১৬১৭ বার পঠিত
Photo Courtesy: Getty Images
অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন কী জন্যে সেটা কী আপনার মনে আছে? দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনি যে গবেষণাপত্রটি করেছিলেন সেটির জন্যে। গবেষণাটি Poverty and Famine নামে প্রকাশিত বই আকারে পাওয়া যায়। এখানে অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন যে দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয়না, দুর্ভিক্ষ হয় মানুষের খাদ্যের অধিকার না থাকলে। সেন ব্যবহার করেছেন Entitlement শব্দটি, সেটিকেই অধিকার বলছি।
অমর্ত্য সেন আমাদের এখানকার মন্বন্তর, চুয়াত্তরের দূর্ভিক্ষ আর আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ এর সবগুলিকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন এইসব দূর্ভিক্ষে যখন হাজার হাজার বা কোন ক্ষেত্রে লক্ষ মানুষ মারা যায় তখন সেইসব দেশে সকল মানুষের জন্যে পর্যাপ্ত খাবার ছিল, বা ব্যবস্থা করার উপায় ছিল। এই যে খাদ্যে অধিকারের কথা বলছি, সেটার জন্যে একটি কার্যকর গণতন্ত্রের উপস্থিতি যে জরুরী সেটাও দেখিয়েছেন অমর্ত্য সেন।
এটা অতি সরল করে বলা। সামাজিক বিজ্ঞানের সকল তত্ত্ব ও ধারণার মতো অমর্ত্য সেনের এই সিদ্ধান্তও বিতর্কের ঊর্ধ্বে না। কিন্তু এই কথাটি মোটা দাগে সকলেই সঠিক মানেন যে একটি কার্যকর গণতন্ত্র যে দেশে থাকে, সেই দেশে চট করে মানুষ না খেয়ে মারা যায় না।
এই কথাটি কেন এখন মনে এসেছে বুঝতে পারছি না। সম্ভবত দেশে যে বন্যা অবস্থা চলছে এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে যেসব পূর্বানুমান শুনছি, সেগুলি থেকে খুব ভয় লাগছে বলেই নানারকম কুকথা মনে আসছে। মানুষ যখন বিপদে থাকে, বা বিপদের শঙ্কার মধ্যে থাকে, তখন মানুষের মনে এইরকম কু’ডাক ডাকেই। মেহেরবানী করে কেউ কোন অপরাধ নিবেন না।
(২)
দেশে বন্যা অবস্থা চলছে। বানের পানিতে গ্রামের পর গ্রাম ডুবেছে, মানুষ মারা গেছে, গরু ছাগলের ক্ষতি হয়েছে, ফসলের ক্ষতি হয়েছে, বাড়ী ঘর ভেসে গেছে। দেশে কোন বন্যা নাই বলে আজ যারা শাহবাগে ইমরান এইচ সরকারকে তাড়া করেছেন, ওরা মন্দ লোক, তস্কর। খুবই খারাপ মানুষ এগুলি। সকলেই বলছেন এরা নাকী ছাত্রলীগের কর্মী। হতে পারে, অসম্ভব কিছুনা। ছাত্রলীগের ছেলেরা কিছুদিন আগে ইমরান আর সনাতনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, ওদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে। আদালতেই ইমরানের উপর হামলা করেছে। ইমরানের ওপর এই হামলাটি যদি ছাত্রলীগ করে থাকে অবাক হবো না। এরা ছাত্রলীগ হোক বা না হোক, এরা যে মন্দ ও গুণ্ডা প্রকৃতির দল এই ব্যাপারে তো আর কোন সন্দেহ নাই।
https://www.youtube.com/watch?v=zxMe23Dlc7Y
দেশের বন্যা পরিস্থিতি: উত্তরাঞ্চলের অবস্থা অপরিবর্তিত, মধ্যাঞ্চলে অবনতি
এই গুণ্ডাগুলি ‘দেশে কোন বন্যা নাই‘ বলে দেশের কী ভালোটা করতে চেয়েছে জানিনা। সরকার বা আওয়ামী লীগেরই বা কী ভালো হবে। এই মূর্খরা কী জানে না যে সরকার বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যে নানারকম ব্যাবস্থা নিয়েছে? এরা কী জানেনা যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে তাদের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে? গাধাগুলি কী এই খবরটি রাখে না যে সরকার ইতোমধ্যেই দেশে বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানির ব্যবস্থা করেছে? ওদেরকে জানিয়ে দিতে পারেন যে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে চাঁদা চেয়ে সরকারে মন্ত্রীরা ইতোমধ্যে বড় বড় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানানো শুরু করেছে।
এইগুলি কেন বলছি, কারণ দেশে যে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটা সরকারও অস্বীকার করছে না। এবং বন্যা পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হবে সে ব্যাপারেও সরকার সচেতন আছে। এর মধ্যে সরকার সমর্থক কেউ যদি বলে দেশে কোন বন্যা নাই, এদেরকে কী বলবেন?
(৩)
গুণ্ডারা গুণ্ডামি করবে, ওদের ছলের অভাব হয় না। করুক। আমার মনে হয় না এইরকম গুণ্ডামির ভয়ে ইমরান বা অন্যরা যারা বন্যার জন্যে ত্রাণ সংগ্রহ করছে ওরা ওদের কাজ বন্ধ করবে। গুণ্ডারা যুগে যুগে ছিল, এখনো আছে। ওরা যা খুশী করুক, আমরা আমাদের কাজটা করে যাবো।
এই সময়ে আমাদের কাজটা কী?
প্রথম কাজ তো হচ্ছে সচেতন থাকা। বিপদ আসছে। আপনারা যারা উপদ্রুত এলাকায় আছেন, নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার চেষ্টা করুন। বন্যা তো কেবল যে পানিতে সব তলিয়ে দেয় সেটা তো নয়, বন্যা নানারকম রোগ ব্যাধি নিয়ে আসে। শিশুদের জন্যে এবং বয়স্ক লোকদের জন্যে বিশেষ করে বন্যার সময়টা খুবই বিপদজনক। সম্ভব হলে আগে থেকেই সরে যান। নিরাপদে জায়গায় চলে যেতে চেষ্টা করুন। আর আপনাদের যেসকল আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব উপদ্রুত এলাকায় আছেন, খোঁজ নিন ওরা কেমন আছেন। যতটুকু সম্ভব ওদেরকে সহায়তা করতে চেষ্টা করুন। বিপদের সময় সামান্য সহায়তাও অনেক বড় উপকার করে।
আর যতটুকু সম্ভব বন্যা ত্রাণে সাহায্য করুন। টাকা দিতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। টাকা ছাড়াও খাবার দাবার ওষুধ কাপড় চোপড় এইসবও দরকার। নিজে সাহায্য করুন, সাহায্য সংগ্রহে সকলকে সহায়তা করুন। তাই বলে সবাই অল্প কিছু টাকা নিয়ে উপদ্রুত এলাকায় দৌড় দেওয়া কোন কাজের কথা না। না, যেতে পারলে তো যাবেনই। স্বেচ্ছাসেবক দরকার আছে। কিন্তু একসাথে সংগঠিত হয়ে সবাই সবার সাথে সমন্বয় করে যেতে পারলে ভালো হয়। অতীতে দেখা গেছে ছোট ছোট দল গিয়ে একই জায়গায় নানারকম রিলিফ সামগ্রী নিয়ে বিতরণ করে চলে এসেছেন, আবার অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দেখা গেল কেউই যাচ্ছে না। এজন্যে সমন্বয় করে নিতে পারলে ভালো।
(৪)
আর কাকে সাহায্য দেবেন? কার হাতে তুলে দেবেন আপনার সাহায্য পৌঁছানোর দায়িত্ব। সেটা আপনি আপনার অবস্থান থেকে নির্ধারণ করবেন। আমার কাছে তো সবসময়ই মনে হয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন সিপিবি এরা খুবই আন্তরিক ও দক্ষ। এরা ছাড়াও আরও সংগঠন আছে, রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই যে ইমরান এইচ সরকার ত্রাণ তুলছেন, তিনি ও তাঁর সংগঠন এরাও নিশ্চয়ই নির্ভরযোগ্য। এছাড়া গণ সংহতি আন্দোলনের কর্মসূচির কথা জেনেছি, ওদের ওপরও আস্থা রাখতে পারেন। আপনার ত্রাণের টাকা এরা মেরে খাবে না।
টাকা পয়সা দিতে চাইলে এমন কাউকে দিন, যারা আপনার টাকাটা কাজে লাগাবে বলে আপনি আস্থা পান। যারাই বন্যা ত্রাণে কাজ করছেন, এদের প্রায় সকলেই ভালো মানুষ।
আর কতো টাকা দিবেন? চেষ্টা করুন যত বেশিসম্ভব দিতে। একবারে না পারেন ভাগ ভাগ করে দেন। কিন্তু বেশি টাকাই দিতে হবে এমন কোন কথা নাই। বেশি টাকা দিতে পারছেন না বলে লজ্জা পাবেন না। একশ-দুইশ পারলে একশ-দুইশ দিন, হাজার-দশ হাজার পারলে তাই দিন, না পারলে দশ বিষ টাকাই দিন। তবুও কিছু সাহায্য করুন। সকলে অংশ নিলে একেকজন কম টাকা দিলেও সেটা বেশি হয়ে যায়। অনেক কাজে লাগে। টাকা ছাড়া কোন ত্রাণসামগ্রী যদি দিতে চান, যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করছেন ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে আলাপ আলোচনা করে নিন, জেনে নিন কোথায় কী ধরনের সাহায্য গেলে ভাল হয়।
আর আপনার আশেপাশের যারা আছেন, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সকলকে বলেন বন্যাত্রাণে এগিয়ে আসতে। সম্ভব হলে আপনি সংগঠিত করুন, অথবা যারা সংগঠিত করছেন, ওদেরকে সাহায্য করুন।
শারীরিকভাবে অংশ নিতে পারলে সেটাও করেন। টাকা পয়সার যেমন দরকার আছে, শ্রমেরও দরকার আছে। যারা শ্রম দিচ্ছেন ওরা টাকার চেয়ে মূল্যবান সহায়তা দিচ্ছেন।
(৫)
বিপদের সম্ভাব্য ভয়াবহতার কথা তো খবরের কাগজে দেখেছেন। কিন্তু বন্যার ভয়াবহতাকে ভয় পাই না। কোন দুর্যোগকেই আসলে বাঙালি ভয় পায় না। আমি যতটুকু জানি আমাদের দেশে এইবছর খাবারের অভাব হওয়ার কথা নয়। ঘাটতি মিটানোর জন্যে সরকার শস্য আমদানির ব্যাবস্থাও করেছে। বেশ কয়েকটি বড় বড় ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছি গত দুই তিন দিনে। তাঁরা জানিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকা দিবে কয়েকদিনের মধ্যেই।
তরুণদের মধ্যে দেখেছি দূর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে আগ্রহ আছে, দৃঢ়তা আছে। অনেকেই ইতোমধ্যে নেমে পড়েছেন কাজে। সব মিলিয়ে বিপদের সম্ভাব্য ভয়াবহতা যতোটুকু হতে পারে, সেটাকেও ভয় পাওয়ার কিছু দেখি না। একটু অসুবিধা হবেই, কিন্তু বড় রকমের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
কিন্তু ওই যে শুরুতেই বলেছি, দেশে পর্যাপ্ত খাবার থাকলেও দূর্ভিক্ষ হতে পারে। তাই-ই হয়। সেই অবস্থা না আবার হয়, সেই আশঙ্কাটা যাচ্ছে না। আপনারা মেহেরবাণী করে যার যার জায়গা থেকে চেষ্টা করুন, সরকার যেন তৎপর থাকে- দেশের গুদামে খাবার থাকা অবস্থায় মানুষ না খেয়ে মরবে সেরকম অবস্থা যেন না নয়। সামনে আশ্বিন-কার্তিক মাস আসছে, বন্যা যখন নেমে যাবে, চাষীদের কাছে শস্যও তো থাকবে না।
আমাদের সকলে মিলে সংকটে একে অপরের পাশে থাকতে হবে। বিপদের দিনে মানুষের পাশে না থাকলে কখন থাকবে? পিঠাপুলি খাওয়ার দিনগুলিতে?
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন