৯৯৯ বার পঠিত
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১; হানাদার বাহিনী পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে মুক্তিলাভ করে। বাংলাদেশ অর্জন করে তার সার্বভৌমত্ব, অর্জন করে তার রাষ্ট্রীয় সীমানা। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় দিবস এটা বহু চর্চিত কথা, যা নতুন করে বলার মতো কিছু নেই।
২)
বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা হওয়ার ৪৬ পরও বাংলাদেশের ইতিহাস এখনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এখনো এই দেশে স্বাধীনতার মূলনীতি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ঐকমত্যের জন্য ন্যুনতম যে কনটেন্ট থাকা প্রয়োজন, তার এককণাও বাঙালিরা আজও ধারণ করতে পারে নি বলেই হয়তো জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি, এরকমটাই আমি মনে করি। আগামীতে কোনদিন জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এরকম কোন সম্ভাবনাও আর দেখতে পাই না। কারণ, বাংলাদেশে সেটা প্রায় অসম্ভব।
৩)
জাতীয় রণধ্বণি বা জাতীয় ধ্বনি নিয়ে যে কোন স্বাধীন দেশের মানুষ গৌরববোধ করেন। জাতীয় ধ্বনির বিষয়ে সকলেই দল, মত বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে যান। যে কোন সভ্য দেশে জাতীয় ধ্বনি উচ্চারণের সময় কেউ ভাবেন না যে তিনি বামপন্থী, না ডানপন্থী, সমাজতন্ত্রী না কমিউনিস্ট, মধ্যপন্থী না ধর্মীয়পন্থী। সেদেশে জাতীয় ধ্বনি সকলের সম্পদ হিসেবে মনে করেন বিধায় সকলেই এই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করতে পারেন। বাংলাদেশের দিকে তাকান, দেখবেন বিচিত্র এক জাতের মানুষজন সেখানে। জাতীয় ধ্বনি নিয়ে তাদের কোনই ঐকমত্য নেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের রণধ্বনি ছিল ‘জয় বাঙলা‘। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও বাংলাদেশে ‘জয় বাঙলা‘ জাতীয় ধ্বনি হিসেবে ন্যুনতম ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারে নি।
৪)
জাতীয় ধ্বনি হিসেবে ‘জয় বাঙলা‘ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ কী কারণে ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারে নি, বা পারছে না সে নিয়ে কারুরই কোনো চিন্তা নেই। চিন্তুা হলো এই ধ্বনিকে কে কোন স্বার্থে নিজেদের দখলে নিয়ে দলীয় স্বার্থ উদ্ধার করতে পারে। ‘জয় বাঙলা‘ ধ্বনিকে আওয়ামী লীগ বরাবরই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজস্ব ধ্বনি হিসেবে দখলে রাখার চেষ্টা করে বলেই কখনোই তা জাতীয় ঐকমত্যলাভ করতে পারে নি। আর এই সুযোগে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী জনগণকে বিভক্ত করে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে সমর্থ হয়েছে। যে কারণে ‘জয় বাঙলা’ কখনোই বাংলাদেশের গণমানুষের ধ্বনি হয়ে উঠতে পারে নি।
৫)
২০১৩তে শাহবাগ আন্দোলনের সময় প্রজন্ম চত্ত্বরে আমরা তরুণ প্রজন্ম যখন জাতীয় ধ্বনি ‘জয় বাঙলা‘ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছুতে পেরেছিলাম তখন মৌলবাদীরাতো বটেই, সেক্যুলার দাবিদার অনেক সংগঠনেরই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছিল। ভয় একটাই, জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে অনেকেরই রাজনৈতিক ধান্দাবাজির কলে টান পড়বে। যার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর হীন স্বার্থ চরিতার্থের স্বার্থেই তারা ধর্ম ও ‘নাস্তিক‘ ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে জনগণের একতাবোধকে বিভক্ত করে ফেলতে পেরেছিল।
এই বিভক্ত করার পিছনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে ওলামা লীগের মতো ভূঁইফোর ইসলাম ধর্মের ঝাণ্ডাধারী সংগঠনরা মাঠে নেমে সেক্যুলার মানসিকতার তরুণ প্রজন্মকে দমন করতে হিংস্র পথ অবলম্বন করার দুঃসাহস পেয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলদাসরা শাহবাগ আন্দোলনের সময় ‘জয় বাঙলা’ ধ্বনির সময় জোর করে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ জুড়ে দেয়ার জবরদস্তিমূলক চেষ্টাও করেছে। শাহবাগ আন্দোলনে যেদিন জয় বাঙলার সাথে জয় বঙ্গবন্ধুকে জুড়ে দেয়া হয়েছে, সেদিনই শাহবাগ আন্দোলনের মৃত্যু ঘটেছে। কারণ শাহবাগ আন্দোলন শুরুতে কখনোই দলীয় কিংবা কোন নেতাকে অনুসরণ করে সংঘটিত হয় নি। শাহবাগ আন্দোলনে আমাদের সম্মিলন হয়েছিল একাত্তরের চেতনাকে সামনে রেখেই।
৬)
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এসে আমরা দেখছি- বাংলাদেশ একটা পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট ও চরম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে আজ সাম্প্রদায়িক মুসলমান ছাড়া কেউই নিরাপদ নয় (সত্যিকার অর্থে তারাও নিরাপদ নয়)। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন মাদরাসানির্ভর হয়ে পড়েছে। দিন দিন মক্তব, মাদরাসার প্রভাব ইউক্যালিপ্টাস গাছের মতো তর তর করে বেড়ে উঠতে শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন সরকার মাদরাসাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর ওপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বলেই আজ সমগ্র দেশে ইসলামি জঙ্গীদের রমরমা চাষাবাদ ও ফলন হচ্ছে। ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী বর্তমান সরকারের কাছ থেকে কী আউটপুট পাওয়া যেতে পারে সেটা যাদের ধারনা নেই তারাই এখনো এই সরকারের সাফাই গান।
এটা প্রমাণিত যে, মাদরাসা কখনোই ভালো মানুষ উৎপাদন করতে পারে না। কেবল মাদরাসাই নয়, ইসলামি ভাবধারায় শিক্ষা দেয় এমন কোন প্রতিষ্ঠানই (প্রতিষ্ঠান বলতে শুধু একাডেমিক নয়, পুরো সিস্টেমটাকেই বুঝাতে চেয়েছি) ভালো মানুষ তৈরি করতে সক্ষম নয়। এটা বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত।
৭)
বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক অবস্থা বর্তমানে ব্রিটিশ শাসনামলের চেয়েও নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশে লেখক-ব্লগার-প্রকাশক হত্যাকাণ্ড, হিন্দু-সংখ্যালঘু খুন-গুম-অপহরণ-ধর্ষণ-লুটপাট, আদিবাসী জনগোষ্ঠী-পাহাড়ি জনগোষ্ঠিদের প্রকাশ্যে খুন, হামলা, লুটপাট হলেও এখন সরকারে লজ্জা হয় না। বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের সাথে জড়িত সংবাদকর্মী, লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, আইনজীবি থেকে শুরু করে কারুরই লজ্জা হয় না। অথচ ব্রিটিশ, পাকিস্তান এমনকী স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের শাসনামলেও কোন লেখক, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক নির্যাতিত বা আক্রান্ত হলে প্রতিবাদ বিক্ষোভে তৎকালীন সরকারের ঘুম হারাম হয়ে যেতো।
এখন লেখক, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, আইনজীবি থেকে থেকে শুরু করে সমাজের উঁচু-নিচু সকল স্তরের লোকজন নগ্নভাবে দলীয় দালালী ও সেবাদাসগিরিতে লিপ্ত। লজ্জা নামক বস্তুটি একদমই ছুঁড়ে ফেলে এরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
৮)
বর্তমান ‘ইসলামি’ আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে আমরা ক্রমশ থেকে ক্রমশ অধঃপতিত হচ্ছি। আমাদের নীতি নৈতিকতা হ্রাস পেতে পেতে এখন শূন্যের কোটায় পৌঁছে গেছে। একটি অকাট মূর্খ, সাম্প্রদায়িক, অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অথর্ব নাগরিক হওয়া ছাড়া আমাদের বোধ হয় আর কোন পথ খোলা নেই।
৯)
লিখতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম আজ বিজয় দিবস। এতোক্ষণ হয়তো অপ্রাসঙ্গিক প্যাচাল পাড়লাম। আমি জানি, একাত্তরে বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনার যুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন সেসব পরিবারের অনেকেই আজকের দিনে বিশেষ অনুভূতিতে আচ্ছন্ন থাকেন। এই অনুভূতির বিষয়টা অনেকের মতো আমাদের পরিবারেও হয়। আমাদের পরিবার হারিয়েছে অনেক আপনজন। সীমাহীন নির্যাতন, কষ্ট, দূর্দশাও সহ্য করতে হয়েছে পরিবারের অনেককেই। বিশেষ করে আমার বাবা ও মা, মামা খালাসহ অনেককেই। একাত্তরের যুদ্ধে আমি হারিয়েছি আমার দাদা, মামা, খালাসহ অনেক আত্মীয় স্বজনকে। জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর থেকে দেখে আসছি এই দিনে সকলেই আবেগাপ্লুত অবস্থায় থাকেন। তাঁরা লড়াই করেছিলেন বলেই আজ হয়তো আমি এই লেখাটা লিখতে পারছি, এই পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করতে পারছি।
১০)
বাংলাদেশের সকল শ্রেণি, পেশার সববয়সী মানুষকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলে ভাল থাকুন, এই প্রত্যাশা করি।
আমি ‘ভালো’ আছি, তুমি ভালো থেকো দেশ।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন