০
১১৬৭ বার পঠিত
বাংলাদেশ: যেখানে গঠনমুলক সমালোচনাকে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের আওতায় অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়
অনাকাঙ্খিত সহিংসতা, অপপ্রচার, শিশু পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি মুক্ত রাখাই তথ্য প্রযুক্তি আইনের (ইন্টারনেট) প্রধান লক্ষ্য। ইন্টারনেট এর ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন দেশে এই আইন (তথ্য-প্রযুক্তি) আইন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরিতাপের বিষয় হলো অধিকাংশ দেশে এমন প্রযুক্তি আইন বিদ্যমান যে অপরাধীকে ছেড়ে প্রশাসন থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও এর নেতাকর্মীদের গঠনমূলক সমালোচনা করলে সমালোচনাকারীদের শাস্তি পেতে হয়।
বাংলাদেশেও একই চিত্র বিদ্যমান। পাঁচবছর আগে এদেশে মাত্র ১৫% মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতো, সেই হার বৃদ্ধি পেয়ে ৫০% অতিক্রম করেছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার ধারাবাহিক বৃদ্ধির ফলে যা হয়েছে তা হলো আশংকাজনকভাবে বাকস্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে। ক্ষমতাসীন দল বিভিন্নসময় এই বিতর্কিত আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচকদের ধড়-পাকড় থেকে শুরু করে নানাধরনের নির্যাতনও চালিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতবছর স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের করা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পক্ষ নিয়ে পুলিশ প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের সমালোচনা করার অপরাধে গ্রেফতার (৫৭ ধারা) দেখানো হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র সাংবাদিক শহীদুল আলমকে। এসময় প্রায় ১০০ দিন তাঁকে কারাগারে রেখে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করা হয় তাঁকে।
বিতর্কিত ৫৭ ধারার আইনে শহিদুল আলমকে গ্রেফতার দেখানোর পর ২০১৮ সালে সেটিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। সাধারণ নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষা,তথ্য সংরক্ষণ, ভুয়া প্রকাশনা ও অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতা এড়াতে এই আইন করা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও সরকারের প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
ফলত,বিভিন্ন ধরনের নিয়মকানুন প্রয়োগের মাধ্যমেই সরকার ইন্টারনেটের ওপর আরো বেশী কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভূয়া তথ্য প্রদান, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে প্রচার,জাতির জনকের অসম্মান, জাতীয় প্রতীক ও পতাকার অবমূল্যায়ন এই ধরনের অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এছাড়াও ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের মত কর্মকাণ্ডের জন্য রয়েছে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান। সম্প্রতি এই আইনে অপপ্রচার ও মিথ্যা অপবাদের অভিযোগ আরোপ করে মানবাধিকারকর্মী আব্দুল কাইয়ুমকে গ্রেফতার করে প্রায় দুইমাস পরে তাকে গত ৩ রা জুলাই মুক্তি দেওয়া হয়।
এছাড়াও এই আইনের আওতায় ক্যাথলিক চার্চের পোপের সমালোচনা ও ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে সুপরিচিত কবি ও লেখক হেনরী স্বপনকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
এছাড়াও গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার অপরাধে হেদায়েত হোসেন মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিদ্যমান দাবি করে সজিব ওয়াজেদ জয় বলেন, এদেশের গণমাধ্যম কর্মীরা যে পারিপার্শ্বিক চাপ, প্রশাসন কর্তৃক ধরপাঁকড়ের কথা বলছেন তা সত্য নয়।
প্রসিদ্ধ সংবাদপত্রের একজন সম্পাদক বলেন, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ বেশ কঠিন। এমনকী ফেসবুকেও যদি রূপক অর্থেও সরকার বা প্রশাসনের করা বা দেখানো কোন কাজের সমালোচনা করা হয় তবুও ধরপাকড় এর সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও তিনি আরো বলেন ক্রমগত ধড়পাকড় ও ভয়ের সংস্কৃতি স্বাধীন সাংবাদিকতা পেশাকে ক্রমগত কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছে। সাংবাদিক সংগঠনের সাথে জড়িত একজন বলেন তারা বাস্তবিক বিষয়সহ প্রকৃত ঘটনার মাত্র ১০-২০% প্রকাশ করতে পারেন।
চলমান এই পরিস্থিতি ও ভয়ের সংস্কৃতি,বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিষয়ে সাংবাদিকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন সাংবাদিকদের কাজ হলো দেশের ভাবমুর্তি বহির্বিশ্বে তুলে ধরা দেশের যাবতীয় বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। আর যারা এই সাংবাদিকতার মহান পেশায় নিয়োজিত, তাদের ভীত হওয়া বা আশংকা প্রকাশের কোন কারণ নেই।
চলামান যে পরিস্থিতি তা থেকে অবশ্যই বাংলাদেশের উত্তরণ প্রয়োজন। আর এর জন্য দরকার জাতিসংঘ, মানবধিকার, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতিসহ সকল সংস্থার সুপারিশ গ্রহণ করে গ্রহণযোগ্য একটি নীতি প্রণয়ন করা। এতে করে চলমান ভয়ের সংস্কৃতি একটু হলেও দুর হবে।
বিতর্কিত এই ৫৭ ধারায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, জাতিবিদ্বেষ,অপপ্রচারসহ ঘৃণা ছড়ানোর মতো কিছু ব্যাপার রয়েছে, যা অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য। এই অস্পষ্টতার ফলে প্রশাসন খেয়াল খুশিমতো গ্রেফতার ও নির্যাতন প্রক্রিয়া জারি রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে এই আইন আরও স্পষ্ট এবং ব্যাখ্যাসংবলিত হওয়া উচিত, যেন প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পায় এবং গঠনমুলক সমালোচনা অপরাধ বলে বিবেচিত না হয়; যেন গ্রেফতারসহ যাবতীয় হয়রানি বন্ধ হয়। সজীব ওয়াজেদ জয় তাঁর বিবৃতিতে বলেন, প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক অনেক দেশে সংবাদ প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আর সত্যিকার অর্থে গঠনমূলক সমালোচনার জন্য জেল বা ভয় ভীতির মতো অবস্থা তৈরি হলে গঠনতন্ত্র আরো ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব কিন্তু আইন করে সরকার ও প্রশাসনের সমালোচকদের জেলে দেওয়া সরকার বা প্রশাসনের কাজ নয়।
এমতাবস্থায় সরকারের উচিত হবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করা এবং এই আইনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্পষ্টতা প্রদান করার সাথে আইনের জটিলতা দূর করে গঠনমুলক সমালোচনাকে অপরাধের কাতারে না রাখা।
আর যদি সার্বিক পরিবেশ এমন হয় তবে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরবে এবং গণমাধ্যম কর্মীরাও এগিয়ে আসবে তাঁদের সর্বাত্মক সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে।
মূল লেখা:
ব্রাড এডামস, হিউম্যান রাইট ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক হিসাবে নিয়োজিত আছেন।
লেখাটি দি ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন