৭
১৩১৬ বার পঠিত
অনেক গবেষক উল্লেখ করেন, নারীকে ‘আপন ভাগ্য’ জয় করবার অধিকার কেন দেয়া হবে না- এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অথচ রবীন্দ্রনাথের এই প্রশ্ন উত্থাপনের বহু আগেই সমকালীন বাঙলার এক ঝাঁক বুদ্ধিজীবি ও মুক্তচিন্তার মানুষ নারীকে ‘আপন ভাগ্য’ জয় করবার অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে আন্দোলন, সংগ্রাম ও তার চর্চা শুরু করেছিলেন।
ঊনিশ শতকের বাঙলায়, বিশেষত কলকাতা ও তার আশেপাশের এলাকাসমূহে প্রচলিত সামন্তমূল্যবোধের ওপরে মানবিক (Humanism) মূল্যবোধের চর্চা ও অনুশীলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ন ওয়ালিশ তাঁর ‘পেট্রিঢাইং ফিউডালিজম’ কায়েম করার প্রয়াস পাওয়া সত্বেও ঊনিশ শতকের বাঙলায় মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
ঊনিশ শতকের বাঙলায় কলকাতা ও তার আশেপাশের বুদ্ধিজীবি ও মুক্তচিন্তার মানুষজনদের শ্রেণিগত অবস্থান, কালিক সীমাবদ্ধতা, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি মুগ্ধতা ও আনুগত্যের দর্শন সত্বেও তাঁরা মানবিক চর্চার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নজির সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
সতীদাহপ্রথা, বাল্যবিবাহপ্রথা, বহুবিবাহপ্রথার বিরুদ্ধে ঊনিশ শতকের বাঙলার মুক্তচিন্তক বুদ্ধিজীবিরা ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ধর্মসভাপন্থীরাও বাঙলার মুক্তচিন্তক বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই প্রচলিত সামাজিক অচলায়তন বজায় রাখার অভিপ্রায়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন। তবে নারী শিক্ষার বিষয়ে নত স্বীকার করতে বাধ্য হয় ধর্মসভাপন্থীরা।
ঊনিশ শতকে নারীর ‘আপন ভাগ্য’ জয় করার অধিকার প্রদানের অনুশীলনগত চর্চায় যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ।
তবে একটা মজার তথ্য হলো- সতীদাহ প্রথা বিলোপের ব্যাপারে রামমোহনের কণ্ঠ উচ্চকিত হলেও, তিনি কিন্তু আইনের (সাংবিধানিকভাবে) মাধ্যমে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছিলেন। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিক এই কুপ্রথা বেআইনি ঘোষণা করার ব্যাপারে রামমোহনের পরামর্শ চাইলে রামমোহন এই আইন প্রণয়নের বিরোধীতা করেন। এ বিষয়ে লর্ড ৮ নভেম্বরের মিনিটে বেন্টিক লিখেছেন-
“রামমোহনের মত হলো এই কুপ্রথা বিভিন্ন প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি ও পুলিশের পরোক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হবে; এর জন্য আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নেই”।
এরপর ১৮২৯ এর ৪ ডিসেম্বর এই কুপ্রথা বেআইনি ঘোষণা ৪২ দিন পর রামমোহন অবশ্য এই প্রথারোধের জন্য বেন্টিককে ‘অভিনন্দনপত্র’ দিয়েছিলেন।
তেমনি বিধবাবিবাহ প্রথার প্রচলন, বহুবিবাহরোধ, স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে প্রধানত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অন্যরা তুমুল সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। স্ত্রী শিক্ষার বিষয়ে ধর্মসভাপন্থী রাধাকান্ত দেবও ঐকমত্য পোষণ করে এই আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন।
সমকালীন সময়ে অনেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কিংবা মুসলিম নারী মুক্তচিন্তকদের অস্তিত্ব থাকলেও ইতিহাসে নারী নের্তৃত্বের কোন সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না মিলে না। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার ও সামন্ত মূল্যবোধের অন্ধকার কানাগলি থেকে বাঙলার নিপীড়িত নির্যাতিত নারীসমাজকে আলোর পথে আনার বিষয়ে উপরোক্ত মুক্তচিন্তক বুদ্ধিজীবিরা নিরলস সংগ্রাম ও পরিশ্রম করেছেন। এরা সকলেই পুরুষ।
সূত্র সহায়তা:
১) প্রদীপ রায়, রামমোহন রায় এক ঐতিহাসিক জিজ্ঞাসা, বুকট্রাস্ট প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৮১ সংস্করণ।
২) নিস্তারিণী দেবী, সেকেলে কথা, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা, ২০১১ সংস্করণ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৭; ৬:২০ পূর্বাহ্ন
রামচন্দ্র মজুমদারের মতে, ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতবর্ষের হিন্দু নারীর নির্যাতিত নারী পৃথিবীর কোন জাতির মাঝে কোন কালেই দেখা যায় নি। এবং হিন্দু নারী মুক্তির সবচেয়ে বড় দু’টো ঘটনা হচ্ছে (১) তাদের মাঝে শিক্ষার আলো বিতরণ এবং সেজন্যে ভারতে বসবাসকারী কিছু পশ্চিমা রমনীর দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা ও নিরলস প্রয়াস সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ, (২) নারীদেরকে অন্তপুরবাস দশা থেকে মুক্তকরণ, যেখান কেশব সেনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিলেত-ফেরত কেশব সেন জীদ করে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে দাওয়াতে বের হওয়ার কারণে পিতা কর্তৃক ত্যাজ্য হন।
ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৭; ১:৪১ পূর্বাহ্ন
@আলমগীর ভাই,
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। কেবল হিন্দু নারীমুক্তির জন্যই নয়, সকল নারীমুক্তির জন্যই শিক্ষা হলো মূল বিষয়। শিক্ষার অভাবেই যুগে যুগে, কালে কালে, বিশ্বব্যাপী নারীর ওপর মানুষের (পুরুষের) নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। নারীমুক্তির জন্য তাই শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেসব সেনের কথা শুনেছি। কেসব সেন বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই। কিছু রেফারেন্স দিবেন কী?
ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৭; ৭:১৬ পূর্বাহ্ন
রামচন্দ্র মজুমদারের ৪ খণ্ডের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ বাঙালি জাতির সঠিক ইতিহাস অনুধাবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে। ইতিহাসকে লেখকরা যেভাবে নাচাতে চায়, সেভাবেই নাচাতে পারে। রামচন্দ্র সেখানে প্রধানত সমকালীন নথিপত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। মনে হয়েছে, বাঙালি পাঠক সেখান থেকে আমাদের ইতিহাসের মোটামুটি সঠিক ধারণা পেতে পারে, অবশ্য যতটা সম্ভব সঠিক।
ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭; ১২:৪০ অপরাহ্ন
আপনার কাছেও এ বিষয়ে লেখা প্রত্যাশা করছি।
মে ৫, ২০১৭; ৫:৩৬ পূর্বাহ্ন
আইনের পক্ষে মত না দেয়াটা কৌশলগত প্রশ্নে, না নীতিগত কারণে বুঝা না গেলেও, পরে, অভিনন্দন পত্র জানান দিচ্ছে, হয়ত কৌশলগত কারণে ঘটে থাকবে। লেখাটা পড়ে ভাল লাগল। লেখক অনেক অজানাকে তুলে এনে , আমাদের জানিয়ে দিলেন, ধন্যবাদ।
ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৭; ১:৪৮ পূর্বাহ্ন
@স্বপন মাঝি,
ব্যস্ততার মাঝেও আমার লেখা পড়ে মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যে কারণেই হোক রামমোহন রায় প্রকাশ্যে (অপ্রকাশ্যে তাঁর ভূমিকা যেহেতু আমরা জানতে পারি না) এই আইনের পক্ষে ছিলেন না, এমন ইতিহাস ও প্রমাণ আমরা এখন জানতে পাচ্ছি। ইতিহাস সবসময়ই শাসকশ্রেণির ছত্রছায়ায় রচিত হয় বলে আমরা সাধারণত সঠিক ইতিহাসের সন্ধান পাই না। বিশেষ করে ভারতবর্ষের ইতিহাস বিষয়ে বহু বিতর্ক রয়ে রয়েছে। বহু ইতিহাস এখনো অমীমাংশিত রয়ে গেছে। রামমোহন ব্রিটিশ সরকারের আজ্ঞাবহ ছিলেন বিধায় ইতিহাসে তাঁর বিষয়ে নেতিবাচক কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এ কারণেই এই আইনের পক্ষে কৌশলগত নাকী নীতিগত কারণে তিনি বিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। কেবল অনুমান নির্ভর হয়েও কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় না। অনুমান সবসময় ফলাফলে হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তাই নয় কী?
জানুয়ারি ৯, ২০১৮; ৭:১৯ পূর্বাহ্ন
সতীদাহ আইন সংস্কার বিষয়ে রাজা রামমোহনের প্রকৃত ভূমিকা জানতে পারলাম। চমকপ্রদ এই তথ্য দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।