যেহেতু আমি একজন নাস্তিক এবং এই পরিচয় নিয়ে কোনো লুকোছাপা করি না, অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে- তুমি কী ভারতীয় পরম্পরা মানো না? কিংবা ভারতীয় ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত নও?
আমি তাদের বলি যে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার নিয়ে আমি অত্যন্ত গর্বিত এবং আমি তা অতি সোচ্চারে ঘোষণাও করি। তবে আপনি যাকে ভারতের পরম্পরা ও সংস্কৃতি বোঝেন বা মানুষকে বোঝানো হয়, আমার কাছে ভারতীয় ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও পরম্পরা তার থেকে অন্যতর যা অত্যন্ত মহান ও আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।
সাধারণভাবে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে যে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মানে হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় বেদান্ত দর্শন ও সেই অনুসারী জীবন চর্চা। কিন্তু যারা প্রাচীন ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কে একটু চর্চা করেন তারা জানেন যে ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞানের বিপুল ভান্ডারে বেদান্ত দর্শন একটি সামান্য অংশ মাত্র। এর বাইরে এমনকি এর বিপরীতে আমাদের রয়েছে এক বিপুল জ্ঞান ভান্ডারের সমুদ্র। এমনকী দর্শনের ক্ষেত্রেও বেদান্ত দর্শনের বিপরীতে রয়েছে সাংখ্য, ন্যায়, মীমাংসা, বৈশেষিক, চার্বাক এর মত দর্শন – যেগুলোর সারাৎসার মূলত বেদান্ত বিরোধী। এছাড়াও প্রাচীন ভারতে চিকিত্সা বিজ্ঞান, স্থাপত্যবিদ্যা, কারগরি, নৌবিদ্যা, ইত্যাদির বিশাল ঐতিহ্য ও পরম্পরা বিদ্যমান। এগুলির প্রতি প্রাচীন বেদান্ত দার্শনিকরা বিরোধ করেছেন অথবা উদাসীনতা দেখিয়েছেন।
দুই।
আগেই বলেছি ভারতের শাসককুল এবং তাদের পোষিত পণ্ডিতেরা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে এসেছে যে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আসলে মূলত বৈদান্তিক দর্শন ও তার অনুসারী চর্চা। এর বিপরীত চিন্তা ও শৈলীগুলিকে তারা হয় ধ্বংস করেছে অথবা নীরব উদাসীনতায় চেপে দিয়েছে। এইকাজে তারা এত সফল যে সাধারণ মানুষ তো বটেই, আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে আমার অনেক নাস্তিক বন্ধুও নিজের অগোচরে এই মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। তাঁরা মনে করেছেন যে ভারতীয় ঐতিহ্য মানেই হল অগণিত শ্রমজীবী (শূদ্র) মানুষের উপর রাজা আর পুরোহিততন্ত্রের শোষণ অত্যাচারের ইতিহাস। নারীর অসম্মানের ইতিহাস। মুষ্টিমেয় মানুষের সকল ধনসম্পদ ও জ্ঞান বিজ্ঞান কুক্ষিগত রাখার ইতিহাস। এর কোনোটাই মিথ্যা নয়।
কিন্তু একইসঙ্গে কোনোটাই একমাত্র সত্য নয়। তাঁদের নজর এড়িয়ে গেছে যে এর বিরুদ্ধে সংগ্রামও ভারতবর্ষের ইতিহাস। ভাববাদী দর্শনের সাথে সাথে এর বিরুদ্ধ দর্শন গুলোও ভারতের ঐতিহ্য। এবং সেগুলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কারিগরি বিদ্যা ও বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস, যার বেশিরভাগটাই তথাকথিত অন্তজদের অবদান- এসবগুলি তাঁদের নজর এড়িয়ে গেছে। অনেক মহিয়সী নারীর পুরুষ তন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই, প্রাচীন ভারতে শ্রমজীবী সমাজে নারীর সম্মানীয় স্হান ও সমানাধিকার- এগুলো তাঁদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে।
এর ফলাফল হয়েছে খুব মারাত্মক। এই বন্ধুদের মধ্যে নিজেদের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা দেয়। অতীত ইতিহাসকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র বর্তমান সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা, ইতিহাসের গতিপথে সমাজ প্রগতিকে স্থাপন না করে হঠাৎ কিছু চিন্তাকে সমাজে গুঁজে দেবার চেষ্টা যা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
উল্টোদিকে এটাই রক্ষণশীল সমাজের অস্ত্র হয়ে উঠেছে। তারা বলতে শুরু করে- এসবচিন্তা ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না। তারা প্রচার করতে থাকেন যে ভারতীয় সমাজ স্বভাবগত ভাবে আধ্যাত্মিক। এখানে বস্তুগত চিন্তার স্থান নেই।
অথচ ভারতীয় সমাজে ব্রহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি প্রতিস্থাপিত করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ভারতের শ্রমজীবী মানুষেরা সহজে তা গ্রহণ করে নি। এর জন্যে দান-দণ্ড ভেদ সবরকম রাস্তাই ধরেছে শাসকেরা। অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেক অত্যাচার হয়েছে। প্রবল পরাক্রান্ত রাজশক্তির ধর্মধ্বজে অনেক রক্ত লেগে আছে।
এমনটা কখনোই নয় যে, আজকের দিনের আমরাই প্রথম ধর্মতত্ত্ব ঈশ্বরতত্ত্বের বিরুদ্ধে, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে, জাতিবাদ নারীর প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা তত্ত্বে তর্কে তরবারিতে এই ভাববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রাম করেছেন যা আমাদের গৌরবান্বিত ঐতিহ্য। আমরা ভুঁইফোড় কেউ নই। আমরা তাদের মহান উত্তরাধিকারী।
তিন।
স্থাপত্যবিদ্যা:
খুব ধর্মপ্রাণ পরিবারে জন্ম এবং ধর্মীয় পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা। একেবারে ছোটবেলায় বার কয়েক পড়ে ফেলি কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাশী মহাভারত, গীতা, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, ইত্যাদি। এগুলো পড়তে পড়তে মনে বেশ কিছু প্রশ্ন জাগতো। এরকম প্রশ্ন মনে উঠতো রামায়ণ-মহাভারতে পড়লে, যখনই কোনো বিশাল রাজপ্রাসাদ গড়ার দরকার হতো, ডাক পড়তো ময় দানবের। এই ময় দানব আবার যে সে কেউ নয়। তিনি স্বয়ং লঙ্কেশ রাবণের শ্বশুর, রানি মন্দোদরীর পিতা। তো এতো বড় বড় করিৎকর্মা দেবতা থাকতে এক দানবের দরকার পড়তো কেন?
এর উত্তর তখন পাই নি। পেলাম অনেক বড় হয়ে, আরও গভীরে গিয়ে।
আর্যরা ভারতে এসেছিল এক যাযাবর পশুপালক গোষ্ঠী হিসেবে। সঙ্গে তাদের বিপুল পশু সম্পদ। তারা চাষবাস করতো না। সেই পশুর দুধ আর মাংস ছিলো তাদের প্রধানখাদ্য। পশুর লোম আর চামড়া দিয়ে তৈরি করতো পোশাক, বিছানা ও অন্যান্য আসবাবপত্র। পশুর চর্বি বা ঘি দিয়ে জ্বালানো হতো রাতের বাতি। মোদ্দা কথা দৈনন্দিন জীবনের দরকারি কাজ পশুজ জিনিস দিয়েই মিটাতো।
কিন্তু সমস্যা ছিল এই বিপুল পশুর পালের খাবার জোগানো। এক এক জায়গার ঘাস লতাপাতা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। ফলে বেশিদিন এক জায়গায় থাকা হয়ে ওঠে না। যাযাবর জীবন। বাড়িঘর বানিয়ে লাভ নেই। ছোট ছোট কুঁড়েঘর বানিয়ে বাস।
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাস সহজ ছিল না। সেখানে হয়তো কোনো কৃষিজীবি গোষ্ঠীর বাস। তারা বাধা দিতো। অন্য পশুপালক গোষ্ঠীর সঙ্গেও এলাকা দখলের লড়াই লেগেই থাকতো। যুদ্ধ বিগ্রহ নিত্য সঙ্গী। তাই আর্যরা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধার জাত। তাদের অস্ত্র শস্ত্র ছিল উন্নত। দ্রুতগামী ঘোড়া আর রথের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। তাই আর্য কারিগরেরা বাড়ি ঘর বানানোতে দক্ষ না হলেও উন্নতমানের অস্ত্র, যান, যন্ত্র বানাতে ওস্তাদ ছিল।
আর্য দেবতা বিশ্বকর্মা যন্ত্রের দেবতা:
আর্যরা যখন ভারতে এলো, এখানে ছিলো তাদের চেয়ে উন্নততর সভ্যতা। সেটা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। পশুর ব্যবহারও ছিল মূলত চাষ আবাদে। তারা কৃষিতে এতো উন্নত কৌশল পদ্ধতি করতো যে অনেক ফসল উদ্বৃত্ত হতো। তাই মহেঞ্জোদারো নগর খুঁড়ে বিশাল শস্যভাণ্ডার পাওয়া যায়। বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত শস্য হওয়ার ফলে সমাজে শ্রেণিবিভাগ ছিল এবং এক বিশাল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা আমরা দেখতে পাই। তার স্থাপত্য দেখে আজকের দিনেও অবাক হয়ে যেতে হয়। বিশাল বিশাল অট্টালিকা, জ্যামিতিক প্যাটার্নে চওড়া রাস্তা, কার্যকরী পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, এসব ছিল অতি উন্নত।
শুধু স্থাপত্যই নয়, নগর পরিকল্পনা দেখেও তাক লেগে যায়। আর্যরা এদেশে বাস করার বহুদিন পর পর্যন্তও সে পর্যায়ের স্থাপত্যবিদ্যা আয়ত্ত করতে পারে নি। রাজা রাম কিংবা রাজা কৃষ্ণের রাজপ্রাসাদের তুলনায় রাক্ষস রাবণ বা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর প্রাসাদ আয়তনে বৈচিত্র্যে বৈভবে সবদিকেই ছিল সেরা। আর সেই জন্যই আর্য রাজারা যখন তাদের বৈভব প্রকাশের জন্যে প্রাসাদ তৈরি করতো, তখনই ডাক পড়ত এইসব অনার্য স্থপতি আর কারিগরদের।
দীর্ঘদিন ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির হোতারা কারিগরিবিদ্যা ও বস্তুবিজ্ঞানকে হেয় দৃষ্টিতে দেখে এসেছে এবং ফলতঃ ভারতের অধঃপতন ও শত্রুর সামনে বার বার অসহায় আত্মসমর্পনের অন্যতম কারণও এটি। একমাত্র কারণ না হলেও, অন্যতম কারণ বটে। এটুকু আশাকরি বোঝাতে পারলাম যে, স্থাপত্যবিদ্যায় আমাদের একটি উন্নত ও মহান ঐতিহ্য আছে । এবং তার সঙ্গে বৈদিক আধ্যাত্মিকতার কোনোই সম্পর্ক নেই।
চার।
অরণ্যের অধিকার:
ভিশাখাপত্তনম থেকে একটা রেললাইন কোরাপুট-জগদলপুর হয়ে কিরণডুল পৌঁছেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি এই রেলপথটাকে চেনেন আরাকু ভ্যালি যাবার রেল হিসেবে। এই রেলপথের দু’ধারের দৃশ্য অতি চমৎকার। ছোটবড় পাহাড়, ঝরণা, গভীর ঘন বন দু’ধারে। কিন্তু ভ্রমণরসিক বাঙালি টেরই পায় না কী নিদারুণ কষ্ট দূর্দশা লুকিয়ে রয়েছে এই অনন্য প্রকৃতির রূপের অন্তরালে।
