৪২৯ বার পঠিত
‘দেশে কোন কাজ করতে গেলেই জট লেগে যায়, কোন কাজই দ্রুত হয় না।’ এমন অভিযোগ যারা করেন তাদের বলি, আরে ভাই চোখ মেলে তাকান, দেখেন কাজ হয় মানে, হয় রীতিমত রকেটের গতিতে!
উদাহরণ দিই, জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর মোবাইল ফোনের কথাই ধরুন।
বেচারা স্বামীর সাথে বন্যার পানি দেখতে গিয়ে একটু সেলফি তোলার আহ্বলাদ করেছেন। কিন্তু হাত ফসকে ফোন পানিতে। স্ত্রীর শখের ফোন বলে কথা। নির্বাহী কর্মকর্তা দ্রুত কাজ নির্বাহের আদেশ দিলেন। চলে এলো ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল। ছয় জন ডুবুরি অনেক ডুবাডুবি করে উদ্ধার করলেন নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর মহার্ঘ ফোনটি। তৃপ্তির হাসি হাসলেন নির্বাহী কর্মকর্তা। গণমাধ্যমকে জানালেন, ‘ফোনটি তার স্ত্রীর বড় প্রিয়’!
সুতরাং, কাজ হয় না কে বললো। পানিতে ডুবে যাওয়া মানুষ উদ্ধারে ডুবুরিদের আসতে দেরি হতে পারে। বিভিন্ন জায়গার অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর ফোন, সেখানে দ্রুত কাজ নির্বাহই মূল কথা। জামালপুরের পাশেই আমার জেলা শেরপুর। কদিন আগে জেলার ঝিনাইগাতীতে বানের পানিতে ডুবে গিয়েছিল একটি বাচ্চা। তাকে উদ্ধারের জন্য ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া হয়েছিল। এসেছিলেনও তারা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। চেষ্টাও করেছিলেন। তবে ডুবন্ত বাচ্চাটির কপাল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রীর ফোনের মতন ভালো ছিলো না। তার জন্যে ছয়জন ডুবুরিও পাওয়া যায়নি। বিকালে নিখোঁজ হওয়া বাচ্চাটিকে উদ্ধার করা হয়েছিল পরদিন দুপুরে, সঙ্গতই মৃত।
যাক গে, সাধারণ মানুষের বাচ্চা, গরীবের ছাও, মরলেই কি বাঁচলেই কি। ‘স্যার’দের ফোনটা যে কত জরুরি। রাজ্যের কাজ হয় সেই ফোন দিয়ে। আর সেই রাজ্যপাটের কাজ যিনি করেন তাকে সামলানো তো আরো কঠিন কাজ। সে কাজটিই করেন গৃহমন্ত্রী মানে স্ত্রী। তার ফোনই যদি পানির নিচে থাকে, তাহলে আর রাজ্য সামলায় কে!
অনেক আগেই লিখেছিলাম, দক্ষিণ এশিয়ার ‘স্যার সিনড্রম’ নিয়ে। একবার নয় বেশ কয়েকবার। কিন্তু কাজ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। ‘মব জাস্টিস’ নিয়েও লিখেছিলাম। কেউ কান খাঁড়া করেননি। এখন সব খাঁড়া করেও থামাতে পারছেন না ‘লিঞ্চিং’কে। এই যে কতিপয় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিগণের নিজেকে রাজা ভাবার চিন্তা, একেই বলা হয় ‘স্যার সিনড্রম’। এমন চিন্তায় ভোগা এসব সরকারি কর্মকর্তা প্রশাসনের ‘অ্যাসেট’ না ‘লায়াবিলিটি’ তা কিন্তু ভেবে দেখার সময় এসেছে। এনাদের কিছু কর্মকান্ডে প্রশাসনে থাকা নিবেদিত প্রাণ কর্মকর্তাদের উপরও আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। উদাহরণ কিন্তু একটা নয়, অনেকই দেয়া যাবে।
সারাদেশ যখন বন্যায় ভাসছে। বানের পানিতে ডুবে এখন পর্যন্ত শিশুসহ মারা গেছেন প্রায় সত্তর জনের অধিক। পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই। ত্রাণের জন্য করা কনসার্টের অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। বিপরীতে মুড়ি, চিড়া, দিয়াশলাই আর মোমবাতি ভর্তি প্যাকেট দিতে গিয়ে গণমাধ্যমের জায়গা ও টিভির সময় দখল করছেন কেউ কেউ। চারিদিকে মানুষের হাহাকারের সাথে বাড়ছে তাদের চাপাবাজিও।
মানুষ যখন বিপদগ্রস্ত, আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন তখন মোবাইল উদ্ধারের এই ‘মশক’টা না করলেই কি হতো না ওই নির্বাহী কর্মকর্তার। এতে কি দায়িত্বশীলদের ভাবমর্যাদা খুব উজ্জ্বল হয়েছে! জানি না হতেও পারে, এমন দ্রুত কর্মসাধনের উদাহরণে! হয়তো এটা নিয়েও কেউ বলবেন, দেখুন আমরা কতটা পারি। পানির নিচে ডুবে যাওয়া মোবাইল উদ্ধার করতে পারি কয়েক ঘণ্টাতেই!
পুনশ্চ: বন্যা, ডেঙ্গু, গণপিটুনি এমন ভয়াবহ সমস্যাগুলোর মধ্যে যখন এমন ‘ক্যারিকেচার’সম কাজ ও বক্তব্য সামনে আসে তখন সাধারণ মানুষের রিঅ্যাকশন কেমন হয়, তা কি যারা এসব করেন- তারা শোনেন, দেখেন বা পড়েন?
এখানে সূত্র রেখে গেলাম:
১) ইউএনও’র স্ত্রীর মোবাইল পানিতে, উদ্ধারে ৬ সদস্যের ডুবুরি দল
২) সেলফি তুলতে গিয়ে ইউএনওর মোবাইল পানিতে, উদ্ধারে ডুবুরি দল
৩) ইউএনও’র স্ত্রীর মোবাইল উদ্ধারে ৬ সদস্যের ডুবুরি দল!
৪) সেলফি তুলতে গিয়ে ইউএনও’র স্ত্রীর মোবাইল পানিতে, উদ্ধারে ডুবুরি দল
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন