সনাতন ধর্ম নারীকে দিয়েছে সম্মান। দিয়েছে ধন, যশ, বিদ্যার মালিকানা। সংহারের অধিকার। বসিয়েছে দেবীর আসনে। কিন্তু ধর্ম বা ধর্মের সৃষ্টিকর্তা পুরুষেরা যেমন তাদের প্রয়োজনে নারীকে দেবীর আসনে বসিয়ে পূজা করেছে তেমনি সেই নারীকেই ‘নরকের দ্বার‘ উপাধীতে ভূষিত করতেও কার্পণ্য করে নি। করেছে গৃহবন্দি, বাবা-মায়ের বোঝা, স্বামীর ভোগের বস্তু আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র।
পুরুষ কখনই নারীকে তাদের চেয়ে অধিক উচ্চস্থানে দেখতে অভ্যস্ত নয়। যখনই কোন নারী জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধিতে পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছে তখনই পুরুষেরা পেশীশক্তি, ধর্ম ও কাল্পনিক ঈশ্বরের সহায়তায় সে নারীকে দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইতিহাসে ক্ষণাসহ আরও অসংখ্য নারীরা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রাক-বৈদিক ও বৈদিক যুগে বিদ্যার্জন, যাগ-যজ্ঞ, শাস্ত্র রচনা, বেদ-উপনিষদসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের শ্লোক, মন্ত্র রচনা ও সংকলনে নারীর অবদান খুঁজে পাওয়া গেলেও, পরবর্তীতে সেই নারীদের থেকেই সেইসব ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
জানা যায় যে, শুধুমাত্র ঋক্বেদের সূত্রকারদের মধ্যে ২৭ জন ছিলেন মহিলা। যাদের মধ্যে গার্গী, যাজ্ঞবল্ক্যর স্ত্রী মৈত্রেয়ী, বিশ্ববারা, লোপাসহ আরও অনেকে উল্লখযোগ্য।
অথচ সেখানেও ছিল নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব। ঋক্বেদের সুত্রকারদের মধ্যে অন্যতম গার্গী যখন যাজ্ঞবল্ককে জনক রাজের রাজসভায় তর্কযুদ্ধে একের পর এক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে থাকেন তখন স্বভাবতই দিগ্বিদিক জয়ী যাজ্ঞবল্কের পৌরুষ্যত্বে আঘাত লাগে এবং তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে গার্গীকে বলে উঠেন-
“গার্গী মাতিপ্রাক্ষীর্মা তে মুর্ধ্বা ব্যপপ্তৎ”
অর্থাৎ. গার্গী আর বেশি প্রশ্ন করোনা, তোমার মাথা খসে পড়বে।
[বৃহদারকোপনিষদ,৩/৬/১]
অর্থাৎ, নারী সে যতোই জ্ঞানী হোক না কেন, তাকে কখনই পুরুষের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া চলবে না, সবসময়ই তাকে পুরুষের পশ্চাদগামী হয়ে চলতে হবে।
ব্রাহ্মণ-নিয়ন্ত্রিত সনাতন ধর্মে কোন রকম ধর্মশাস্ত্র ও ধর্মানুষ্ঠানে শুদ্রকে যেমন কোন অধিকার দেওয়া হয় নি তেমনি নারীকেও দেওয়া হয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
মনুসংহিতায় সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে-
“নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।।“ [৯/১৮]
স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই। এ-ই হ’ল ধর্মব্যবস্থা। “ন ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ” স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে এবং কোনও মন্ত্রেও এদের কোন অধিকার নেই- এজন্য এরা মিথ্যা বা অপদার্থ।
“নারী ও শুদ্ররা বেদ পড়া ও শুনার উপযুক্ত নয়।”
নারীকে সম্পূর্ণভাবে শিকলবন্দী করে পুরুষেরা ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠানের উপর নিয়েছে একচ্ছত্র অধিকার। নারীকে দমন করার জন্য ধর্মগ্রন্থগুলোতে একের পর এক ফতোয়া সংযুক্ত করে সেগুলো কল্পিত ঈশ্বরের বাণী বলে নারীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আচার্য শংকর তার দর্শনশাস্ত্রে প্রচার করলেন,
“পুরুষই সত্য, প্রকৃতি মায়া, মিথ্যা, দুঃস্বপ্ন”।
তিনি নারীকে নরকের দ্বার বলেও সমাজে প্রচার করলেন।
অথচ সনাতন ধর্মে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলেই অনেককে তেড়ে এসে বলতে দেখা যায়, এই ধর্মই নাকী নারীকে সর্বোচ্চ স্থানে বসিয়েছে। সনাতন ধর্মে দেবতার পাশাপাশি লক্ষী, সরস্বতী, দুর্গা, কালী, মনসা ছাড়াও আরো অনেক দেবী রয়েছে। এই ধর্মের সকল দেবীকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা-ভক্তি করা হয়।
দেবী দুর্গার পূজার আরাধনায় মুখবন্ধরূপে কুমারী পূজা করা হয় এবং এ পূজার মধ্য দিয়ে হিন্দুরা সমগ্র নারী জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। অথচ যে দেবীকে নারী জাতির প্রতিনিধি হিসেবে মাতৃরূপে পূজার্চনা, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয় সেই দেবীর সামনেই মন্ত্র উচ্চারিত হয় –
“যশো দেহি, ধনং দেহি, পুত্রং দেহি।“
এখানে কন্যা সন্তানের জন্য কোন মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়না। একদিকে নারীকে দেবীর আসনে বসিয়ে পূজা করা আবার সেই দেবীর সামনেই শুধুমাত্র পুত্র কামনার মন্ত্র! এরচেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে!
হিন্দুদেরকে কথায় কথায় বলতে শুনা যায়, নারী হচ্ছে ঘরের লক্ষী অর্থাৎ সৌভাগ্যের দেবী। কিন্তু বিষ্ণুপত্নী দেবী লক্ষীর কথা মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে উঠে সমুদ্রের মাঝে শায়িত সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুর পা টেপায় ব্যস্ত এক নারী। অর্থাৎ মানবী হোক বা দেবী, নারীর স্থান সর্বদা পুরুষের নিচে আর কাজ সেই একটাই, পুরুষের মনোরঞ্জন ও সেবাদাসী হয়ে জীবন অতিবাহিত করা। এই ক্ষেত্রে মানবী অথবা দেবী কারোরই কিন্তু কোন রেহাই বা ছাড় নেই।
সনাতন ধর্মে নারীদের পর্দাপ্রথার কোন বিধান নেই। যা নিয়েও হিন্দুদেরকে বেশ অহংকার আর গর্ববোধ করতে দেখা যায়। কিন্তু বেদ, মনুসংহিতা ও অন্যন্য ধর্মগ্রন্থের বিধানই বা পর্দাপ্রথার চেয়ে কম কিসে।
ঋক্বেদে আছে-
“যেসকল নারী দেহ রূপ দেখিয়ে অপরের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়, তারা হায়েনার মতো। তাদের পরিত্যাগ করো”। [১০/৯৫/১৫]
তাছাড়া সনাতন সমাজের সাধারণ আচার, অনুষ্ঠানগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায় সনাতন ধর্মে নারীর অবস্থান ঠিক কতটা নীচুতে।
সনাতন ধর্মে শুধুমাত্র বংশের প্রদীপ থিওরি-ই সনাতনী নারীর সমাজে সুস্থভাবে বেড়ে উঠার অধিকার, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, মূলকথা নারীর সমগ্র জীবনকে বিভীষিকায় পরিণত করার জন্য যথেষ্ট।
সনাতন ধর্ম যতোগুলো স্তম্ভের উপর দাড়িয়ে আছে তারমধ্যে জন্মান্তরবাদ অন্যতম। জন্মান্তরবাদের চক্র থেকে মুক্তিলাভ, নরকের ভয়, স্বর্গ নামক সব পেয়েছির দেশের নাগরিকত্ব লাভের আশায়, সর্বোপরি মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ধারণা, সেই জীবনে অফুরন্ত সুখলাভ এবং পূর্বপুরুষদের স্বর্গের পাসপোর্ট-ভিসা কনফার্ম করার জন্য সনাতন ধর্মে তৈরি হয়েছে নানা রকমের অবশ্য পালনীয় রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান।
হিন্দু শাস্ত্রানুসারে আত্মা অমর, অবিনশ্বর। মৃত্যুর পর মানুষের দেহের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না। তখন এই আত্মার কোন অবয়ব থাকে না এবং তা আকাশ, বায়ুমণ্ডল ও জলে অবস্থান করে এবং অকল্পনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে। মৃত্যুর পর থেকে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত প্রতিদিনের পিণ্ড প্রদানের ফলে উক্ত আত্মার অবয়বের পূর্ণতা পায় এবং যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ করে।
অনেক সনাতনী ধর্মগুরুর মতে শ্রাদ্ধ বংশের প্রধান ধর্মানুষ্ঠান। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পূর্ববর্তী তিন পুরুষকে উদ্দেশ্য করে পিণ্ড ও জল প্রদানের পাশাপাশি তাদের নাম উচ্চারণ করা হয় এবং বংশের পিতাকে স্মরণ করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধারণা, এতে করে পির্তৃপক্ষের সাথে বংশের পরবর্তী প্রজন্মের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় এবং এইসব আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই মৃত ব্যক্তির আত্মা স্বর্গে প্রবেশাধিকার পায়। আর এই অনুষ্ঠানেও পুরুষেরা করে নিয়েছে তার একচ্ছত্র অধিকার।
মৃত ব্যক্তির পুত্র (বহুপুত্রক হলে জ্যেষ্ঠ পুত্র) বা পির্তৃকুলের কোন পুরুষ আত্মীয়ই একমাত্র মুখাগ্নী ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করার অধিকারী। পির্তৃকুলে পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।
এ প্রসংগে গড়ুঢ় পুরাণে বলা হয়েছে-
“পুত্র বিনা মুক্তি নাই।”[৪]
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে-
“পত্নী সহগামিনী, কন্যা দুঃখ, পুত্র ঊর্ধ্বতম স্বর্গের আলো, পুত্রহীন ব্যক্তি কখনো স্বর্গলাভ করেনা।” [৬/৩/৭/১৩]
“পিতামাতার জন্য কন্যা সন্তান অভিশাপ। [৬/৩/১৩]
পিতৃকুলের একমাত্র মুক্তিদাতা পুত্র।
সনাতন ধর্মে বর্ণিত বিভিন্নপ্রকার নরকের মধ্যে অন্যতম ও ভয়ংকর নরক ‘পুন্নাম নরক’ এ অপুত্রকদের স্থান হয়। [বাংলা অভিধান]
বামন পুরাণে বর্ণিত আছে-
“পুন্নামনরকং ঘোরং বিনাশং প্রাহ সর্বতঃ।
এতস্মাৎ কারনাৎ সাধ্যস্ততঃ পুত্রো লিগদ্যতে।।”
অর্থাৎ পুত্র জন্মিয়ে এই সকল পাপ (পুন্নামনরক) হইতে ত্রাণ করে। [৫৮]
কিন্তু “নারীদের ক্ষেত্রে জাতকর্মাদিসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের সময় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু পাঠ করা যাবে না।“ [মনুসংহিতা, ২/৬৬]
হিন্দুদের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ মহাভারতে পুরোহিত, ব্রাহ্মণদেরকে শ্রাদ্ধের দক্ষিণাতে অন্যান্য বস্তু ও দ্রব্যাদির সাথে নারীদেরকেও দান করার নজির রয়েছে। [আশ্রমবাসিকপর্ব ১৪/৪, ৩৯/২০, মহাস্থানপর্ব ১/৪, স্বর্গারোহনপর্ব ৬/১২, ১৩]
কোন দম্পতির শুধুমাত্র পুত্র সন্তান না থাকার কারণে এবং পুত্র সন্তান পিতা-মাতার মুখাগ্নি, শ্রাদ্ধাদি, পিণ্ডদান না করলে মৃত্যুর পর সেই দম্পতির নরক গমন হবে এমন আজগুবি আর উদ্ভট বিশ্বাস, রীতিনীতি বৈদিক যুগেরও আগে থেকে সনাতন ধর্মে জায়গা করে নিয়েছে।
বেদে উল্লেখ আছে-
“মেয়েশিশুকে অন্য কোথাও জন্মাতে দাও। এখানে জন্মাতে দাও ছেলে শিশুকে। পুত্র সম্পদ। পুত্র আশীর্বাদ। বৃদ্ধ বয়সে পিতাকে শক্তি দেবে পুত্র। পুত্র মুখাগ্নি করবে পিতার। তাই পিতা স্বর্গে যাবে। পুত্রই পিতাকে নরক থেকে মুক্ত করবে।”
অথচ নারীকে রূপান্তরিত করা হয়েছে পুরুষের শষ্যক্ষেত্রে। যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য পুরুষ যে শষ্যক্ষেত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার করবে। স্বর্গে গমনের আশায় যে শষ্যক্ষেত্রে পুরুষ তার বীর্য নিক্ষেপ করবে পুত্র নামক শষ্য উৎপাদনের জন্য। এর প্রমাণ মনুসংহিতাতেই পাওয়া যায়।
মনুসংহিতায় বলা হয়েছে-
“অন্য নয়টি বংশের পাশাপাশি, যে বংশে পুরুষ জন্মায়না (অর্থাৎ কেবল মেয়ে সন্তানই প্রসূত হয়) সে বংশের কন্যাকে বিবাহ করা চলবে না। কারণ এতে বিবাহোত্তরকালে উৎপন্ন সন্তানও স্ত্রী হতে পার।” [মনুসংহিতা, ৩/৭]
“পুত্রিকাশংকায় ভার্তৃহীনা কন্যা অবিবাহ্যা।” [মনুসংহিতা, ৩/১১]
(ভ্রার্তৃহীনা কন্যার কোন পুত্র হলে সে নিজে পুত্রস্থানীয় হয়ে সপিণ্ডনাদি কাজ করবে, অপুত্রক পিতার এইরকম অভিসন্ধি থাকলে সেই কন্যাকে ‘পুত্রিকা’ বলা হতো।)
“বন্ধ্যাষ্টমেহধিবেদ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা।
একাদশে স্ত্রীজননী সদ্যস্বত্বপ্রিয়বাদিনী।।” [মনুসংহিতা, ৯/৮১]
অর্থাৎ নিঃসন্তান স্ত্রীকে বিয়ের আট বছর পর ত্যাগ করা যায়, মৃত সন্তানের জন্মদানকারী স্ত্রীকে ত্যাগ করা যায় দশ বছর পরে, যে নারী শুধু কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তাকে ত্যাগ করা যায় এগারো বছর পরে, ঝগড়াপরায়ন স্ত্রীকে ত্যাগ করতে বিলম্ব করা যাবে না।
“সেই নারী উত্তম যে পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর কথার উপর কথা বলেনা।” [ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৩/২৪/২৭]
নারীর শুধু একটাই কাজ, পুত্র উৎপাদন করা। যদি নারী স্বামীর সংসারে টিকে থাকতে চায়, যদি সে সমাজে মর্যাদা চায় তবে তাকে অবশ্যই পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে হবে। নাহলে আস্তাকুঁড়েও তার স্থান হবে না।
“বলয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।
ন স্বতন্ত্র্যেণ কর্তব্যং কিঞ্চিত কার্যং গৃহেষ্বপি।।” [মনুসংহিতা, ৫/১৪৭]
বালিকা কিংবা যুবতী অথবা প্রাপ্তবয়স্কা নারীরা স্বাধীনভাবে কোনকিছু করতে পারবে না। এমনকী নিজের ঘরেও না।
“শৈশবকালে নারী পিতার, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীনস্ত থাকবে। নারীরা কখনই স্বাধীন হতে পারবে না, এমনকী তারা স্বাধীন হওয়ার যোগ্যই না“। [মনুসংহিতা, ৫/১৪৮, ৯/৩]
“সর্বগুণে গুণান্বিত নারীও পুরুষের চেয়ে অধম।” [তৈত্তিরীয় সংহিতা, ৬/৫/৮/২]
“সেই পুরুষ সৌভাগ্যবান যার স্ত্রীর সংখ্যা অপেক্ষা পশুর সংখ্যা বেশী।” [ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ২/৩/২/৮]
বিয়ে নামক প্রথার মাধ্যমে বাবা-মায়েরা তাদের মেয়েকে অন্য পুরুষকে দান করে দেন। নিজের গর্ভজাত মেয়ের ওপর তাদের আর কোন অধিকারবোধ থাকে না। তাই বাবা-মায়েরা বৃদ্ধ বয়সে মাথা গোঁজার জায়গা আর তিনবেলা আহার নিশ্চিত করার জন্য ছেলে সন্তান কামনা করে। প্রধান কথা হলো, বংশের প্রদীপও চাই। ছেলেসন্তান না থাকলে যে বংশ নির্বংশ হবে। ফলে পূর্ববর্তী তিন পুরুষের আর স্বর্গে গমন করাও হবে না। মেয়ে আর যাই করুক, বংশের প্রদীপ তো আর জ্বালাতে পারবে না।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, “স্বর্গ ও মর্তের মাঝামাঝি স্থানে পির্তৃলোক অবস্থিত। জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন পুরুষ পর্যন্ত পির্তৃলোকে বাস করে। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন স্বর্গে গমন করেন এবং ঈশ্বরে লীন হন।
যার মানে দাঁড়ায়- কারুর বংশে পুত্র সন্তান না থাকলে সেই বংশের পূর্ববর্তী তিন পুরুষ স্বর্গে প্রবেশের কোন সুযোগই পাবে না। তাদের অনন্তকাল পির্তৃলোকেই থাকতে হবে। যে কারণে হিন্দু সমাজে বংশের প্রদীপ রক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বিষয়।
“পুন্নাম্নো নরকাদ্ যস্মাৎ ত্রায়তে পিতারং সুতঃ।
তস্মাৎ পুত্র ইতি প্রোক্তঃ স্বয়মের স্বয়ম্ভুবা।।” [মনুসংহিতা, ৯/১৩৮]
যেহেতু পুত্র পিতাকে ‘পুৎ’ নামক নরক থেকে পিতাকে উদ্ধার করে, সেই জন্য ব্রহ্মা স্বয়ং তাকে ‘পুত্র’ নামে অভিহিত করেছেন। [পৃথিবীতে যেসব প্রাণীর উৎপত্তি হয় তাদের সেই উৎপত্তিটাকেই ‘পুৎ’ নামক নরক বলা হয়। পুত্র জন্মালে পিতাকে তা থেকে পরিত্রাণ করে, অর্থাৎ পিতা তখন পৃথিবীতে পূনর্জন্ম গ্রহণ না করে দেবলোকে জন্মপ্রাপ্ত হয়। সেই কারণে তাকে ‘পুত্র’ বলা হয়।]
“পুত্রেণ লোকান্ জয়তি পৌত্রেণানন্ত্যমশ্নুতে।
অথ পুত্রস্য পৌত্রেণ ব্রধ্নস্যাপ্নোতি বিষ্টপম্।।” [মনুসংহিতা, ৯/১৩৭]
মানুষ পুত্রের দ্বারা স্বর্গাদি শোকদুঃখহীন লোকপ্রাপ্ত হয়, পৌত্রদ্বারা ঐ মানুষ স্বর্গাদি ঐসব লোকে চিরকাল অবস্থিতি লাভ করে; আর পুত্রের পৌত্রদ্বারা সূর্যলোক প্রাপ্ত হয়।
সমাজে মানুষের পুত্রপিপাসা যতোই বেড়েছে, নারীর প্রতি অন্যায়, অবিচারের মাত্রাও ততো তীব্রতর হয়েছে। এমনকী মেয়ে শিশু ও মেয়েভ্রুণ হত্যার মতো প্রথাও সমাজে চালু হয়েছে শুধুমাত্র পুত্রাকাঙ্খ্যার কারণে।
কারুর কারুর মতে সীতা জন্মের পর থেকেই এই সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার। সীতার পালক পিতা রাজা জনক সীতাকে মাটির নিচে পুঁতে রাখা অবস্থায় একটি হাঁড়িতে পেয়েছিলেন। যেখান থেকে সীতাকে উদ্ধার করা হয়েছিল সেখানকার ঐতিহ্য ছিল জীবন্ত মেয়েশিশুকে হাড়ির ভেতর রেখে তার সাথে একটুকরা গুড় ও একটু সুতা সঙ্গে দিয়ে হাড়ির ঢাকনা শক্ত করে লাগিয়ে মাটির তলায় পুতে রেখে লোকে চেচিয়ে বলতো, ‘গুড় খা, ওখানেই থাক, আর কখনো ফিরে আসিস না, তোর ভাইকে পাঠিয়ে দে‘।
ধর্ম পুত্র চায়, পরিবার পুত্র চায়, সমাজ পুত্র চায়।
ঋক্বেদে উল্লেখ আছে-
“হে সর্বশক্তিমান প্রভু, তুমি পর্যাপ্ত দাতা, ইহাকে (পত্নীকে) উত্তম পুত্রযুক্ত, উত্তম ভাগ্যশালী করো। দশবার ইহাকে পুত্র দান করে পতিকে একাদশতম কর।” [১০/৮৫/৪৫]
বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবল্ক বলেছেন-
“যা হি এব পুত্রৈষণা সা বিত্তেষণা।” [৩/৫/১]
অর্থাৎ যাহা পুত্র কামনা তাহাই বিত্ত কামনা।
পুত্রের আকাঙ্খাই সমাজে নিয়োগ প্রথার মতো জঘন্য আর ঘৃণ্য প্রথার আবির্ভাবের কারণ। মূলত রাজ পরিবারগুলোতে বংশের প্রদীপ রক্ষা ও উত্তরাধিকারীর জন্য এই প্রথা চালু হলেও পরে সমগ্র সনাতন সমাজে এই প্রথা জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এখনো ভারতবর্ষের কিছু কিছু অঞ্চলে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে এই প্রথার ব্যবহার হয়ে আসছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মহাভারতেও নিয়োগবিধির ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু ও সত্যবতীর দুই ছেলের (চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য) কেউই কোন উত্তরাধিকারী না রেখে মারা গেলে বংশ রক্ষার্থে তখন রাজমাতা সত্যবতী বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রীতে (অম্বা ও অম্বিকা) তার কুমারী কালের সন্তান ব্যাসদেবকে ভার্তৃবধুর গর্ভে সন্তান জন্মদানের নির্দেশ দেন। এবং এর ফলে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্ম হয়।
যদিও এখানে বল প্রয়োগের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু ধর্ম, পরিবার ও সমাজ কেউ কী নারীর মতামত বা সম্মতির তোয়াক্কা করেছে? সদ্য বিধবা দুই কিশোরীর কথা কী কেউ ভেবেছিল?
ভাবেনি। কারণ তখন তারা তাদের বংশরক্ষা আর পূর্বপুরুষদেরকে স্বর্গে পাঠানোর বন্দোবস্ত করায় ব্যস্ত ছিল।
কথিত আছে, বিবাহিতা নিঃসন্তান নারীর নাকী মৃত্যুর পর নরকপ্রাপ্তিও হয় না। একেতো স্বামীর শোক, তার ওপরে আপৎধর্ম নামক এক জঘন্য ধর্মীয় প্রথার শিকার! ধর্ষিত হওয়া ছাড়া আর কী কিছু করার ছিল অসহায় এই দুই নারীর?
সন্তান জন্মদানে অক্ষম পাণ্ডুর দুই স্ত্রীও (কুন্তী ও মাদ্রী) একই প্রথা অবলম্বন করে সন্তানের জননী হন।
মনুসংহিতায় “জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী কনিষ্ঠ ভ্রাতার নিকট গুরুপত্নী স্বরূপ এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিকট পুত্রবধু স্বরূপ বলে কথিত হয়েছে“। [৯/৫৭]
তবে আপৎকালে, অর্থাৎ সন্তান সন্ততি না থাকলে বংশ রক্ষা ও ভবিষ্যৎ দেখভালের জন্য জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীতে এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীতে উপগত হওয়ার বিধান মনুসংহিতায় দেওয়া হয়েছে। [৯/৫৮]
অথচ নিরুক্তিতে আছে,
“দেবর কস্মাদ দ্বিতীয় বর উচ্চতে।” [৩/১৫]
অর্থাৎ দ্বিতীয় স্বামীকে দেবর বলে।
অনেক ধর্মগুরুই এই প্রথাকে কল্যাণকর বলে মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু পুত্রসন্তান উৎপাদনের জন্য নারীতে কোন পুরুষ নিয়োগের পূর্বে কী উক্ত নারীর মতামত নেওয়ার আদৌ প্রয়োজনবোধ করা হতো? এই প্রথা যদি ধর্ষণের পর্যায়ে না পড়ে তবেতো ধর্ষণের সংজ্ঞাই পালটে দেওয়া উচিত।
পুত্রের প্রয়োজনে পুরুষেরা যে ধর্মে নারীকে ধর্ষণের স্বীকৃতি পর্যন্ত দিয়েছে, সেই একই ধর্মেই নারীকে দ্বিতীয় বিয়ের, বিধবা নারীর পূনরায় বিয়ের বিরুদ্ধে দিয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
“বিধবা নারীরা পূনরায় বিয়ে করতে পারবে না, তাদেরকে বরং নিরামিষভোজী ও অত্যন্ত দ্বীনহীনভাবে বাঁকি জীবন কাটাতে হবে”
[মনুসংহিতা, ৫/১৫৭, ১৬০]
অথচ সেই একই গ্রন্থে পুরুষের বেলায় সব নিয়ম উল্টে গেল।
“স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ করে স্বামী আবার বিয়ে করবে ও অগ্নাধ্যান করবেন”
[মনুসংহিতা, ৫/১৬৮]
এই হল ব্রাহ্মণ পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সনাতন ধর্ম।
শুধু সনাতন কেন, ইসলাম ধর্মমতেও জানাজার নমাজে মেয়েদের থাকতে নেই, কবরস্থানে যেতে নেই। এইসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ছেলেরা এলাউড্। ছেলেদের কাছ থেকে বাবা-মায়ের মৃত্যু পরবর্তী কেবল একটাই প্রত্যাশা, তাদের জানাজার নমাজে তাদের ছেলেরা থাকবে, তাদেরকে তাদের ছেলেরা কবরে শোয়াবে। ছেলে মুখাগ্নী করবে, বাবা-মায়ের আত্মার তৃপ্তির জন্য পিণ্ডদান করবে, তাদের স্বর্গলাভের জন্য প্রতিবছর তাদের শ্রাদ্ধাদি করবে।
পৃথিবীর প্রায় ৪২০০ ধর্মের প্রায় প্রতিটা ধর্মের সৃষ্টিকর্তাগণ নারীকে যথেচ্ছ ব্যবহার করলেও হাতে গোনা যে কয়টি ধর্ম নারীকে চূড়ান্ত অবমাননা করেছে, সনাতন ধর্ম সেগুলোর মধ্যে প্রথম সারির একটি ধর্ম।
ধর্ম নামক এই অস্ত্রের আঘাতে আজ নারীর চিন্তা, চেতনা, অধিকারবোধ; এমনকী সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচবার কল্পনাশক্তিও লোপ পেয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষে এখনো দেখা যায়, ছেলে সন্তানের আশায় প্রায় পরিবারগুলোতেই অনেকগুলো কন্যাসন্তান জন্ম নিয়ে থাকে। বর্তমান যুগেও ছেলে সন্তান লাভের জন্য শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রায় গর্ভবতী মহিলাকেই মাজারে মানত করতে হয়। পীর, ফকির, দরবেশ বাবাদের পানিপড়া খেতে হয়। এখনো ছেলে সন্তানহীন দম্পতিদের দিকে আমাদের সমাজ করুণার দৃষ্টিতে তাকায়।
সমাজের সেই এককথা- চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, ধর্ষক যাই হোক, ছেলেতো বংশের প্রদীপ। বাবা-মায়ের শেষ ভরসা। এখনো মেয়ে সন্তান জন্মালে পাড়া-প্রতিবেশি, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমাজের প্রতিটা মানুষই সহানুভূতি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। নানান রকমের কথার মাধ্যমে ছেলে সন্তানহীন বাবা-মায়ের প্রতি করুণা প্রদর্শন ও মানসিক নির্যতন চলতেই থাকে।
কিন্তু একবারও কী ভেবে দেখেছেন, আপনাদের ঈশ্বর নামক কাল্পনিক সত্তার মেয়েদের নিয়ে এতো সমস্যা কী কারণে? আর মেয়েদের নিয়ে যখন এতোই সমস্যা, তখন তিনি মেয়েদের সৃষ্টি করতেইবা গেলেন কেন? ছেলেদের মতো মেয়েরাও যে তাদের শরীরে তাদের বাবার জীন বহন করে এই সামান্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞানটুকুও আপনাদের ঈশ্বরের মাঝে নেই?
কী নেই মেয়েদের মধ্যে? শুধুমাত্র ভিন্ন লিঙ্গ নিয়ে জন্মানোর কারণে কেন মেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠান করতে পারবে না? কেন নিজের বাবা-মায়ের ওপর তাদের অধিকার থাকবে না? মেয়ে সন্তান থাকা সত্বেও ছেলে সন্তানহীন বাবা-মা কী কারণে নরকগামী হতে যাবেন?
সনাতন ধর্মের এইসব রীতিনীতি যতোদিন অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকবে, যতোদিন হিন্দুদের স্বর্গের মোহ থাকবে, ততোদিনই বাবা-মায়েদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য ছেলে সন্তানের প্রয়োজন হবে। আর নারীরা অভিশপ্ত, পরগাছা, পাপযোনী আর নরকের দ্বার হিসেবেই থেকে যাবে।