১
৩২৩৭ বার পঠিত
বর্তমানে দুনিয়াতে মোট ৬ হাজারের মত ভাষা আছে। প্রাণিজগতের মত দুনিয়ার ভাষাগুলোর একটা প্রাকৃতিক ইতিহাস আছে যার শুরু হয় আফ্রিকা মহাদেশে। সেখানে প্রথমবারের মত ভাষার মাধ্যমে মানুষ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে। তারপরে আফ্রিকা থেকে মানুষ যখন সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে তখন প্রত্যেক গ্রুপের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভার্সনের তৈরি হয়। এভাবে এক ভাষা থেকে অনেকগুলো ভাষা সৃষ্টি হতে থাকে। চুড়ান্ত পর্যায়ে আমরা নানান বৈচিত্র্যময় হাজার হাজার ভাষা দেখতে পাই। তবে ভাষায় যে অর্থবোধক শব্দ থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। একেবারে আদিম ভাষায় মানুষ জিহবা দিয়ে টুংটাং শব্দ করে চালিয়ে দিত। যে ভাষার উদাহরণ এখনো আফ্রিকার খইসা ভাষায় চালু আছে। কালাহারি মরূভূমির বুশম্যানেরা সেই ভাষায় কথা বলে।
ভাষা স্থির নির্দিষ্ট কোন কিছু নয়, ভাষার বিবর্তন হয়। ভাষা বহতা নদীর মত চলমান, জীবন্ত। পরিবর্তনের ধারায় পুরাতন ধ্বনি থেকে নতুন ধ্বনি তৈরি হয়, শব্দ থেকে ব্যকরণ তৈরি হয়। ভাষার গতিপথ নানামুখী। ফলে দুনিয়াতে বাংলা, ইংরেজির মত ভাষা যেমন আছে তেমনি জাপানিজ ভাষাও আছে।
বলা যায় প্রত্যেক ভাষাই প্রতিনিয়ত নতুন আরেকটি ভাষায় পরিবর্তিত হচ্ছে ; যে ভাষা নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে না, হতে পারছে না সেই ভাষা বিলীণ হবার পথে আচে। ভাষার চলমানতায় পুরাতন ভাষা মরে গিয়ে নতুন ভাষা জন্ম নেয়, ভাষার ভেতরে নতুন ভাষা জন্ম নেয়। আঞ্চলিক ভাষাগুলো এভাবে তৈরি হয়। অনেক সময় আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে যে কোন একটাকে প্রমিত, মান ভাষা হিসেবে স্থির করা হয়। যে ভাষাকে এভাবে প্রমিত বানানো হয় তার পরিবর্তনের, এডাপ্টেশানের হার কমে যায়। যেসব ভাষা শুধু মুখের ভাষায় আছে, লিখিত রূপ নেই সেগুলো বেশি পরিবর্তিত হয়। লেখার স্থায়িত্বের কারণে এটা হয়। মুখের ভাষা সবসময় চেইঞ্জ হচ্ছে, কিন্তু ছাপা অক্ষর যেমন আছে তেমনই থাকছে।
দুনিয়ার সকল ভাষাই অপর ভাষা থেকে শব্দ ধার করে, সেজন্য কোন ভাষারই বিশুদ্ধ শব্দমালা বলে কিছু নেই। কিছু ভাষা আছে তারা অন্য ভাষা থেকে এত পরিমাণ শব্দ ধার করেছে যে সেসব ভাষায় অরিজিনাল শব্দের পরিমাণ নগন্য যেমন, ইংরেজি ভাষা। যেসব ভাষা একসাথে ব্যবহৃত হয় তারা একে অপরের কাছ থেকে ব্যকরণের নিয়মও ধার করে। বাংলা এবং ইংরেজি ইন্দো-ইওরোপিয়ান ভাষা গোষ্ঠির সদস্য হলেও বাংলা বাক্যের গঠনরীতি ( সিনট্যাক্স) কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া যেমন, “আমি ভাত খাই”। subject–object–verb (SOV) কাঠামো।
অপরদিকে ইংরেজিতে দেখা যায়, “ আই ইট রাইস”, মানে কর্তা-ক্রিয়া-কর্ম, subject–verb–object (SVO)। ইন্দো-ইওরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠির অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষা যেমন ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ভাষায় SVO সিনট্যাক্স দেখা যায়। বাংলা ভাষায় বাক্য গঠন রীতির এই ফ্লিপের কারণ হয়ত দ্রাবিড়িয়ান ভাষাগোষ্ঠির প্রভাব। দ্রাবিড়িয়ান ভাষাগোষ্ঠির তামিল, তেলেগু, কানাড়া, মালয়লাম ভাষাগুলো সব কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া, SOV নিয়ম অনুসরণ করে।
কিছু ভাষা আছে যেগুলো দু’তিনটি ভাষার সংকর। ভাষার ব্যবহার খুবই স্বতস্ফূর্ত একটা প্রক্রিয়া, এজন্য ভাষার ক্রম পরিণতিতে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংখ্যক ভাব, অভিব্যক্তি, অলংকার ইত্যাদি তৈরি করে করে। ভাব প্রকাশের জন্য অতকিছুর আসলে দরকার হয় না। যেমন, অনেক ভাষায় বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া সবকিছুকে লিঙ্গ দিয়ে চিহ্নিত করতে হয়, যেটা না করলেও চলত। যাদের সবকিছুতে লিঙ্গ পরিচয় লাগে না তারাও ভাব প্রকাশে পিছিয়ে নেই।
পিজিন ভাষাঃ
কোন রকম প্রশিক্ষণ ছাড়া মানুষ যখন খুব দ্রুত নতুন কোন ভাষা শেখে তখন তারা সেই ভাষার নতুন একটি বিকৃত রূপ তৈরি করে যেটাকে বলা হয় পিজিন। পিজিন শব্দটি এসছে ইংরেজি বিজনেস শব্দ থেকে। ঔপনিবেশিক সময়ে ব্যবসা চালানোর জন্য স্থানীয় মানুষকে কর্মের জন্য কিছু কলোনিয়াল শব্দ শিখতে হতো। সে সময় ইংরেজি, ফরাসী, স্প্যানিশ ভাষার সংস্পর্শে এসে অনেকগুলো পিজিন ভাষার সৃষ্টি হয়।
যেমন, জাপানিজ পিজিন ইংরেজি যেটা ব্যাম্বু ইংলিশ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকান মিলিটারি বেইজে এই ভাষার জন্ম হয় যার মাধ্যমে দখলকৃত জাপানিজদের সাথে আমেরিকানদের যোগযোগ সৃষ্টি হয়।
থাইল্যান্ডে Tinglish নামের একটি থাই-ইংলিশ পিজিন প্রচলিত আছে।
ক্রেওল ভাষাঃ
মানুষকে যদি দৈনন্দিন প্রয়োজনে পিজিন ভাষা ব্যবহার করতে হয় তাহলে যেটা তৈরি হয় সেটাকে বলা হয় ক্রেওল। ক্রেওল ভাষায় পিজিনের সাথে স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে এক নতুন ভাষার তৈরি হয়। পাপুয়া নিউ গিনিতে টক পিসিন নামে একটি ক্রেওল ভাষা আছে যার মানে হলো, টক পিজিন।
বর্তমানে দুনিয়ায় ইংরেজি ভাষার অনেক ক্রেওল আচে যেমন, জ্যামাইকান, সিঙ্গাপুরে প্রচলিত Singlish, মালয়েশিয়াতে Manglish। ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের হিন্দী ক্রেওল প্রচলিত আছে।
ভাষার বিবর্তনে সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো বর্তমানে প্রাণি যেমন বিলীণ হয়ে যাচ্ছে তেমনি প্রতিদিন ভাষাও বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে বর্তমান ধারা চলতে থাকলে একুশ শতকের শেষে দুনিয়ার মোট ভাষার সংখ্য ৬ হাজার থেকে কমে ৫০০ তে নেমে আসবে। এর মানে সাড়ে পাঁচ হাজার (৫৫০০) ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে। বিশ্বায়নের কারণ বর্তমানে দুনিয়াতে মাত্র কয়েক ডজন ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যে কোন ভাষায় মাত্র একটা জেনারেশন যদি মিস হয় আর সেটা যদি লিখিত ভাষা না হয় তাহলে সে ভাষা পুরোপুরি বিলীণ হয়ে যায়। যেকোন চালু ভাষা মরে যাবার সময়ে আবারো পিজিন রূপ নেয়, পুরোপুরি বিলীণ হবার আগে অল্প কিছু মানুষ ভুলভালভাবে সেটা ব্যবহার করে। যেমন বাংলাদেশের অস্ট্রোএশিয়ান পরিবারের মুন্ডা গোত্রের ভাষা কোডা এখন বিলীণ হবার পথে। ২০০৫ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৩০০ জন কোডা ভাষী আছে। তবে এ ভাষার অধিবাসীদের মতে বাংলা এখন তাদের প্রধান ভাষা।
সারাবিশ্বে খুব দ্রুত ভাষাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর প্রকোপে আমেরিকান স্যু জাতির ডাকোটা এবং লাকোটা ভাষা ব্যবহারকারীদের জীবন বিপন্ন হতে বসেছে। জীবিত কয়েক শত মানুষ মারা পড়লে এ ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে। আশার কথা স্যু রা যারা ভাষা জানে তাদের আগে ভ্যাকসিন দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভাষার ব্যাপারে একটা বড় মিথ চালু আছে, ভাষা মানে লিখিত রূপ থাকতে হবে। অথচ দুনিয়ার বেশির ভাগ ভাষার লিখিত রূপ নেই। এসব ভাষা বিলীণ হবার আগে যদি ভাষাতাত্ত্বিকরা সেগুলোকে সঠিকভাবে নথিবদ্ধ করতে না পারেন তাহলে সেগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন
ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২১; ৮:৩২ পূর্বাহ্ন
সুন্দর লেখা।