এই শতকের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারের নাম ইণ্টারনেট বা অন্তর্জাল, যার মাধ্যমে মানুষ যাত্রা শুরু করেছে দিগন্তহীন তথ্য মহাসড়ক বা ইনফর্মেশন হাইওয়ে দিয়ে অসীম জ্ঞানের দিকে। আগের যে কোন জ্ঞানী মানুষের চেয়ে তাই আজকের গড়পড়তা বুদ্ধিমান মানুষ অনেক বেশী জানে ও বুঝে। বিজ্ঞান, কলা, দর্শনের আবিস্কারে তাই মানুষের শানৈ শানৈ গতি। এইসব ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ইতিহাস সৃষ্টি করেছে সে পূর্বের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। এসবের বাইরে আরও আছে বিশ্বাসের আরেক মাত্রা, যার প্রভাব রয়েছে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে, কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেও সে প্রভাবিত করেছে। কলা, বিজ্ঞান ও দর্শনকে গুরুত্ব দিয়ে তাই বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই। মানুষের ধারাবাহিক অগ্রগতি, পতন, সংগ্রাম ও বিশৃঙ্খলার ইতিহাসের সাথে অন্যসব নিয়ামকের সঙ্গে ধর্ম-বিশ্বাসেরও গুরুত্ব রয়েছে। ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে যে ঈশ্বর বসে রয়েছেন তারও রয়েছে ভিন্নতা জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে। মানুষের ধর্ম তাই বিভিন্ন প্রকারের, স্বাদের, বর্ণের। ঈশ্বরও ভিন্ন। ঈশ্বরের চরিত্র, আকার, মিথ সব কিছুতে রয়েছে ভিন্নতা। ইতিহাসের আলোকে পাই, এই ভিন্নতা বা বৈচিত্র কখনও আশির্বাদ হয়ে আসেনি মানুষের মাঝে। এইসব ভিন্নতা নিয়ে কখনও তারা সহাবস্থান করেছে বিরক্তিতে, উপায়ন্তর না দেখে। আবার কখনও একে অপরকে আক্রমন করেছে নিজস্ব ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীতে। এই নিবন্ধে চেষ্টা করবো বিশ্বাসের কেন্দ্রে বসে থাকা সেই ঈশ্বরের স্বরূপ উন্মোচনে। পক্ষপাতহীনভাবে প্রয়াস চালাবো দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও পুরহিতের ঈশ্বরকে আলোতে নিয়ে আসার।
দার্শনিকের ঈশ্বর কেমন, সেই অনুসন্ধানের আগে যদি একটু ধারণা নেয়া যায়, দার্শনিক বলতে আসলে কী বুঝি, তাহলে দর্শনের ঈশ্বরকে বুঝতে সুবিধা হবে। ফিলোসফি শব্দটা খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রীক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস সম্ভবত প্রথম একাডেমিকালি চালু করেন। ফিলোসফি শব্দের আবিধানীক অর্থ লাভ অব উইজডাম বা প্রজ্ঞার প্রতি ভালবাসা। আর উইজডাম, স্যাপিয়েন্স বা প্রজ্ঞা বলতে আমরা বুঝি- জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বোধ, কাণ্ডজ্ঞান, বা কমন সেন্স, ও অন্তর্দৃষ্টিকে প্রাকৃতিকভাবে স্বভাবে ও আচরণে ব্যবহার করার ক্ষমতাকে। দর্শন মূলত সাধারণ ও মৌলিক সমস্যা, যেমন- অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, কারণ, মন ও ভাষা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে। এইসব বিষয় আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে উপণিত হবার জন্যে দার্শনিকগণ প্রশ্নকরণ, সমালোচনা ও অনুসন্ধানী আলোচনা, যুক্তিসিদ্ধ বিতর্ক, ও পদ্ধতিগত উপস্থাপনা ব্যবহার করে থাকেন। যুক্তিসিদ্ধ আলোচনার ক্ষেত্রে তারা আরোহ ও অবরোহ উভয় পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে থাকেন। দর্শনের এমন একটা অবকাঠামোর ভিতরে বিশ্বাসের কেন্দ্রে উপবিষ্ট ঈশ্বরকে ফেলে তার যাচাই, বাছাই ও স্বরূপ অনুসন্ধান করতে গেলে কী ফলাফল বের হয়ে আসে তা দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এমানুয়েল ক্যাণ্ট ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল নামের দুইজন প্রথিতযশা দার্শনিকের ঈশ্বর বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মানীতে জন্ম নেয়া এমানুয়েল কাণ্ট বিশ্বাস করতেন ‘স্বর্ণাভ নীতি’ বা গোল্ডেন রুলে, যার মূল কথা- তুমি অন্যের কাছে যেমন ব্যবহার আশা করো, মানুষের সাথে তেমন ব্যবহার করবে। যখন তুমি তোমার নিজের প্রজ্ঞার আলোকে তা করবে, তখন সেটা বিশ্বনীতি বা ইউনিভার্সাল রুলে পর্যবেশিত হবে।
ইমানুয়েল ক্যাণ্টের টেক্সটে ঈশ্বর অনুসন্ধান করতে গেলে, একটা বিষয় উঠে আসে- তিনি কোন ভাবে ধর্মের উপযোগিতা বা ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তাকে বাতিল করে দেন নাই। তিনি দেখিয়েছেন মানুষের একটা অসহায়ত্বের জায়গা আছে, যে জায়গাটা পূরণ করেছে ঈশ্বর। যদিও মানুষের ভাল থাকা বা মন্দ থাকার উপরে ঈশ্বরের কোন হাত নেই, তবু মানুষের অসহায় বোধের শূন্যস্থানটা ঈশ্বরকে দিয়ে পূরণ করার বাস্তবতাকে তিনি অস্বীকার করেননি। তিনি একথাও বলেছেন এই অসহয়াত্বের গভীরতার প্রকার অনুসারে একেক জনের ঈশ্বর এক এক রকমের হতে পারে। তার টেক্সেটে তাই পার্সোনাল গডের সমর্থন রয়েছে। মানুষের জ্ঞান ও ভৌত অস্তিত্ব যেহেতু পরিবর্তন ও বিবর্তনশীল, বিশ্বাসকেও তাই পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। দেখা যাক বিপুল প্রভাবশালী এই দার্শনিকের বই ঘেটে ঈশ্বর বিষয়ক দুয়েকটা বাণী। ক্যাণ্ট তার ক্রিটিক অব পিওর রিজন (Critique of pure reason) বইতে বলেন- The ideal of the supreme being is nothing but a regulative principle of reason which directs us to look upon all connection in the world as if it originated from an all-sufficient necessary cause. অর্থাৎ, সর্বোচ্চতম অস্তিত্ব বা ঈশ্বর কার্য ও কারণের সক্রীয় ও ফলিত নীতি-নিয়ম ছাড়া আর কিছুই নয়, যা আমাদের ভিতরে এই বোধের জন্ম দেয় যে, পরস্পর সংযুক্ত এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু সয়ম্ভু ও প্রয়োজনীয় কারণ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি এখানে শুধু সুপ্রিম বিয়িং না বলে বলেছেন, আইডিয়াল অব সুপ্রিম বিয়িং। এতে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। মনে হতে পারে, তাহলে হয়তো সুপ্রিম বিয়িং বলতে অন্য আরেকজন আছেন। আসলে আইডিয়াল অব সুপ্রিম বিয়িং এবং সুপ্রিম বিয়িং একই বস্তু। কাণ্টের এই বাণীর ভিতর দিয়ে আমরা যে ঈশ্বরকে দেখতে পাচ্ছি, সেটা পুরোহিতের ঈশ্বর থেকে অনেক বেশী ভিন্ন। এই ঈশ্বরকে বন্দনা করার দরকার নেই। মানুষের বা সকল প্রাণীর ভাল-মন্দ তার অস্তিত্বের উপরে বা তার সন্তুষ্টি, অসন্তুষ্টির উপরে নির্ভর করে না। ঈশ্বরের এই সংজ্ঞায়ণের পরে তার যে স্বরূপ দাড়ায়, তাতে তাকে বিশ্বাসের জায়গা থেকে অস্তিত্ববাদী বলা যায় না কোন মতে। কাণ্টের ঈশ্বরের স্বরূপ পুরোহিতের ঈশ্বর থেকে যোজন যোজন দূরে। যেহেতু কাণ্ট ধর্মের ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তার বাস্তবতাকে বাতিল করেননি। তাই অনেক বিশ্বাসনির্ভর আস্তিত্ববাদী তাকে আস্তিকদের দলে ভিড়াবার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
বার্ট্রাণ্ড রাসেল ছিলেন গণিতজ্ঞ, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, লেখক, রাজনৈতিক সমালোচক এবং নোবেল লরিয়েট। জন্ম ১৮৭২ সালে ইংল্যাণ্ডে। তিনি স্বঘোষিত নিরিশ্বরবাদী ছিলেন। তিনি তার ‘Why I am not a Christian’ বইতে ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন- যদি প্রতিটা জিনিসের একটা কারণ থাকে, তবে ঈশ্বরেরও কারণ আছে। ধর্ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন- শুধুমাত্র বুদ্ধিগত বিষয়ের জন্যই নয়, দৈহিক বিষয়ের জন্যেও ধর্ম অনিষ্টকর।
What I Believe বইয়ে তিনি মঙ্গলময় জীবন বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে বলেন- মঙ্গলময় জীবন হলো সেই জীবন, যা প্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত। তাঁর এই বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে, মঙ্গলময় বা আদর্শ জীবনের সাথে বিশ্বাস বা ঈশ্বরের কোন সম্পর্ক নেই। Why I am not a Christian-বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় ঈশ্বর বিষয়ে যে মতামত এই বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ব্যক্ত করেছেন, তা উনবিংশ শতকের মুক্তবুদ্ধির চর্চায় আলোকায়ণের সঞ্চার করেছে কোন সন্দেহ নেই। I do not pretend to be able to prove that there is no God. I equally can not prove that Satan is a fiction. The Christian God may exist; so may the Gods of Olympus, or of ancient Egypt, or of Babylon. But no one of these hypothesis is more probable than any other: they lie outside the region of probable knowledge, and therefore, there is no reason to consider any of them. অর্থাৎ, ঈশ্বর নেই, সেটা প্রমাণ করার ভান আমি করবো না, আবার শয়তান একটা বায়বীয় জিনিস, এটাও প্রমাণ করতে পারবো না। খ্রীষ্টানদের গড হয়তো আছেন; তাহলে অলিম্পাসের ঈশ্বরগুলো, প্রাচীন মিশরের বা বেবিলনের, সবার ঈশ্বর আছে বলে ধরে নিতে হয়। তাহলে কি দাড়ালো? এই সমস্ত হাইপথেসিসের কোনটাই অন্য আরেকটা থেকে বেশী সম্ভাব্য নয়। তারা সবাই আসলে সম্ভাব্যতা-জ্ঞানের বাইরে অবস্থান করে। ঠিক সেই কারণে তাদের কাউকে বিবেচনায় রাখার কোন কারণ নেই। বার্ট্রাণ্ড রাসেল জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন, নোবেল লরিয়েট ছিলেন, তাই তার এই কথাগুলো নির্বিচারে মেনে নিতে হবে? মোটেই তা নয়। রাসেলের উপরের কথাগুলো নিজের কমন সেন্সের দাড়িপাল্লায় বসিয়ে দেখুন আপনি অবিকল তার মতন যে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিজ্ঞানের মুখে ঈশ্বরের কথা শোনার আগে দেখে নেই, বিজ্ঞান বলতে আসলে আমরা কি বুঝি। একটা সংজ্ঞায়নে দেখা যায়- Science is the pursuit and application of knowledge and understanding of the natural and social world following a systematic methodology based on evidence. ঠিক তাই, লব্ধ জ্ঞানের ফলিত রূপ বা ব্যবহারিক অবস্থা থাকতে হবে, বিষয়বস্তু প্রাকৃতিক ও সামাজিক হতে হবে, উপস্থাপনের পদ্ধতিগত প্রকৃয়া থাকতে হবে, সর্বোপরি থাকতে হবে সাক্ষ্য-প্রমান বা পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও নিরীক্ষা। তবেই তাকে বিজ্ঞান বলা যাবে। বিজ্ঞানের এই ছাঁচের ভিতরে ধর্ম বা ঈশ্বরকে ফেলা যায় কিনা ভাবতে হবে। কারণ বিজ্ঞানের একটা মৌলিক বৈশিষ্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা, অর্থাৎ পঞ্চেন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা লব্ধ সাক্ষ-প্রমান বিজ্ঞানের প্রধান অঙ্গ। অথবা বলা যায়, বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কার, যা ইন্দ্রিয়ের সক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়, যেমন- লেজার, মাইক্রোওয়েভ, তড়িতচৌম্বকীয় সিগনাল, রাডার ইত্যাদি বিজ্ঞানের বাস্তব ভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল প্রদান করে। ধর্মের ঈশ্বর এমন একটা বিষয়, যাকে বিজ্ঞানের টেমপ্লেটে বসানো যায় না। কারণ তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা নেই, আছে চেতনার বিভ্রান্তি-মায়া বা ইলিউশন। বিজ্ঞানের নিজস্ব একটা চিন্তন পদ্ধতি রয়েছে, যার উপরে ভর করে বিজ্ঞানের দর্শন গড়ে উঠে। এই বিজ্ঞানের দর্শনের ফ্রেমওয়ার্কের ভিতরে ঈশ্বরকে রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে এবং তাতে একটা রেজাল্টও আসে হয়তো, তবে তা মোটেই বিশ্বাস আশ্রয়ী ঈশ্বরের মতন নয়। অন্যরকম কিছু একটা। তবে বিজ্ঞানের দর্শন আর বিজ্ঞান প্রায় একই জিনিস, একই মূদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
পৃথিবীর সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন জন্মেছিলেন ১৮৭৯ সালে জার্মানির উলম শহরে প্রায় ১৩৮ বছর আগে। বিজ্ঞানের ব্যাপারে ফাইনাল বলে কিছু নেই। আজকের তত্ত্ব কাল বাতিল হয়ে যেতে পারে। তবুও এখন পর্যন্ত তাঁর জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি জগতের অপার বিষ্ময়। যেহেতু সমাজ ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিবেচ্য বিষয়, তাই সেই সমাজে লালিত ধর্মাশ্রয়ী বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসের কেন্দ্রের ঈশ্বর সম্পর্কে তার রয়েছে যৌক্তিক চিন্তা ভাবনা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তিনি ঈশ্বর বিষয়ে কথা বলেছেন। ধর্ম বিষয়ে একবার তিনি বলেছিলেন– It was, of course, a lie what you read about my religious convictions, a lie which is being systematically repeated. এটা ছিল তার ধর্ম বিষয়ে কথা বলার প্রতিক্রীয়ায় একটা ফিডব্যাক মাত্র। ধর্ম ও ঈশ্বরের ব্যাপারে কথা বলার সময় পরবর্তীতে তিনি বেশ সাবধানী হয়েছিলেন।
এরপরে ১৯৫৪ সালে এসে তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন অনেকটা এইভাবে- I do not believe in a personal God and I have never denied this but have expressed it clearly. If something is in me which can be called religious then it is the unbounded admiration for the structure of the world so far as our science can reveal it. এখানে এসে তিনি বলছেন- কোন পার্সোনাল গডে আমি বিশ্বাস করি না, অথবা তাকে অস্বীকারও করি না। ধর্মীয় কিছু যদি আমার ভিতরে থেকে থাকে তবে তা, মহাবিশ্বের অস্তিত্বের বিশালতায় সিঞ্চিত দিগন্তহীন বিষ্ময় ছাড়া আর কিছু নয়। আমার যে বিষ্ময়ের মূলে রয়েছে বিজ্ঞান। তার এই জটিলতর বক্তব্যের গোড়ার দিকে রয়েছে, তার অজ্ঞেয়বাদী মনের স্বীকারোক্তি। দ্বিতীয় বা শেষাংশে রয়েছে খুব নিপূণতার সাথে ব্যাক্ত ঈশ্বর অস্তিত্বের প্রতি অস্বীকৃতি। আপেক্ষিকতাবাদের এই স্রষ্টা এক বক্তৃতায় একবার বলেছিলেন- The knowledge of god is immensely immune to human perception. তারমানে, মানুষে মস্তিষ্কের পক্ষে সম্ভবই না ঈশ্বরকে ধারণ করা। এই কথা দিয়ে তিনি বুঝাতে চান, ঈশ্বর একটা অতিরিক্ত ও অনাবশ্যক অনুকল্প। তাঁকে প্রমাণ ও অপ্রমাণ কোনটা করাই সম্ভব না। ঠিক এমন একটা কথা মৃত্যুসয্যায় বসে মহোর্ষী গৌতমও বলেছিলেন তার দুই শিষ্যকে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন কার্ল সেগান নামের একজন প্রখ্যাত ও জনপ্রিয় জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী। তিনি জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখকও বটে। কসমস নামে তার ১৬ এপিসোডের একটা ভিডিও প্রকাশনা রয়েছে, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনসাধারণ্যে জনপ্রিয় করতে অঢেল অবদান রেখেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর প্রকাশিত এর থেকে সহজ, সরল ও বোধগোম্য আর কোন প্রকাশনা আমার চোখে পড়েনি।
এই দীর্ঘ প্রকাশনার অনেক জায়গায় ঈশ্বর ও ধর্মের বিষয় এসেছে আলোচনার খাতিরে। এক জাগায় তিনি ঈশ্বরকে ‘ডু নাথিং কিং’ বা অপদার্থ, কুড়ের বাদশা বলে সমালোচনা করেছেন। আরেক জায়গায় তিনি তার এই সমালোচনার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলছেন- আমাদের এই স্থান-কালের চতুর্মাত্রিক বিশ্বটাই সব নয়। এর বাইরে রয়েছে বহুমাত্রিক বিশ্ব ও সমান্তরাল বিশ্বসমূহ, বা প্যারালাল ইউনিভার্স। এখন পর্যন্ত এগারো মাত্রার গাণিতিক বিন্যাসে হিসাব নিকাশ করা গেছে। এই পর্যায়ে প্রশ্ন এসে যায়- সৃষ্টি অসীম না সসীম। এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া মানুষের পক্ষে এখনও সম্ভব হয়নি। মাথার উপরে এই যে অসীম সংখ্যক বা প্রায় অসীম সংখ্যক বিচিত্র সব সৃষ্টি, তাদের নবায়ন, ধ্বংস, ব্যবস্থাপনা, সম্প্রসারণ, রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যে একটা ভয়াবহ বুদ্ধিমত্তার সর্বোচ্চ অস্তিত্বের প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা এই অসীম প্রজ্ঞাবান অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন, তবে তাদের এই অস্তিত্ববাদের সাথে ধর্মাশ্রয়ী অস্তিত্ববাদের অমিল রয়েছে ব্যপক। অসীম প্রকৃতির সর্বাত্মক পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন একগুচ্ছ নিয়ম বা রুল, যারা পারস্পরিক মিথোস্কৃয়ায় প্রয়োজন মত তৈরি করতে পারে অজস্র সূত্র। তারা স্থান-কাল নিরপেক্ষ থেকে সেলফ-কমাণ্ডের মাধ্যমে সৃষ্টি, ধ্বংস ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। তারা অসীম বুদ্ধিমত্তা সমৃদ্ধ ও স্থান-কাল নিরপেক্ষ। এটা একটা অস্তিত্ব হিসাবেও যদি ধরা হয়, তবে এই অস্তিত্বকে বন্দনা করার কোন দরকার নেই। মানুষের শান্তি ও অশান্তির সাথে এই অস্তিত্বের কোন সম্পর্ক নেই। ঈশ্বরের বিকল্প ধারণায় বিজ্ঞানের সেট অব রুলসই শেষ কথা। শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ধারণার মূলে রয়েছে এই সেট অব রুলস, ধর্মকেন্দ্রীক ঈশ্বর নয়।
অহিংস বা ননভায়োলেন্স মুভমেণ্টের স্রষ্টা মহাত্মা গান্ধী তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- Law and the lawmaker is the same. আইন ও আইনের স্রষ্টা একই অস্তিত্ব। তিনি কি এই কথা সব দিক চিন্তা ভাবনা করে বলেছিলেন? যদি বলে থাকেন, তাহলে বিজ্ঞানের বাইরের একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সমর্থন পাই উপরে বর্ণীত ‘সেট অব রুলস’কে ধর্মশাস্ত্রের ঈশ্বরের বিকল্প হিসাবে। বিজ্ঞানের সাথে ভাববাদের একটা সেতুবন্ধন হয়তো এখানে এইভাবে পেয়ে যাই মহাত্মার বাণীর ভিতর দিয়ে। মহাত্মা গান্ধীকে কোনভাবেই আমরা বিজ্ঞান বা পুরোহিতের মুখপাত্র হিসাবে দেখতে চাই না। তিনি উপমহাদেশের একজন আধ্যাত্মিক ও ভাববাদী সফল নেতা ছিলেন। এইই তার আসল পরিচয় বলে মনে করি।
আমরা কমবেশী সবাই বিশ্বাসাশ্রয়ী ঈশ্বরের স্বরূপ কেমন তা জানি। সেই স্বরূপ অন্বেষণে যাওয়ার আগে দেখে নেই বিশ্বাসের ফ্রেমওয়ার্কটা আসলে দেখতে কেমন। প্রত্যেক ধর্মের সেণ্টারে থাকে অদৃশ এক ক্ষমতাধর ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার জন্যে একেবারে সূচনায় এক বা একাধীক মৌলিক বিষয়কে যুক্তিহীনভাবে মেনে নিতে হয়। সেই বিষয়গুলো এমন, যে এর পরে ধর্মের আর কোন বিষয়ে প্রশ্ন করার সব অধিকার পুজারী হারিয়ে ফেলে। একটা মিথ্যা ঢাকতে গেলে যেমন মিথ্যার পিঠে আরও অনেকগুলো মিথ্যা বলা লাগে, ঠিক তেমনি ঐ কয়েকটা বিষয়ে শর্তহীন বিশ্বাস স্থাপনের পরে আরও বহু বিষয়ে শর্তহীন বিশ্বাস স্থাপন করার আবশ্যক হয়। এরপরে প্রথমে আসি ঈশ্বরের বিষয়ে। আজকের সুসংগঠিত ধর্মসমূহের ঈশ্বরেরা যে রূপ পরিগ্রহ করেছেন, অতীতে তারা তা ছিলেন না। ঈশ্বরের বিবর্তন হয়েছে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। তাই এই বিষয়ে জানতে হলে ধর্মের ধারাবাহিক ইতিহাস জানতে হবে। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংগঠিত বিশ্বাসগুলো এক সময় নবী, পয়গম্বার, অবতার ইত্যাদি খেতাবে ভুষিত মহামানবদের হাত ধরে সংগঠিত ফ্রেঞ্চাইজ ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রায় সব ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে বসানো হয়েছে তাদের নিজ নিজ ডেইটি, দেবতা, ঈশ্বরসমূহকে। ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসে সেইসব ডেইটির নামকরণ হয়েছে ভগবান, ঈশ্বর, গড, জেহবা, আল্লা ইতাদি নামে। যেসব ধর্ম বিশ্বাসে কোন ডেইটি নেই, যেমন- আদিবৌদ্ধ, এসপিনোজা, যাদেরকে প্রচলিত ধর্মের ভিতরে ফেলা যায় না বলে মনে করি।
প্রত্যেক ভিন্ন ধর্মের ঈশ্বরদের স্বভাব, চরিত্র, আকার, অবস্থান, ক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন। এই ঈশ্বরদের নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পূজা, অর্চনা, ইবাদাত, বান্দেগি করে সন্তুষ্ট করতে হয়। প্রায় সব ধর্ম নিয়তিবাদী এবং মানুষের পরলৌকিক জীবনকে মোটামুটি নিশ্চিত করতে পেরেছে নানান হিসাব নিকাশের মারপ্যাচে, কিন্তু ইহলৌকিক জীবনকে সে নিশ্চিত করেছে নিয়তিবাদের মাধ্যমে, অনেকটা গোজামিল দিয়ে। কোন কোন ধর্ম পরিণত হয়েছে সর্বসংরক্ষণবাদী বা টোটালিটেরিয়ানে। উঠা-বসা সহ সকল ব্যক্তিগত জৈবনিক কর্মকাণ্ড, এমনকি ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক সব দিক নিজের আওতায় নিয়ে এসে ব্যক্তিকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে ফেলেছে, যাতে নিজের মতন করে এতটুকু স্বাস-প্রশ্বাস সে না নিতে পারে। এই অবস্থায় ধর্ম নিজেকে ঘোষণা দিয়েছে পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসাবে। দাবী করেছে রাষ্ট্রের সংবিধান হিসাবে ধর্মীয় ঐশিগ্রন্থকে অন্তর্ভুক্ত করার। সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা হচ্ছে, ধর্মের ফ্রেমওয়ার্কের ভিতরে বিজ্ঞান ও দর্শনকে বসিয়ে নানান জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌছানোর চেষ্টা। তথাকথিত ভণ্ড পণ্ডিত জাকের নায়েকের মাধ্যমে চলেছে ধর্মীয় ধাচের বিবর্তনবাদ ও আপেক্ষিকতাবাদ উদ্ভাবনের ব্যার্থ চেষ্টা। এখানেই ফুটে উঠেছে ধর্মীয় বিস্বাসের সর্বসংহারী চেহারা। প্রায় সকল ধর্ম বিশ্বাস কালের পরিক্রমায় পরিবর্তন, পরিমার্জনের ধারাবাহিকতায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। ইসলাম পারেনি এই ধারাবাহিকতায় শামিল হতে। এটা তার নিজস্ব ব্যার্থতা। ধর্ম সংস্কৃতিকে অনুসরণ করবে, এর উল্টোটা নয়। যে বিশ্বাস সংস্কৃতির বিপরীত স্রোতে চলার চেষ্টা করেছে, তার অস্তিত্ব সংকট ঠেকাবার কোন পথ নেই। প্রত্যেক বিশ্বাসের কেন্দ্রে যে ঈশ্বর, তার স্বভাব ও চরিত্রের সংস্কার দরকার সবার আগে। কারণ সাধারণ মানুষের প্রতি সব ধর্মের নির্দেশ- স্রষ্টার রঙে রঞ্জিত হও। তাই সব ধর্মের স্রষ্টাকে হতে হবে প্রেমিক, মানবিক, বুদ্ধিমান ও যুক্তিবান। তাহলে সেই ধর্মে বিশ্বাসী মানুষও হবে মানবিক স্বভাবের। উন্নত হবে সমাজ। সংস্কৃতির বিপরীত স্রোতে সাঁতার কাটা ধর্ম ও তার কেন্দ্রে জাপড়িয়ে বসে থাকা ঈশ্বরের পাণ্ডা-বিলুপ্তি ঘটবে কোন সন্দেহ নেই।