলো বুঝে নিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করতাম। এখন আমি লিখি, আমার তাৎক্ষণিক কোনো ক্রিটিক নেই। ফলে আমার অনেক লেখাই ফরমায়েশি হয়ে উঠে। ভুল থেকে যায়। সে হোক বাংলা অথবা ইংরেজি। আমার কিছু লেখা ইংরেজি করে দেবার কথা ছিলো ফাগুনের। আমার ইংরেজি ভালো নয়, তাই ওকে বলেছিলাম। ও বলেছিলো করে দেবে। এখন কীভাবে করে দিবি বাবা, বলতো দেখি!
প্রতিটা মানুষের একটা গোপন ইচ্ছা থাকে তার সন্তান তার মতো হোক। কিন্তু আমি চাইনি আমার ছেলেটা সাংবাদিকতায় আসুক। আমাদের যারা আছেন তাদের কেউ-ই চাইবেন না তাদের সন্তান এ পেশায় আসুক। অনিশ্চিত একটা জীবনে কে তার উত্তরপ্রজন্মকে রেখে যেতে চায়। অথচ ফাগুন এসে গিয়েছিলো। এসেছিলো নিজের ইচ্ছাতেই। তবে এখন কেনো যেনো মনে হয় আমিও হয়তো অবচেতনে চাইতাম ছেলে আমার পেশায় আসুক। আমার ধারাটা টিকে থাক। আমার বাবা যেমন তার ধারাটাকে আমার ভেতর প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেভাবে হয়তো আমার ভেতরটা চাইতো ছেলেটাও আসুক। না হলে, ওর কাজের প্রশংসা শুনলে বুকটা চওড়া হয়ে যেতো, এখনো যায় কেনো!
আমি এ পেশায় কাজ করে বুঝি, ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন রেজা’র মতন ঝকঝকে মেধাবী তরুণ এই পেশায় কতটা প্রয়োজনীয়। এখানে মেধাবীদের সত্যিই বড় প্রয়োজন। একটা স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছাতে মেধাবীদের কোনো বিকল্প নেই। আর মেধাবী হাটে-ঘাটে পাওয়া যায় না, তাদের খুঁজে নিতে হয়। আর ফাগুন রেজা পর্যায়ের মেধাবী পাওয়া অনেকটাই অসম্ভব। না, নিজের ছেলে বলে বলছি না, একজন প্রফেশনাল হিসাবে বলছি। আমি বলার আগে অনেকেই বলেছেন। ও যখন ছিলো, অর্থাৎ ফাগুন গুপ্তহত্যার শিকার হবার আগেও বলেছেন অনেকজন। পিতা হিসাবে তখন শুনেছি শুধু। বলিনি, পাছে যদি অহঙ্কার প্রকাশ পায়, এই ভেবে। আমার ছেলেটার ক্ষতি হয়ে যায়, এমন ভাবনায়। তাই শুধু শুনেই গিয়েছি। এখন কিছুটা বলি, এখনতো ও সব ক্ষতির উর্ধ্বে।
২০১৯ এর ২১ মে ঈদের আগে নিজ জেলায়, নিজের বাসায় ফেরার আগে ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন রেজা নিখোঁজ হয়ে যায়। যে ছিলো দেশের অন্যতম একটি গনমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগের উপ-সম্পাদক। রাতে তার মৃতদেহ পাওয়ায় যায় জামালপুরের নান্দিনা এলাকার রেললাইনের ধারে। আজ ১৪ মাস পূর্ণ হলো তার হত্যাকান্ডের। থানায় মামলা হবার পর ফাগুনের ফোন উদ্ধার হয়েছে। সন্দেহভাজন একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। হত্যাকান্ডে জড়িত বা জড়িতদের সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া গেছে। তারপরেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি সম্ভাব্য মূল খুনিরা। কেন হয়নি, এ নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে। এ প্রশ্নগুলো এক সময় উঠবে এবং এর জবাব নিশ্চিত দিতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
প্রতিটা মাসের একুশ তারিখ পিতা হিসাবে আমার আঙুলের কর গুনে যায়। জুলাইয়ের এক তারিখ ছিলো ফাগুনের জন্মদিন। সেদিনও লিখেছিলাম। আজ একুশ তারিখ। চৌদ্দ মাস পূর্ণ হলো ফাগুন চলে যাবার। প্রতিমাসের একুশ তারিখই আমার কাছে ফাগুনের চলে যাওয়ার দিন। প্রতিটা মাস কাটে আমার অসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে। আর একুশ তারিখে সে যন্ত্রণা অসম্ভবের হয়ে উঠে। যেহেতু ফাগুনের ফিরে আসার পথ নেই, তাই এভাবেই কাটবে যতদিন বেঁচে আছি, থাকবো।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন