আরবী কোরানের অনারবীয় উৎস:
আগের পর্বে হাদিসগুলির অন্তঃসারশূন্যতা আমরা দেখেছি। এই পর্বে হাদিস সংকলেনর ইতিবৃত্ত আলোচনা করার কথা ছিল। বিশেষ কারণবশত দুই পর্বের জন্য হাদিস আলোচনা স্থগিত রাখলাম। তার বদলে আমরা এই পর্বে কোরান নিয়ে আলোচনা করব। মুসলিমদের কাছে কোরান আল্লার বাণী, আল্লা নিজেই বলেছেন এই সেই গ্রন্থ যাতে কোন ভূল নাই। অতএব কোন ধার্মিক মুসলিমের পক্ষে কোরানের কোন ভূল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবটা হল কোরানের ভাব ও ভাষা দুটোই এমন মাত্রায় এলোমেলো আর দুর্বোধ্য যে তাফসিরের সাহায্য ছাড়া সরাসরি আরবী কোরান পড়ে এর অর্থ বোঝা অসম্ভব। কোরানে আরবী ব্যাকরণের আদ্যোশ্রাদ্ধ করা হয়েছে। কোরানে আরবী ব্যকরণের সাধারণ নিয়মাবলী ও বাক্যগঠনগত দিক থেকে শত শত ভূল পাওয়া যায়(১)। ব্যাকরণগত ভূলগুলি এখানে আলোচনা করা সম্ভব হল না। আলী দস্তি রচিত ‘বিশত ও সেহ সাল’ (ইংরাজীতে 23 Years) গ্রন্থের সংশ্লিষ্ট অংশে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদের মধ্যে গোড়ামি ও অত্যুক্তি চেপে বসার আগে বহু ধর্মীয় দার্শনিক যেমন মুতাজিলা দার্শনিক ইব্রাহিম আন-নাজ্জাম (৭৭৫-৮৪৫) খোলাখুলি স্বীকার করেছেন কোরানের বিন্যাস ও বাক্যগঠন অলৌকিক কিছু নয় এবং অন্য কোনো খোদাভীরু মানুষের পক্ষে একই ধরনের কাজ এর থেকেও বেশী সাহিত্যমানসম্পন্ন কাজ করা সম্ভব।
আলী দস্তির মতে-
“কোরানের বাক্যসমূহ অসম্পূর্ণ এবং সম্পূর্ণভাবে বোধগম্য হবার ক্ষেত্রে এগুলির ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। এতে অনেক বিদেশি শব্দ, অপ্রচলিত আরবি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেক শব্দ রয়েছে যেগুলোকে স্বীয় সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। লিঙ্গ এবং সংখ্যার অন্বয়সাধন না করে বিশেষণ এবং ক্রিয়াপদের ধাতুরূপ করা হয়েছে। অনেক সময় সংশ্লিষ্টতা নেই এমন অপ্রয়োজনীয় ও ব্যাকরণগতভাবে ভুল সর্বনাম পদ ব্যবহার করা হয়েছে এবং ছন্দবদ্ধ অনুচ্ছেদসমূহে এমন অনেক বিধেয় পদ ব্যবহার করা হয়েছে যার সাথে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে আলোচ্য মূল বিষয়ের সাথে এগুলোর কোনো মিল নেই। ফলে ভাষাগত এমন অনেক অগ্রহণযোগ্য বিষয়াদি কোরানের সমালোচকদের (যারা কোরানের বোধগম্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন) সমালোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সমস্যাগুলো নিষ্ঠাবান মুসলমানদের মনেও যথেষ্ট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে কোরানের তফসিরকারকরা কোরানের বক্তব্যের ব্যাখ্যা খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। কোরান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মতভিন্নতার পিছনে যেসব কারণ রয়েছে, এ বিষয়টি তাদের মধ্যে অন্যতম।“
……. বলা বাহুল্য, কোরানের তফসিরকারকদের এই অসংলগ্নতাগুলোকে ব্যাখ্যা এবং সমর্থনীয় করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তাঁদেরই একজন হচ্ছেন পারস্যের বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত ও ভাষাবিদ এবং জার-আল্লাহ (আল্লাহর প্রতিবেশি) খেতাবে ভূষিত আলজামাখশারি, পুরো নাম আবু আল-কাশিম মাহমুদ ইবনে উমর আল-জামাখশারি (জন্ম হিজরি ৪৬৭ বা ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দ-মৃত্যু হিজরি ৫৩৮ বা ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দ) যার সম্পর্কে একজন মুরীয় (উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার আরব মুসলমান) লেখক বলেছেন, ‘ব্যাকরণঅনুরাগী এই তাত্ত্বিক একটি গুরুতর ভুল করেছেন। আরবি ব্যাকরণের সাথে মিল রেখে কোরান পড়ানো আমাদের দায়িত্ব নয়। বরং আমাদের উচিত সম্পূর্ণ কোরান যেভাবে আছে সেভাবে একে গ্রহণ করা এবং আরবি ব্যাকরণকে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা” (আলী দস্তি, নবী মুহম্মদের ২৩ বছর)
মুসলিম স্কলারদের এইরকম চরম অবস্থানের ফলে আমাদের অমুসলিম স্কলারদেরই অনুসরণ করতে হবে যারা প্রকৃতই নির্মোহভাবে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। দেখা যায় কোরান বারবার বলেছে যে তা আরবী ভাষায় লিখিত- দ্রষ্টব্য ১৬:১০৩,১৩:৩৭,২৬:১৯২-৯৫,১২:১,৪৩:৩। সুরা শুয়ারার ১৯৫ নং আয়াত অনুসারে কোরান সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে। কোরানের ভাষা কি রকম স্পষ্ট তা এমনকি যে কোরানের মূলানুগ অনুবাদও পড়ার চেষ্টা করেছে সেই জানে! গবেষকরা জানাচ্ছেন কোরানের প্রতি পাঁচটার বাক্যের অন্তত একটির কোনই অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না (ভাষাবিদ গার্দ-র পুইনের মত, অধিকাংশ অমুসলিম স্কলার সমর্থন করেছেন)। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন পরিস্কার আরবী ভাষায় লিখিত আল্লার বাণী কোরানের অন্তত পাঁচভাগের একভাগ সম্পূর্ণ অর্থহীন। অত্যন্ত যৌক্তিক যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হল কোরানের এই বিশাল ভাষাগত অসংলগ্নতার কারণ কি? ঠিক এইখান থেকেই আমরা আমাদের অনুসন্ধান শুরু করব। কারণ এইখানেই ইসলামী ইতিহাসের প্রবল তাৎপর্যপূর্ণ অথচ প্রায় অনোলোচিত বিষয় লুকিয়ে আছে।
কোরান কেন তা আরবী ভাষায় লিখিত বলে বারবার দাবী করছে। সুরা নাহলের ১০৩ নং আয়াতে দেখা যায়- “আমি তো ভালভাবেই জানি যে, তারা বলেঃ তাকে জনৈক ব্যক্তি শিক্ষা দেয়। যার দিকে তারা ইঙ্গিত করে, তার ভাষা তো আরবী নয় এবং এ কোরআন পরিষ্কার আরবী ভাষায়”। কুরাইশরা নাকি কোরানের পার্থিব উৎসের দিকে ঈঙ্গিত করাতে এই আয়াত নাজিল হয়েছিল। সিরাত লেখক ইবনে ইশাক এই আয়াতে উল্লিখিত অনারব ব্যক্তির পরিচয় দিয়েছেন – তিনি হলেন খৃষ্টান ধর্মালম্বী জাবর, বানু আল-হাঁদরামির ক্রীতদাস যার থেকে মুহম্মদ শিক্ষা নিতেন বলে কথিত রয়েছে। আমি অল্প কয়েকটা আয়াত উপরে উল্লেখ করেছি প্রকৃতপক্ষে অজস্র আয়াতে একই ধরণের বক্তব্য পাওয়া যাবে। এখন মূল ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়তে গিয়ে কি কোন ব্যক্তির সন্দেহ জাগে যে এটি হিব্রু ভাষায় রচিত নয়। গীতা পড়তে গিয়ে কারো কি মনে হয় যে তিনি যেটা পড়ছেন সেটা ধ্রুপদী সংস্কৃত নয়। তাহলে কোরান সম্পূর্ণ অপ্রাসাঙ্গিক বিষয় বারবার কেন উল্লেখ করছে? বারংবার অপ্রাসঙ্গিকভাবে আরবীর উল্লেখ কি কিছু ঈঙ্গিত করছে? তবে কি কোরান আসলে আরবী ভাষায় লিখিত ছিল না?
যদি কোন আলেমের কাছে যান তিনি বলবেন কোরানের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ হল আলীফ-লাম-মীম; চোদ্দোশ বছরেও এর অর্থ বোঝা যায় নাই- এর অর্থ শুধু আল্লাহই জানেন। আমাদের আল্লার মোনোপলিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না। অতএব চলেন আলীফ-লাম-মীম ছেড়ে আমরা অন্য কয়েকটি কোরাণিক শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করি। কোরানে বিস্তর শব্দ আছে যেগুলো আরবী ভাষার শব্দ তো নয়ই জানা কোন ভাষারই শব্দ নয়। কোরানের তাফসিরকারক ও অনুবাদকরা এইসব শব্দের একেকরকম অর্থ করেছেন। সাধারণভাবে মুসলিম স্কলাররা এইসমস্ত বিষয়ে একমত হলেও তাদের ঐক্যমত্য কোন ভাষাতাত্বিক বিবেচনা থেকে নয় বরং তারা শুধুমাত্র একেকজন স্কলার তাদের পূর্বসূরীকে অনুসরণ করেছেন। এর অর্থ হল তারা কোন একটি প্রথার অনুসরণ করেছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা একেবারেই একমত হতে পারেন নি। কোরানের ১০৮ নং সুরার নাম হল আল-কাওসার। এই সুরার প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে “নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি”। কিন্তু কাওসার বস্তুটি কি?এই সুরার বাইরে সম্পূর্ণ অপরিচিত। সাধারণভাবে কোরান অনুবাদকরা এর অর্থ করেছেন প্রাচুর্য বা আধিক্য। জনপ্রিয় তাফসির তাফসির আল-জালালাইন ব্যাখ্যা করেছে – কাওসার হল জান্নাতের উদ্যানে অবস্থিত একটি নদী যার মাধ্যমে সেখানকার অধিবাসীদের জল দেওয়া হয়। এর অর্থ অসীম মঙ্গল নবুয়ুৎ, কোরান, ইবাদত ও অনান্য বস্তুর আকারে(২)। অনান্য কোরাণিক স্কলাররা আদৌও নিশ্চত নন। কোরান বিশেষজ্ঞ আল-কুরতুবী (১২৭৩ খৃষ্টাব্দ) কাওসার শব্দের ১৭টি অর্থ দিয়েছেন আরেক বিশেষজ্ঞ কুরতুবীর সমসাময়ীক ইবন আন-নাকিব (১২৯৮খৃষ্টাব্দ) দিয়েছেন ২৬ টি। বোঝাই যায় তাদের শব্দটির অর্থ জানা ছিল না। তারা প্রকৃতপক্ষে সর্বোচ্চ সংখ্যক আন্দাজ করছিলেন।
এইরকম আরেকটি শব্দ হচ্ছে ‘কালালা’ (৪:১২)। ঐতিহাসিক ও কোরান বিশেষজ্ঞ মু্হম্মদ ইবনে জারির আট-তাবারী (৮৩৯-৯২৩) তিনটি পৃথক সনদ অনুসরণ করে শব্দটির তিনটি পৃথক অর্থ ধায্য করেছেন। সুরাটি থেকে আদপেই এর অর্থ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। আরেকটি শব্দ হল সিজ্জিন (৮৩:৭-৯) । যেটি আরবী শব্দ নয় এবং অন্য কোন ভাষারও শব্দ নয়। তাফসিরকারকরা জানাচ্ছেন সিজ্জিন হল এমন একটি জায়গা যেখানে পাপীদের আমলনামা রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সিজ্জিনের অর্থ শুধু পাপীদের আমননামা। পূর্বেই বলা হয়েছে এই ধরণের অনুমানের পেছনে যেসব ভাষাতাত্বিক বিবেচনা দেখানো হয় সেগুলো যে দুর্বল শুধু তাই নয় একেবারে যদৃচ্ছ। একই ধরণের শব্দ সিজিল (sijill) পাওয়া যায় সুরা আম্বিয়ার ১০৪ নং আয়াতে- “সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব সিজ্জিলের মতো” আরবেরীর মতো কোরান অনুবাদকরা সিজিলের অনুবাদ করেছেন স্ক্রল বা গুটানো দলিল। কিন্তু সিজ্জিল একটি নামবাচক বিশেষ্যও হতে পারে। আর্থার জেফারী তার বই ‘The Foreign Vocabulary of Qur’an’ এ দেখিয়েছেন কোরানের আদি ব্যাখ্যাকারদের এই শব্দটির অর্থ পুরোপুরি অজানা ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর জনপ্রিয় তাফসিরকারক ইবনে কাসীর তার প্রবর্তিত তাফসিরে লিখেছেন- “সিজিল বলতে যা বোঝায় তা হল কিতাব। আস-সুদ্দী এই আয়াতের বিষয়ে বলেছেন- আস-সিজিল একজন ফিরিস্তা যার উপর দলীল রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে; যখন কোন ব্যক্তি মারা যায় তার আমলনামা আস-সিজিলের কাছে চলে যায়”। জেফারীর মতে সিজিল কোন আরবী শব্দই নয়। এই শব্দটি এসেছে গ্রীক ‘sigillion’ থেকে যার অর্থ রাজকীয় ফরমান। বিতর্ক রয়েছে সুরা আল ইখলাসের ২ নং আয়াত – ‘আল্লা-হুসসামাদ’(Allahu as-samad) নিয়েও। আবদুল্লা ইউসুফ আলী আয়াতটির অনুবাদ করেছেন Allah, the eternally Besought of all। আরবেরী অনুবাদ করেছেন God, the everlasting Refuge। কিন্তু তাদের কেউই নিশ্চিত ছিলেন না যে as-samad বলতে কি বোঝায়। তাবারি এই শব্দটির অনেকগুলি অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। সবকিছু ক্ষতিয়ে দেখে ঐতিহাসিক ফ্রানজ রোসেনথাল সিদ্ধান্ত করেন যে as-samad প্রকৃতপক্ষে ছিল উত্তর-পশ্চিম সেমিটিক ধর্মীয় পরিভাষা। মনে হয় মুহম্মদ বা যিনি কোরান সংকলন করেছিলেন তিনিও এর অর্থ জানতেন না(3)।
ওল্ড টেস্টামেন্টের সাথে যদি মিলিয়ে দেখেন আপনার চোখে পড়বে প্রায় সমস্ত পৌরাণিক কাহিনী এক থাকলেও চরিত্রগুলির নাম অনেকাংশে পালটে গেছে। ফ্যারাও হয়ে গেছে ফেরাউন, মোজেস হয়ে গেছে মুসা, বাইবেলের নোয়া হয়ে গেছে নুহ, আব্রাহাম হয়ে গেছে ইব্রাহিম, জেসাস অর্থ্যাৎ যীশু হয়ে গেছেন ইশা (যদিও এই বিষয়টি বাকিগুলোর থেকে আলাদা), রাজা ডেভিড হয়ে গেছে দাউদ, যীশুর মা মেরী হয়ে গেছেন মরিয়ম। কারণটা আর কিছুই নয় কোরানে এই নামগুলি সরাসরি হিব্রু থেকে নেওয়া হয়নি, বরং সিরিয়াক থেকে নেওয়া হয়েছে। কোরানে সিরিয়াক ভাষার প্রভাব এখানেই শেষ নয়; পাঠকরা শুনে চমকে উঠবেন বহুল প্রচলিত প্রায় সমস্ত ধর্মীয় পরিভাষা যেমন ১. আয়াত ২. কাফির ৩. সালাত ৪. নাফস ৫. জন্নৎ ৬. তাঘুত ৭. মসিহ প্রকৃতপক্ষে সিরিয়াক উৎস থেকে আগত। খৃষ্টান বোঝাতে কোরানে নাসারা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটি সিরিয়াক ভাষা থেকে আগত কারণ সিরিয়াক ছাড়া আর কোন ভাষা নেই যেখানে এর কাছাকাছি কোন প্রতিশব্দ আছে। (রোমান সাম্রাজ্যে এমনকি আংশিকভাবে পারসীক সাম্রাজ্যেও অখৃষ্টানরা খৃষ্টানদের nasraye নামে ডাকত। সেখান থেকেই সিরিয়াক ভাষায় পদটি এসে থাকবে।
শুধুমাত্র ধর্মীয় শব্দই নয় কোরান সাংস্কৃতিক ও আইনগত শব্দও সিরিয়াক থেকে ধার করেছে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হল জিজিয়া(4)।কোরানে সিরিয়াক প্রভাব শুধু শব্দ ধার নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সেমিটিক ভাষার প্রবাদপ্রতিম গবেষক আলফোনসে মিঙ্গানা (১৮৭৮-১৯৩৭) কোরানের বাক্যগঠনের উপর সিরিয় ব্যাকরণের প্রভাব তুলে ধরেছেন। মিঙ্গানা দেখিয়েছেন যে সুরা বাকারার ৮৫ নং আয়াতের অংশ যার সাধারণভাবে অনুবাদ হয়ে থাকে – “তোমারাই তো সেই লোক যারা পরস্পর খুনোখুনি করছ” আরবী ভাষায় যথেষ্ট অদ্ভুত বাক্যগঠন। কারণ সাপেক্ষ সর্বনাম ছাড়াই নির্দেশক সর্বনামের ব্যাবহার আবরীর বৈশিষ্ট নয় বরং সিরিয়াক ভাষার বৈশিষ্ট। এই ধরণের গঠন কোরানে বেশ কিছু পাওয়া যায় যেগুলী সিরিয় ব্যাকরনের আলোকেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। এরকম আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় – “তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যদি কেউ হাতছাড়া হয়ে কাফেরদের কাছে থেকে যায়” (৬০:১১)। এখানে স্ত্রী অর্থে ‘শাই’ (Shai) শাই শব্দটি রয়েছে যা আদৌ মানুষ বোঝাতে ব্যাবহৃার করা হয় না। এইরকম সাংঘাতিক অসংলগ্নতার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাফসিরকারক ও অনুবাদকরা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন।
সিরিয়াক প্রকৃতপক্ষে আরামায়িক ভাষার একটি উপভাষা। একে সিরিয়-আরামায়িক নামেও উল্লেখ করা হয়। ইসলামের উত্থানের যুগে সিরিয়াকের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যিনিই কোরান সংকলন করে থাকুন না কেন দেখে মনে হয় আরবী ভাষার থেকে তার সিরিয়াক ভাষাতেই দখল বেশী ছিল। তবে কি কোরান প্রাথমিকভাবে ছিল সিরিয়াক গ্রন্থ যেটা পরবর্তীকালে খৃষ্টধর্ম থেকে আলাদা (পঞ্চম পর্ব দ্রষ্টব্য) পৃথক ধর্ম হিসাবে ইসলামকে ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজনে আরবীতে অনুবাদ করা হয় এবং মৌলিক আরবী গ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়? সেক্ষেত্রে অবশ্য কোরানের ভাষাগত অসংলগ্নতার দায় অনায়াসে অযথার্থ অনুবাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। পরের পর্বে আমরা দেখব শুধুমাত্র ভাষাতাত্বিক বিবেচনাই যথেষ্ট নয় অসংলগ্নতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য, আরো কিছু উপাদান পাশাপাশি কাজ করেছে। এই অনুমান মেনে নিলে কোরানের বারংবার আরবী গ্রন্থ হিসাবে দাবীরও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। প্রবাদে আছে না- অতিভক্তি…..
1. Ali Dasti; “23 Years”
2. Al-Mahali and as-Suyuti, Tafsir al-Jalalayn
3. কোন শব্দের এতগুলী অর্থ থাকতেই পারে না। কোন শব্দের পরস্পর থেকে পৃথকযোগ্য চার-পাঁচটির বেশী অর্থ থাকলেই তার ব্যবহার সেই ভাষায় যথেষ্ট ambiguity বা দ্বার্থকতার সৃষ্টি করবে। ফলে দ্বার্থকতার নিরসন করার জন্য শেষ পর্যন্ত্য শব্দটির ব্যবহার কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে সীমিত হয়ে যাবে। অর্থ্যাৎ শব্দটি আর এতগুলী অর্থে ব্যাবহার হবে না।
4. Alphonse Mingana “Syriac Influence on the Style of the Koran” in Ibn Warraq “What the Koran Really Says”