[ গত ১৮ই নভেম্বর ২০১৭ আন্তর্জ্জালিক পত্রিকা ‘বঙ্গযান’-এর ৫ম সন্মিলনীর অধিবেশন হল কলিকাতার কলেজ ষ্ট্রীট কফি হাউসের ত্রিতলে অবস্থিত ‘বই-চিত্র’ সভাঘরে। আমন্ত্রিত সদস্যরাই উক্ত সভাঘরে অংশগ্রহণ করেহিলেন এবং সভাঘর কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল। সেই সভার আলোচনার সারাৎসার পরিবেশন করব পর্য্যায়ক্রমে। আজ এখানে প্রধান অতিথি হিসাবে উক্ত সন্মিলনীতে শ্রীকলিম খান প্রদত্ত ‘অভিভাষণ’ অংশটির পূর্ণাঙ্গ বয়ান নবযুগ ব্লগের পাঠকবৃন্দের উদ্দেশে প্রকাশ করা হল।]
বঙ্গযানের ৫ম সম্মিলনীতে প্রদত্ত শ্রীকলিম খানের অভিভাষণ
মাননীয় মহোদয় ও মহোদয়াগণ,
নমস্কার।
[ আমি একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনাচ্ছি. এটি লিখে শ্রীরবি চক্রবর্ত্তীকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি এতে কিছু সংযোজন/বিয়োজন করেছেন। সেই বিচারে এটি আমার একার কথা নয়, আমাদের দুজনের যৌথ বক্তব্য। এখন সেটিই আমি পড়ে শোনাচ্ছি ]।
সভার আলোচ্য বিষয়ে যাওয়ার আগে, অনুমতি করুন, প্রথমেই ভাষা ও শব্দের দুটো রূপের কথা বলে নিই। যেখান দিয়ে জ্ঞানধারা বা অন্য কোনো অদৃশ্য ধারার ‘তীরে থামা’ হয়, ওঠা নামা করা হয়, তাকে ‘তীর্থ’ বলা হত। গ্রন্থের মাধ্যমে জ্ঞানধারায় নামা যেত বলে গ্রন্থকে ‘তীর্থ’ বলা হত। সেজন্যেই এখনও অভিধানে ‘তীর্থঙ্কর’ শব্দের মানে দেওয়া থাকে গ্রন্থকার বা ‘শাস্ত্রকার’। আর, একই তীর্থের মাধ্যমে যাঁরা কোনো জ্ঞানধারায় নামতেন, তাঁদের সেকারণেই বলা হত সতীর্থ। যে জ্ঞানীর মাধ্যমে কাব্যের জ্ঞানধারায়, ব্যাকরণের জ্ঞানধারায় ও পুরাণের জ্ঞানধারায় নামা যায়, সেই জ্ঞানী ব্যক্তিকেও তাই ‘কাব্য-ব্যাকরণ- পুরাণ-তীর্থ’ বলা হত, এখনও হয়। আর, অনেকেই জানেন, জলধারার বা নদীর বিখ্যাত ঘাটকেও তীর্থ বলা হত; তবে সেটা ছিল তীর্থ শব্দটির সাদৃশ্য অর্থ। শব্দের এই প্রকার সাদৃশ্য অর্থ যাঁরা বুঝতেন, সেকালে তাঁদের বলা হত নিম্ন-অধিকারী এবং অদৃশ্য-সাদৃশ্য উভয় প্রকার অর্থ যাঁরা বুঝতে পারতেন তাঁদের বলা হত উত্তম-অধিকারী। মনে রাখা ভাল, ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল অদৃশ্য জগৎ- সংসার বিষয়ে মানুষের উপলব্ধ জ্ঞানের পারস্পরিক লেনদেন করার জন্যই। …
যাই হোক, এবার আলোচ্য বিষয়ে যাওয়া যাক। কেউ কেউ বলেন, রবি চক্রবর্ত্তী ও আমি, ধর্ম্মচক্র প্রবর্ত্তনের ন্যায় একটি নতুন ‘জ্ঞানচর্চ্চার ধারার’ প্রবর্ত্তন করেছি। বাংলার সংস্কৃতিতে কিন্তু এরকম করে বলার চল নেই, বলতে হয় ‘তোমার কর্ম্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।’ কার্য্যত সত্য সেটাই। সেভাবে ভাবলে আমরা কিছু করিনি; আমাদের দুজনকে, রবি চক্রবর্ত্তীকে ও আমাকে নিমিত্তরূপে খাড়া করে যা করার পরমাপ্রকৃতিই করেছেন; ঘটনাচক্র আমাদের দুজনকে শুধুমাত্র নিমিত্ত হওয়ার যোগ্য করে তুলেছে। আমাদের দুজনকে নিমিত্তরূপে খাড়া করে যে জ্ঞানধারার প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে পনেরোটি তীর্থের বা গ্রন্থের মাধ্যমে সেই জ্ঞানধারায় নেমে পড়া যায়। সেই প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে বঙ্গযান ও তার সুহৃদবৃন্দ যোগ দিয়েছেন; যোগ দিয়েছেন আমাদের চেনা-অচেনা আরও অনেকে। এই সহযোগীদের মধ্যে এমনও দুই তীর্থঙ্কর রয়েছেন, যাঁরা ওই জ্ঞানধারার তীরে দুইখানি নতুন তীর্থ নির্ম্মান করে ফেলেছেন। তীর্থ দুটি ‘বর্ণসঙ্গীত’ ও ‘বিন্দুবিসর্গ’ নামে ইতোমধ্যেই খ্যাতিলাভ করেছে। লোকে ‘বঙ্গযান’সহ পূর্ব্বোক্ত পনেরোটি তীর্থের পাশাপাশি ওই দুই তীর্থে গিয়েও উপরোক্ত জ্ঞানধারায় নামছেন, অমৃতরসে নিমজ্জিত হচ্ছেন এবং সিদ্ধিলাভ করতে শুরু করেছেন।
হ্যাঁ, এ পর্য্যন্ত আমাদের দুজনের নামে মোট পনেরোটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; কোনো প্রকাশকের মাধ্যমে নয়, পাঠকদের অর্থাৎ আপনাদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায়। সেই গ্রন্থগুলিতেই উপরোক্ত জ্ঞানচর্চ্চার ধারা ক্রমান্বয়ে বিধৃত হয়েছে। আপনারা অনেকেই সেই গ্রন্থগুলির সবগুলিই পাঠ করেছেন; কেউ-বা কিছু কিছু পাঠ করেছেন। সেই গ্রন্থাদিতে বিধৃত বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি আজ এখানে করব না; সমগ্র জ্ঞানপ্রবাহকে ধারণ করার অভিজ্ঞতাস্বরূপ নিমিত্তের মজুরীরূপে আমাদের যে উপলব্ধি হয়েছে, তার কথাই অতি সংক্ষেপে বলে নেব; তারপর আমাদের দুজনের মতো আরও কিছু নিমিত্তের খোঁজে চলে যাব আমরা।
মাঝপথে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই আমি কে, এখন কোথায় আছি, কোথা থেকে এখানে এলাম, কী করে এলাম, কেন এলাম … এই সব প্রশ্নের উত্তর জরুরী হয়ে দেখা দেয়। সে সব জানার পর ঠিক করা হয়, এখন তাহলে কোথায় যাব, কী করব। এ কথা কেবল ব্যক্তির ক্ষেত্রেই খাটে এমন নয়, জাতির ক্ষেত্রেও খাটে। অতীত জীবন্ত না থাকলে পরবর্ত্তী পদক্ষেপ সকলের পক্ষেই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। রবি চক্রবর্ত্তী, যাঁর কথা এইমাত্র আপনারা শুনলেন, বুঝেছিলেন ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতিকে, উদ্ভব থেকে আজ অবধি, সমগ্রভাবে না বুঝলে আমাদের অধঃপতনের কারণ জানা যাবে না। তিনি দেখেছিলেন সেই সংস্কৃতিকে আড়াল করে রেখেছে পাশ্চাত্যপ্রভাবে অত্যন্ত প্রভাবিত ভাষাসমূহের প্রচলিত প্রতীকী শব্দার্থবিধি; অতএব ঐ শব্দার্থবিধির রহস্য জানতে হবে। অপরদিকে আমি বুঝেছিলাম আমাদের অধঃপতনের কারণ জানতে হলে আদিকাল থেকে আজ অবধি ইতিহাসটা জানতে হবে এবং তার জন্য আমাদের বেদ-পুরাণাদি থেকে শুরু করে আজ পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের লিখিত ইতিহাসটা পড়তে হবে, বুঝতে হবে।
কিন্তু বেদপুরাণ রামায়ণ মহাভারত তো পড়ে বোঝার কোনো উপায় নেই; পাশ্চাত্য-প্রভাবিত প্রচলিত প্রতীকী শব্দার্থবিধি সেই পথ আটকে বসে রয়েছে। তাকে সরাতে গিয়ে আমাদের হাতে উঠে এল ‘ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি’। মানুষের স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক বহুরৈখিক ও অনায়াস বয়ানের ধারায় পলি পড়ে পড়ে যে একরৈখিক প্রতীকীরূপে কোনোমতে যে ক্ষীণ এক ধারায় সে প্রবাহিত হয়ে চলেছিল, আবিষ্কৃত এই ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি সেই পলি সরিয়ে দিয়ে ধারাটিকে রীতিসম্মত বহুমুখী ধারায় প্রবাহিত করে দিল। জানা গেল, আমাদের প্রাচীন পূর্ব্বসূরী মহান মানুষেরা বিশ্বকে উপলব্ধি করেছিলেন প্রধানত তার অদৃশ্য রূপে এবং ঝাঁক জীবের নিয়ম মান্য করে সকল সদস্যদের নানাভাবে তা জানানোর উপায় বের করেছিলেন – সুর ও সঙ্গীতের মাধ্যমে, মুখের কথার বা ক্রিয়াভিত্তিক-ধ্বনিভিত্তিক (বর্ণভিত্তিক) ভাষার সাহায্যে, অদৃশ্য সত্তার চিত্রাঙ্কন করে ও শত শত মূর্ত্তি বা প্রতিমা গড়ে, হাজার হাজার রকমের আচার অনুষ্ঠান ও প্রথার মাধ্যমে, প্রবাদ প্রবচন বাকধারার বিপুল সমাহারের মাধ্যমে এবং সর্ব্বোপরি বেদ-পুরাণ- রামায়ণ-মহাভারতাদি রচনা করে শ্রুতি ও স্মৃতির মাধ্যমে সেগুলিকে প্রবহমান রেখে।
সুর ও সঙ্গীতের সাহায্যে কেমন করে আমাদের সেই মহান পূর্ব্বজগণ অদৃশ্য জগতের সংবাদ সরবরাহ করতেন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধ্বংসাবশেষ কমবেশী প্রবাহিত থাকলেও, তার রহস্য এখনও অধরা। রবীন্দ্রনাথের হাজার মিনতি সত্ত্বেও সঙ্গীতজগতের কালোয়াতগণ সুরের ভিতরের সেই রহস্য আজও উদ্ধার করে উঠতে পারেননি। আর, বেদ তো শুধু একটি গ্রন্থই নয়; যার দ্বারা বিশেষভাবে বিদিত হওয়া যায়, তাই-ই বেদ। সেই বিচারে ধ্রুপদী সুর ও সঙ্গীত, প্রাচীন ভাষা-প্রবাদ-প্রবচন-বাগধারা, প্রাচীন চিত্র-প্রতিমা-ভাস্কর্য, বহুকাল ক্রমাগত আচার-অনুষ্ঠান-প্রথা-রীতি-নীতি এবং সর্ব্বোপরি লিখিত বেদপুরাণাদি গ্রন্থ-শ্রুতি-স্মৃতি সবই বেদ পদবাচ্য। দেখা যাচ্ছে, ভাষা থেকে পুরাণাদি ও শ্রুতি-স্মৃতি অবধি যে বিপুল সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারা, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি একাই সেই সব বিষয়ের প্রকৃত তাৎপর্য্য একের পর এক সমস্তই উদ্ঘাটন করে হারানো এক বিশাল দুনিয়াকে আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। শিবপূজা, লিঙ্গপূজা থেকে বিড়ালে রাস্তা কাটা অবধি সর্ব্বপ্রকারের বিশ্বাস ও আচারাদির নিহিত সত্যসমূহ সবই উদ্ধার করে দিয়েছে। মোট কথা, এই শব্দার্থবিধি পূর্ব্বোক্ত ভাষারহস্যের অন্ধকার ভেদ করে মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস ও সংস্কৃতিকেই কেবল দেখবার উপায় করে দিল না; জানিয়ে দিল মানুষের অধঃপতনের বা অহিতের মূল কারণ ও বিহিতের উপায়। এখন সবাই যদি সেই কারণ ও উপায়কে বুঝে নিয়ে কাজে হাত লাগান, মানুষের অহিতবিনাশের কাজটি সম্পন্ন হতে পারে। …
এ পর্য্যন্ত আলোচনা থেকে, আশা করি, একটি কথা পরিষ্কার হয়েছে যে, ভাষার চর্চ্চায় ও ব্যবহারে কোনো ত্রুটি না থাকলে একটি জাতির অতীত তার কাছে জীবন্ত থাকে। বাংলাভাষীদের ক্ষেত্রে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি মান্য করে মাতৃভাষার যথার্থ চর্চ্চা তাই একান্ত জরুরী। তার জন্য বাংলাভাষার মর্য্যাদা পুনরুদ্ধার করা, প্রতিষ্ঠা করা এবং তার সঙ্গে যথাযথ ব্যবহার করা চাই। মাকে সংসার থেকে পৃথক করে দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা এবং একদিন তাঁকে দেখতে যাওয়ার মতো মাতৃভাষাকে জগৎসংসারের কাজ থেকে বাদ দিয়ে, ইংরেজী ভাষা দিয়ে সেই কাজ চালিয়ে, বছরে একদিন ২১ শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা দিবস পালনের নামে কান্নাকাটি করলে দুঃখ ঘুচবে না। মাতৃভাষাকে সম্পূর্ণ প্রাণবন্ত রাখার জন্য তার মর্য্যাদা পুনরুদ্ধার করা, প্রতিষ্ঠা করা, নিত্যনতুন সংযোজনের সাহায্যে তার বিকাশ সাধন করে করে চলা দরকার। দুঃখের বিষয় হলেও একথা সত্যি যে, মাতৃভাষা-দিবস পালনকারী একালের বাংলাভাষা- প্রেমিকরা সে রকম কিছুই করেন না।
তাঁরা না করুন, আমরা সবাই যে যার সাধ্য মতো দু-একটা কাজ তো করতেই পারি। আমরা যদি বাংলাভাষাকে আদৌ ভালবাসি তার ন্যূনতম সেবা অনায়াসে করা যায়। যতটুকু বুঝেছি, এ কাজ করার জন্য বড় বড় মিছিল মিটিং কিংবা বিপ্লব করার দরকার নেই, যিনি যতটুকু অবসর পান, ততটুকু সময় ঘরে বসেই এ কাজে যোগদান করতে পারেন। ঐ কাজে যোগদানের ফলে আপনার যা উপলব্ধি ঘটবে, তা পাঠিয়ে দিতে পারেন ই-পত্রিকা ‘বঙ্গযান’-এ। তাঁরা আমাকে বলেছেন, আপনার পরিশ্রমের ফল আপনার নাম উল্লেখ করেই তাঁরা প্রকাশ করবেন এবং সকলের কাজ মিলিয়ে একটা কাজের কাজ হবে বলে আমার মনে হয়। কবি বলেছেন – ‘…বিন্দু বিন্দু জল / গড়ি তোলে মহাদেশ সাগর অতল’। আমাদের মাতৃভাষার জ্ঞানধারার প্রবাহে আমরা যে যার সাধ্যমতো এক-আধ ঘটি জল তো ঢালতেই পারি। আর যাঁরা পারবেন তাঁরা সেই প্রবাহের তীরে নতুন নতুন তীর্থ গড়বেন; উপনদীর ও শাখানদীর ন্যায় নতুন নতুন জ্ঞানপ্রবাহের সূচনা করে ঐ জ্ঞানধারাকে সমৃদ্ধ করবেন।
এখন প্রশ্ন হল – ওই এক-আধ ঘটি করে জল ঢালার কাজটি আসলে কীরকম কাজ?
১) বাংলাভাষার যে বিপুল সংখ্যক শব্দ বাংলাভাষীর মুখ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে; পদাবলী সাহিত্যের ও কীর্ত্তনের, পল্লীগীতির, লালনের এমনকি রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও বহু শব্দই এখন আর ব্যবহৃত হয় না। এসব উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে বঙ্গযান-এ পাঠিয়ে দিন; তাঁরা আমাকে নিশ্চয় করে বলেছেন, আপনার নাম সহ তা সেখানে ছাপা হয়ে যাবে।
২) আমরা এখন দশটির বেশী গাছপালা, লতাপাতা, শাকসবজী, ফুল, ফল, পশুপাখী, জলজ প্রাণী, পোকামাকড়, জড়জগতের সত্তাসমূহের নাম জানি না; জানলেও জানি না তাদের নিহিত অর্থ। অথচ তাদের সকলের নাম, এমনকি স্থাননাম, মনুষ্যনাম, পদবী-নাম, জগতের সর্ব্ব প্রকার সত্তার নামসমূহ জানলেই জগৎসংসারকে দৃশ্য-অদৃশ্য উভয় রূপেই চেনা হয়ে যায়। সে কাজেও আপনারা সহযোগিতা করতে পারেন। এটি একটি বিশাল কাজ। এতে শত শত বাংলাভাষীকে হাত লাগাতে হবে। কেননা, একাজে কেবল বাংলাভাষার নামশব্দের দুনিয়াটা নাই, দুনিয়ার সব ভাষার নামশব্দের দুনিয়াও রয়েছে। এ কাজে একা যোগ দিতে পারেন, গোষ্ঠী গড়েও যোগ দিতে পারেন। বঙ্গযান আপনার এবং আপনাদের সকলের ভাষাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানলব্ধ অবদানের জন্য হাত পেতে রয়েছে।
৩) এর মধ্যে একেবারে প্রাথমিক কাজের কথাও উঠতে পারে। ধরা যাক, বাঙালীর মন পাওয়ার জন্য বাঙালীর বর্ত্তমান শাসকেরা ঘোষণা করলেন যে, প্রশাসনিক সহ সব রকম কাজে ত্রিভাষা সূত্র – বাংলা-হিন্দী-ইংরেজী – এখন থেকে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হবে। তক্ষুনি আবার সেই ১৯৭৫ সালের মতোই দুরবস্থা হবে আমাদের। আমলারা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইবেন – পরিভাষা কই? মুখ্যমন্ত্রী একালের বাংলাভাষার পণ্ডিতদের বলবেন – পরিভাষার একটি অভিধান করে দিন। তাঁরা এমন অভিধান বানিয়ে দেবেন, যাতে ইংরেজী Truck শব্দের বাংলা পরিভাষা থাকবে ‘ষড়্চক্রমালবাহী-শকট’। তা দেখে আমলারা পুনরায় যাবেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। এইরকম বাংলা পরিভাষা দিয়েই কি পশ্চিমবাংলার প্রশাসনিক কাজ চালানো হবে? তিনি চোখ কপালে তুলে বলে উঠবেন – ‘বাংলা পরিভাষার এই নমুনা?’ তার চেয়ে বরং যেমন চলছে তেমনি চলুক। মুখে বাংলা-হিন্দী-ইংরেজী, কিন্তু কাজে ইংরেজী-হিন্দী-বাংলা, ত্রিভাষার একেবারে উলটপুরাণ!
এখন যদি সত্যিই যথার্থ ত্রিভাষা সূত্র – বাংলা-হিন্দী-ইংরেজী – শুরু করতে হয়, তাহলে তো প্রকৃত পরিভাষাকোষ লাগবে? তখন কী হবে? আমরা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছি – আমাদের পূর্ব্বসূরী বাঙালী পণ্ডিতগণ এবং গ্রামবাংলার মূর্খ বাংলাভাষীরাই বাংলার যথাযথ পরিভাষা তৈরী করতেন এবং ঐ দুই স্রষ্টারাই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি মান্য করে সেই পরিভাষা সৃষ্টি করতেন। সেকারণেই আমরা আমাদের পূর্ব্বসূরী বাঙালী পণ্ডিতদের কাছে algebra=বীজগণিত, physics =পদার্থবিদ্যা, Writers’ Buildings=মহাকরণ … ইত্যাদি অজস্র পরিভাষা পেয়েছি এবং মূর্খ বাংলাভাষীর কাছ থেকে stapler=গাঁথনাকল, subway/culvert= গলাপোল, bank of a river=নদীপাল … প্রভৃতি অজস্র বাংলা পরিভাষা পেয়েছি; যা কিনা ইংরেজী শব্দগুলির তুলনায় অধিক সমৃদ্ধ এবং উন্নত মানের। এই নীতি মান্য করে এই কাজে আমাদের ভিতর থেকে দুই শ্রেণীর সহযোগী পরিভাষা প্রস্তুত করার কাজে যোগদান করতে পারেন। একদলে থাকবেন তাঁরা যাঁরা পূর্ব্বসূরী বাঙালী পণ্ডিতদের পথ অনুসরণ করবেন এবং নতুন নতুন পারিভাষিক বাংলা শব্দ উদ্ভাবন করে পাঠিয়ে দেবেন বঙ্গযান-এ। অপর দলে থাকবেন তাঁরা যাঁরা যাবেন মূর্খ বাংলাভাষীর কাছে যে ইংরেজী শব্দের বাংলা পরিভাষা চাই সেই বিষয় বা বস্তুটিকে নিয়ে। কিন্তু যা নিয়ে যাচ্ছেন, তার ইংরেজী নামটি কখনও উচ্চারণ করবেন না মুখে, কিন্তু সেটি কী ক্রিয়া করে বা তা দিয়ে কী করা হয়, সেসব তাঁকে দেখতে দেবেন; প্রয়োজনে বলবেন। খানিক পরে আপনি অবাক হয়ে দেখবেন – বিষয় বা বস্তুটিকে সেই মূর্খ বাংলাভাষী একটি বাংলা নামে উল্লেখ করছেন। এভাবে দেখবেন, ইংরেজী নামওয়ালা বস্তুটির বাংলা নাম আপনার হাতে এসে গেছে। ব্যস! সেই শব্দটাকে, পারলে সংস্কার করে নিয়ে, পাঠিয়ে দেন বঙ্গযান-এ। দেখতে দেখতে পরিভাষাকোষ প্রস্তুত হয়ে যাবে।
৪) এছাড়া আরও নানান কর্ম্মক্ষেত্র রয়েছে। সব মানুষই রসগোল্লা ভালবাসেন না। যাঁদের ভাষা নিয়ে কাজ করতে ভাল লাগে না, কিন্তু দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি বা ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে ভাল লাগে, তাঁরা সেগুলি নিয়েই কাজ করতে পারেন। তাছাড়া নিমিত্ত হয়ে আমরা তো কেবল ভাষাতত্ত্বের কথকতা করিনি; সে তো মূল কাজ থেকে উপজাত (বাইপ্রোডাক্ট) এক পড়ে পাওয়া অমূল্য মুক্তো। প্রধান কাজ তো ছিল রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, ইতিহাস … ইত্যাদির আগাপাশতলা পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের কাজ। বলতে কি জ্ঞানের প্রায় সব শাখাতেই পরমাপ্রকৃতি আমাদের দু’জনকে বিচরণ করিয়েছেন এবং বাঙালীর জ্ঞানভাণ্ডারকে ঋদ্ধ করেছেন। আপনার যেদিকটা নিয়ে কাজ করতে ভাল লাগে, সেদিকেই হাত লাগান। যে কোনো কর্ম্মক্ষেত্রে বঙ্গযান আপনার হাতের ছোঁয়ার প্রত্যাশী। …
ইতোমধ্যে শ্রী দেবতোষ দাশ ক্রিয়াভিত্তিক পথে উদ্ধার করা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন এবং একটি উপন্যাস-গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে কিনা উদ্ধার করা সেই ইতিহাসের এলাকাটা তো বিশাল। চাইলে এখানে আরও দু-পাঁচ হাজার নতুন নতুন গ্রন্থ রচনা করা যেতে পারে। অবসর পেলে লেগে যান। কিংবা শ্রীশুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্রের মতো ভাষাতত্ত্ব নিয়ে লেগে যান। ওখানেও বিরাট এলাকা ফাঁকা পড়ে রয়েছে।
আপনি রাজনীতি নিয়ে কাজ করা পছন্দ করেন? ভাল কথা। লেগে যান। দেখতে পাবেন, গণতন্ত্র যে তিন রকম সেটাই এখনও কেউ সেভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। যে গণতন্ত্র এখন সক্রিয় রয়েছে, তার নাম লুঠেরাতন্ত্র। তার কুষ্টি-ঠিকুজী খুঁজে বার করুন।
সমাজশাসনব্যবস্থার বিষয়ে পাঁচটি আনকোরা গবেষণাপত্র আমাদের দুজনের হাত দিয়ে বেরিয়েছে। এই ক্ষেত্রে দেখতে পাবেন চারিদিকে ধাঁধা। সেই ধাঁধা কাটাতেই কত শত মানুষের মেধা ও শ্রম খরচ হবে তার ইয়ত্তা নাই। সভ্যতার বিকাশ সাধন ও অগ্রগতি বিষয়ক কাজের কথা তো আরও বড় এক কর্ম্মক্ষেত্র। মনে রাখা ভাল, নীতির রাজাকে রাজনীতি বলে। যজ্ঞই ভুবনের নাভি বা প্রোডাকশন সিষ্টেমই সুপারষ্ট্রাকচার-সমূহের নিয়ামক বলে অর্থনীতি রাজনীতি দর্শনাদি সবই জন্মায় সমাজের বিশেষ বিশেষ প্রকারের উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞ থেকেই, তবে তাদের মধ্যে একমাত্র রাজনীতিই পারে কর্ম্মযজ্ঞের ধরণ বদলে দিতে, আর কেউ যা পারে না। সমাজবদলের ক্ষমতা ধরে একমাত্র সমাজের বক্ষ বা হৃদয়, সেকালে যাঁদের কর্ম্মযোগী বলা হত, একালে বলা হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা অ্যাকটিভিষ্ট। …
সবশেষে বলার কথা একটিই। এবার তবে কোনো একটি তীর্থের মাধ্যমে আমাদের নামে চিহ্নিত জ্ঞানধারার প্রবাহে নামুন, ডুব দিন, অমৃত- রসধারায় নিমজ্জিত হয়ে জীবনরস চয়ন করুন, এবং সেই প্রবাহের সেবা করে জীবন সার্থক করুন। পরমাপ্রকৃতি আপনার সহায় হোন।
এইবার আমাকে এই অভিভাষণ শেষ করতে হবে। সেটি আমি শ্রীদেবতোষ দাশ ও শ্রীশুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্রকে অভিবাদন ও অভিনন্দন জানিয়ে শেষ করতে চাই। আমার সহযোগী শ্রীরবি চক্রবর্ত্তীর সেটাই ইচ্ছে; আমারও।
[ এর পর উত্তরীয় পরিয়ে ও পুষ্পস্তবক দিয়ে উভয়কে অভিবাদন ও অভিনন্দন জানিয়ে শ্রীকলিম খান তাঁর অভিভাষণের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ]