১৬১৭ বার পঠিত
সামাজিকমাধ্যমে একটি ছবি ঘুরছে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া একটা বাচ্চা মেয়ে ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালাচ্ছে। যারা ছবিটা পোস্ট করেছেন তারা জানাচ্ছেন, বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে স্কুল ছেড়ে মেয়েটিকে সংসারের হাল সামলাতে, অটোরিক্সার হ্যান্ডেল ধরতে হয়েছে। এ নিয়ে মেয়েটিকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন লোকজন। ভালো কথা, ভাসান। কিন্তু ভাসানোর আগে একবার ভেবে দেখেছেন কি, পঞ্চম শ্রেণির একজন বাচ্চাকে স্কুল ছেড়ে যে পরিস্থিতিতে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করতে হয়, সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য কে দায়ি? একটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী? একটা রাষ্ট্র কেনো গড়ে ওঠে? না, ভাবেননি। ভাবলে কোনো বাচ্চা মেয়েকেই স্কুল ছাড়তে হতো না। বুড়োর সাথে স্কুল পড়ুয়া নাবালিকার বিয়ে দেবার ঘটনাও ঘটতো না।
জানি না, সেই ছবিটি ফেইক কিনা। এখন কোনটা যে ফেইক, কোনটা যে নয়, তা নির্ধারণ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেইক হোক আর না হোক, মানুষের চিন্তার ধারাটিকে ধরেই বলছি, একটা বাচ্চা পঞ্চম শ্রেণিতে স্কুল ছেড়ে রিক্সা চালাচ্ছে এটা উৎসাহ দেয়ার কোনো বিষয় নয়। প্রথমত, একটা বাচ্চার স্কুল ছাড়ার দায় আমাদেরও কিছুটা। কারণ আমরা রাষ্ট্রটাকে উপযুক্ত করে তুলতে পারিনি। সুকান্তের ভাষায়, এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। দ্বিতীয়ত, অপ্রাপ্তবয়স্ক একটা বাচ্চা মেয়ের রিক্সা চালানোটাও মেনে নেয়ার বিষয় নয়, এখানেও আমাদের ব্যর্থতা। এমন একটা রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমরা সমর্থ হইনি যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার পূর্ণ নিশ্চয়তা রয়েছে। উল্টোদিকে মৃত্যুর পর একজন মানুষের সংসারের হাল কে ধরবে, তারও কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় রাষ্ট্র উৎপত্তির ধারণাটি সঙ্গতই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। নাগরিকদের জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি, সেই যাপিত জীবন যদি অনিশ্চয়তারই হয় তাহলে রাষ্ট্র ধারণার কী প্রয়োজন- এ ক্ষোভও অসঙ্গত নয়।
সেই অটোরিক্সা চালানোর ছবিটিই দেশের একমাত্র ঘটনা নয়। এমন অসংখ্য খবর রয়েছে গণমাধ্যমেও। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে পথে নেমেছেন বউ-বাচ্চারা- এসব খবর দেখে ও পড়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এ দেশের মানুষ। অথচ এ দেশেরই এক শ্রেণির মানুষ হাজার-লাখো কোটি টাকা চুরি করে অন্যদেশে গড়ে তুলেছেন বেগমপাড়া। আজকে কানাডার বেগমপাড়া সারা বিশ্বে আলোচিত। যে পরিমান টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, তা যদি দেশে থাকতো তবে বাংলাদেশের যতগুলো হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে প্রত্যেকটিতে আইসিউ এর ব্যবস্থা করা যেতো। অন্তত মানুষ অসুস্থতায় চিকিৎসাটা পেতো, বিশেষ করে চলমান মহামারীতে। এখন যেমন চিকিৎসা তো দূরের কথা, করোনার টেস্ট করতেই জান বেড়িয়ে যাবার অবস্থা। তেমন অভিজ্ঞতার কথাই লিখেছেন গণমাধ্যমকর্মী ফাতেমা আবেদীন নাজলা। না, গণমাধ্যমে নয় লিখেছেন সামাজিকমাধ্যমে। গণমাধ্যমের কর্মী হয়েও তিনি গণমাধ্যমে কেনো লিখলেন না, সে প্রশ্নটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কি স্বয়ং গণমাধ্যম গণমানুষের কথা বুঝতে বা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হচ্ছে?
সেই গণমাধ্যমকর্মী করোনার এক টেস্ট করার জন্য কত জায়গায় ফোন করেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। এই বর্ণনার এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়। এমন ভুক্তভোগী অসংখ্য রয়েছেন। অগণিত ক্ষুব্ধ অভিযোগ রয়েছে এ ব্যাপারে। যে দেশে একটা টেস্ট করতেই এত হ্যাপা পোহাতে হয়, সেখানে যারা চিকিৎসা নিয়ে গর্ব করেন, তাদের আপনি কী বলবেন? এই যে ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি তাতে আমাদের যে অবস্থা, সেটা নিয়ে কী বলার আছে? মডার্না ও বায়োএনটেকে’র ভ্যাকসিন ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ কার্যকর। অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র ভ্যাকসিনের কার্যকরিতা টেনেটুনে ৭০ ভাগ। অথচ আমাদের চুক্তি হলো অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র ভ্যাকসিন নিতেই। তাও আবার সরাসরি নয় তৃতীয় পক্ষ ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে। সেই চুক্তিতেও রয়েছে তৃতীয় পক্ষ বেক্সিমকো লিমিটেড। মডার্না আর বায়োএনটেকে’র ভ্যাকসিন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই পাবার কথা। অ্যাস্ট্রাজেনেকা’রটা পাওয়া যাবে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। সব দিক থেকেই পিছিয়ে অ্যাস্ট্রজেনেকা। সে অনুযায়ী পিছিয়ে আমরাও।
এই যে একটা বাচ্চা মেয়ের সংসারের হাল ধরার চেষ্টা, ভ্যাকসিনেশনে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা এ সবই আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে একটা প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। সাথে টাকা পাচার, হত্যা, গুম আর দুর্ঘটনাতো রয়েছেই। জানি, বিপরীতে অনেক সফলতার খবরও আছে। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, স্কাইস্ক্র্যাপার, সবই রয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবন নিরাপদ না হলে। বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা না থাকলে, সে সফলতার মূল্য কী! উল্টো এসব সাফল্য আখেরে দাঁড়াবে তো কংক্রিটের জঞ্জাল হয়েই।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন