ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সেসময় ভারতে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তাঁর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি খণ্ডচিত্র‘ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা ধারাবাহিকভাবে বণিকবার্তায় প্রকাশিত হচ্ছে। লেখাটি এই প্রজন্মের পাঠকদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এখানে শেয়ার করলাম।
মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি খণ্ডচিত্র
– জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী
প্রথম পর্ব:
‘অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির
ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর’
– জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
শুরুর কথা
২৫ মার্চ ১৯৭১। লন্ডন আইটিএনের রাতের খবর ‘নিউজ অ্যাট টেন’। টেলিভিশনের পর্দায় হঠাৎ আবির্ভূত হলেন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পূর্ব পকিস্তানের জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সব নির্বাচনী এলাকায় বিজয়ী পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান; সুঠাম, দীর্ঘদেহী, উন্নত শির, চোখে-মুখে দৃঢ় প্রত্যয় কিন্তু চিন্তিত। ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ফটকে দাঁড়ানো, ঠোঁটের কোনায় চেপে রাখা ধূমপানের পাইপ।
ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্ন,
‘Mr. Rahman, are you not afraid that Pakistanis may kill you?’
‘মিস্টার রহমান, আপনার কি পাকিস্তানিদের হাতে মারা যাওয়ার ভয় নেই?’
তাত্ক্ষণিক উত্তর দিলেন বঙ্গবন্ধু—
‘No, if they kill me, they have to face their worst enemy- the Communists.’
‘না, আমাকে মারলে তাদেরকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু কমিউনিস্টদের মুখোমুখি হতে হবে।’
উল্লেখ্য, সত্তরের দশকে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের শঙ্কায় ছিল ভয়ানক চিন্তিত ও তাড়িত। ভারতে কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদার অনেককে নির্ঘুম করে দিয়েছিলেন।
কয়েক মুহূর্ত পরেই উচ্চৈঃস্বরে গম্ভীর গলায় শেখ মুজিব বললেন,
‘Have Pakistanis got enough bullets to kill seven crore Bangalees?’
‘৭ কোটি বাঙালিকে হত্যার জন্য কি পাকিস্তানিদের পর্যাপ্ত গুলি আছে?’
চমকিত হলাম বীরের সাহসী বক্তব্যে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার খবর প্রকাশ পেল ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, বিবিসি সংবাদে। ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে লুকিয়ে থাকা বিবিসির সাংবাদিক মাইকেল ক্লেটন তথ্য ও ছবি প্রকাশ করলেন। একই দিন জেনারেল ইয়াহিয়ার পাকিস্তানিদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ উদ্ধৃত করে করাচি থেকে কেনেথ ক্লার্ক লিখলেন, ‘জিন্নাহর একতার স্বপ্ন রক্তে ধুয়ে মুছে গেছে’। ’৭১-এর ২৭ মার্চ লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তরুণ বাঙালি মেজর জিয়ার পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। শেখ মুজিবুরের তুলনায় খর্বকায় কিন্তু সাহস ও দৃঢ়তার চিহ্ন মুখমণ্ডলে। তার উচ্চারিত দুই শব্দ— ‘We Revolt’ শুনে চমকিত হলেন বিলেতের বাম রাজনৈতিক কর্মীরা। দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, পাকিস্তানের আয়ু শেষ হয়ে গেছে। নতুন দেশ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম আসন্ন। একধারে প্রসববেদনার যাতনা, অন্য পক্ষে শুভ সংবাদের জন্য অপেক্ষমাণ প্রবাসী বাঙালিরা। সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন করলাম মিডলসবরোতে আমার বন্ধু ডা. মাহমুদুর রহমান বাবলু ও তার স্ত্রী ডা. সাবেরাকে। বাবলুর মা মিসেস জহুরা রহমান খুবই মিশুক ও দানশীল নারী এবং সুগায়িকা, বাবলুর বাবা অধ্যাপক লুত্ফর রহমান ছিলেন বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক ও প্রখ্যাত যক্ষ্মা বিশেষজ্ঞ, অতীব নিরীহ ভদ্রলোক, ঠিক বাবলুর মার বিপরীত। তারা উভয়ে আমাকে সন্তানসম স্নেহ করতেন। তারাই পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে সাভারে তাদের পুরো জমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনের জন্য দান করেছিলেন।
দ্রুত যোগাযোগ করলাম ডা. মসিহুজ্জমানের সঙ্গে। মসিহ খুব ভালো ছাত্র ছিল। মসিহ ও আমি একই দিনে একই সঙ্গে বিলেতে গিয়েছিলাম। মসিহর বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর আকতারুজ্জামান আমার পাকিস্তানি পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তার সিদ্ধেশ্বরীস্থ টিনের বাড়িতে বেশ কিছুদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে বসবাস করেছেন। তার আরেক ছোট ভাইয়ের প্রেমকাহিনী সিনেমার উপজীব্য হতে পারে, সে ছবির ভিলেন পাকিস্তানের একসময়ের নিরাপত্তা প্রধান ও পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অন্যতম প্রিয়পাত্র এসএমএস সফদার পিএসপি, যিনি বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী ইসলামী কলেজের ছাত্র ও কলকাতার বেকার হোস্টেলের বাসিন্দা ছিলেন। আগরতলা মামলায় সফদার আইয়ুব খানের পক্ষে শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। সফদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ একাডেমিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন।
মসিহর ছোট ভাই কর্নেল খাইরুজ্জামান ফিলিপাইন ও মিয়ানমারে রাষ্টদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি পূর্ব পাকিস্তানের ডাক্তারদের সঙ্গে প্রতিদিন রাত ১২টা পর্যন্ত ফোনে বিষয়টির আলাপ অব্যাহত রাখলাম। সবাই চিন্তিত, উত্কণ্ঠিত।
১৯৭১ সালে এক হাজারের বেশি বাঙালি ডাক্তার আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন কাউন্টিতে কর্মরত ছিলেন, মূলত উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে আসা।
এছাড়া এক লাখের অধিক বাঙালি ছিল বিভিন্ন পেশার ও হোটেল রেস্টুরেন্টের কর্মচারী, যাদের অধিকাংশই সিলেটের। বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র ছিলেন কয়েক হাজার। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাদের অন্যতম।
লন্ডন, গ্লাসগো, এডিনবরা, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, লিডস, নিউক্যাসেল, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও অন্য ছোট বড় শহরে শনি, রোববারে পূর্ব পাকিস্তানের চিকিৎসক, ছাত্র ও অন্যান্য পেশাজীবী জড়ো হতে থাকলেন শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে।
সম্ভবত ’৭১-এর ২৭ মার্চ ছিল শনিবার। লন্ডনে সবচেয়ে বেশি ভিড় হতে থাকল পুরনো কমিউনিস্ট কর্মী তাসাদ্দুক হোসেনের ‘দ্য গ্যানজেস রেস্টুরেন্ট’-এ। এটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রদের আড্ডাখানা। এখানে শুক্রবার সন্ধ্যা ও শনি, রোববারে বহু ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য সপরিবারে ভারতীয় খাবারের স্বাদ নিতে আসতেন।
’৭১-এর ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার সর্বত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মমতার চিত্র প্রকাশ করল তাদের রিপোর্টার সাইমন ড্রিংয়ের বরাতে, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় শিরোনামে।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকা শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার আগে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও শেখ মুজিবের আলোচনা পর্যবেক্ষণের জন্য আসা বিভিন্ন দেশের মিডিয়া ও সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়। বিবিসির মাইকেল ক্লেটন ও ডেইলি টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের ছাদে লুকিয়ে থাকেন ঢাকার ইংরেজি দৈনিক দ্য পিপলের সম্পাদক আবিদুর রহমানের পরামর্শে। অ্যাসোসিয়েট প্রেসের ফটোগ্রাফার মিশেল লরেন্টকে নিয়ে সাইমন ড্রিং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ মার্চ রাতে বর্বরতা ও নির্মমতার স্বাক্ষরের চিত্র ধারণ করে, সুকৌশলে পরের দিন ব্যাংকক পৌঁছে সেখান থেকে ডিসপ্যাচ পাঠান, যা ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয় প্রথম পৃষ্ঠায়, বড় শিরোনামে।
বহুল প্রচারিত রক্ষণশীল দৈনিক টেলিগ্রাফের সংবাদে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যস্থ পূর্ব পাকিস্তানিরা স্তম্ভিত ও বেদনায় নীল হয়ে যায়। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পরিচিত ও নিকটজনের চিন্তায়।
স্মরণ প্রয়োজন যে, শেখ মুজিবের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বিখ্যাত ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানীর ‘স্বাধীনতার দাবিতে আপসহীন’ থাকার আহ্বান এবং ১২ মার্চ ময়মনসিংহে কৃষক সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার স্বপক্ষে অবিচল থাকার পুনঃ আহ্বানকে বিলেতের বাঙালি পেশাজীবী ও ছাত্ররা খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। এমনকি ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর পাকিস্তানকে ‘ওয়ালাইকুমস্ সালাম’ খুব বেশি উত্তাপ সৃষ্টি করেনি। এসব বক্তব্যকে তারা দরাদরির রাজনৈতিক স্টান্ট বলে ধরেছিলেন। তবে এবার প্রবাসী বাঙালি ধাক্কা খেল আইটিএন, বিবিসি, টাইমস ও টেলিগ্রাফের সচিত্র সংবাদে।
অধিকতর সংবাদ প্রত্যাশায় তারা জড়ো হতে থাকে সপ্তাহ শেষে শনি, রোববারে ৩ ও ৪ এপ্রিল লন্ডনের হাইড পার্ক কর্নারে। জমে ওঠে বক্তৃতা ও পাকিস্তানিদের প্রতি ধিক্কার। অধিকতর সংবাদ সংগ্রহ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লন্ডনের পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের ধারণা ও চিন্তার তথ্য জানার জন্য স্কটল্যান্ডের লাঙ্কাশায়ারের থেকে ‘ল’ হাসপাতালের ডা. মবিন ও আরো অনেকে এসে যোগ দেন হাইড পার্কের সমাবেশে। মবিন ঢাকার ছেলে কিন্তু পাস করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে। ভালো ক্রিকেট খেলেন। তার মেজ ভাই হাসনাত আব্দুল হাই তখনকার দিনে সব উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত পরিবারের একান্ত কাম্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য, একজন সিএসপি। মবিনের এক ভাইপো মাসুদ বিন মোমেন বর্তমানে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত।
ভাবের আতিশয্যে হাইড পার্কে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমিও তাদের অনুসরণ করি। আমরা রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হই।
ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশী সংগঠন: বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএমএ)
১৯৭১ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে, সম্ভবত ১০ তারিখে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানের প্রায় একশ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি চিকিৎসক লন্ডনের কিংস ক্রসের কাছে এক কমিউনিটি হলে মিলিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য-সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত নাম বিএমএ বিধায় নবগঠিত বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত নাম ঠিক করা হয় বিডিএমএ। পাঁচ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি মনোনীত হয়। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন লন্ডনের উপকণ্ঠে সারেতে কর্মরত চক্ষু চিকিৎসক আবু হেনা সাইদুর রহমান, যিনি ‘খসরু ভাই’ নামে বেশি পরিচিত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা, আমার কয়েক বছরের সিনিয়র, পূর্ব লন্ডনে কর্মরত রংপুরের এমএ হাকিম, এমআরসিপি সহসভাপতি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রথম বা দ্বিতীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি আলতাফুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক। আলতাফ নিকটবর্তী লাঙ্কাশায়ারের একটি শহরে ডাক্তারি করতেন। তিনি পরবর্তীতে ওই শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। আলতাফই ব্রিটেনে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশী মেয়র।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন মোস্তফা ও তার স্ত্রী ডা. মমতাজ বেগম কহিনুর। তারা সবাই স্কটল্যান্ডে থাকতেন। প্রয়াত ডা. মোয়াজ্জেম মোস্তফা ছিলেন অ্যানেস্থেশিয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম এফএফএ (Fellow of Faculty of Anaesthesia, Royal College of Surgeon)। মমতাজ ছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। অন্য উদ্যোগী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসক কাজী কামরুজ্জমান উলভার হ্যাম্পটনে অ্যানেস্থেশিয়ায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। অন্য সদস্য নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ মবিন। আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি ইয়র্ক শহরে জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারির রেজিস্ট্রারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে এসেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করার উদ্দেশ্যে। আস্তানা গেড়েছি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির ছাত্র রকি নুরুল আলম, লুিফ জাহান চৌধুরী ও মাহবুবদের সঙ্গে, তাদের উত্তর লন্ডনের ক্রিকলউডের বাসায়।
স্থির হয় প্রত্যেক সাধারণ সদস্য চিকিৎসক মাসে ন্যূনতম ১০ পাউন্ড চাঁদা দেবেন ব্যাংক স্ট্যান্ডিং অর্ডারের মাধ্যমে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করার লক্ষ্যে। কয়েকজন অনেক বেশি চাঁদা দিতেন। স্কটল্যান্ডের ডা. কাজী ফজলুল হক এবং সারে/সাসেক্সের ডা. এম বখত মাজমাদার তাদের অন্যতম। উভয়ের বিদেশী স্ত্রী। তাছাড়া ম্যানচেস্টার এলাকার ড. সালেহ আহমদ, নুরুল আলম, জর্জিসুর রহমান, সুশান্ত বিশ্বাস, খুলনার তৈয়বুর রহমান, নজরুল (যিনি ১৯৭২ সালে লন্ডনে শেখ মুজিবুর রহমানের পিত্তথলি অপারেশনে প্রধান সহকারী ছিলেন) চট্টগ্রামের আব্দুর রহিম, চক্ষু চিকিৎসক নূর হোসেন ও আরো অনেকে সহায়তা করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপক উৎসাহ ও সহযোগিতা দেন নিউইয়র্কের চিকিৎসক ডা. খন্দকার মো. আলমগীর, যিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা শহরে একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য মিরপুরে তার একখণ্ড জমি ও ২ কোটি টাকা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে তিনি দান করেছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাকাউন্ট খোলা হয় মিডল্যান্ড ব্যাংকে, যা বর্তমানে এইচএসবিসি নামে পরিচিত।
পরের সপ্তাহে এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, যত দ্রুত সম্ভব মে মাসের মধ্যেই ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী ও ডা. এমএ মবিন নিজ খরচে কলকাতা যাবেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য।
সব সদস্যকে অনুরোধ করা হয় বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয় ব্রিটেনের স্থানীয় জনসাধারণকে জ্ঞাত করার জন্য এবং ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের কাপড়চোপড় ও ওষুধপত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য। কয়েকটি ভ্যান নিয়ে চিকিৎসকদের চার-পাঁচটি দল প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়ত জড়ো করা সংগৃহীত সাহায্য লন্ডনে নিয়ে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে প্যাকেট করার জন্য। সংগৃহীত ওষুধগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে প্যাকেট করা হতো। অনেক চিকিৎসকের স্ত্রীরা এ কাজে সহায়তা করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ পর্যবেক্ষণে যাত্রা
দামেস্ক বিমানবন্দরে পাকিস্তানের অযাচিত হস্তক্ষেপ
হাইড পার্ক কর্নারে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়ে যোগাযোগ করি ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরে। সেখান থেকে আমাদের দেয়া হয় ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ একটি এক পৃষ্ঠার প্রত্যয়নপত্র। ওটা দেখিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করি ভারতীয় ভিসা। নয়াদিল্লির উদ্দেশে যাত্রার আগের দিন হঠাৎ ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে সাদা পোশাকের এক অফিসার দেখা করে আমাদের সতর্ক থাকতে সাবধান করে জানালেন, যারা বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয়, তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে পাকিস্তান দূতাবাস। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিলেতের ‘হোম’ মিনিস্ট্রিকে অনুরোধ করেছেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত।
আমরা লন্ডন হিথরো বিমানবন্দর থেকে সিরিয়ান এয়ারলাইনসে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করি সম্ভবত ১৬ মে ১৯৭১, রোববারে। প্লেন ছাড়ার পর আমি টানা ঘুম দিলাম। ১ ঘণ্টার বিরতি দামেস্ক বিমানবন্দরে। স্বল্প বিরতির কারণে আমরা প্লেন থেকে নামলাম না। ১ ঘণ্টার জায়গায় ৪ ঘণ্টা পার হলো, কিন্তু প্লেন ছাড়ে না। সবাই উসখুস করছে, বিরক্ত। আমি বিমানবালাকে ডেকে প্রশ্ন করলাম, দেরি কেন হচ্ছে? প্লেনে কি কোনো যান্ত্রিক বিপত্তি ধরা পড়েছে? আর কতক্ষণ লাগবে? নীরস ও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিমানবালা আমাদের দুজনকে দেখিয়ে জবাব দিলেন, ‘আপনাদের কারণে সিরিয়ান এয়ারলাইনসের দামেস্ক থেকে নয়াদিল্লি যাত্রা বিঘ্নিত হয়েছে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের দুই নাগরিককে গুরুতর অপরাধে বিচারের জন্য পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে যেতে চাইছে। দামেস্ক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানাল, প্লেনে কোনো পাকিস্তানি নাগরিক নেই। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ দাবি করল, ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী ও ডা. এমএ মবিন পাকিস্তানি নাগরিক, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে বিচারের জন্য সিরিয়া ও পাকিস্তান দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের চুক্তি অনুসারে সিরিয়া তাদের পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য। সিরিয়া কর্তৃপক্ষ জানাল, ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যয়ন অনুযায়ী এ দুজন রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক, পাকিস্তানি নন।
দ্বিতীয়ত. তারা সিরিয়ার ভৌগোলিক এলাকা দামস্কে অবতরণ করেননি। তারা প্লেনে অবস্থান করছেন, যা আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন, সিরিয়ার আইনবহির্ভূত এলাকা। তাই তাদের পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর হবে আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। শেষ অবধি পাকিস্তান সিরিয়ার আইন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মেনে নিয়ে প্রস্থান করলে বিমান নয়াদিল্লির উদ্দেশে যাত্রার প্রস্তুতি নেয়। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
পরের দিন সোমবার আমরা দিল্লি পৌঁছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিনিধি আমাদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, দামেস্ক বিমানবন্দরে পাকিস্তানি তত্পরতায় তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন। সম্ভবত লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমাদের সম্পর্কে তথ্য জ্ঞাত করেছিল।
আমাদের ভারতে তৈরি অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে করে একটি সরকারি অতিথিশালায় নিয়ে যাওয়া হলো। শুরু হলো বিভিন্ন সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ, এদের অনেকেই বাঙালি ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা। দিল্লির রাস্তায় বিদেশী গাড়ির বাহুল্য চোখে পড়েনি। বিপরীত ঘটনা পাকিস্তানের সব বড় শহরে, বিদেশী গাড়ির ভিড়। দেখা হলো বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম আনুগত্য প্রকাশ করা দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশন ছেড়ে আসা সাহসী সেকেন্ড সেক্রেটারি শেহাবুদ্দিন ও প্রেস সচিব আমজাদুল হকের সঙ্গে। তাদের মনে ভীতি নেই, শঙ্কা নেই। তাদের একমাত্র কামনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরামর্শ দিল ভারতীয় পুলিশের অনুমতি ছাড়া কলকাতার বাইরে না যেতে, কলকাতার আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা ভালো নয়। কিছু ‘দুষ্কৃতকারী’ নকশাল সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আরো বলল, কয়েক দিন কলকাতায় থেকে ফিরে যেতে, বিলেতে ওষুধপত্র ও কাপড়চোপড় যা সংগৃহীত হবে তা ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছে দিলে তারা ভারতীয় জাহাজে করে এনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে দেবে, চাইলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পৌঁছে দেবে।
দ্বিতীয় পর্ব:
কলকাতায় প্রথম সপ্তাহে যা দেখলাম জানলাম
দুদিন পর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে রাতে কলকাতা দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। উৎসাহ ও উত্কণ্ঠা নিয়ে ট্যাক্সি করে সোজা বাংলাদেশ হাইকমিশনে। ধারণা ছিল যুদ্ধ যখন চলছে, তখন নিশ্চয়ই সারা রাত কমিশন খোলা, সবাই ব্যস্ত, কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর। পৌঁছে চমকে দেখলাম হাইকমিশন নীরব নিষ্প্রভ। অনেক চেষ্টার পর খবর পৌঁছালাম পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হোসেন আলীর কাছে। তিনি আমাদের কথা শুনে বিরক্ত মনে বললেন, আপনারা কষ্ট করে কেন এসেছেন, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। যান রাতটা নিকটবর্তী লিটন হোটেলে কাটান, তাদের এয়ারকন্ডিশন রুম আছে। ধাক্কা খেলাম, এয়ার কন্ডিশন রুমে আরাম-আয়েশে থাকার জন্য তো আমরা লন্ডন থেকে কলকাতায় আসিনি। হাইকমিশনের মেঝেতে শয়ন ব্যবস্থা করলে বেশি খুশি হতাম। এসি হোটেলে অর্থ ব্যয় না করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সে টাকা ব্যয় তো সঠিক কাজ।
পরের দিন অনেকের সঙ্গে দেখা হলো— বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী। সবার একই কথা, তারা ভয়ানক কষ্টে আছেন, আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা নেই; একই প্রশ্ন, ‘প্রাণের তাগিদে আমরা দেশ ছেড়েছি, আপনারা কেন এসেছেন?’ কেউ কেউ বললেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য আমরা সাহায্য করতে পারব কিনা?
দেখা হলো ব্যারিস্টার মওদুদ, আমিরুল ইসলাম ও প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে। চাষী আমাদের নিয়ে গেলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে ৮ নং থিয়েটার রোডে। প্রথমে সাক্ষাৎ করালেন কর্নেল (অব) মহম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর সঙ্গে। ছাত্রজীবনে তার সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিল। তিনি ১৯৬২-৬৩ সালে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ঢাকা এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্রদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানে উৎসাহিত করার জন্য। তিনি সিলেটি ভাষা ভালো বলেন, আলাপনে বাংলার চেয়ে ইংরেজি বেশি বলেন।
আমরা লন্ডন থেকে এসেছি শুনে হাত বাড়িয়ে বললেন,
‘ওয়েলকাম ইয়ং ম্যান। হাউ ইজ লন্ডন নাও এ ডেইজ, হাউ ইজ তাসাদ্দুক? গ্যানজেস কেমন চলছে? সিলেটিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন, আমার কথা বলবেন, সকল সিলেটবাসী আপনাদেরকে সাহায্য করবে অকাতরে।’
তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। তখন তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। বসতে বলেই জিজ্ঞেস করলেন,
‘বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কেমন আছেন? বাঙালিদের বিভেদ, দলাদলি কীভাবে সামাল দিচ্ছেন? বাম রাজনৈতিক দলগুলো চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আছে তো? যুদ্ধ চলছে, দেশ পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পুরো মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। নিজেরা গিয়ে দেখুন, বিলেতের প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধভাবে সাহায্য করতে বলবেন। বিলেতের ডাক্তারদের তো অনেক আয়।’
তিনি আরো বললেন,
‘যুদ্ধ চলছে যশোর ক্যান্টনমেন্ট, আগরতলা সীমান্তে, নিজেরা গিয়ে দেখেন। প্রস্তুতি চলছে গেরিলা যুদ্ধেরও, মুক্তিবাহিনী সত্বর দেশের অভ্যন্তরে আক্রমণ শুরু করবে।’
তাজউদ্দীন সাহেবের বক্তব্যে আমরা আশান্বিত হলাম। বুঝলাম, যোগ্য লোকের হাতে নেতৃত্ব আছে। এখানে নিশ্চয়ই বিলেতের মতো দলাদলি নেই। ভুল ভাঙল কয়েক দিন পরে।
পরের দিন গেলাম যশোর সীমান্তে। ক্যাপ্টেন হাফিজ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড চাপে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পিছু হটে ভারতীয় সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন কিন্তু ক্লান্তি বা হতাশার চিহ্ন নেই। অধিকতর উদ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা ছাত্র ও শ্রমিকদের রণকৌশল শেখাচ্ছেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ নিজের জন্য কিছু চাইলেন না। বললেন, ‘তরুণ গেরিলাদের কাপড়চোপড় ও খাদ্য দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করুন।’
সেখান থেকে ফিরে দেখা হলো কাজী জাফর ও মেননের সঙ্গে। মেননের ভাই সাদেক খান বললেন,
‘যুদ্ধ দেখতে হলে আগরতলা যান, সেখানে খালেদ, জিয়া, শফিউল্লার নাগাল পাবেন, দেখবেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ কীভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তরুণ গেরিলারা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা আক্রমণের জন্য।’
সাদেক খান খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম হয়েছিলেন। সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট কর্মী হয়ে অনিয়মের কারণে যক্ষ্মা আক্রান্ত হন এবং কয়েক বছর লেখাপড়া বন্ধ রাখেন। পরে কিছুদিন অভিনয়ে ও চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে ব্যবসায়ে অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন।
আমরা বোকার মতো সরল মনে কলকাতা পুলিশের কাছে আগরতলা ও আসাম যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। দুদিনের মধ্যে অনুমতি পেয়ে যাব আশ্বাস দিলেও চারদিনেও অনুমতিপত্র না পাওয়ায় বিষণ্ন হয়ে পড়ি। আমাদের দুঃখের কথা শুনে সাদেক ভাই বললেন,
‘বোকামি করেছ, পুলিশের কাছে কেন গিয়েছ, কখনো তোমরা অনুমতি পাবে না। নাম বদলিয়ে টিকিট কেটে সোজা আগরতলা চলে যাও। সেখানে খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎ পাবে’ ।
সাদেক খান এজেন্টের মাধ্যমে মি. জেড চৌধুরী ও মি. মবিন নামে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন।
সপ্তম দিনে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে কলকাতা থেকে আগরতলা। পূর্ব পাকিস্তানের মহকুমা শহরের চেয়েও ছোট। হোটেলের সন্ধানে শহরের প্রবেশপথে প্রথম দেখা হলো ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে। ছাত্রজীবনে আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম বলে মনির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই একটু শঙ্কিত হয়ে তাকাতেই মনি বললেন, ‘ডাক্তার, আমি জানতাম আপনি আসবেন, কমিউনিস্টরা লন্ডনে বসে থাকবে না।’ হাসিমুখে ভালো ব্যবহার করলেন। জিজ্ঞেস করলেন কলকাতায় কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
‘প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ফজলুল হক মনি হঠাৎ রেগে গেলেন। বললেন,
‘কোথাকার প্রধানমন্ত্রী? কে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন? প্রতারক তাজউদ্দীন, নিজে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কমিউনিস্ট।’
আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভাবলাম যুদ্ধের সময় যদি এরূপ বিভেদ থাকে, ভবিষ্যতে কী হবে? নিশ্চয়ই তাজউদ্দীন সাহেবের জীবনটা সুখের হবে না। স্বাধীনতা উত্তরকালে তা-ই প্রমাণিত হয়েছিল। ‘কৃতঘ্ন’ শব্দটা অন্য ভাষায় নেই। ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। যুদ্ধকালীন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনির সহায়তায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) সৃষ্টি করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমান্তরাল অন্য একটি বাহিনী হিসেবে।
দেখা হলো চট্টগ্রামের এমআর সিদ্দিকী সাহেবের সঙ্গে। তিনি ওই রাতে তাদের সঙ্গে আগরতলা সার্কিট হাউজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরের দিন ভোরেই রওনা হলাম দুই নম্বর সেক্টরের উদ্দেশে, মেলাঘরের পথে। সাক্ষাৎ হলো মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়া, শফিউল্লাহ, মীর শওকত আলী ও অন্যদের সঙ্গে। যুদ্ধে ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলার পর খালেদ বললেন,
‘আমার ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন অস্ত্র এবং বুলেট অ্যান্ড বুলেটস। আপনারা লন্ডন ফিরে গিয়ে আইআরএর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমাদের জন্য রাতে দেখা যায় এরূপ বাইনোকুলার, ছোট ডুবুরি যান মিডগেট এবং ছোট ছোট অস্ত্র জোগাড় করে পাঠান। চেকোশ্লোভাকিয়ায় অল্প মূল্যে স্বয়ংক্রিয় ছোট অস্ত্র পাওয়া যায়।’
কয়েক দিনের মধ্যে আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে গেলে মেজর খালেদ তার মত বদলাতে বাধ্য হন। দুই মাসের মধ্যে গড়ে ওঠে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর দেহরক্ষী হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে ৪৮০ বেডের ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। প্রবাসী সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন। বেশির ভাগ খরচ ও সব যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছিল লন্ডনস্থ বিডিএমএ। হাসপাতাল তৈরির মূল কৃতিত্ব ডা. মবিনের। এ হাসপাতালে ২২ অক্টোবর মাথায় গুলিবিদ্ধ মেজর খালেদ মোশাররফ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছিলেন, পরে স্থানান্তর হয়েছিলেন লক্ষ্ণৌতে, ভারতীয় সেন্ট্রাল কমান্ডের বড় মিলিটারি হাসপাতালে।
বিডিএমএ থেকে অন্য চার চিকিৎসক- ডা. কাজী কামরুজ্জমান, বরকত আলী চৌধুরী, আলতাফুর রহমান ও মাহফুজ অক্টোবরে ভারতে এসে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা দেন। বিজয়ের প্রাক্কালে বিলেত থেকে আসেন ডা. মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার, যার ঢাকায় শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল। ডা. বরকত চৌধুরী বর্তমানে অসুস্থ, আলজেইমার রোগে আক্রান্ত, ডা. কাজী কামরুজ্জমান বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ঢাকায় মগবাজারস্থ কমিউনিটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন। ডা. মাহফুজ একজন বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্ট হিসেবে বিলেতে অবসর জীবন যাপন করছেন। তিনি বাংলাদেশের এনআরবি ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক। ডা. আলতাফ লন্ডনে অবসর জীবন যাপন করছেন। মধ্যে মধ্যে বেড়াতে দেশে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর অজ্ঞাতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারতের সঙ্গে চুক্তি
ফরাসি কবি-সাহিত্যিক, রোমান্টিক রাজনীতিবিদ ও ফরাসি সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী আঁন্দ্রে মালরো স্প্যানিস সিভিল ওয়ারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ষাটের দশকে নাইজেরিয়ায় বিয়াফ্রার যুদ্ধে মালরো বিয়াফ্রার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেই যুদ্ধ হঠাৎ থেমে যাওয়ায় তার কাছে বহু অব্যবহৃত অস্ত্র ছিল।
মালরোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সেপ্টেম্বরে ওসমানী সাহেব আমাকে ফ্রান্সে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারতীয় পুলিশ আমার ডায়েরিটি এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষ দামি ক্যামেরাটা রেখে দেয়।
প্যারিসের উপকণ্ঠে আঁন্দ্রে মালরোর প্রাসাদসম বাড়ি। আমার সঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মালরোর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্য ওসমানী সাহেব একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন, যা ভারতীয় পুলিশ পরীক্ষার নিমিত্তে রেখে দিয়েছিল। বিষয়টি জেনে লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাস চক্রান্ত করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ফ্রান্স যাত্রায় বাধা সৃষ্টি করেছিল। আমি একলা আঁন্দ্রে মালরোর সঙ্গে দেখা করি। সাক্ষাৎ কাহিনী পরে কখনো লেখার চেষ্টা করব।
প্যারিস থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার পর পরই ওসমানী সাহেব আমাকে লক্ষ্ণৌতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত খালেদ মোশাররফকে দেখে আসতে অনুরোধ করেন। খালেদ মোশাররফ নিজে আমাকে দেখতে চেয়েছেন। খালেদ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের অত্যন্ত প্রিয়জন। কলকাতা থেকে সরাসরি লক্ষ্ণৌ ফ্লাইট না পাওয়ায় দিল্লি হয়ে লক্ষ্ণৌ যাত্রা করি। দিল্লিতে বিশিষ্ট বাঙালি ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তারা সাক্ষাতে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে, আপনারা ডিসেম্বরে ঢাকা ফিরতে পারবেন। প্রবাসী সরকারের সাথে ভারতের চুক্তি হয়েছে।’ আশ্চর্য হলাম, ওসমানী সাহেব আমাকে কিছুই বলেননি!
লক্ষ্ণৌ সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতালে খালেদ মোশাররফ আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলেন,
‘আমাকে লন্ডনে নিয়ে চলুন, ভারতীয়রা আমাদেরকে ভুটান সিকিম বানাবে। তারা আমাদের চাইনিজ অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় নিম্নমানের অস্ত্র দিচ্ছে, আমাদেরকে তাদের পদানত করে রাখার জন্য।’ আমি বললাম, ‘আপনার জন্য টিকিটের ব্যবস্থা তো আমিই করতে পারি কিন্তু ভারতীয়রা আপনাকে ভারত ছাড়ার অনুমতি দেবে তো? বিষয়টি আমি সর্বাধিনায়ককে জানাব।’
ফেরার পথে আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দিল্লি-কলকাতার একটা ফ্লাইট লক্ষ্ণৌ হয়ে যায়। প্লেনে ওঠার পর দেখি আমার পাশে আবদুস সামাদ আজাদ এমএনএ। তিনি দিল্লি থেকে উঠেছেন। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তিনি ন্যাপ-ভাসানী দল করতেন। বহুদিন জেলে ছিলেন। চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এলে তার পুলিশ গার্ডকে আমাদের ক্যান্টিনে বসিয়ে ভালো করে খাওয়াতাম এবং সামাদ ভাইকে গোপনে তার আগা মসিহ লেনের বাসায় পাঠিয়ে দিতাম। স্ত্রীর সঙ্গে সারা দিন কাটিয়ে বিকালে জেলে ফেরত যেতেন। তার চিকিৎসাপত্রে পুনরায় পরের সপ্তাহে চিকিৎসার জন্য আসার নির্দেশ লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করতাম। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, আমার দৌর্দণ্ড প্রতাপ, আমি সবার প্রিয়। সামাদ ভাই বললেন,
‘তুমি আমাকে দেখোনি। কাউকে বলবে না। এয়ারপোর্টে আমার গাড়ি থাকবে, সেটা নিয়ে তুমি চলে যেয়ো। আমার জন্য অন্য আরেকটি গাড়ি থাকবে। তুমি আমার কথা কাউকে বলো না’।
আমার অনুসন্ধিৎসা বাড়ল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিল্লিতে কী করলেন? কোনো চুক্তি হয়েছে কি?’ তিনি উত্তর দিলেন না। আমার মনে সন্দেহ দৃঢ় হলো। কলকাতা পৌঁছে সোজা থিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের রুমে। রেগে বললাম, ‘দেশ বেচে দিয়েছেন।’ তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি খালেদ মোশাররফ ও আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথা বললাম, আবদুস সামাদ আজাদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে। তাদের সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত তথ্য জানালাম। আরো জানালাম দিল্লির বিশিষ্টজনরা আমাকে কী বলেছেন। ওসমানী সাহেব সোজা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ঘরে ঢুকে উচ্চৈঃস্বরে বললেন,
‘You sold the country, I will not be a party to it.’
