ফেসবুকের হোমপেজ স্ক্রল করার সময় পাপিয়া জেরীন-এর লেখা নিচের স্ট্যাটাসটায় চোখ আটকে গেল। তাঁর লেখা স্ট্যাটাসটা হুবহু কোট করছি, তিনি লিখেছেন-
“বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া আর বিজ্ঞান নিয়া পড়া এক বিষয় না। বিজ্ঞান কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে? আমার পেনিসিলিন নিতে সমস্যা নাই, বস্তুবাদ নিতে সমস্যা আছে। একজন ইঞ্জিনিয়ার প্রার্থনা করলে, আর একজন ডাক্তার শিবলিঙ্গে জল-বেলপাতা দিলে তারে প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক বলা যায় না, যদিও তারা বিজ্ঞানেরই ছাত্র। কথা কি কিলিয়ার, নাকি ভেজাল আছে?”
পাপিয়া জেরীনের লেখাটায় সুক্ষ্ণ ক্ষোভ বহমান। কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। যাদের বোঝার তারা ঠিকই বুঝেছেন। তবে লেখাটি আমার ভালো লেগেছে।
২.
ব্যক্তিগত জীবনে আমি কোনো ধর্মকর্মে বিশ্বাসী নই। এটা ঢোল পিটিয়ে বলবার মতো বিষয় নয় বলে সারাক্ষণ ঢোল পিটিয়ে বলবার মধ্যেও কোনো মাহাত্ম দেখিনা। তবে আমার ফেসবুক প্রফাইলের বায়োগ্রাফির ইনফোেত কেউ নজর দিলেই স্পষ্ট বুঝতে পারার কথা ব্যক্তিগত জীবনে আমার স্ট্যাটাস কী। আমি একজন মানুষ, এবং মানুষ হিসেবে আমার যা কর্তব্য সেটা পালনের জন্যই আমি আমার জীবনকে নিবেদিত করে মরতে চাই। মরতে চাই বলার অর্থ এই নয় যে আমি আমার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শহীদ হয়ে যাবো। শহীদ হবার কনসেপ্টটা ধার্মিকদের। কারণ তাদের পরকালের প্রতি বিশ্বাস ও মোহ আছে বলেই হয়তো তাদের ইহলৌকিক জীবনের প্রতি মায়া কম। কিন্তু আমি এই পৃথিবীতে বাঁচতে চাই, এই পৃথিবীর আনন্দ-সুখ উপভোগ করতে চাই। পাশাপাশি মানুষ হিসেবে আমার যে কর্তব্য সেটাও যথাযথভাবে পালন করতে চাই। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের ভেতরে ক্ষুদ্র একজন মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে আমি আমার কর্মস্বাক্ষর রেখে তারপরই মরতে চাই। কথা কিলিয়ার?
৩.
প্রথম অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গে ফিরি। ধার্মিক মানুষ সম্পর্কে আমার কোনো সূচিবাই নাই। আমার বন্ধুমহলে আপাদমস্তক নিধার্মিক থেকে শুরু করে আপাদমস্তক ধার্মিক মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে। অনেক সনাতনী ধর্মানুসারী বন্ধু আছে যারা আমাকে নমস্কার সম্ভাষণ করে আলাপ শুরু করে, আমিও তাদের সম্মান দিয়ে শুভেচ্ছা বা নমস্কার জানাই। অনেক মুসলমান বন্ধু আছে যারা আমাকে আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে আলাপ শুরু করে, আমিও তাদের প্রতিউত্তরে সালামের জবাব দিই। সালাম বা নমস্কারের জবাব দেয়ার সাথে আমার নিধার্মিক চরিত্রের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন বা ত্রুটি হয় না। এতে করে আমার নিধার্মিকতার পতন বা পরিবর্তনও হয়না। যারা নমস্কার দেন কিংবা সালাম দেন, তাদের প্রতি কোনো ঘৃণাও আমার ভেতরে সঞ্চারিত হয়না। বরং আমি মনে করি অনেক নিধার্মিক মানুষের চেয়ে তারা অনেক মহৎ। মহৎ বললাম একারণে যে, যাদের প্রসঙ্গে বলছি তারা সকলেই জানেন সংশয়বাদের পথ থেকে সরে এসে ২০০০ সাল থেকেই আমি আর ধর্মকর্মে বিশ্বাসী নই। সে হিসেবে আমার মতো মানুষের সাথে তাদের তো কথা বলাই পাপ! তারপরও তারা আমার সাথে কথা বলেন, মেলামেশা করেন, হাসিঠাট্টা করেন, আমার সুখ-দুঃখের খবর নেন। অপরদিকে সমগোত্রীয় অনেক নিধার্মিক ‘বন্ধু’ রয়েছেন যাদের বেশিরভাগ কখনোই আমার কুশলাদি জানতে চাওয়া তো দূরের কথা, পেছনে নানানরকম কূটনামি ও ষড়যন্ত্র করে থাকেন। কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যেই। এসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। কারণ নাস্তিকতা আমার পেশা নয়, এই পেশাকে উপরে উঠবার কিংবা জীবনধারণের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করিনা। আমার পরিচয়, আমি মানুষ।
৪.
কথা শুরু করেছিলাম পাপিয়া জেরীনের ছোট ওই স্ট্যাটাস কোট করে। স্ট্যাটাসটির ডিপ থিম ছিল ছাত্রলীগের পাশবিক নির্যাতনে বুয়েটের নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের ধর্মকর্ম পালন ও ঈশ্বরে বিশ্বাস বিষয়ে। যদিও সেই পোস্টের বিষয় আবরার নয়।
পোস্টের বিষয় ছিল আবরারের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে যে বা যারা সমালোচনা করছেন তাদের নীতি নৈতিকতা নিয়ে। যারা নিহত আবরারের ধর্মাচার নিয়ে কথা বলছেন, অথচ যে কারণে আবরার ছাত্রলীগের হাতে খুন হলেন সে কারণ নিয়ে টু শব্দটিও করছেন না। অর্থাৎ ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের আগ্রাসন কিংবা বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের দেশবিরোধী চুক্তি ও কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো কথা নেই। আবরারের ব্যক্তিগত জীবনের ধর্মাচার পালনের বিষয়কে বিদ্রুপ করে প্রকারান্তরে ছাত্রলীগের খুনিদের ইনডেমনিটি দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে। যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। কারণ জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ধর্মকর্ম পালনের অধিকার এবং যারা ধর্মকর্ম করেন না, তাদের সকলের অধিকার সুরক্ষা রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
অর্থাৎ ধার্মিক-নিধার্মিক উভয়ের অধিকারই সংরক্ষিত। সেখানে বলা নাই যে ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ার কিংবা বিজ্ঞানী হলে তিনি ধর্মকর্ম করতে পারবেন না। পৃথিবীতে বহু বহু বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী এবং তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। এতে এটাই স্পষ্ট হয় যে, বিজ্ঞানী হওয়ার অর্থ এটা নির্দেশ করেনা যে তাকে নিধার্মিক হতেই হবে। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার প্রধান নিজেও মহাকাশযান উৎক্ষেপণের পূর্বে পুজা-অর্চনা করেছেন বলে আমরা নিউজ মিডিয়ায় দেখেছি। এর অর্থ এই নয় যে তিনি বিজ্ঞানী হবার যোগ্যতা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। এর অর্থ এই নয় যে তিনি ভারতের উগ্রবাদী হিন্দু সন্ত্রাসী সংগঠন আরএসএস-এর পারপাস সার্ভ করেন।
৫.
নিহত আবরার ফাহাদের ধর্মাচার আপনার চোখে লাগে এজন্যই যে, আবরার বাংলাদেশ-ভারতের অসম চুক্তির বিরোধীতা করেছিলেন। চোখে লাগে এজন্যই যে, আবরার কাশ্মীরের সাধারণ জনগণের ওপর ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলেন। চোখে লাগে এজন্যই যে, আবরার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সবকিছু ছাপিয়ে আবরারের ধর্মাচার আপনার চোখে কাঁটার মতো খচখচ করে এজন্যই যে, আবরার ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের দিকে আংগুল তুলেছিলেন।
অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সভাষদগণরা যখন মাথায় জোব্বা লাগিয়ে মক্কায় হ্জ্জ্ব করতে যান, কিংবা মদিনা সনদ বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দেন, কিংবা তেঁতুল হুজুর হেফাজতের আমির আল্লামা শফির করকমলে করজোরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন; তখন আপনার চোখে কাঁটা নয়, ফুলের পাঁপড়ির ছোঁয়া লাগে।
আবরারও মানুষ আপনিও মানুষ। দু’জনের মধ্যে তফাৎ কোথায় বলতে পারেন?
০
facebook 
Twitter .svg)
Email 