বাংলাদেশে প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাষা পরিবার ইন্দো-ইওরোপিয়ান থেকে শুরু করে, আরেকটি বড় পরিবার সিনো-তিবেতান ভাষা পরিবার, অস্ট্রোএশিয়াটিক, এবং দ্রাবিড়িয়ান এই চারটি ভাষা পরিবারের সদস্য আছে।
ইন্দো-ইওরোপিয়ান ভাষা পরিবারঃ
বাংলাদেশ ইন্দো-ইওরপিয়ান ভাষা পরিবারের ইন্দো-ইরানিয়ান শাখার অন্যতম শাখা ইন্দো-এরিয়ান সদস্যদের দখলে। ভারতে প্রচলিত ইন্দো-ইওরোপিয়ান ভাষাগুলো ইন্দো-এরিয়ান শাখার সদস্য।
বাংলাদেশে ইন্দো-এরিয়ান ভাষা সমূহঃ
ইন্দো-এরিয়ান ভাষাগুলো আবার দু’ভাগে বিভক্তঃ
বাংলা ভাষা গ্রুপ এবং বাংলা ব্যতীত ইন্দো-এরিয়ান ভাষাসমূহ।
বাংলা ভাষা গ্রুপে আছে প্রমিত বাংলা, যেটা সারাদেশে লেখাপড়া, যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মর্যাদা প্রাপ্ত। এরপরে আছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষা চাঁটগাইয়া আর সিলেট জনপদের ভাষা সিলেটি।
বাংলা বাদে অন্যান্য ইন্দো-এরিয়ান ভাষার তালিকাঃ
চাকমা ভাষাঃ
চাকমা ভাষা চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। চাকমা ভাষার সাথে আশেপাশের এলাকায় প্রচলিত তিব্বতী-বার্মিজ ভাষার কোন সম্পর্ক নেই, তবে চাঁটগাইয়া, তঞ্চঙ্গা এবং আরাকানিজ ভাষার সাথে কমন কিছু বৈশিষ্ট্য আচে । চাকমারা চম্পকনগর থেকে আরাকানে যায় তারপরে সেখান থেকে ষোড়শ শতকের শেষে সপ্তদশ শতকের শুরুতে বাংলাদেশে আসে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩ লক্ষের উপরে চাকমা আছে। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মিজোরামে আরো সাড়ে তিনলক্ষ চাকমা জনগোষ্ঠির বাস আচে যারা চাকমা ভাষায় কথা বলে। চাকমা বর্ণমালা অজ পাঠ নামে চাকমা লিপিতে লিখিত।
বাংলাদেশ বা ভারতে চাকমা ভাষার অফিসিয়াল স্বীকৃতি নেই। তবে মিজোরামের চাকমা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলে চাকমা ভাষা অফিসিয়াল ভাষার মর্যাদা প্রাপ্ত।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীঃ
বাংলাদেশে প্রচলিত আরেকটি ইন্দো-এরিয়ান ভাষা, বাংলাদেশে বসবাসকারী মণিপুরী মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষা থেকে ভিন্ন ধরণের এই ভাষা তিব্বতী-বার্মিজ গ্রুপ থেকে অনেক কিছু আত্তীকরণ করে।
হাজংঃ
হাজং ভাষা আদিতে তিব্বতী-বার্মিজ হলেও বাংলা ও আসামিজ ভাষার সাথে মিশে ইন্ডিক ভাষাতে পরিণত হয়। বাংলাদেশে ময়মনসিংহ এবং সিলেট অঞ্চলে হাজংদের বসতি। হাজং ভাষা বাংলা এবং ল্যাটিন হরফে লিখিত হয়।
মারমাঃ তিব্বতী-বার্মিজ ভাষা থেকে উৎপত্তি বাংলাদেশে বসবাসকারি মার্মা জনগোষ্ঠীর ভাষা। মারমা বা মগেরা ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকে রাখাইন প্রদেশ থেকে চট্টগ্রামে আসে। এদের সংখ্যাও ২ লক্ষের উপরে।
রোহিঙ্গাঃ
বার্মার আরাকান অঙ্গরাজ্যের ভাষা। বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা অভিবাসীদের ভাষা।
তঞ্চঙ্গাঃ চাকমা ভাষার সাথে অনেক মিল। আরেকটি ইন্দো-এরিয়ান ভাষা, তঞ্চঙ্গা জাতির মানুষ এ ভাষায় কথা বলে।
সাদরিঃ ভারতের ঝাড়খন্ডের অধিবাসীদের ভাষা। বাংলাদেশে স্বল্প সংখ্যক মানুষ এ ভাষায় কথা বলে।
বিহারিঃ ভারতে বিহার রাজ্যের অধিবাসীরা এই ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারি জনগোষ্ঠি বিহারি ভাষায় কথা বলে।
চিনা-তিব্বতি (Sino-Tibetan) পরিবারের ভাষাঃ
বাংলাদেশে সিনো-তিবেতান ভাষা পরিবারের তিব্বতি-বার্মিজ শাখার কিছু ভাষা দেখা যায়। ভারতের উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলের ভাষাগুলো তিব্বতি-বার্মিজ ভাষার সদস্য। বাংলাদেশে তিব্বতি-বার্মিজ ভাষার মধ্যে চিন ভাষার উল্লেখযোগ্য সদস্য হলো খুমি কোচ, গারো, মৈতেয়ী মণিপুর, মিজো, রাখাইন, টিপরা ইত্যাদি।
কোচ অথবা রাজবংশী ভাষাঃ
বাংলাদেশে প্রচলিত একটি সিনো-তিবেতান ভাষা। এটি কোচ জনগোষ্ঠির ভাষা। আসাম এবং মেঘালয় রাজ্যের তিব্বতি-বার্মিজ ভাষার সদস্য। গারো এবং খাসিয়াদের মত কোচেরাও আন্তর্জাতিক সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং ভারতে বসবাস করে।
রাজবংশী, রংপুরি, কামতাপুরি, পলিয়া ইত্যাদি নানা নামে প্রচলিত ভাষা বাংলা-আসামিজ ভাষা, বাংলাদেশে রাজবংশী জনগোষ্ঠি এ ভাষায় কথা বলে। ভারতে এরা কামতাপুরি, রাজবংশী, গোয়ালপারিয়া, সূর্যপুরি, কোচ রাজবংশী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত।
গারোঃ
সিনো-তিবেতান ভাষা পরিবারের একটা শাখার নাম বোরো-গারো, এই শাখার অন্যতম সদস্য গারো। এছাড়া আরো আচে বোরো, কোচ, দিমাসা এবং দেওরি।
বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় এদের বসবাস। বাংলদেশে প্রায় দেড়লক্ষের মত গারো জনগোষ্ঠির বসবাস। গারো ভাষা ভারতের মেঘালয় অঙ্গরাজ্যের গারো পাহাড় অঞ্চলের অফিসিয়াল ভাষা।
টিপরা ভাষাঃ
ককবরক (টিপরা) ভাষা ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্যে বসবাসকারী ত্রিপুরি মানুষদের ভাষা। বাংলাদেশে কুমিল্লা জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ককবরক ভাষার প্রচলন আচে। ককবরক ভাষায় কক মানে ‘মুখের ভাষা’ আর বরক মানে মানুষ। এভাবে ককবরক শব্দটির উৎপত্তি হয় যার মানে মানুষের ভাষা। আসামের দিমাসা, বোরো আর কাচারি ভাষার সাথে ককবরকের সম্পর্ক আচে।
মিজোঃ
খুমি অথবা খুমি চিন ভাষা বার্মার কুকি-চিন-মিজো ভাষার সদস্য। বাংলাদেশে কিছু পরিমাণে মানুষ খুমি ভাষায় কথা বলে।
মিজোরা বাংলাদেশে কুকি নামে পরিচিত। অরূণাচল ছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারতের সব রাজ্যে তাদের দেখা মিলে। লুসাই পাহাড়ি অঞ্চলের ডায়ালেক্ট দিয়ে মিজো ভাষা সৃষ্টি হয়।
মিজোদের ইতিহাস অনুযায়ী তারা ৭৫০ সালে চিন থেকে পশ্চিম বার্মাতে আসে। তারপরে সেখান থেকে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে তারা বর্তমান মিজোরাম রাজ্যে বসতি গড়ে তোলে। ১৮শ শতকে মিজোরা তাদের বর্তমান অবস্থানে অভিবাসন সম্পন্ন করেন। মিজো ভারতের মিজোরাম অঙ্গরাজ্যের অফিসিয়াল ভাষা।
মৈতেয়ীঃ
সিনো-তিবেতান ভাষা, ভারতের মণিপুর রাজ্যের প্রধানতম ভাষা। মৈতেয়ী ভারতের সরকারি ভাষাসমূহের অন্তর্গত একটি ভাষা।
ম্রোঃ
ম্রোং, মুরুং ইত্যাদি নামে পরিচিত ভাষা, বাংলাদেশে রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবানে ম্রো জাতি এই ভাষায় কথা বলে। সিনো-তিবেতান এই ভাষা বাংলাদেশে একটি স্বীকৃত ভাষা।
রাখাইন ভাষাঃ
আরাকানিজ বা রাখাইন ভাষা তিব্বতি-বার্মিজ ভাষার সদস্য। বাংলাদেশে বসবাসকারি রাখাইন এবং মার্মাদের মধ্যে রাখাইন ভাষা প্রচলিত। প্রমিত বার্মিজ ভাষার সাথে এর অনেক ভিন্নতা আছে।
অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষা পরিবারঃ
অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষা পরিবার ভিয়েতনামিজ, খেমার এবং থাইল্যান্ড ও লাওসের ভাষার সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের প্রচলিত অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষাসমূহের মধ্যে মুন্ডা, খাসি, সাঁওতালি, কোল, কোডা,মুন্ডারি, প্নার, ওয়ার-জৈন্তিয়া এগুলো উল্লেখযোগ্য।
মুণ্ডাঃ
ভারত এবং বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ মুণ্ডা ভাষায় কথা বলে। মুন্ডা ভাষার আদি উৎস জানা যায় না। তবে মুন্ডা ভাষা ভারত বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষার আগে থেকে এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। “তু মুন্ডা বিলকুল দেশি…”
মুন্ডা ভাষা পরিবার দু’ভাগে বিভক্ত। উত্তম মুন্ডা, যেটা ঝাড়খন্ডের ছোট নাগপুর,ছত্রিশগড়, বাংলা। উড়িষ্যা অঞ্চলে বিস্তৃত। দক্ষিণ মুন্ডা মধ্য উড়িষ্যা এবং অন্ধ্র ও উড়িষ্যার সীমান্তে প্রচলিত।
খাসিঃ
খাসি ভাষা বাংলাদেশে প্রচলিত অন্যতম অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষা। এ ভাষায় প্রধানত ভারতের মেঘালয় অঙ্গরাজ্যের খাসি জনগোষ্ঠি কথা বলে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভাষা ভিয়েতনামিজ, খেমার, পালাউং এবং মন ভাষা খাসি ভাষার সাথে সম্পর্কিত। নিকোবর দ্বীপ্পুঞ্জে প্রচলিত মুণ্ডা ভাষার সাথেও খাসি ভাষার মিল আচে।
সাঁওতালিঃ
সাঁওতালি ভাষা বাংলাদেশে অস্ট্রোএশিয়াটিক পরিবারের মুন্ডা উপ-পরিবারের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত ভাষা। ভারতের আসাম, বিহার, ঝাড়খন্ড, মিজোরাম, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা এবং বাংলা রাজ্যে সাঁওতালদের বসবাস। সাঁওতালি ভারতে আঞ্চলিক ভাষার স্বীকৃতি প্রাপ্ত। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান মিলে প্রায় ৮ মিলিয়ন মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। যার ফলে ভিয়েতনামিজ এবং খেমার ভাষার পরে সাঁওতালি তৃতীয় বৃহত্তম অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষা।
১৯২৫ সালে পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু কর্তৃক ঐ চাকি বর্ণমালা আবিষ্কারের পূর্বে সাঁওতালি ভাষা একটি মুখে প্রচলিত ভাষা হিসেবে ছিল। বর্তমানে এই বর্ণমালা ভারতে সাঁওতালি ভাষা লিখতে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে দিনাজপুর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় সাঁওতালি ভাষা প্রচলিত আচে। সাঁওতালরা ১৯৫০ সালে ইলা মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনে অংশ নেই। এছাড়া কোল বিদ্রোহ, স্বদেশী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
কোলঃ
কোল বাংলাদেশে প্রচলিত একটা মুন্ডা ভাষা। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার বাবুডাইং এলাকায় কোলদের বসতি আছে।
কোডাঃ
কোডা বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে প্রচলিত একটি মুন্ডা ভাষা, কোল ভাষার সাথে সম্পর্কিত। কোডা বর্তমানে এন্ডেঞ্জারড ভাষা। ২০০৫ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৩০০ জন কোডা ভাষী আচে। তবে অধিবাসীদের মতে বাংলা এখন তাদের প্রধান ভাষা।
ওয়ার-জৈন্তিয়াঃ
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জৈন্তা পাহাড় অঞ্চলের ওয়ার এলাকার প্রচলিত ভাষার নাম ওয়ার জৈন্তিয়া। এ ভাষা অন্যান্য জৈন্তিয়া বা প্নার ভাষার চেয়ে পৃথক। ওয়ার জৈন্তিয়া ভাষার মানুষেরা খাসি এবং জৈন্তিয়াদের ভাষা বুঝতে পারে।
দ্রাবিড়িয়ান ভাষা পরিবারঃ
বাংলাদেশে দ্রাবিড়িয়ান ভাষা পরিবারের দুটি ভাষা পাওয়া যায়। এরা হলো, কুরুখ এবং সাউরিয়া পাহারিয়া।
কুরুখঃ
কুরুখ বাংলাদেশে প্রচলিত একটি দ্রাবিড়িয়ান ভাষা। ভারতের ঝাড়খন্ডের কিষাণ জাতি, মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা, এবং বাংলার প্রায় দুই মিলিয়ন ওঁরাও কুরুখ ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০০০ মানুষ কুরুখ ভাষায় কথা বলে। কুরুখ ইউনেস্কোর ভালনারেবল ভাষার তালিকায় আছে।
সাউরিয়া পাহাড়িয়াঃ
মালতো ভাষা পূর্ব ভারতে প্রচলিত উত্তর দ্রাবিড়িয়ান ভাষা। অঞ্চল ভেদে এই ভাষার লেখ্যরূপ বাংলা লিপি অথবা দেবনাগরি লিপিতে লেখা হয়। মালতো ভাষার দুটি রূপ প্রচলিত আছে, কুমারভাগ পাহাড়িয়া এবং সাউরিয়া পাহাড়িয়া। বাংলাদেশের কিছু অংশে এবং বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে সাউরিয়া পাহাড়িয়া ভাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১; ১০:৪৬ পূর্বাহ্ন
খুবই চমৎকার এবং বিশ্লেষণধর্মী লেখা।
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১; ৩:০৪ অপরাহ্ন
থ্যাঙ্ক ইউ। মন্তব্য করার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।