ভাষাগুলো মরে যাচ্ছে, তবে মরে যাওয়ার আগে অন্য ভাষায় একটু শব্দ করে যাক। ভাষা গতিশীল, মানুষের জীনগত বৈশিষ্ট্য যেমন বংশানুক্রমে প্রবাহিত হয়, ভাষাও তেমনি গতিশীল এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষ, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় সম্প্রসারিত হয়। উত্তরাধিকার হিসেবে মানুষ ভাষার ব্যবহার শেখে। চলার পথে ভাষা নতুন ভাষার সংস্পর্শে আসে, এতে কিছুটা পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের হার অনেক বেশি হলে সেটা নতুন ভাষার মর্যাদা পায়। এজন্য যেকোন ভাষার সাথে তার আশেপাশে চালু ভাষাগুলোর একটা সম্পর্ক থাকে। প্রত্যেকটি ভাষার কমন কিছু বৈশিষ্ট্য এবং শব্দ ভান্ডার থেকে থেকে জানা যায় কোন কোন ভাষা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত,একই পরিবারের অন্তর্গত। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে শুনতে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলেও শব্দমূল, ইতিহাস, আশেপাশের ভাষার প্রভাব, এবং পরিশেষে জীনগত তথ্য থেকে ভাষার গতিবিধি এবং ঠিকুজি বের করা সম্ভব।
বাইবেলের মতে একসময় মানুষের একটা ভাষা ছিল এবং তারা মিলেমিশে ছিল। ঈশ্বর মানুষের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য আনার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং মানুষকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিলেন।
বর্তমান ভাষাবিজ্ঞানীরাও মনে করেন আজ থেকে ৫০০০০ বছর আগে মধ্য-দক্ষিণ আফ্রিকায় মানুষ প্রথম আদিম ভাষায় কথা বলা শুরু করে। তারপরে সেখান থেকে আফ্রিকার তীর ঘেঁষে এশিয়া, ইওরোপ, আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়ে। যত দূরে সরে যায় ততো তাদের ভাষা পরিবর্তিত হতে থাকে নতুন নতুন ভাষার জন্ম নেয়। কিন্তু কোন ভাষাই বিচ্ছিন্ন নয় তাদের সাথে প্রতিবেশীদের সম্পর্ক থাকে। সেজন্য ‘বিচ্ছিন্ন ভাষাগুলো অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় যার মধ্যে হয়ত অনেক অজানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে।
ভারতবর্ষের বেশিরভাগ ভাষা ইন্দো-ইওরোপিয়ান অথবা দ্রাবিড়িয়ান ভাষা পরিবারের সদস্য। যেমন বাংলা, হিন্দী, উড়িয়া,উর্দু, চাকমা এসব ইন্দো-ইওরোপিয়ান ভাষা। অপরদিকে তামিল, তেলেগু, কানাড়া, মালয়লাম এগুলো দ্রাবিড়িয়ান ভাষা। এর বাইরে অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষা যেমন মুন্ডা, এবং চিনা-তিব্বতী ভাষা আছে যেগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত।
ল্যাঙ্গুয়েজ আইসোলেট বা বিচ্ছিন্ন ভাষাঃ
ভারতবর্ষে কিছু ভাষা আছে যেগুলো বর্তমানে জানা কোন ভাষা পরিবারের সাথে সম্পর্কিত নয়। ভাষাগত পার্থক্য বিবেচনা করলে এরা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, আশেপাশে তাদের পরিবারের কোন সদস্য নেই। চারপাশের ভাষাগুলোর সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই। এই ভাষাগুলোকে তাই বলা হয় ‘বিচ্ছিন্ন ভাষা’ বা ‘ল্যাংগুয়েজ আইসোলেট’।
একসময় হয়ত আরো অনেক ভাষা একসাথে ছিল কিন্তু যেকোন কারণে বাকি সবগুলো ভাষা এখন অপ্রচলিত বা সেসব ভাষার সকল সদস্যই মারা পড়েছে। যেভাবে হোক বিচ্ছিন্ন ভাষাগুলো ভাষাবিদদের জন্য অন্যতম একটা বিস্ময়। ভাষার বিবর্তন এবং গতিমূখের সাথে এসব ভাষা পুরোপুরি ‘আউটলায়ার’।
আধুনিক দুনিয়ায় বিচ্ছিন্ন ভাষার মধ্যে বিখ্যাত হলো বাস্ক। স্পেনের বাস্ক অঞ্চলে মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। স্পেন এবং স্পেনের চারপাশে প্রচলিত ইন্দো-ইওরোপিয়ান কোন ভাষার সাথে বাস্কের কোন মিল নেই, unrelated to any other existing languages। এমনকী সেমিটিক কোন ভাষা বা আমাদের জানা কোন ভাষার সাথে বাস্কের কোন মিল পাওয়া যায়নি।
ভারতবর্ষের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ভাষাঃ
ভারতবর্ষের তিনটি বিচ্ছিন্ন ভাষা হলো, বুরুশাসকি, কুসুন্ডা এবং নিহালি। তিনটি ভাষার সাথে আশেপাশের প্রচলিত ভাষাগুলো কোন মিল নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন একটি মাত্র ভাষা দিয়েই তারা একটি ভাষা পরিবারের মত। তবে সবগুলোর অবস্থা সঙ্গীন, এখন অল্প কিছু মানুষ এসব ভাষায় কথা বলে। নতুন প্রজন্মের কেউ এসব ভাষায় কথা বলছে না। আশে-পাশের ডমিনেটিং ভাষার চাপে এই ভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
বুরুশাসকি ভাষাঃ
নেটিভদের কাছে বুরুশাস্কি ভাষা মিশাস্কি ভাষা নামে পরিচিত। এই ভাষা প্রধানত পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গিলগিট=বালতিস্তান এলাকার হাঞ্জা, নাগর এবং ইয়াসিন উপত্যকার ভাষা। অফিসিয়ালি ঠিক কত মানুষ এই ভাষায় কথা বলে তার কোন রেকর্ড নেই। গবেষকদের মতে প্রায় এক লাখ মানুষ বুরুশাসকি ভাষায় কথা বলে। তার উপর ইয়াসিন অঞ্চলের ভাষার সাথে নাগর এবং হানজা অঞ্চলের ভাষার ডায়ালেক্টে পার্থক্য আছে।
বুরুশাসকি অঞ্চলে ইন্দো-ইরানিয়ান, তিব্বতী-বার্মিজ, আলতাইক ভাষা পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়। যার কারণে বুরুশাসকি ভাষা ফারসি, আরবি, উর্দু, শিনা, ওয়াখি, বালতি এবং কাশ্মিরী ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। ফলে বর্তমানে নেটিভ বুরুশাসকি মানুষেরা সবাই অন্ততঃ দুটি করে ভাষা জানে। তারা বুরুশাসকির সাথে উর্দু, ওয়াখি, শিনা, কাশ্মিরী, বালতি এর যেকোন ভাষায় মত বিনিময় করতে পারে। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর চাপ সবচেয়ে বেশি। নতুন জেনারেশনের অনেকে শুধু উর্দু শিখছে, বুরুশাসকি ভাষা তারা কোন রকম কাজ চালানোর মত জানে।
বুরুশাসকি ভাষার উৎপত্তি এবং ভাষাভাষীদের জীনগত বিশ্লেষণ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এই ভাষার অরিজিন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কারো কারো মতে বুরুশাসকির সাথে বাস্ক এবং ককেসিয়ান ভাষা পরিবারের মিল আছে (Bengston 1991-1998)। অনেকে একে ইন্দো-ইওরোপিয়ান ভাষার সাথে মিলাতে চেয়েছেন, বিশেষ করে বলকান অঞ্চলের ভাষার সাথে মিল খোঁজার চেষ্টা করেছেন Čašule (1998, 2004, 2010, 2014)। কিন্তু এসব গবেষণার কোনটাই বুরুশাসকি ভাষাকে মানুষের জানা কোন ভাষার সাথে সম্পর্কিত করতে পারেনি।
বুরুশাসকি ভাষার যেহেতু লিখিত রূপ নেই, সেজন্য এই ভাষা এখন বিলীণ হবার মুখে। লিখিত রূপ না থাকলেও এই ভাষার সাহিত্য ভাণ্ডারে অনেক সম্পদ আছে। লোকমুখে এসব সাহিত্য প্রবাহিত হতো। উর্দু এবং ফার্সি ভাষার সংস্পর্শে এসে বুরুশাসকি ভাষায় অনেক কাসিদা এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক সঙ্গীত রচিত হয়েছে। বর্তমানে অনেক বুরুশো বুরুশাসকি ভাষার এসব সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডকুমেন্টশনের প্রয়োজনীয়ত বোধ করছেন কারণ বয়স্ক জনগোষ্ঠি মারা গেলে এগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে।
কুসুন্ডা ভাষাঃ
মধ্য নেপালে প্রচলিত একটি ভাষার নাম কুসুন্ডা। এটি আরেকটি আইসোলেটেড ভাষা, ভারতবর্ষে প্রচলিত আশেপাশের কোন ভাষার সাথে এর কোন মিল নেই। কুসুন্ডা নেপালের রহস্যময় ভাষা। অরণ্যাচারী খর্বাকৃতির কালো মানুষেরা এই ভাষায় কথা বলে। এই ভাষার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিক অনেক গবেষণা হয়েছে। কুসুন্ডাকে কেউ প্রতিবেশী তিব্বতি – বার্মিজ ভাষাগোষ্ঠির সাথে মিলাতে চেয়েছেন, কিন্তু পরবর্তী গবেষকেরা সেটা বাতিল করে দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্ণিয়া-বার্কলির যৌথ গবেষণা থেকে জানা যায় কুসুন্ডা আসলে ইন্দো-প্যাসিফিক ভাষা। এই ভাষার সাথে তারা পাপুয়া নিউ গিনি এবং আশেপাশের দ্বীপের ভাষার মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাদের মতে কুসুন্ডা ভাষাভাষীরা ভারতবর্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড এলাকায় অভিবাসন করেছে এমন গোষ্ঠিগুলোর মূল ভূমিতে ফেলে আসা ছোট একটা দল। এটা নিয়ে আরো অনেক গবেষণার দরকার আছে কিন্তু হাইপোথিসিস একেবারে ফেলে দেয়ার মত নয়। বিশেষ করে ভারত থেকে মানুষ নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েছে সেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এখন নিউ গিনির আদিবাসীদের সাথে কুসুন্ডার মিল পাওয়া গেলে সেটা অবশ্যই আগেকার তিব্বতি-বার্মিজ গ্রুপে ফেলার চেয়ে ভাল কাজ হবে। এছাড়া আমাদের হাতে এখন আরো অনেক টুলস আছে।
নিহালি ভাষাঃ
ভারতের মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে প্রচলিত বিচ্ছিন্ন ভাষার নাম নিহালি। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী এই ভাষায় মাত্র ২০০০ লোক কথা বলে। অন্যান্য ভাষাগুলোর মত এই ভাষার সাথেও আশেপাশে প্রচলিত ইন্দো-ইওরোপিয়ান এবং দ্রাবিড়িয়ান ভাষার সাথে কোন মিল নেই।
ভেদ্দা ভাষাঃ
শ্রীলংকায় ভেদ্দা নামের একটা সিনহালিজ ক্রেওল ভাষা আছে যেটার উৎপত্তি অজানা। ধারণা করা হয় ভেদ্দা শ্রীলংকায় প্রচলিত একমাত্র বিচ্ছিন্ন ভাষা, দশম শতকে এই ভাষা সিনহালিজের সাথে মিশে নতুন এই ক্রেওল ভাষার সৃষ্টি হয়।
বিচ্ছিন্ন ভাষাগুলোর সবার পরিণতি একই রকম, বিলীণ হবার মুখে। বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাষা টিকে থাকে না। বিচ্ছিন্ন ভাষায় চারপাশের অনাত্মীয় ভাষার চাপে প্রথমে ক্রেওলাইজেশন হয় তারপরে একসময় নতুন ভাষার সৃষ্টি হয় বা প্রতিবেশী শক্তিশালী কোন ভাষার উপভাষাতে পরিণত হয়। আত্মীয়, পরিজন আবৃত হয়ে না থাকলে মানুষের ভাষা টিকে থাকে না। মুখের ভাষায় প্রবাহিত এসব ভাষার জীবনকাল শেষ কয়েকজন মানুষের জীবনের উপর নির্ভর করবে। তাদের সাথে এই ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে। বুরুশাসকি হয়ত একসময় উর্দুর ভেতরে হারিয়ে যাবে। তেমনি কুসুন্ডা হয়ে পড়বে নেপালি। এসব ভাষা সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবার আগে রেকর্ড এবং ডকুমেন্টেশান করা খুবই জরূরি।