অতি ব্যস্ত রেলপথ। সারাদিন ধরে রেলগাড়ি ছুটছে। কিন্তু টাইম-টেবিল দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। সারাদিনে একটিমাত্র ট্রেন আপ, আর একটিমাত্র ট্রেন ডাউনে যাতায়াত করে। আর বাকিসময় ধরে মালগাড়ি চলে এই অঞ্চলের বিপুল খনিজ সম্পদ তুলে নিয়ে যেতে। অভ্র বক্সাইট লোহার বিশাল ভাণ্ডার এই অরণ্যভূমি। সেখান থেকে গাছ কেটে, পাহাড় গুঁড়িয়ে, খনিজ সম্পদ তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাছের ভাইজাগ বা পারাদ্বীপ বন্দরে। দেশ-বিদেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে এই সম্পদে। স্ফীত হয় কলকাতা দিল্লি বোম্বে নিউ ইয়র্ক মস্কো টোকিও। আর এই অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজভূমে পরবাসী। ঠিকাদার, সরকারি আমলা, মস্তান, নেতাদের অত্যাচারে আধমরা। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র সংগঠিত হলেই নেমে আসে ভয়ংকর সন্ত্রাসী আক্রমণ। তবু প্রতিবাদ প্রতিরোধ থেমে থাকে না। মাঝে মাঝেই তার মাত্রা এতোদূর পর্যন্ত পৌঁছায় যে, রাষ্ট্রের তখ্ত তাউস পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।
এ চিত্র কেবল ভারতবর্ষের কোনো একটা অঞ্চলের নয়। নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, অরুণাচল, আসাম থেকে ওরিশা, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্র হয়ে ছত্রিশগড় মহারাষ্ট্র, হিমাচল কাশ্মীর, উত্তরাঞ্চল সর্বত্র একই দৃশ্য। তারতম্য শুধু রকম ফেরে।
এই অরণ্যের অধিকারের জন্যে লড়াই আজকের নয়। ইংরেজ আমলেও অরণ্যের সম্পদের উপর লোলুপ দৃষ্টি ছিল শাসক ইংরেজ, তাদের পোষা জমিদার, ঠিকাদার, ব্যবসায়ী লুটেরাদের। ইচ্ছেমতো জঙ্গল কেটে, জমি থেকে উচ্ছেদ করে, প্রবল অত্যাচার করেছে তারা। বীর স্বাভিমানী আদিবাসী জনতা মুখ বুজে এ অত্যাচার সহ্য করে নি। অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছে প্রবল পরাক্রান্ত ইংরেজদের বিরুদ্ধে। মনে রাখতে হবে, ভারতে শিক্ষিত নেতৃত্বের অধীনে যখন আন্দোলন ইংরেজের কাছে আবেদন নিবেদনে সীমাবদ্ধ, সেইসময়ে ভারতের আদিবাসী জনতা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে। বীর শহীদ বিরসা, সিধো, কানু সেই সংগ্রামী নেতৃত্বেরই উত্তরাধিকার।
এই সংগ্রামের ঐতিহ্য এত পুরোনো?
আমি বলবো, আরও অনেক পুরনো। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই এই সংগ্রাম চলে আসছে। আজ সেই ঐতিহ্যের কথাই বলবো। এ ইতিহাস হয়তো আপনাদের কাছে কিছুটা শকিং হলেও কোনো কাহিনীই মিথ্যে নয়।
আর্যরা ভারতে এসেছিল যাযাবর পশুপালক এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা গোষ্ঠী হিসেবে। মূলত পশুপালন তাদের জীবিকা ছিল। ভারতে তখন বহু গোষ্ঠী ছিল যারা চাষাবাদ করতো। মহেঞ্জোদারো নগরের বিশাল শস্যাগার তার নিদর্শন। আর চাষাবাদ ছাড়া নগরকেন্দ্রিক সভ্যতাও গড়ে ওঠে না। যাই হোক, আর্যরা ধীরে ধীরে গোটা উত্তর ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে রাজত্ব করতে লাগল। একইসঙ্গে তারা বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষাবাদ শুরু করল। মজার ব্যাপার হলো তারা কিন্তু নিজেরা চাষ করতো না। কাজে লাগাতো পরাজিত এদেশের আদি অধিবাসীদের, যারা বংশ পরম্পরায় চাষ করে এসেছে এবং এই কাজে তাদের সহজাত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এরা যেহেতু যুদ্ধে পরাজিত, তাই আর্যরা তাদেরকে দাস বলতো এবং সেই হিসেবেই তাদের ব্যবহার করতো। এরফলে বিপুল পরিমাণ শস্য উৎপন্ন হতে থাকলো। এতে আর্য রাজারা বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করার সুযোগ পেলো, আর বড় বড় নগর বানানো সম্ভব হলো। আজকের বর্ণ হিন্দুরা যে সভ্যতার জন্যে গর্ব প্রকাশ করে, আসলে তা ভারতের অনার্য আদি মানুষদের দান।
মনে রাখতে হবে, আর্যরা প্রথমে উত্তর ভারতেই প্রভুত্ব স্থাপনা করে। দক্ষিণ ভারতে তখনও বেশ কিছু বড় নগর সভ্যতা ছিল মূলনিবাসী রাজাদের অধীনে। লঙ্কেশ্বর রাবণ তারই প্রতিনিধি। রামায়ণের কাহিনী মূলত আর্যদের দাক্ষিণাত্য বিজয়ের গল্প।
(এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে রামায়ণ মহাভারত দু’টি গ্রন্থ মহান দুই মহাকাব্য। এর কাহিনী কল্পিত হলেও সেই সময়ের সামাজিক রাজনৈতিক ছবি এর থেকে আমরা পেতে পারি)।
আর্য রাজাদের বিপুল সেনাবাহিনী ঠাটবাট সবেরই মূল অর্থনৈতিক উৎস ছিল চাষ, পশুপালন, অধীন সামন্তদের দেওয়া শস্যের অংশ এবং লুটের ধন। আবার পশুখাদ্যের জন্যেও চাষ চাই, নগর বড় হচ্ছে, আরও শস্য দরকার, বেশি বেশি করে জমিতে কৃষি করতে হবে। তাই নতুন নতুন আবাদের প্রয়োজন। কিন্তু চাষের উপযুক্ত জমি কোথায়?
নগর প্রাচীরের বাইরে বৃত্তাকার ঘিরে কৃষিজমি, আর তারপরেই গভীর বন। এই গভীর অরণ্যানিতে আছে বড় বড় গাছ, নানা পশুপাখি, সর্বোপরি দলে দলে আদিবাসী মানুষ। এরা অরণ্যে বাস করে অরণ্যের অংশ হয়ে। বনের ফলমূল খায়, বনের প্রাণী শিকার করে তার মাংশ পুড়িয়ে খাওয়া তাদের নৈমিত্তিক কাজ। আর্যরা তাদের বলতো রাক্ষস। কিন্তু নতুন নতুন চাষের জমি পেতে গেলে এই জঙ্গল নিজেদের কব্জায় নিতে হবে। সুতরাং চলতে থাকে গাছ কাটা আর বন থেকে রাক্ষসদের উৎখাত। ব্যাপকহারে চলে অরণ্য নিধন, পশু শিকার, আদিবাসী উৎখাত ও হত্যা। এইকাজে ব্রাহ্মণদের বিশেষভাবে কাজে লাগানো হলো। তারা রাজার সাহায্য নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে তপোবন সৃষ্টি করতে থাকল। রাজারা তাদের উপহার দিল প্রচুর গবাদিপশু ও দাসদাসী। বনচারী রাক্ষসেরা কোথাও কোথাও নিজেদের মতো করে বাধা দিতে থাকল। ঋষিরা তখন রাজার সাহায্যে তাদের হত্যা করতো। রামায়ণে দেখি ঋষি বিশ্বামিত্র রামকে ডেকে নিয়ে তারকাকে হত্যা করায়।
আগেই বলেছি বনবাসী রাক্ষসেরা বিনা বাধায় এই ধ্বংসলীলা মেনে নেয় নি। তারা যথাসাধ্য যুদ্ধ করেছে। তারা ধাতুর অস্ত্র তৈরি করতে জানতো না, তাই পাথর ছুঁড়ে লড়াই করেছে। প্রচণ্ড বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেও আর্যদের ধাতুর তৈরি তীর, গদা, বল্লমের কাছে প্রাণ দিয়েছে তারা। যেমনভাবে ইংরেজদের বন্দুকের কাছে প্রাণ দিয়েছে সিধু, কানু, বিরসা। একইভাবে অরণ্যের অধিকার রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছে সুবাহু, তারকা, খর, দূষণ, অয়োমুখীরা।
পাঠকরা, তাই আমি সিধু কানু বিরসার ঐতিহ্যে গর্বিত। আমি গর্বিত তারকা, সুবাহু, অয়োমুখীর সংগ্রামী ঐতিহ্যে।
মে ১২, ২০১৭; ৪:৩৫ অপরাহ্ন
আপনার লেখার হাত বেশ শক্ত। নবযুগ ব্লগে নিয়মিত হাজিরা দিলে ভাল জমবে।