এপোনিম (Eponym) মানে কারো নামে কোন চালু শব্দ, একজন ব্যক্তির নাম থেকে আহরিত একটি শব্দ। যেটা দ্বারা এখন নামের অতিরিক্ত অন্য কিছু বোঝায়। বাংলা ভাষায় এপোনিম শব্দ খুব কম, অন্ততঃ আমার চোখে পড়েনি। সবচেয়ে বেশি যেটা মনে পড়ছে সেটা হলো, মীরজাফর, বিশেষণ এবং ক্রিয়া এই দুই হিসেবেই ব্যবহার হয়। যেমন, তুই একটা মীরজাফর! অথবা আমার সাথে মীরজাফরি করিস না। তবে এই নাম এত বেশি নেগেটিভ প্রচারণা পেয়েছে যে এখন কাউকে মীরজাফর নাম রাখতে শোনা যায় না।
আরেকটা মনে পড়ছে বাস্তব মানুষ নয়, গল্পের চরিত্র, ‘আদুভাই’। আদুভাই মানে যে প্রমোশন না পেয়ে একই ক্লাসে দু’তিনবার থাকে। স্লো, রিটার্ডেড, আনসাকসেস্ফুল এরকম বিভিন্ন সেন্সেও আদুভাই ব্যবহার হতে পারে।যেমন, তোমার সাথের সবাই প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র পোস্টে চলে গেল আর তুমি এখনও আদুভাইয়ের মত আগের পোস্টেই আছো।
বাংলায় কেন ব্যক্তির নামাঙ্কিত শব্দ সংখ্যা কম বা নাই বললেই চলে। থাকলেও সেটা মানুষ কথা-বার্তায় যতটুকু ব্যবহার করে, সাহিত্যে প্রয়োগ নেই বললেই চলে। এর কারণ কী? মৃত মানুষের প্রতি সম্মান থেকে বাঙালি কারো নামে শব্দ চালু করতে চায় না? অথবা কারো নামে শব্দ চালু করার ব্যাপারে ঈর্ষা কাজ করে?
ইংরেজি ভাষায় এপোনিমের অভাব নেই। অনেক এপোনিম আছে যেগুলোর ইতিহাস মানুষ খোঁজ রাখে না। যেমন, Sandwich, Nicotine, Sideburns, Boycott, Chauvinist, Morphine, Jacuzzi, Maverick, Derby, Jumbo, Bloomers এই শব্দগুলো একসময় কারো না কারো নামে চালু হয়েছিল। বর্তমানে এগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।
Sandwich: ইংল্যান্ডের আর্ল অফ স্যান্ডউইচের জুয়ার নেশা ছিল । জুয়ার টেবিল থেকে উঠে সে মাঝেমধ্য খেতে যেত না। তখন চাকরেরা দুই পিস ব্রেডের মধ্যে কিছু মাংস মুড়ে দিত, সে খেলাতে বসে বসে সেটা খেতে। বিঞ্জ ইটিং উইথ বিঞ্জ গ্যাম্বলিং! তো স্যান্ডউইচের বন্ধুদেরও ক্ষুধা লাগত, তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলত স্যান্ডউইচ যা খাচ্ছে আমাদেরকেও সেটাই দাও। গিভ আস দ্য সেইম এজ স্যান্ডউইচ! এভাবে খাবারের নামটাই স্যান্ডউইচ হয়ে গেল।
Sideburns: আমেরিকনা সিভিল ওয়ারের সময়কার জেনারেল Ambrose Burnside নামের এক ভদ্রলোকের হেয়ার স্টাইল এখন সাইডবার্ণস নামে পরিচিত।
Shrapnel: হেনরি শ্রাপনেল (১৭৬১-১৮৪২) ছিলেন একজন ব্রিটিশ আর্টিলারি অফিসার। তিনি প্রথমে শ্রাপনেল আবিষ্কার করেন, কার্তুজের মধ্যে শার্প ধাতব পদার্থ দিয়ে দেন যাতে সেগুলো মানুষ মারতে পারে। পরে সেটা ব্রিটিশ আর্মি তাদের কামান ও বন্দুকে ব্যবহার করে।
Quixotic: সারভান্তেস এর লেখা ডন কিহোতে বইয়ের মূল চরিত্রের নামে ইংরেজি কুইক্সোটিক শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। কুইক্সোটিক মানে foolishly impractical,বা romantically impulsive
Chauvinist: কোন বিশেষ লিঙ্গ, ব্যক্তিত্ব বা দলের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি-ভালবাসা দেখায় এমন ব্যক্তি, অতিরিক্ত দেশপেম দেখানো ব্যক্তি। ১৯ শতকে ফ্রান্সে নিকোলাস শভিন নামে এক সৈন্য ছিল। সে সম্ভবতঃ নেপোলিয়নের আন্ডারে কাজ করত। তার অতিরিক্ত দেশপ্রেম এবং ভক্তি দেখে তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করত।
Derby: ডার্বি রেইস, ঘোড়দৌড়। ১৭৮০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের ডার্বি এলাকার বারতম আর্ল ছিলেন এডওয়ার্ড স্মিথ-স্ট্যানলি। এডওয়ার্ড তার বন্ধুদের নিয়ে তাদের তিন বছর বয়সী ঘোড় নিয়ে একটা ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে যাতে বিজয়ীর জন্য একটা পুরষ্কারের ব্যবস্থা ছিল। ব্রিটেনে এখন এটি অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। এছাড়া কেন্টাকি ডার্বি এবং ফ্রেঞ্চ ডার্বি আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ খেলা।
Jacuzzi: বাথটাব , হট টাব। ক্যান্ডিডো জাকুযি নামে এক ইতালীয়ান আমেরিকাতে অভিবাসী হন। ক্যালিফোর্ণিয়ার বার্কলিতে জাকুযি ভাইয়েরা বিমানের প্রপেলার বানানোর ব্যবসা করতেন। জাকুযির ছোট ছেলে ছিলে বাতের রোগী। ছেলের জন্য জাকুযি একটা পাম্প তৈরি করেন যেটা বাথটাবে ব্যবহার করে তাকে হাইড্রথেরাপি দেয়া হত। জাকুযি তার পাম্প বিক্রয়ের জন্য বাজারে ছাড়েন, এবং অল্প সময়ের মধ্যে স্পা এবং হেলথ সেন্টারগুলোতে তার পাম্প এবং বাথ টাব জনপ্রিয়তা পায়।
Jumbo: ইওরোপে ১৮৬০-১৮৮৫ সালের দিকে সার্কাসের হাতী যার নাম ছিল জাম্বো। সে ছিল ইওরোপে আসা প্রথম হাতী, লণ্ডন চিড়িয়খানার সবচেয়ে বড় বাসিন্দা। সেসময় জাম্বোকে সার্কাসের কাছে বিক্রয় করে দেবার পরে মানুষের মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। ইওরোপের প্রথম হাতীর জনপ্রিয়তার কারণে ইংরেজিতে ‘জাম্বো’ শব্দটি স্থান করে নেয়, যার মানে ‘বিশাল’, ‘ অনেক বড়’।
Mentor: মেন্টর শব্দটি হোমারের ওডেসিয়ুসের এক চরিত্রের নাম। ওডেসিয়াস যখন সমুদ্র যাত্রায় ছিল তখন তার ছেলে টেলেমাকাসের ওস্তাদের নাম ছিল মেন্টর।
Nicotine: ষোড়শ শতকে পর্তুগালে জঁ নিকো (Jean Nicot (1530-1600)) নামে এক ফরাসী রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি ফ্রান্সে তামাক চালু করেন এবং দাবী করেন এর রোগ নিরাময়কারী ক্ষমতা আছে। যার কারণে তামাকের নেশাদ্রব্য নিকোটিনকে তার নামে রাখা হয়।
Morphine: রোমান নিদ্রার দেবতা সোমনাসের ছেলের নাম ছিল মরফিউস যে ছিল স্বপ্নের দেবতা। মরফিউস মানুষকে নকল করতে পারত এবং স্বপ্নে দেখা দিত। আফিম থেকে পাওয়া ড্রাগ মরফিনকে গ্রিক দেবতা মরফিউসের নামে নামকরণ করা হয়।
Paparazzi: ইতালিয়ান পরিচালক Federico Fellini’র ১৯৬১ সালের মুভি ‘লা ডলসে ভিটা’ ( দ্য সুইট লাইফ) মুভিতে সেলেব্রেটিদের অনুসরণ করা গসিপ ম্যাগাজিনের সাংবাদিকের নাম ছিল পাপারাজ্জো। সেই থেকে সেলেব্রেটিদের পেছনে বা সংবাদের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরা সাংবাদিকদের বলা হয় পাপারাজি।
Scrooge: কৃপণ। চার্লস ডিকেন্সের ‘A Christmas Carol’ উপন্যাসের চরিত্র এবেনযার স্ক্রুজ ক্রিসমাস পছন্দ করত না, সে ক্রিসমাসের গিফট দেয়াও পছন্দ করত না। পরবর্তীতে ক্রিসমাসের স্পিরিট তাকে দর্শন দিলে তার ভিতরে ব্যাপক পরিবর্তন হয় এবং সে ক্রিসমাস পছন্দ করা শুরু করে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে ক্রিসমাস জনপ্রিয়তা লাভ করে।
Silhouette: ছায়ার মতো কালো ছবি। এতিয়েন দ্য সিলুয়েত (1709-1767) নামে একজন ফরাসি অর্থমন্ত্রী নাগরিকদের উপর বিপুল করের বোঝা চাপিয়ে দেন। যার ফলে মানুষ তাদের আত্মপ্রতিকৃতি রঙ করাতে পারত না। তখন তারা চিপাচিপি করে খরচ করত। সে সময় যেকোন কিছু কম খরচে করা হলে তাকে সিলুয়েট বলা হত।
Maverick: ব্যতিক্রম, নতুনত্ব।উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে টেক্সাসে ম্যাভেরিক নামের র্যঞ্চার তার গবাদি পশুর গায়ে কোন ধরণের সীল দিত না। তার যুক্তি আশেপাশে সবাই যেহতু গরুকে ব্রাণ্ডিং করে তখন যেসব গরুর ব্রাণ্ডিং নেই সেগুলো তার। পশুক্লেশ নিবারণের চেয়ে তার অদ্ভূত এবং ব্যতিক্রমধর্মী আইডিয়ার কারণে শব্দটি এখনো টিকে আছে।
Malapropism: শব্দের হাস্যকর ব্যবহার। আঠারশ শতকে রিচার্ড ব্রিনস্লি শেরিডান এর লেখা কমেডির চরিত্র মিস ম্যালাপ্রপ শব্দের মিসইউজ করত, যেটা অনেক সময় খুবই হাস্যকর শোনাত। তার নামে ম্যালাপ্রপিজম শব্দটি চালু হয়। এমনিতে propos মানে fitting, appropriate, pertinent. তার আগে ম্যাল প্রেফিক্স বসানো হলে সেটা হয় ইনএপ্রপ্রিয়েট। ম্যালাপ্রপিজমের কিছু উদাহরণ, বস্টনের মেয়র টমাস মেনিনো একবার বলেছিলেন, “He was a man of great statue.” তেমনি শিকাগোর মেয়র রিচার্ড ড্যালি বলেছিলেন, “The police are not here to create disorder, they’re here to preserve disorder.”
Gerrymander: নির্বাচনে জেতার উদ্দেশ্যে নির্বাচনী এলাকার মানচিত্র পালটানো। ১৮১২ সালে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের গভর্ণর এল্ব্রিজ জেরি নামের নির্বাচনী ম্যাপে কাটাছেঁড়া করে ভোটে জেতার প্ল্যান করেন। বিরোধী দলের রাজনীতিকরা তার আঁকা ম্যাপ নিয়ে সভা করার সময় একজন রাজনীতিক জেরির আঁকা ম্যাপটিকে ক্যারিকেচার করে একটা সাপের আকৃতি দেন। জেরির ম্যাপ অরিজিনাল ম্যাপের তুলনায় যেন একটা স্যালাম্যান্ডার। সে সভায় উপস্থিত আরেকজন তখন বলেন এটা আসলে একটা জেরিম্যান্ডার। জেরিম্যান্ডার তাই একটা এপোনিম এবং একইসাথে একটা পোর্টম্যান্টো শব্দ। এল্ব্রিজ জেরির থেকে জেরি এবং স্যালাম্যান্ডার এর ম্যান্ডার একসাথে হয়েছে জেরিম্যান্ডার। আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে জেরিম্যান্ডার এখনও খুবই চালু এবং প্রাসঙ্গিক একটি শব্দ।
Bowdlerize: খারাপ অংশকে বাদ দিয়ে কোনকিছুকে বিশুদ্ধ, স্যানিটাইজ করা, ‘to expurgate a text’। টমাস বোদলার নামে এক ভদ্রলোকের মনে হয়েছিল সেক্সপিয়ারের লেখা ঠিকই আছে শুধু কিছু কিছু জায়গা বাদ দিলে এটা পরিবারের সবাইকে নিয়ে পড়া যাবে। তিনি অনেক চেষ্টা চরিত্র করে সেক্সপিয়ারের যেটা তার ভাল লাগেনি সেগুলো বাদ দিয়ে ‘ফ্যামিলি ফ্রেন্ডলি সেক্সপিয়ার’ প্রকাশ করেন। তখন থেকে কোনকিছুকে পিউরিফাই করার জন্য এর থেকে খারাপ অংশ বাদ দিয়ে সম্পাদনা করার কাজকে বলা হয় বোদলেরাইজ করা।
Boycott: বয়কট, অসহযোগ। উনিশ শতকের শেষদিকে চার্লস বয়কট নামে এক আইরিশ ল্যান্ডলর্ড ছিলেন যিনি চাষিদের উপর ধার্যকৃত কর কমাতে প্রত্যাখ্যান করেন। তার অধীনস্থ চাষীরা তখন বয়কটের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনে সিদ্ধান্ত হয় এখন থেকে চাষীরা তার জন্য কাজ করবে না এমনকী তার কাছে কিছু বিক্রি করবে না। গণ অসহযোগিতার কারণে শেষ পর্যন্ত বয়কট এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।