তাজউদ্দীন সাহেব কর্নেল ওসমানীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, নিচু স্বরে কী বললেন আমি শুনতে পেলাম না। আমি দরজার বাইরে ছিলাম।
কয়েকদিন পরে উভয়ের মধ্যে পুনরায় বাগিবতণ্ডা ভারতীয় একটি প্রস্তাবনা নিয়ে। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে আইন-শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি আইএএস ও আইপিএস বাংলাদেশের সব বড় শহরে একটা মেয়াদে অবস্থান নেবেন। ওসমানী সাহেব বললেন,
‘এটা হতে পারে না, আমাদের বহু বাঙালি সিএসপি, পিএসপি আছে। কেউ কেউ পাকিস্তানে আটকা পড়েছেন। এরা তো নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।’
ওসমানী সাহেবের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের মতপার্থক্যের কথা জেনে ভারতীয়রা আরো সতর্ক হলেন। ওসমানী সাহেবকে কড়া নজরে রাখলেন। কাগজে-কলমে যৌথ কমান্ডের কথা থাকলেও বস্তুত তারা ওসমানী সাহেবকে একাকী করে দিলেন। ভারতীয়রা সব কমান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলেন। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে ভারত কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হলো।
১৬ ডিসেম্বরের বিমান দুর্ঘটনা কী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীকে হত্যার ষড়যন্ত্র?
পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশী গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী অতর্কিতে সরাসরি যশোর সীমান্তে আক্রমণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। যৌথ কমান্ড বাহিনীর অন্যতম মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ককে যশোর পরিদর্শনে বাধা সৃষ্টি করা হলে জেনারেল (অব) ওসমানী ছাত্রনেতা কেএম ওবায়দুর রহমান ও আমাকে ’৭১-এর ৫ ডিসেম্বর যশোরের অবস্থা দেখে আসার জন্য নির্দেশ দেন। ওই দিনই আমরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছে হতভম্ব হয়ে যাই। ভারতীয় সেনারা একের পর এক অফিসারদের বাসস্থানের এসিসহ বিভিন্ন সামগ্রী, অস্ত্রাগার, এমনকি যশোর সিএমএইচের যন্ত্রপাতি লুট করছে। বলছে, ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট এত বৈভব ও আরাম-আয়েশে ছিল, কেন বিদ্রোহ করেছ? বিষয়টা ফোনে ওসমানী সাহেবকে জানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে ৭ ডিসেম্বর আমি কলকাতা ফিরে আসি। ওবায়দুর রহমান তার জেলা ফরিদপুরের পথে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রা করেন। কলকাতায় পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে আমি পুরো বিষয়টি ওসমানী সাহেবকে জানানোর পর তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে অবগত করেন। দুঃখের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বললেন,
‘তাহলে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তফাত কোথায়?’ ওসমানী সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছেন, ভারতীয়রা আমাকে কেন সরাসরি সমরাঙ্গনে যেতে দিচ্ছে না, তাদের উদ্দেশ্য ভালো না।’
কয়েকদিন অক্লান্ত চেষ্টার পর কুমিল্লা হয়ে সিলেট পরিদর্শনের জন্য একটি বড় হেলিকপ্টার সম্ভবত এম-৮ দেয়া হলো ব্রিগেডিয়ার গুপ্তের তত্ত্বাবধানে। ১৩ ডিসেম্বর বিকালে কুমিল্লা পৌঁছি। বিশ্রামের জন্য কুমিল্লা সার্কিট হাউজে পৌঁছে আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। ওসমানী সাহেবকে হাত বাড়িয়ে ‘রিসিভ’ করছেন কয়েকজন ভারতীয় বাঙালি। একে একে পরিচয় দিলেন, ‘আমি মুখার্জি, আইএএস, আমি গাঙ্গুলি আইপিএস ইত্যাদি।’ বললেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে গতকাল এখানে পৌঁছেছি কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। অবশ্য এখনো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধ চলছে।’ ওসমানী সাহেব ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে সার্কিট হাউজে রাত্রি যাপন করতে রাজি না হওয়ায় আমরা ওয়াপদা গেস্ট হাউজে যাই। পরের দিন ভোর থেকে ওসমানী সাহেব কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পরিদর্শনে বিভিন্ন পথে গেরিলাদের পাঠান এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর সেনাদের সম্মুখ আক্রমণে উত্সাহিত করতে থাকেন। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে যায়। পরের দিন তারা আত্মসমর্পণ করে। খবর পাই, ঢাকার পতন আসন্ন। আমরা ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি।
১৬ ডিসেম্বর সকালে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জানালেন, আজ ঢাকায় পাকিস্তান সেনারা আত্মসমর্পণ করবে। ভাবলাম, নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের কাছে। আশ্চর্য, ওসমানী সাহেব একবারে চুপ, কোনো কথা বলছেন না। বিষয়টায় খটকা লাগল।
জেনারেল ওসমানীর এডিসি, আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুরের বড় ছেলে শেখ কামাল আমাকে বলল, ‘স্যার কখন রওনা হবেন তা তো বলছেন না। জাফর ভাই, আপনি যান, জিজ্ঞেস করে সময় জেনে নিন। অধীর আগ্রহে আমরা সবাই অপেক্ষা করছি।’ আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করায় ওসমানী সাহেব বললেন,
‘I have not yet received PM’s order to move to Dhaka.’
অর্থাৎ ‘ঢাকার পথে রওনা হওয়ার জন্য কলকাতা থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের কোনো নির্দেশ পাইনি।’
আমি বললাম, ‘আপনাকে অর্ডার দেবে কে? আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।’ ওসমানী বললেন,
‘I decide tactics, my order is final for firing, but I receive orders from the cabinet through PM, Mr. Tajuddin Ahmed.’
‘যুদ্ধক্ষেত্রে আমি সর্বেসর্বা কিন্তু মূল আদেশ আসে মন্ত্রিসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের বরাতে।’ কথাগুলো বললেন অত্যন্ত বিষণ্ন মনে। পরিষ্কার হলো, তিনি আসন্ন ঢাকা পতনের সংবাদ জানেন এবং প্রবাসী সরকারের নির্দেশের অপেক্ষা করছেন।
আমাদের অস্থিরতা দ্রুত বাড়ছে আর বাড়ছে। শেখ কামাল বারবার আমাকে চাপ দিচ্ছে পুনরায় ভালো করে বুঝিয়ে বলে ওসমানী সাহেবকে রাজি করাতে, ঢাকা রওনা হওয়ার জন্য।
ঘণ্টাখানেক পরে পুনরায় ওসমানী সাহেবের সামনে দাঁড়ানোর পর পরই জেনারেল ওসমানী অত্যন্ত বেদনাতাড়িত কণ্ঠে যা বললেন, তার মমার্থ হলো, ‘আমার ঢাকার পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ নেই। আমাকে বলা হয়েছে পরে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে একযোগে ঢাকা যেতে, দিনক্ষণ তাজউদ্দীন সাহেব জানাবেন। গণতন্ত্রের আচরণে যুদ্ধের সেনাপতি প্রধানমন্ত্রীর অধীন, এটাই সঠিক বিধান।’ মনে হলো, তিনি জেনে-শুনে বিষপান করছেন। পরে ব্রিগেডিয়ার গুপ্তকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিলেটের কী অবস্থা?’ ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত জানালেন, ‘সিলেট ইজ ক্লিয়ার।’ ওসমানী বললেন, ‘তাহলে চলুন আমরা সিলেট যাই, সেখানে গিয়ে আমার পিতামাতার কবর জিয়ারত করব, শাহজালালের পুণ্য মাজারে আমার পূর্বপুরুষরা আছেন।’ ওসমানী সাহেব শেখ কামালকে ডেকে সবাইকে তৈরি হতে বললেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা আকাশে, নিরুপদ্রব যাত্রা। ভারতীয় এম-৮ বিমানে সিলেটের পথে চলেছি। পরিষ্কার আকাশ। প্লেনের যাত্রী জেনারেল ওসমানী ও তার এডিসি শেখ কামাল, মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল এমএ রব এমএনএ, রিপোর্টার আল্লামা, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত, ভারতীয় দুই পাইলট এবং আমি। কেউ কথা বলছে না, সবাই নীরব।
অতর্কিতে একটি প্লেন এসে চক্কর দিয়ে চলে গেল। হঠাৎ গোলা বিস্ফোরণের আওয়াজ, ভেতরে জেনারেল রবের আর্তনাদ, পাইলট চিত্কার করে বলল, ‘উই হ্যাভ বিন অ্যাটাকড।’ রবের ঊরুতে আঘাতের পর পরই তার কার্ডিয়াক এরেস্ট হলো। আমি এক্সটার্নাল কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিতে শুরু করি। পাইলট চিত্কার করল, ‘অয়েল ট্যাংক হিট হয়েছে, তেল বেরিয়ে যাচ্ছে, আমি বড়জোর ১০ মিনিট উড়তে পারব’ বলে গুনতে শুরু করল ওয়ান, টু, থ্রি…টেন…টুয়েন্টি…থার্টি…ফোরটি…ফিফটি…নাইন সিক্সটি-ওয়ান মিনিট গান (Gone), এভাবে মিনিট গুনছে, উদ্বিগ্ন চিন্তিত পাইলট। ধীরস্থিরভাবে পাইলটের আসনে বসা অন্য পাইলট। ওসমানী সাহেব লাফ দিয়ে উঠে অয়েল ট্যাংকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিত্কার করলেন, ‘জাফরুল্লাহ্, গিভ মি ইয়োর জ্যাকেট।’ আমি আমার দামি জ্যাকেটটা ছুড়ে দিলে ওসমানী সাহেব ওটা দিয়ে তৈলাধারের ছিদ্র বন্ধের চেষ্টা করতে থাকলেন। বললেন,
Do not worry my boys, I know Sylhet like the palm of my hands.’
‘ভয় পেয়ো না আমি সিলেটকে আমার হাতের তালুর মত চিনি।’
কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি ভাবছিলাম, আজ ১৬ ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু আজ আমরা সবাই কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাব। আগামীকাল পত্রিকায় শোক সংবাদ কলামে কী লেখা হবে? বীরের মৃত্যু, অপঘাতে মৃত্যু? কার গোলায় এ দুর্ঘটনা? পাকিস্তানের সব বিমান তো কয়েক দিন আগে ধ্বংস হয়েছে কিংবা গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। তাহলে আক্রমণকারী বিমানটি কাদের? গোলা ছুড়ে কোথায় গেল? গুয়াহাটির পথে? চিন্তা বিঘ্নিত হলো ওসমানী সাহেবের চিত্কারে। নিচে একটা জায়গার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘Land here.’ ‘এখানে নামো।’ আরো বললেন, ‘Let me land first to taste the enemy attack if there is one.’ ‘শত্রুর গুলির স্বাদ নেয়ার জন্য আমাকে প্রথম নামতে দাও, যদি কোনো শত্রু এখনো থেকে থাকে।’ তিনি লাফ দিয়ে নামলেন, ধরুন বলে আমি জেনারেল রবকে ছুড়ে দিলাম, সঙ্গে নামলাম আমি। আমার পেছনে পেছনে অন্যরা লাফিয়ে নামলেন। প্লেনটা আমাদের চোখের সামনে দাউ দাউ আগুনে পুড়ছে।
হঠাৎ গ্রামবাসী এসে ওসমানী সাহেবকে ঘিরে ধরল— ‘দুষমন আইছে রে বা দুষমন আইছে, দুষমনরে ধর।’ পর পরই ভালো করে তাকিয়ে দেখে হঠাৎ চিত্কার করে উঠল— ‘আমাদের, কর্নেল সাব রে বা’ এবং তারপর তাকে নিয়ে নাচতে শুরু করল।
জনতার বিজয় উল্লাসে যেন জেনারেল রবের ঘুম ভাঙল, তিনি চোখ খুলে তাকালেন, দেখলেন আমার মুখে হাসি। জেনারেল রব সবাইকে বলতেন, ডা. জাফরুল্লাহ্ আমাকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন। প্লেনে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত ও শেখ কামালও সামান্য আহত হয়েছিলেন।
ফাঁসির মঞ্চ থেকে শেখ মুজিবুরের দেশে প্রত্যাবর্তন
২৬ মার্চ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা থেকে লন্ডন পৌঁছলেন। ঢাকার ধ্বংসযজ্ঞের আরো বিস্তারিত সংবাদ দেখলেন পরের দিন বিবিসি ও লন্ডন টাইমস পত্রিকায়।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬২ সালে। তখন তিনি পাকিস্তান হাইকোর্টের নবীন বিচারপতি। আমার ভাইয়ের শ্বশুর বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী তখন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। দেশে আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন চলছে। এরই মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন হচ্ছে। আইয়ুব খান, মোনেম খানের কোনো মন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা যাবে না। প্রধান বিচারপতিকে প্রধান অতিথি করার সিদ্ধান্ত হয়। আমি আপত্তি তুলি, কারণ বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী অত্যন্ত রক্ষণশীল, প্রাচীনপন্থী; প্রায় সামরিক সরকার ঘেঁষা। তাই তার পরিবর্তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জুনিয়র, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার, টাঙ্গাইলের আব্দুল হামিদ চৌধুরীর সন্তান, বর্তমানে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি ব্যারিস্টার আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে একটি সুন্দর জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন, যা খুব প্রশংসিত হয়েছিল।
২৮ মার্চ আমি লন্ডনের বালহাম এলাকায় গিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করি। সামান্য পরিচয় দিতে তিনি আমাকে চিনলেন, বললেন তিনি সত্বর ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন। তার ছাত্রদের মারা হচ্ছে, তার বিহিত করতে হবে। আমি বললাম, ‘সর্বনাশ, এত বড় ভুল করবেন না। ঢাকায় প্রতিবাদ করতে গেলে আপনার জীবননাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বরং আপনি লন্ডনে থেকে বাংলাদেশের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলুন। ব্রিটেনে আপনার উপস্থিতির একান্ত প্রয়োজন রয়েছে। প্রবাসী বাঙালিদের আপনি নেতৃত্ব দিন। প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উপদলে বিভক্ত। প্রগতিশীল বাম সংগঠনগুলো বিভিন্ন মতবাদে বিচ্ছিন্ন। আপনি হবেন সম্মিলিত প্রবাসী বাঙালিদের নেতা।’ তিনি হেসে বললেন, ‘গত দুদিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এসেছিলেন এবং তাদের সাথে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছেন। আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছেন।’ বিচারপতি চৌধুরী ওই দিনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে ইস্তফা দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বার্থে সব প্রবাসী বাঙালিকে একত্রিত করার মূল দায়িত্ব পালন শুরু করেন সক্রিয়ভাবে। শুরু হলো তার জীবনের সাধনা বাংলাদেশের স্বপক্ষে ব্রিটেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় জনমত সৃষ্টি এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানোর প্রাণপণ সাধনা।
চার মাস— এপ্রিল থেকে জুলাই বিচারপতি চৌধুরী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চরকির মতো ঘুরলেন এক শহর থেকে অন্য শহরে। দেখা করলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, ডিন ও বিচারপতিদের সঙ্গে। কয়েকবার হাজির হলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, সাক্ষাত্ করলেন মন্ত্রী ও ছায়ামন্ত্রীদের সঙ্গে, দীর্ঘ আলোচনা করলেন রক্ষণশীল দলের নেতা স্যার জেরাল্ড নবারো ও রেভারেন্ড ইয়ান পেইসলি এবং বামপন্থীদের কণ্ঠস্বর ইয়ান মির্কাডো ও এন্ডু্র ফাউলসের সঙ্গে।
আবু সাঈদ চৌধুরী একাধারে বিচারপতি, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিধায় গণ্যমান্য সবার সঙ্গে সাক্ষাত্ করা তার জন্য সহজ হয়েছিল। ২৪ এপ্রিল তার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতায় বিলেতের কভেন্ট্রি শহরে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি’ এবং স্থির হয় পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি। আজিজুল হক ভুঁইয়া মনোনীত হলেন আহ্বায়ক। উক্ত সভার সভানেত্রী ছিলেন শিক্ষিকা লুলুু বিলকিস বানু।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও সোসিয়ালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ সম্পাদক মার্টিন এনালস ও হ্যানস ইয়ান্টসেককে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চেষ্টা করতে রাজি করালেন। আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শে ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউজ, ব্রুচ ডগ- লাসম্যান ও পিটার শোর সব ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্রর নিষ্ঠুরতার বিষয় আলোচনার জন্য ১৪ মে পার্লামেন্টের আলোচ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হন। আলোচনার আগের দিন ‘নীরব বিবেক’ নামে দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকা এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
উল্লেখ্য, মার্চে ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ বিবৃতিকালে বিলেতের অবজারভার পত্রিকা বাঙালি চরিত্রের বর্ণনা দেয় যে, দুই বাঙালি দুজনে আলাদা দুই দল গঠন করে আবার দুজন মিলে তৃতীয় দল তৈরি করে। বাঙালিরা শান্তিপ্রিয় কিন্তু ভীতু লোক। তারা এবার ক্ষেপেছে, রুখে দাঁড়াবে, হয়তোবা অচিরে পৃথিবীতে একটি নতুন দেশ হবে।
ব্রিটেনের ছায়া সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেনিস হিলি পার্লামেন্টে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য বিশেষ জোর দেন এবং বলেন, ‘শেখ মুজিবই সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি।’ প্রবাসী সরকারের পরামর্শে ২৪ মে বিচারপতি চৌধুরী গ্লাসগো থেকে নিউইয়র্ক গেলেন। শুরু করলেন একে একে অনেক সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে সাক্ষাত্। যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝালেন তাদেরকে বাংলাদেশের পক্ষে থাকার জন্য, শেখ মুজিব তো তাদের মতাদর্শের ও পুঁজিবাদের প্রবক্তা। উপমহাদেশে শান্তির জন্য শেখ মুজিবের অনতিবিলম্বে মুক্তি অত্যাবশ্যক।
বিচারপতি চৌধুরীর প্রচেষ্টায় জুনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চারজন নামি সদস্য— কনজারভেটিভ দলের জেমস রেমসটেন ও টবি জোসেফ এবং শ্রমিকদলের আর্থার বটমলি ও রেজিনান্ড প্রেনটিস বাংলাদেশ ও ভারত সফর করে যে তথ্য প্রকাশ করেন, তাতে বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত হয়।
২৬ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানচিত্র ও শেখ মুজিবের ছবিযুক্ত দুটি ডাকটিকিট উন্মোচন হয়। ১ আগস্ট ট্রাফলগার স্কয়ারের জনসভায় লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১০ আগস্ট পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য ফাঁসি চেয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করে। চিন্তিত বিচারপতি চৌধুরী বিভিন্ন সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রের সহায়তায় জাতিসংঘে শেখ মুজিবের বিচার বন্ধের দাবি উপস্থাপন করলেন এবং পুরো সেপ্টেম্বর পরিভ্রমণ করলেন একে একে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো— নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। দেখা করলেন সব দেশের প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল শেখ মুজিবের মুক্তির লক্ষ্যে সুইডেনস্থ বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। অসলো বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের গণহত্যাসংক্রান্ত কমিশন গঠনে উত্সাহিত হলো।
বাংলাদেশকে সমর্থন ও স্বীকৃতিদানের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যৌথভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম চিঠি লেখেন ভারতের দৃষ্টি এড়িয়ে, যা ২৬ মে বার্লিন থেকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানো হয়।
২৮ সেপ্টেম্বর খোন্দকার মোশতাক কলকাতাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে বৈঠক করেন। শেখ মুজিবের মুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেয়ে কম মূল্যবান নয় বিবেচনায়। এ আলোচনায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্মতি ছিল। শোনা যায়, আওয়ামী লীগের জহিরুল কাইয়ুমসহ অন্য ৪৩ জন জাতীয় সংসদ সদস্য আলোচনা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।
খন্দকার মোশতাক মার্কিন দূতাবাসকে বুঝিয়েছিলেন যে, শেখ মুজিববিহীন বাংলাদেশ হবে পরোপুরি কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত ভারতের করদ রাজ্য। অক্টোবরে ভারত প্রবাসী সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন আলোচনার সংবাদ পেয়ে যাওয়ায় ইন্দিরা গান্ধীর পররাষ্ট্রবিষয়ক পরামর্শদাতা ডিপি ধর কলকাতায় এসে ‘মোশতাককে বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দেন এবং প্রবাসী সরকারকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদলাতে বাধ্য করেন। আবদুস সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রকৌশলী এফআর খান ও অন্যদের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে প্রভাবিত করেন শেখ মুজিবের বিচার স্থগিতের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা থেকে রেহাই দিয়ে ফাঁসির দণ্ড থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করে। মার্কিন প্রশাসন বিশ্বাস করে যে, কেবল শেখ মুজিবই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে কমিউনিস্ট ও ভারতের কবল থেকে মুক্ত রাখতে পারবেন। নভেম্বরে পাকিস্তান হঠাত্ শেখ মুজিবের বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করে।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান কনফেডারেশন গঠনের প্রত্যাশায়।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি রাত ৩টায় পাকিস্তান এয়ারলাইনসের বিমানে ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনের পথে যাত্রা করেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে তাকে বিদায় জানান এবং ফোনে সংবাদটা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে জানিয়ে দেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে, ভারতীয় বিমানের পরিবর্তে ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের প্লেনে বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন নয়াদিল্লি হয়ে। তারিখটি ছিল সোমবার, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের পদাবনতি ঘটে। তিনি অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হন। পাকিস্তানকে সহায়তা করার অপরাধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বরখাস্ত আইয়ুব খানের প্রিয় পাত্র এসএমএস সফদর পিএসপি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পূর্বপদে যোগ দেন একই দিনে, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।
====================================================
লেখক পরিচিতি:
মোঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চিকিৎসক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামক স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা।