০
২২২৩ বার পঠিত
আমার পরিচিত একজন তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন বাসায়। বাচ্চা দুটোর বয়স দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। বললেন, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন, তাই বেড়িয়ে গেলেন। এই করোনাকালে তার নিজের এবং বাচ্চাদের কারো মুখেই মাস্ক নেই। জিজ্ঞেস করলাম, মুখে মাস্ক নেই কেনো? বললেন, আল্লাহ ভরসা। এই হলো অবস্থা। যার কথা বললাম তিনি ধনবান। সম্প্রতি প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্যক্রমে সে সময় আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শিশুদের মাস্ক পরা কেনো জরুরি এমন একটা বিষয় পড়ছিলাম। এমন মুহূর্তেই দুটো বাচ্চার মাস্কহীন মুখ মেজাজটা খারাপ করে দিলো। সেই মানুষটির অর্থ-বিত্ত মুহূর্তেই আমার কাছে মূল্যহীন মনে হলো। মনে হলো অর্থ আর নির্বুদ্ধিতার কম্বিনেশন বড়ই ভয়ংকর। সাথে মূর্খতা সেটাকে আরো অন্যমাত্রা দেয়।
বাচ্চা দুটোকে সুস্থই দেখলাম। তারপরও ডাক্তার দেখানো কেনো এমন প্রশ্নের উত্তর ছিলো, রুটিন চেকআপ। এ সময়ে অপরিহার্য প্রয়োজন ছাড়া ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিরুৎসাহিত করা হয়। অথচ হয়তো বিত্তের প্রাবল্যেই তার ডাক্তারের কাছে আসা। অন্তত মানুষকে দেখানো, বাচ্চাদের প্রতি সপ্তাহে ডাক্তার কাছে নেয়া হচ্ছে এমনটা। এদের কী বলবেন বলুন তো। আমার স্ত্রী আমার প্রশ্নের ধরনে কুণ্ঠা বোধ করছিলেন। আমার প্রশ্নটা তার কাছে রূঢ় মনে হচ্ছিলো। সে চাচ্ছিলেন না, আমি এমন প্রশ্ন করি। অথচ মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। দুটো বাচ্চা, যাদের সব কিছুতেই আগ্রহ। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলে ডাক্তারের টেবিলে থাকা জিনিসপত্তর, ঘরে থাকা এটা-সেটা সবই ধরে দেখতে চায়। একজন বয়স্ক মানুষ যেভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, বাচ্চাদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। যার ফলে বাচ্চারা নিজেরা এবং তাদের দ্বারা বয়স্কদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিপরীতে সেই বাচ্চাদ্বয়ের পিতা একেবারে নিরূদ্বেগ। সত্যিই বিচিত্র।
আমাদের সমাজের মাথার দিককায় এমন বিচিত্র মানুষের সংখ্যাই বেশি। এমন কিছু মানুষের কাছে অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি এসে গিয়েছে, যাদের ফলো করতে গেলে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। অথচ এক সময় ছিলো সমাজের মাথা মানুষগুলোর জীবনাচরণ অনুসরিত হতো। সে সব নমস্য মানুষদের যাপিত জীবন তাদের কাছে আদর্শ ছিলো। আর সেই সমাজের মাথা মানুষগুলোও হতেন তেমন। জ্ঞানে-গুণে-চরিত্রে সত্যিকার আইডল। এখন তো আইডল হলেন গাইয়ে, ইন্ডিয়ান আইডল, বাংলাদেশি আইডল- ইত্যাদি। অর্থাৎ সময়ের সাথে আইডলের সংজ্ঞা পাল্টে গিয়েছে। এখন আর জ্ঞানি-গুণীগণ আইডলের কাতারে পরেন না।
সে সময় আদর্শ হিসাবে সমাজে পরিচিত হতেন স্কুল মাস্টারগণ। তাদের জীবনাচরণ মানুষ অনুসরণ করতো। হতেন বিদ্বান-বিদগ্ধজন। শুধু অর্থ-বিত্তের মালিকরা কখনোই আদর্শ হতেন না, তাদের অনুসরণও করা হতো না। একজন পন্ডিতের সামনে মাথা নিচু করে থাকতে হতো অর্থ-বিত্তের মালিকদের। এখন হয়েছে উল্টো। এখন পন্ডিতদেরই মাথা নত করে থাকতে হয় বিত্তবান অকাটদের সমুখে। এখন বিদ্যা আর জ্ঞান প্রদর্শন বা বিতরণের বিষয় নয়, লুকানোর বিষয়। জ্ঞানীদের বলা হয় বোকা। এখন প্রদর্শনের বিষয় হলো বিত্ত-বৈভব। তবে বিতরণের ব্যাপার এখন নেই। বিত্ত-বৈভবওয়ালারা তাদের বিত্ত বিতরণ তো দূরের কথা যেনতেন উপায়ে আহরণেই ব্যস্ত থাকেন।
সৃষ্টিকর্তার কথা হলো, যে যেমন তার নেতৃত্বও হয় তেমন। আমরা হয়তো তেমন দলেরই অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। না হলে, করোনাকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা যাদের তারা গা ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন কেনো! বিবিসি’র মতো গণমাধ্যমও এমন আশঙ্কার কথা জানাচ্ছে। বলছে, গা ছেড়ে দেয়ার কথা। করোনা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হলেও প্রায় কারো মুখেই মাস্ক নেই। বাধ্যতামূলক হলেও বাধ্য করার কোনো প্রক্রিয়া চালু নেই। তার মধ্যে বুলেটিন বন্ধ, হাসপাতালের সংখ্যা কমানো ইত্যাদি সব কার্যক্রমে মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মেছে করোনা বিদায় নিয়েছে। সে জন্যেই ছোট বাচ্চাদের নিয়ে নির্ভয়ে বেড়িয়ে পড়ছে মানুষ। আর কিছু একটা হয়ে গেলে দোষ পড়ছে সৃষ্টিকর্তার উপর, তিনি যা করেন। অথচ সৃষ্টিকর্তাই বলেছেন, পরিবর্তনের চেষ্টার কথা। বলেছেন, যে জাতি নিজের ভাগ্য পরিবর্তন চায় না তাদের জন্য তিনি কিছু করেন না। আমরা আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই না, আর পরিবর্তনের দায়িত্ব যাদের তারা আমাদের উপেক্ষা করেন। এ এক অদ্ভুত চক্র।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন