০
১৪৯৪ বার পঠিত
‘আমি আসলে খাতা-কলমে মানে কাগজে লিখতে চাই। আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে, কি-বোর্ডে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। কী আশ্চর্য সময় এটা, খাতা-কলমে একসময় লিখতে চাইতাম না…’
অরিন্দম নোটবুক’টা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে। তার নিজেকে মনে হতে থাকে ষাট-সত্তরের দশকের মানুষ। এখানে নোটবুকের বদলে কলম আর অফ হোয়াইট কাগজ মানাতো। এই কফি হাউজে। অরিন্দমের মনে হল যে সবকিছুই মানাচ্ছে শুধু আসলে নোটবুক’টা যাচ্ছে না। কফি হাউজের ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে অজানা কিন্ত পুরনো মনে হওয়া জ্যাজ মিউজিক। এখানের চেয়ার টেবিল আর মানুষগুলো’কে অবলীলায় ৫০ বছরের পুরনো হিসেবে চালানো যাবে, মনে হয় না এখানে কোন আধুনিক পরিপাটি বেশে কেউ বসে আছে। অরিন্দম নিশ্চিত হতে চারপাশে তাকায়। এক কোণে বসে আছে দু’জন বুড়ো-বুড়ি, তাদের বেশভূষা মনে হয় ৬০-৭০ এর দশকেরই। আরেকটা মেয়ে, তরুণী, বয়স ২০-২৫ এর মাঝে, সে পরে আছে পুরনো ম্যাজেন্ডা রঙের পাতলা সোয়েটার… এবং সে। কেবল এই চারজন… নাহ, আরেকজন একা বসে আছে শারত-প্যান্ট করে এবং সে শেভ কতদিন করে নি সেটা অনুমান করা শক্ত। উপরের ফ্যানগুলো ঘুরছে, ধীরে ধীরে। তার চোখের দৃষ্টি সাদা-কালো করে দেয়া হলে অবশ্যই এটাকে ৬০-৭০ দশকের সাদাকালো ছায়াছবি বানিয়ে দেয়া যেতো। আমাদের অরিন্দম অবশ্য সিনেমার প্লট খুঁজতে এই কফি হাউজে আসে নি, কিন্ত ওর মাথার যন্ত্রণা ওকে ভাবাচ্ছে যে চারপাশ’টা সাদাকালো বা পুরনো হলে ভাল হতো। এমন সময়কাল যখন সে জন্মায় নি। এটা অনেকটা অন্য মানুষে রূপান্তরিত হবার প্রত্যাশাও বলা যায়। আমাদের অরিন্দম কল্পনাপ্রবণ মানুষ। সে এমন ভাবতে পারে। সে ভাবছে একটা সময়কাল যেখানে সে থাকবে না কিন্ত দেখে যেতে পারবে চারপাশ’টা। হ্যতো একটা ছবি’র মতই, সে আসলে হতে চাইছে সাদাকালো ক্যামেরা। যে ক্যামেরা নিজের গল্প জানে না, জানে কেবল অন্যদের গল্প। যুদ্ধের বা পাসপোর্ট-এর জন্যে ছবি তোলা ক্যামেরা নয়, এমন এক ক্যামেরা যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গল্প বলে যায় মানুষের। এই ক্যামেরা হবে এমন এক ক্যামেরা যা দেখাতে থাকবে কেউ একজনের প্রতিদিনের যাপন; সে কোথায় প্রতিদিন সিগারেট কিনতে যায় কিংবা কোথায় তার সবচে প্রিয় রাতের খাবারের মেন্যু পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যবশত, ক্যামেরাটা হতে হবে সাদাকালো। রঙিন ক্যামেরায় নানা কিছু চোখ এড়িয়ে যায়, সেখানে নানা বর্ণে মানুষের গল্পটাই বরং ঝাপসা হতে থাকে। অরিন্দম রঙিন ক্যামেরায় কফি হাউজের কোণে বসে থাকা বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার দিকে তাকায়, নাহ মানাচ্ছে না। এমনকী সামনের টেবিলে বসা তরুণী’কেও মানাচ্ছে না। তাই অরিন্দম সাদা কালো ক্যামেরা হয়ে পড়ে, সে জানতে পারে সামনে বসা তরুণীর গল্প, এমনকি তরুণীর গল্প সে ভালবেসেও ফেলে। তার সামনে থাকা ন্যাপকিন দিয়ে মাঝে মাঝে সে ক্যামেরার গ্লাস পরিস্কার করে।
‘ আপনি আমাকে কিছু বলবেন ?’
‘ না তো !’
‘ আপনি আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছেন, মন হচ্ছে আপনি কিছু একটা ভাবতে চাইছেন আমাকে নিয়ে ?’
‘ সেরকম কিছু না, আপনার এই ম্যাজেন্ডা রঙের পাতলা সোয়েটার আমি আগে কখনও দেখেছি কিনা মনে করতে চাইছিলাম। আচ্ছা এটা কি আপনার মায়ের উপহার দেয়া ?’
‘ দুঃখিত, আপনার কথা বুঝতে পারছি না !’
‘ সেরকম কিছু না ম্যাম, আমি আসলে আপনার দিকে কেন তাকিয়ে ছিলাম সেটা আমি জানি না।‘
‘ এটা কি অস্বস্থিকর নয় ?’
‘ হয়তো আমি ভাবছিলাম যে আপনি আপনার স্কুলে গ্রেডস কেমন পেতেন ?’
‘ আপনি কি লেখালেখি করেন ?’
‘ নাহ। আমি মানুষকে দেখতে পছন্দ করি হয়তো… কিন্ত আমি খুবই দুঃখিত আপনার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার জন্যে। ‘
‘ আসলে দেখুন, আমি কেউ না। খুব সাধারণ, আমার কোন অসাধারণ মানুষের সাথে পরিচয়ের ইচ্ছে নেই। আপনি প্লিজ এভাবে আমার দিকে আর তাকাবেন না, আমার অস্বস্তি হচ্ছে।‘
‘ ঠিক আছে ম্যাম।‘
ম্যাজেন্ডা সোয়েটার ফিরে যায় সামনের টেবিলে। মেয়েটা এবার অন্য পাশ ফিরে বসে। অরিন্দম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মেয়েটার সাথে কথা বলতে গিয়ে সে হুট করে দেখতে পেল মাথা ব্যথা নেই। কেন নেই? সে কি চাপ নিয়ে ফেলেছিল মেয়েটার সাথে কথা বলতে গিয়ে? অরিন্দম শুনেছে মাঝে মাঝে মস্তিষ্কে চাপ নিলে মাথাব্যথাসহ নানা ব্যথা চলে যায়! এটা কি হাস্যকর নয়? সে কি সত্যিই চাপ অনুভব করেছিল… নাহ, আবার মাথার যন্ত্রণা ফিরে আসছে। অরিন্দম এবার পিছন ফিরে থাকা মেয়েটার সোনালী চুলে সাদাকালো ক্যামেরার আলো ফেলে। শৈশব দেখতে পায় সে। নির্মোহ সবুজ ঘাস আর সাদা পাথরের শৈশব। নদী, বরফ এবং পাহাড়। রেইনট্রি। পায়ের অস্পষ্ট ছাপ। মায়ের স্পর্শ আর ডাইরিতে পেন্সিলে লেখা ভূতের গল্প। যে ভূতের গল্পে ধর্ম নেই কিন্ত জেসাস আছেন। অরিন্দম ক্যামেরা লেন্স বাকা করে, দেখতে পায় আবার নদী। সাঁতরে যাওয়া সময় এবং নীল আকাশে ঘুরতে আসা মেঘেদের সাথে গল্প। একটা কালো গুবরে পোকা এবং চিংড়ি মাছ ও কাঁকড়া’দের অদ্ভুতুড়ে গল্প। ডাইরিতে লেখা। সাদাকালো ক্যামেরায় সে দেখতে পায় এলোমেলো হাতে পেন্সিলে আঁকা ভূত, হ্যালোউইন। একটা অজানা মাস্ক এবং রং পেন্সিলে আঁকা ভয়ের ছবি যেখানে ড্র্যাকুলা রক্তের অন্বেষণে শিকারের খোঁজ করছে। সাদাকালো ক্যামেরা ডাইরির পাতা উল্টাতে থাকে, স্কুল এবং ছোটবেলার বান্ধবী। একটা পোষ মানা গ্রে-হাউন্ড কুকুর, সাদা বেড়াল এমনকী একটা বেশ লম্বা পাখি। পাখির নাম অরিন্দম জানে না।
ডাইরির এক জায়গায় ছোট করে নীল কলমে লেখা, ‘ইউরোপা’। নাকি ইউরোপ? ইউরোপা নামে একটা গ্রহাণু আছে না? ইউরোপার গল্প কি মেয়েটির বাবা তাকে শুনিয়েছে? গল্প শুনতে শুনতে অবাক বিস্ময়ে নীল চোখ তাকিয়ে ছিল রাতের আকাশে?
অরিন্দম ডাইরির পাতা উল্টোতে থাকে সাদাকালো ক্যামেরা চোখে। আমরা এবার অরিন্দম থেকে একটু আলাদা হয়ে, তার হয়ে গল্প না বলে বরং অরিন্দমের দিকেই একটু দেখি, আমরাও একটা সাদাকালো ক্যামেরা লাগিয়ে নেই, রঙিন না যা কিনা ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারে গল্পের কিংবা গল্প’কে ছাপিয়ে যেতে পারে। অরিন্দম অফ হোয়াইট সাদা শার্ট পড়ে আছে, সব’কটি বোতাম লাগানো বলে কেমন যেন তাকে দমবন্ধ দেখাচ্ছে। সে শার্ট ইন করেছে করেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না কারণ কফি টেবিলের আড়ালে পড়ে গ্যাছে তার নিম্নাংশ, ক্যামেরায় সেটা ধরা পড়ছে না। তার চুল আঁচড়ানো নেই, একপাশ সিঁথি করা এবং সম্ভবত সেটা হাতের আঙুল চালিয়ে করা। টেবিলের নিচ দিয়ে দেখা জুতো ও মোজা দেখা যাচ্ছে যা দেখে পুরনো বা নতুন – এমন সিদ্ধান্তে আসা যায় না। আমাদের অরিন্দমের চোখে কালো ফ্রেমের একটা চশমা আছে যার পাওয়ার খুব বেশি না এবং সে ক্লিন শেভ করে এসেছে আজ কফি খেতে। সম্ভবত তার তেমন কোন উদ্দেশ্য নেই এখানে বসে কফি খাওয়া ছাড়া। নোটবুকে সে কিছু লিখতে চেয়েছিল কিন্ত আপনারা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছেন যে সে মাথা ব্যথায় স্বস্তি’তে নেই। নোটবুকের ওপর তার এক হাত রেখে দেয়া এমনভাবে যেন নোটবুকের অংশ হয়ে পড়েছে সেটি এবং আরেক হাত সহজভাবে কফির টেবিলে রাখা।
কিন্ত অরিন্দম এবার ডাইরির পাতা বন্ধ করে ফেলে মেয়েটির। তার চোখ লাল হয়ে উঠছে, মাথার যন্ত্রণা বাড়ছে। সে কি অসুস্থ হয়ে পড়লো হুট করেই? সাথে প্যারাসিটামল নেই, তাকে বাড়িতে যেতে হবে। মাথা ব্যথার স্মৃতি অনেক পূর্ণ, মাথা ব্যথা মানেই বালিশে চেপে রাখা কপাল, চোখ বন্ধ, লাইট অফ করে রাখা রুমের জানালা দিয়ে দেখা অন্ধকারের গাছ। সেখানে সোনালী চুল নেই, খুব বেশিই নির্মম সে জগত। কফি হাউজের মালিক অ্যাডাম তার কাছে ঝুঁকে বলে কোন সমস্যা বোধ করছে কিনা সে, কিন্ত অরিন্দমের এখন এমনি এমনি কথা বলার ইচ্ছে নেই। সে কোনমতে উঠে বাসার উদ্দেশে পা বাড়াতে যায় এবং সে হড়কে যায় মর্ত্য থেকে পাতালে, সাদাকালো ক্যামেরা নিমেষেই ঢেকে যায় ভীষণ অন্ধকারে। শব্দ নেই কোন আশেপাশে…
চলবে…
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন