১০৩৭ বার পঠিত
গত ১১ জুন,২০১৮ বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গীদের গুলিতে খুন করা হয় শাহজাহান বাচ্চুকে। তিনি একাধারে মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক, ‘আমাদের বিক্রমপুর’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এর মুন্সিগঞ্জ জেলা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
বাংলাদেশের ব্লগারদের হত্যা করার জন্য ধর্মীয় মৌলবাদীরা বিভিন্নসময় যে হিটলিস্ট তৈরি করে, তার মধ্যে তাঁর নামও ছিল। বিভিন্ন সময়ে অনলাইনে লেখালিখির কারণে তিনি নিয়মিত মৌলবাদীদের হুমকি পাচ্ছিলেন।
শাহজাহান বাচ্চু হত্যা এবং বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরকারের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনার-এর কাছে প্রতিবাদ মিছিলসহ স্মারকলিপি প্রদানের আয়োজন করা হয় গতকাল ২০ জুন বিকাল সাড়ে তিনটায়।
আয়োজক ছিল অল ইন্ডিয়া পিপলস ফোরাম (AIPF),পশ্চিমবঙ্গ গণ সাংস্কৃতিক পরিষদ, ফেসবুকের পূর্ব-পশ্চিম (Purba Paschim) গ্রুপ, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস এসোশিয়েশন, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, ও পিউপিলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ।
প্রবল বৃষ্টিপাতকে উপক্ষো করে পূর্বঘোষিত স্থান থেকেই প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয় বিকাল ৩ টা৩০ মিনিটে। মিছিলে অংশগ্রহণ করেন কোলকাতার নানান সামাজিক আন্দোলনের কর্মী,মুক্তমনা – যুক্তিবাদী,বিজ্ঞান সংগঠন থেকে শুরু করে, ছাত্র-যুবসহ সমাজের নানান পেশার মানুষ।
শ্লোগানে-শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে কলকাতার রাজপথ। মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে- ‘শাহজাহান বাচ্চুর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। মুক্তমনা লেখক, ব্লগার কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। এই উপমহাদেশ থেকে ধর্মীয় মৌলবাদ নিপাত যাক, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ মানছি না, মানবো না!’ ইত্যাদি।
রাজপথের দু’ধারের মানুষ সচকিত হয়ে উঠেন। পায়ে-পায়ে দৃপ্তকণ্ঠের মিছিল এগিয়ে চলে এ,জি, সি,বোস রোড ধরে বেকবাগান মোড় হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সরণীতে। সেখানে মিছিল প্রবেশ করতেই কলকাতা পুলিশ মিছিলের গতিপথ রোধ করে এবং শুরু হয়ে যায় সংগঠকদের সাথে পুলিসের বাক-বিতণ্ডা। প্রতিবাদকারীদের মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা দেখে কলকাতা পুলিস কিছুটা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
ইতোমধ্যে মিছিলের সংবাদে বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনার এর অফিসের সামনে বিশাল ব্যারিকেড গড়ে তোলে পুলিসবাহিনী। পুরোই সাজ সাজ রব! পুলিসের ব্যারিকেডের প্রেক্ষিতে সেখানেই প্রতিবাদ সভা সংঘটিত হয়।
সভায় প্রাথমিক বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বাসুদেব বসু। তিনি বলেন,
“গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদ আজ ভীষণভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে শাসকদের মদতে। সমাজটাকে জাতপাত, ধর্ম দিয়ে বিভাজন করা হচ্ছে,আর এর বিরুদ্ধে যারাই কথা বলছেন,লড়াই করছেন,তাদেরকেই টার্গেট করছে মৌলবাদীরা। এবং নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে।”
পূর্ব পশ্চিম (Purbo Paschim)গ্রুপ-এর পক্ষে কলকাতার অন্যতম যুক্তিবাদী সংগঠক হেতুবাদী পত্রিকার সম্পাদক সাধন বিশ্বাস তাঁর বক্তব্যে বলেন,
“শাজহাহান বাচ্চুসহ বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, রাজিব হায়দার, সমপ্রেমী আন্দোলনের সংগঠক ও রূপবান পত্রিকার সম্পাদক জুলহাজ মান্নান, তনয়, নিলয় নীল, ওয়াশিকুর রহমান বাবুসহ অন্যান্যদের যেভাবে দিনের-পর-দিন ধর্মীয় মৌলবাদীরা হত্যা করে চলেছে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। বাংলাদেশ সরকারের কাছে এইসব হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত খুনিদের বিচার দাবি করছি।“
তিনি আরও বলেন,
“তোরা করবি যতো খুন, আমরা বাড়বো ততো গুণ!”
এ,আই,পি,এফ-এর রাজ্য কমিটির পক্ষে জয়তু দেশমুখ বলেন,
“যে রবীন্দ্রনাথ রচিত গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়,আর নজরুল যে দেশের জাতীয় কবি, ঐক্য ও সম্প্রীতির সেই দেশে অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক শাহজাহান বাচ্চুর মতো মুক্তচিন্তক মানুষদের ওপর ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ ও হত্যার ঘটনা খুবই দূর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়! এই হত্যাকান্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবী করছি”।
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এর গবেষক,বিশিষ্ট বিজ্ঞানী শ্রী তুষার চক্রবর্তী বলেন,
“দিনকে দিন যেভাবে অপবিজ্ঞানের চর্চা বাড়ছে, আর মানুষকে ক্রমশ ধর্মীয় চিন্তাভাবনার আবর্তে ফেলে দেওয়া হচ্ছে,তা সমাজ অগ্রগতির পথ নয়! মানুষকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে,আজকে উভয়দেশের সমাজে অত্যন্ত সুকৌশলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরির অপচেষ্টা চলছে। যে কোনোভাবেই হোক একে রুখতে হবে”।
এ,আই,এস,এ-এর রাজ্য সভাপতি নীলাশিষ বসু বলেন,
“যখন সমাজে কুসংস্কার,জাতপাতের বিভাজন বাড়ছে,তখন কিছু মানুষ এইসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলছেন,আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলছেন। আর তখনই শাসকদের প্রচ্ছন্ন মদতে ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাদের ওপর আঘাত হানছে, হত্যা করছে। আমরা দেখছি শাসকশ্রেণী আক্রমণের এক নয়া নীল নকশা নামিয়ে আনছে, যেন-তেন প্রকারে সকল মানুষের মগজটাকে দখল করতে চায় তারা। একটা শাসকের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাইছে, চাইছে মানুষের সকল অধিকারগুলোকে কুক্ষিগত করতে”।
সভা চলাকালীন ৫ জনের এক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার-এর কাছে স্মারকলিপি জমা দিতে গেলে কলকাতা পুলিশের অতি সক্রিয়তায় মাত্র দু’জন প্রতিনিধি অর্থাৎ শ্রী অমূল্যভুষণ চৌধুরী ও অম্লান ভট্টাচার্য বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে স্মারক লিপি জমা দেন।
বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার বি,এম, জালাল হুসেইন প্রতিনিধি দলকে প্রতিশ্রুতি দেন, বাংলাদেশ সরকারে ওপরমহলে তিনি আমাদের উদ্বেগ ও দাবির কথা জানাবেন। তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকার ব্লগার হত্যার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ভারতবর্ষেও ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্তেও তিনি চিন্তিত বলে জানান।
স্মারকলিপি প্রদান করার পরে প্রতিবাদ সভায় আবারও বিস্তারিতভাবে বক্তব্য রাখেন অম্লান ভট্টাচার্য। তিনি বলেন,
“এই উপমহাদেশে ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানেও উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, আর তার বিরুদ্ধেই চলমান এক আন্দোলন জারী আছে। লাগাতার এই লড়াইয়ে নানাভাবে যারা যুক্ত, যারা নেতৃত্ব প্রদান করে চলেছেন; তাদেরই একজন হলেন বাংলাদেশের শাহজাহান বাচ্চু। বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণেই সেখানকার সরকার, এবং বিরোধী দল মৌলবাদীদের নানাভাবে সহযোগিতা করে চলেছে। ভারতবর্ষেও এখন মৌলবাদের উত্থানের পিছনে রাষ্ট্রশক্তির পূর্ণ সমর্থন আছে। তাই এই অপশক্তির বিরোধীতা আমাদের করতেই হবে। ভারত, বাংলাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষকে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে”।
প্রতিবাদ সভায় বাউল শাহ আব্দুল করিমের গান পরিবেশন করেন,পশ্চিমবঙ্গ গণ সাংস্কৃতিক পরিষদ-এর সম্পাদক গণ -কবিয়াল নিতীশ রায়।
বাংলাদেশের মুক্তমনা অনলাইন একটিভিস্ট শাহজাহান বাচ্চু হত্যার বিচারের দাবীতে কলকাতার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এই প্রতিবাদ মিছিল এক নতুন বার্তা পৌছে দিলো আজকের ভারতবর্ষে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার যাবতীয় চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের লড়াই জারী থাকবে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন