০
৮৭২ বার পঠিত
আশ্বিনের শেষাশেষি সময় এখন, মহালয়া পেরিয়ে গেলো। ভারতবর্ষের বহুস্থানেই চলছে নবরাত্রি উৎসবের আয়োজন।।যদিও বাংলায় মা আসবেন তার বাপেরবাড়ি আরো ক’দিন পর। ষষ্ঠী পূজার তোড়জোড় চলছে তাই ঘরে ঘরে। আমি জানি না কী সূত্রে হিমালয় দূহীতার পিত্রালয় হবার গৌরব পেলো এই বাংলা, তবে শারদকালীন তার আগমণ ঘিরে প্রকৃতির এই যে সেজে উঠা তা বড় ভালো লাগে।
শরতের আবহাওয়া এমন, যেন সদ্য স্নান সেরে এলেন মা তেমনি সুরভী ছড়ানো ভোর। ভাবতে অবাক লাগে, যে দেশে জাতপাত নিয়ে এতো হানাহানি সেদেশে ঊমার মতো অমন নরোম একফোঁটা মেয়ে কেমন নিজে নিজের বর বেছে নিলেন, কী তাঁর তেজ! আর সেই সূত্র ধরে বাংলার ঘরে ঘরে প্রথা চালু হলো গৌরিদানের। গৌরি, হিমালয় কন্যা উমারই আরেক নাম। পর্বতরাজ হিমালয় তার কন্যাকে মহাদেবের কাছে সম্প্রদান করেছিলেন নিতান্তই বালিকাবস্থায়। ছোটবেলায় যখন টিভিতে মহিষাসুর মর্দিনীর আখ্যান দেখতাম ভেবে অবাক লাগতো নয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে কী করে শ্বশুর ঘর করতে এলো! যে দেশে কন্যা সন্তান স্রেফ একটা বোঝা বৈ নয়, পুত্রাকাঙ্খায় আজো বলি চড়ে রোজ কত শত কন্যাভ্রূণের সে দেশে অসুর বধে আবাহন করতে হয় নারীকেই!
আর মজা দেখুন, সৃষ্টির মূল যিনি তিনি নারীই। তিনিই স্বয়ং আদ্যাশক্তি। আবার মহাঅষ্টমী পূজায়, কুমারী কন্যাই ঈশ্বরীর প্রতিভূ হিসেবে পূজা নেন। ভাবতে অবাক লাগে না কি, সেই কন্যাটি যাকে লক্ষণ দেখে সুলক্ষণা মেনে অষ্টমীর কুমারী পুজা যথাবিহিত হলো সে তার নিজের ঘরেও হয়তো ঠিক সম্মান পায় না? বাংলার তাবত পুরুষ কুল মা মা বলে অস্হির, সব কিছুতেই মায়ের চরণে ফুল জল ঢালতে ছোটে। নারীকে দেবী শক্তি মেনে পুজা দিতে রাজী, কেবল মানুষ মেনে ন্যায্য অধিকার দিতেই তার যতো অনীহা। সারাদেশের নিগৃহীত নারীরাও পুজার কয়টা দিন উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে। স্বপ্ন দেখবে এবার থেকে মা যদি মুখ ফিরে চান, যদি তার সংসারটা এবার একটু স্হির হয়। কত শত মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য মর্তে দূর্গার আবির্ভাব! কত শত সন্তানের মুখে হাসি ফোঁটাতেই তিনি এবার ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আসছেন৷ তবুও ষষ্ঠী পুজার বোধনের আগেই বাংলায় দেবী মূর্তি ভাঙার তান্ডব শুরু হয়ে গেছে।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসেবে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হিন্দুদের ১৬৮ টি বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ১৩০ টি পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। ৪৯ জন হিন্দু আহত হয়েছেন, সাতজন মারা গেছেন। ২০০১-২০১৬ সাল পর্যন্ত মন্দির ভাংগা, পরিবারের উপর হুমকি ও নির্যাতন এবং আস্থাহীনতার ফলে গড়ে বছরে প্রায় ২০০,০০০ জন দেশ ত্যাগ করেছেন। ২০০১ ও ২০১১ সালের আদমশুমারির পরিসংখ্যান তুলনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) বলছে, গত ১০ বছরে কমপক্ষে ৯০০,০০০ হিন্দু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নিরর্যাতনের জন্য দেশ ত্যাগ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত তাঁর ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ রিফরমিং এগ্রিকালচার-ল্যান্ড-ওয়াটার বডিস ইন বাংলাদেশ’ বইতে বলছেন, প্রতক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্যাতন ও আস্থা হারিয়ে প্রতিদিন গড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৬৩২ জন দেশ ছাড়ছেন। সে হিসেবে, বছরে প্রায় ২৩০,০০০ জনের বেশি দেশ ত্যাগ করে। যদিও দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগের সরকার থাকায় হিন্দুরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে কম চিন্তিত থাকেন। তবুও পুজার দিনগুলিতে সরকারের এতো সুন্দর ব্যবস্হাপনা, এতো নিরাপত্তা বেষ্টনি থাকা স্বত্তেও দেশের বিভিন্ন স্হানে প্রতিমা ভাঙছে দুর্বৃত্তরা।
বিশেষত দেশের যে সকল স্হানে জামাত ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো বেশি সক্রিয় মূর্তি ভাঙার ঘটনা সেখানেই বেশি। সরকারের পাশাপাশি এরকম অনভিপ্রেত ঘটনা রুখতে সোচ্চার হতে হবে এলাকাবাসীকেও। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মূর্তি ভাঙতে চাওয়া লোকের তুলনায় পরধর্ম সহিষ্ণুতা এদেশে বেশি। প্রতিটা পাড়ায় পূজার দিনগুলোতে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি হোক। আর যেন কোথাও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা আমরা না দেখি।
সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।
ই-মেইলে যোগাযোগ করুন